বিয়ে নামের প্রতিষ্ঠানে এখন অনেকে বিশ্বাস করেন না। একইভাবে মনের মিল না হলে আজীবন এক ছাদের তলায় সম্পর্কহীন দাম্পত্য টেনে নিয়ে যেতেও আগ্রহী নন অনেকে। যেমনটা দেখা যেত আমাদের বাপ-ঠাকুরদার আমলে। লোকে কী বলবে, এই আশঙ্কা থেকেই গুমরে মরতেন অনেক মহিলা। এখন সময় পাল্টেছে। আত্মীয়-পড়শির তোয়াক্কা না করে স্বাধীন জীবন বেছে নিতে মহিলারা দ্বিধা করেন না। কিন্তু সমাজের চোখরাঙানি, পদে পদে বাধা অনেক ক্ষেত্রেই তাদের জীবন কঠিনতর করে তোলে। আর তাতে যদি সামিল হয় খোদ সরকার, তাহলে অবস্থা সহজেই অনুমেয়!
এটা খ্রিস্টাব্দ ২০২৪। মোটেও ২০২৪ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দ নয়!
কিন্তু পরিপার্শ্বের কিছু ঘটনায় সত্যিই সংশয় জাগে। কখনও কখনও মনে হয়, টাইম মেশিনে চড়ে আমরা কালের স্রোতে পিছনে ফিরে চলছি না তো! আধুনিক ঝাঁ-চকচকে শপিং মল, বিরাট আবাসন, মুখে ফটাফট ইংরেজি বুলি, দামি গাড়ি আর ফ্যাশনদুরস্ত পোশাকের আড়ালে আমাদের মানসিক গঠন মধ্যযুগের স্তরেই বাঁধা পড়ে যায়নি তো?
বর্তমান সমাজে বিয়ে যেমন বাস্তব, তেমনই বিচ্ছেদও ঘটছে আকছার।
বিয়ে নামের প্রতিষ্ঠানে এখন অনেকে বিশ্বাস করেন না। একইভাবে মনের মিল না হলে আজীবন এক ছাদের তলায় সম্পর্কহীন দাম্পত্য টেনে নিয়ে যেতেও আগ্রহী নন অনেকে। যেমনটা দেখা যেত আমাদের বাপ-ঠাকুরদার আমলে। লোকে কী বলবে, এই আশঙ্কা থেকেই গুমরে মরতেন অনেক মহিলা। এখন সময় পাল্টেছে। আত্মীয়-পড়শির তোয়াক্কা না করে স্বাধীন জীবন বেছে নিতে মহিলারা দ্বিধা করেন না। কিন্তু সমাজের চোখরাঙানি, পদে পদে বাধা অনেক ক্ষেত্রেই তাদের জীবন কঠিনতর করে তোলে। আর তাতে যদি শামিল হয় খোদ সরকার, তাহলে অবস্থা সহজেই অনুমেয়!
আমরা তালিবান শাসন দেখেছি। যাদের দাপটে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা আফগানিস্তানের মেয়েদের। পুরুষ অভিভাবকের বশ্যতা মেনে নিয়ে চলাই সেখানে দস্তুর। আফগান নারীদের ওপর জারি হয়েছে কঠোর বিধিনিষেধ। তাদের চলাফেরার স্বাধীনতা, শিক্ষা, জীবিকা ও স্বাস্থ্য পরিষেবার অধিকার সংকুচিত। কোনও পুরুষ-সঙ্গী ছাড়া স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া, একা পার্কে ঘোরার অধিকার পর্যন্ত নেই। জনসমক্ষে ঢেকে রাখতে হয় মুখ। সেই পুরুষতান্ত্রিক তালিবানি ফতোয়ার মনুবাদী-সংস্করণ যখন ‘আধুনিক’ ভারতেও শুনতে হয়, তখন হৃৎকম্প উপস্থিত হতে বাধ্য।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
কিছুদিন আগেই ঢাকঢোল পিটিয়ে দেশের গণতন্ত্রের পীঠস্থান নয়া সংসদ ভবনের উদ্বোধন হল। অথচ দেশের প্রথম নাগরিক, রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু উদ্বোধক তো দূর, আমন্ত্রিতই ছিলেন না! কোনও না কোনওভাবে মনুস্মৃতির বহমানতা আজও চলছে। যেমন তাতে বলা হয়েছিল, বিচারের অগ্রাধিকার ঠিক হবে বর্ণের ভিত্তিতে (মনুস্মৃতি, অধ্যায় ৮, শ্লোক ২৪)। এখনও বাস্তব পরিস্থিতি, নথিপত্র খতিয়ে দেখলে তারই প্রতিফলন মিলবে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
হঠাৎ এমন কথা কেন? তাহলে খুলেই বলা যাক। আরও অনেকের মতোই বিয়ের পর স্বামীর পদবি গ্রহণ করেছিলেন দিব্যা মোদি। নাম হয় দিব্যা মোদি টোঙ্গা। কিন্তু গোল বাঁধে এরপর। স্বামীর সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় তিনি বিচ্ছেদের পথে হেঁটেছেন। সেই মামলা বিচারাধীন। স্বাভাবিকভাবেই আর স্বামীর পদবি নামের সঙ্গে জুড়ে রাখতে চাননি তিনি। কিন্তু পদবি বদলের আবেদন করতেই তাঁকে জানানো হয়েছে, হয় তাঁকে বিচ্ছেদের নথি দিতে হবে। না হলে স্বামীর কাছ থেকে আনতে হবে অনুমতিপত্র বা এনওসি (অর্থাৎ স্ত্রী পদবি পরিবর্তন করলে স্বামীর আপত্তি নেই)। যদিও ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বম্বে হাই কোর্ট রায় দিয়েছে, বিবাহিত মহিলাদের বিয়ের আগের পদবি ব্যবহার সম্পূর্ণ আইনসংগত। তারপরেও এই বিতর্কিত বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে কেন্দ্রীয় সরকারের আবাসন ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রক!
