চারিদিকে বড় ফ্রিয়ের দেমাক। একটা কিনলে আরেকটার দিন উবে গিয়েছে। এখন কাজ করলেও ফ্রিতে। ফ্রিলান্সার কিংবা কাজ করিয়ে টাকা না দেওয়ার রেওয়াজ বাংলা বাজারের নানা ক্ষেত্রে বেশ চেপে বসে গিয়েছে। এসেছে কোল্যাব রীতি। সহজে শোষণ। বাংলার অর্থনীতি কি এই বিনা মাগনা চর্চায় আদৌ পুষ্টিলাভ করবে?
গ্রাফিক্স: অর্ঘ্য চৌধুরী
একথা আমরা মোটের ওপর সকলেই জানি যে, সবার উপর মানুষ সত্য আর তাহার উপর ‘আমাদের না একদম বাজেট নেই, এবার তো একটু অ্যাডজাস্ট করে নাও, এরপর থেকে আর তোমায় বলতেও হবে না।’ কিন্তু এসব পুরাকালের কথা। প্রাচীন ঐতিহাসিক যুগের সমস্ত গুহা-জেপেগ থেকে এ জিনিস এক্সট্র্যাক্ট করা হয়েছে। কারণ বর্তমান যুগটা দাঁড়িয়েই আছে একটা অপূর্ব শব্দের উপর, ‘কোল্যাব’।
কোল্যাব, এই শব্দটার ঐতিহাসিক যুগে যেটাকে বলা হত ‘বেগার খাটা’। মানে আপনি সারাদিন ঘুরে ঘুরে কাজ-টাজ করবেন, ছবি তুলবেন অথবা তোলাবেন, অখাদ্য সমস্ত খাবার খেয়ে ‘সো অথেন্টিক, সো লদলদে’ বলে রিভিউ করবেন, বিয়ে বাড়ির বাইরের ‘বি ওয়্যার অফ খুঁতখুতে পিসেমশাই’ সতর্কবার্তা হাতে দাঁড়িয়ে থেকে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের দুনিয়ায় নব্য দিগন্ত খুলে দেবেন, আর সেইটের বদলে আপনার জুটবে একটি নোটিফিকেশন। অমুক পেজ আপনাকে কোল্যাব করবার অনুরোধ জানিয়েছি। ব্যস। শেষ। এই পর্যন্তই। ফলত, টেকনিক্যালি আপনাকে ‘বেকার’ না বলা গেলেও, গুণগত মানে আপনার সঙ্গে যে মানুষটা সারাদিন কোনও একটি চায়ের দোকানে বসে বিশ্ব-রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করে কাটিয়ে দিচ্ছে, তার বিশেষ ফারাক নেই।
আপনার বাড়ির লোক দেখছে আপনি সকালবেলা চান-টান করে বেরোচ্ছেন। সারাদিন এত খাটছেন যে, গাধা অবধি কমপ্লেক্স খাচ্ছে। কিন্তু আপনি খাওয়ার টাইম পাচ্ছেন না। কারণ বাড়ি ফেরার পরও আপনার কাজ থামছে না। সারা রাত জেগে আছেন, যাতে টাইমের মধ্যে সেই কাজটা ডেলিভারি করতে পারেন, যেটার মূল্য হিসেবে আপনাকে সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘শাউট আউট’ দেওয়া হবে। আপনিও খুশি। আপনি যার জন্যে এই কাজ করলে সেও আপনাকে বোকা বানিয়ে খুশি। একেবারে লস লস সিচুয়েশন যাকে বলে। এবার আপনি বলবেন, ‘কেন কোল্যাব মানে কি খারাপ নাকি?’ না, না। খারাপ হতে যাবে কেন। ‘কোল্যাব’ শব্দটার উৎপত্তি তো ‘কোলাবোরেশন’ শব্দটি থেকে। মানে একসঙ্গে মিলে কিছু একটা করা। কিন্তু এটা যদি সমানে সমানে হয় তাহলে কোনও ক্ষতি নেই। নিজ নিজ ক্ষেত্রে দু’জন অত্যন্ত সফল ব্যক্তি যদি কোল্যাব করেন তাহলে তাতে উভয়েরই লাভ। কিন্তু একজন ভীষণ সফল ব্যক্তি যদি একজন স্ট্রাগলারকে, ‘আমার সঙ্গে কোল্যাবে কাজ করলে কিন্তু অনেকে তোর নাম জানবে’ বলে একটিও পয়সা না দিয়ে খাটিয়ে নেয়, তবে সেটা অন্যায়। এইবার সেই সফল ব্যক্তি হয়তো বলতে পারেন, ‘কীসের অন্যায় হে!? আমাকে কি এই জায়গাটা কেউ করে দিয়েছে? আমি নিজের দমে খেটে নিজের এই জায়গাটা তৈরি করেছি। আমার সঙ্গে অমুক স্ট্রাগলার যদি কোল্যাব করে তাহলে ওর লাভই হবে। পাঁচটা লোক ওর নাম জানবে। তাছাড়া আমি তো ওকে জোর করছি না ভাই। ও যা করার স্বেচ্ছায় করছে।’
…………………………………………..