বাধ্য হয়েই আইনের আশ্রয় নিয়েছেন দিব্যা। দিল্লি হাই কোর্টে তাঁর আর্জি, এই বিজ্ঞপ্তি তাঁর মৌলিক অধিকার ও ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেছে। এটা সংবিধানের ১৪, ১৯(১)(এ) এবং ২১ নম্বর অনুচ্ছেদের পরিপন্থী, নারীদের প্রতি বিদ্বেষমূলক মনোভাবের পরিচয় বলেও অভিযোগ করেছেন দিব্যা।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: দেশের জনসংখ্যা ১৪০ কোটি, আর কন্ডোম-পিলের নাম শুনলেই কানে আঙুল?
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
এই প্রসঙ্গে মনুস্মৃতির একটি বহুল প্রচলিত শ্লোক স্মরণ করতে হয়। ‘বাল্যে পিতুর্বাসে তিষ্টেত পাণিগ্রাহস্য যৌবনে/পুত্রাণ ভর্তারি প্রেতে ন ভজেত স্ত্রী স্বতন্ত্রতাম’ (মনুসংহিতা ৫:১৪৮, ৯:৩)। যার অনুবাদ, ‘নারীর শৈশবকালে তার পিতার অধীনে থাকা উচিত, যৌবনে তার স্বামীর অধীনে এবং স্বামীর মৃত্যুর পর পুত্রদের অধীনে থাকা উচিত। নারী কখনও স্বাধীনতার যোগ্য নয়।’ কখনও আবার বলা হয়েছে, ‘একজন স্বামী যতই খারাপ হোক না কেন, একজন কর্তব্যনিষ্ঠ স্ত্রী দেবতাজ্ঞানে সেই স্বামীকে পুজো করবে’ (মনুসিংহিতা, ৫:১৫৪)।
এই ভাবনাই হয়তো বয়ে নিয়ে চলেছে ভারতের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলটি।
কিছুদিন আগেই ঢাকঢোল পিটিয়ে দেশের গণতন্ত্রের পীঠস্থান নয়া সংসদ ভবনের উদ্বোধন হল। অথচ দেশের প্রথম নাগরিক, রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু উদ্বোধক তো দূর, আমন্ত্রিতই ছিলেন না! কোনও না কোনওভাবে মনুস্মৃতির বহমানতা আজও চলছে। যেমন তাতে বলা হয়েছিল, বিচারের অগ্রাধিকার ঠিক হবে বর্ণের ভিত্তিতে (মনুস্মৃতি, অধ্যায় ৮, শ্লোক ২৪)। এখনও বাস্তব পরিস্থিতি, নথিপত্র খতিয়ে দেখলে তারই প্রতিফলন মিলবে।
ব্রাহ্মণ্য যুগে মেয়েদের শিক্ষার অধিকার ছিল। মেয়েদের শিক্ষা দেওয়া ছিল বাবা-মায়ের আবশ্যিক কর্তব্য। সে কারণেই বিশ্ববারা, শাশ্বতী, ঘোষা, অপালার মতো মন্ত্রদ্রষ্টা মহিলা ঋষির নাম পাওয়া যায়। আচমকাই যেন ছবিটা পাল্টে গেল। নারী হয়ে গেল ‘নরকের দ্বার’। তুলসীদাসের দোঁহায় উঠে এল ‘নারী দিনকো মোহিনী, রাতকো বাঘিনী’। বলা হল, ‘পথে নারী বিবর্জিতা’। অর্থাৎ তাদের ঠাঁই চার দেওয়ালের অন্দরেই।
রামায়ণে প্রজা-রঞ্জনের জন্য বলি হয়েছিলেন অন্তঃসত্ত্বা সীতা। মহাভারতে দুই বংশের রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে ভরা রাজসভায় দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ হয়েছিল। স্ত্রী দ্রৌপদীকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি মনে করে পাশা খেলায় বাজি ধরেছিলেন যুধিষ্ঠির। আজও কি সেই ছবিটা খুব একটা পাল্টেছে? নানা সময় সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বলি হন সেই মেয়েরাই। এমনই একটা বার্তা যুগ যুগ ধরে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে যে, মেয়েরা অবলা-শক্তিহীনা। তাদের রক্ষাকর্তা পুরুষ। আর পিতৃতান্ত্রিক সমাজ সেই অধিকার কায়েম করতে গিয়ে মেয়েদের প্রতি পদক্ষেপে হেয় করেছে। মেয়েরা কার্যত হয়ে গিয়েছিলেন ‘গলগ্রহ’।
সেই অবস্থা যে আর নেই, তা মানতে চান না পুরুষতন্ত্রের ধ্বজাধারী কিছু ‘চোখ থাকতেও দৃষ্টিহীন মানুষ’। আশা, মেয়েরাই এবার তাঁদের চোখ খুলে দেবেন।