ডিজাইনের পর ডিজাইন করিয়ে নেবে, দিস্তার পর দিস্তা সিনেমা সিরিজ লিখিয়ে নেবে, অ্যাডভান্স চাইতে যান, মনে হয় কিডনি চাইছেন। তবে সমস্যা সেটা নয় যে, এরকম হয়। সমস্যা হল, এটা যেই বিষয়টা এখন ‘নরমাল’ হয়ে গেছে। স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে। স্বাভাবিক অবশ্য হয়ে গিয়েছে আরেকটা জিনিস। কিছু মানুষ এত কম টাকার বিনিময় কাজ করা শুরু করেছে যে তার থেকে ‘কোল্যাব’ করাও ভালো। এই মানুষগুলো সমস্ত ক্ষেত্রে সমস্ত মার্কেটের যে অবস্থা করে রেখেছে, তার বর্ণনা ভদ্র ভাষায় করা সম্ভব নয়।
…………………………………………..
এইবার প্রধান মুশকিলটা হল এইসব ক’টা কথা সত্যি। যিনি স্বেচ্ছায় এই কাজ করতে রাজি হচ্ছেন সেই ব্যক্তিকে খতিয়ে দেখলে তো আরওই সত্যি এবং যথেষ্ট লোভনীয়ও বটে। ধরুন না, যদি হঠাৎ আমাকেই কোনও এক প্রকাণ্ড সাহিত্যিক এসে বলেন, ‘চলো ভাই, একসঙ্গে কোল্যাবে কিছু একটা করি’ তাহলে আমিও ল্যা ল্যা করে চলে যাব। এক মুহূর্তের অপেক্ষা করব না। একবারের জন্য পয়সার কথা জিজ্ঞাসা করব না। সেই সাহিত্যিকের সঙ্গে আমার নাম একসঙ্গে বেরলে, আখেরে লাভ আমারই। কিন্তু এত শর্তেও ঠিকটা ঠিকই থাকবে এবং ভুলটা ভুল। একটা মানুষকে কাজ করিয়ে নিয়ে সেই কাজের যথাযথ মূল্য না দেওয়া ভুল। অন্যান্য শ্রেণীর মানুষ কী করেন জানি না তবে একজন মধ্যবিত্ত হিসেবে বলতে পারি, যে মানসিকতায় আমাদের বড় করা হয়েছে তাতে আমরা ছোট থেকে শিখেছি– টাকা চাওয়া পাপ! নিজের কাজের ন্যায্য টাকা চাইলে ঠাকুর পাপ দেয়। তাই এমনভাবে চাই, যেন ধার চাইছি। এবং যাদের কাছে চাইছি তারাও সেটা জানে। তারা এমন একটা ভাব করে যেন আমার ভাগের টাকা আমাকে দিয়েই তারা উপকার করছে।
ডিজাইনের পর ডিজাইন করিয়ে নেবে, দিস্তার পর দিস্তা সিনেমা সিরিজ লিখিয়ে নেবে, অ্যাডভান্স চাইতে যান, মনে হয় কিডনি চাইছেন। তবে সমস্যা সেটা নয় যে, এরকম হয়। সমস্যা হল, এটা যেই বিষয়টা এখন ‘নরমাল’ হয়ে গেছে। স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে। স্বাভাবিক অবশ্য হয়ে গিয়েছে আরেকটা জিনিস। কিছু মানুষ এত কম টাকার বিনিময় কাজ করা শুরু করেছে যে তার থেকে ‘কোল্যাব’ করাও ভালো। এই মানুষগুলো সমস্ত ক্ষেত্রে সমস্ত মার্কেটের যে অবস্থা করে রেখেছে, তার বর্ণনা ভদ্র ভাষায় করা সম্ভব নয়। সত্যিই তো হাজার টাকার কাজটা যে লোকটা একশো টাকায় করে দিচ্ছে হাসিমুখে, আপনি পারবেন? অবশ্য তারও কম্পিটিশন রয়েছে, নব্বুই টাকায় করে দেওয়ার দল এল বলে। অবশ্য এই জিনিস শুধু এখানে চলছে, এমনটা নয়। কারণ, মানুষ নামক জাতটা তো গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। আর ফ্রিতে খাটিয়ে নেওয়া মানুষের মজ্জাগত। মানুষ এই নিয়ে গর্ব করে।
‘দশ চাইছিল তো বুঝলি, শুরুই করলাম দেড় থেকে, এক পঁচাত্তরে লক হলো’
গর্বিত। রুচিশীল। নমন।
পুনশ্চ: এসব কিছু থেকে বাঁচতে কিছু বুদ্ধিমান মানুষ নিজেই কিছু একটা ব্যবসা করার চেষ্টা করছেন অথবা পারিবারিক ব্যবসা সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন। অথচ বার্ষিক কর্মীবল সমীক্ষা বা পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভে (পিএলএফএস) ২০২৩-২৪ পরিসংখ্যান বলছে, এ রাজ্য কর্মরতদের মধ্যে ৪৫ শতাংশ মানুষ স্বনির্ভর বা নিজের ব্যবসা বা কারখানা চালান। ১১.৪ শতাংশ মানুষ পারিবারিক ব্যবসা বা কারখানায় বিনা বেতনে কাজ করেন। স্থায়ী চাকরিতে থাকা বেতনভুক কর্মীর সংখ্যা ২০.৪ শতাংশ মাত্র। দু’বছর আগে, ২০২১-’২২-এ বেতনভুক কর্মীর হার ২১.৮ শতাংশ ছিল।
আশ্রমে মেলার মাঠে যুযুৎসু দেখে রানী চন্দ তাঁর অনুভূতির কথা জানিয়েছেন। 'মনে হল যেন আমাদের একটা রুদ্ধ দিক খুলে গেল– যেখানে অজস্র আলো অবাধ হাওয়া। যেখানে দিন নাই রাত্রি নাই– খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে এই যে আমি আছি, ভয় নেই কারুর।'