ভারতীয়রা দলবদ্ধতা ভালোবাসে, এমনটা আঁচ করা যায় আমাদের পরিবার-কাঠামোর দিকে তাকালে। ব্যক্তিগত পরিসর বা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের ধারণা আমাদের সামাজিক বিন্যাসে কিছুটা অপরিচিতই ছিল, অন্তত কিছুদিন আগেও। ফলে আমরা একদিকে যেমন অনায়াসে প্রতিবেশীর ব্যক্তিগত জীবনে নাক গলিয়ে ফেলি, অন্যদিকে তেমনই সদলবলে ঘুরতে বেড়িয়ে মনে রাখতে ভুলে যাই যে, পাশের মানুষটির একটু কোলাহলহীন শান্ত সময় প্রয়োজন হতে পারে।
প্রচ্ছদ শিল্পী: দীপঙ্কর ভৌমিক
দিন দুই আগের ঘটনা। গোকুল শ্রীধর নামে এক প্রবাসী ভারতীয় ব্যক্তি ফিনল্যান্ডের একটি ট্রেন থেকে বিরক্তিভরা টুইট করেছেন। লিখছেন, তিনি ট্রেনে করে হেলসিঙ্কি যাচ্ছেন, এবং ট্রেনের পরিবেশ এমনিতে অত্যন্ত শান্ত, নিস্তব্ধ। কিন্তু তার মধ্যে একটি পরিবার শুধু উচ্চগ্রামে কথা বলে চলেছে, ভিডিও কলে চিৎকার করে গল্প করছে– হিন্দি ভাষায়! শেষে শ্রীধর যোগ করেছেন– “We really don’t get civic sense, do we?”
এই দৃশ্য বেশ পরিচিতই। ভারতীয়রা, কে না জানে, সিভিক সেন্সের ধার ধারে না প্রায়শই। নিজের দেশে বা ভিনদেশে যেখানেই হোক, দলবদ্ধভাবে বেড়াতে যাওয়া মানেই যেন হৈ চৈ, চেঁচামিচি– আশেপাশের অন্য মানুষজনের সুবিধে-অসুবিধের তোয়াক্কা না করেই। কিছুদিন আগে সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছিল একটি পোস্ট– বন্দে ভারত এক্সপ্রেসে সরকারি বীমা কোম্পানির একদল কর্মচারী যাচ্ছিলেন, কোনও কনফারেন্সে সম্ভবত। তাঁরা নিজেরা চেঁচিয়ে গল্পগাছা তো করেছিলেনই, উপরন্তু খাবার খেয়ে সমস্ত বাক্স, প্লেট ইত্যাদি ডাস্টবিনে না ফেলে কামরার মেঝেতে ফেলে ছড়িয়ে নোংরা করে গেছেন!
বিশ্বের অন্য অঞ্চল– তা ইউরোপ-আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়া যেখানেই হোক, কিংবা জাপান-কোরিয়ার মত এশীয় দেশ, এহেন অসভ্যতায় অভ্যস্ত নয়। ফলে ভারতীয়দের সরব উপস্থিতি সেসব দেশের পাবলিক ট্রান্সপোর্টে বাকিদের শিরঃপীড়ার কারণ হয় বৈ কি!
………………………………………
ইউভাল নোয়া হারারি তাঁর বেস্টসেলিং বই ‘স্যাপিয়েন্স’-এ বলেছেন, মানবসভ্যতার বিকাশে ‘গসিপ’-এর গুরুত্বের কথা। তাঁর মতে, ‘গসিপ’ শেখার আগে মানুষ ছিল আর পাঁচটা স্তন্যপায়ী প্রাণীর মতোই, খাদ্যশৃঙ্খলের মাঝামাঝি কোথাও তার অবস্থান– দৈহিক শক্তিতে তাকে হারিয়ে দিতে পারে বহু পশুই। কিন্তু, ওই যে মানুষ নিজেদের মধ্যে আড্ডা দিতে শিখল, গল্পগুজব ছড়াতে শিখল– সেখান থেকে একটা অন্যরকম বন্ধন তৈরি হয়ে গেল, মানুষ আর একা রইল না, একটা বৃহৎ কৌমের অন্তর্গত হয়ে গেল, যা তাকে ক্রমশ এগিয়ে দিল অন্য পশুদের তুলনায়। সেদিক থেকে দেখতে গেলে, ভারতীয়দের এই দলবদ্ধ হুল্লোড়-প্রবণতা সেই আদিম গোষ্ঠীবদ্ধতারই পরিবর্ধিত সংস্করণ।
………………………………………
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি– দার্জিলিঙের চিড়িয়াখানায় দাঁড়িয়ে মানুষ বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি করে বাঘকে উত্যক্ত করছে, নয়তো ওখানে দাঁড়িয়েই ভিডিও কল করে বাড়িশুদ্ধ সবাইকে দেখাচ্ছে ভাল্লুকের লম্ফঝম্প। ট্রেনে বসে দেখেছি, লোকজন মোবাইলে দস্তুরমতো সিনেমা দেখছেন স্পিকার মোড অন্য করে। অন্য দেশ থেকে ভারতে ফেরার সময়ে দুবাই, ব্যাংকক কিংবা সিঙ্গাপুরে ফ্লাইট বদলাতে গিয়ে দেখেছি, আগের ফ্লাইটের জনতার তুলনায় ভারতগামী দ্বিতীয় ফ্লাইটের জনতা অনেক বেশি উচ্চকিত।
কেন এমন হয়? ভারতীয়রা দলবদ্ধতা ভালোবাসে, এমনটা আঁচ করা যায় আমাদের পরিবার-কাঠামোর দিকে তাকালে। ব্যক্তিগত পরিসর বা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের ধারণা আমাদের সামাজিক বিন্যাসে কিছুটা অপরিচিতই ছিল, অন্তত কিছুদিন আগেও। ফলে আমরা একদিকে যেমন অনায়াসে প্রতিবেশীর ব্যক্তিগত জীবনে নাক গলিয়ে ফেলি, অন্যদিকে তেমনই সদলবলে ঘুরতে বেড়িয়ে মনে রাখতে ভুলে যাই যে, পাশের মানুষটির একটু কোলাহলহীন শান্ত সময় প্রয়োজন হতে পারে। দ্বিতীয় কারণ হিসেবে মনে হয়– আমাদের সমাজে একটা সামন্ততান্ত্রিক ধাঁচ কোনও না কোনওভাবে রয়ে গেছে এখনও, রয়ে গেছে একধরনের সেন্স অফ এনটাইটেলমেন্ট। ফলে আমরা বিদেশগামী ফ্লাইটে উঠে বসে ভাবি, ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্টরা আমাদের দাসদাসী; নিজের দেশের পাহাড়ি হোমস্টে-তে গিয়ে ভাবি, এ আমাদের পৈতৃক সম্পত্তি!
তাহলে কি আমরা গল্প করব না? বেড়াতে গিয়ে আনন্দ করব না ? আত্মীয়দের সঙ্গে, বন্ধুদের সঙ্গে থাকব না বেঁধে বেঁধে? ইউভাল নোয়া হারারি তাঁর বেস্টসেলিং বই ‘স্যাপিয়েন্স’-এ বলেছেন, মানবসভ্যতার বিকাশে ‘গসিপ’-এর গুরুত্বের কথা। তাঁর মতে, ‘গসিপ’ শেখার আগে মানুষ ছিল আর পাঁচটা স্তন্যপায়ী প্রাণীর মতোই, খাদ্যশৃঙ্খলের মাঝামাঝি কোথাও তার অবস্থান– দৈহিক শক্তিতে তাকে হারিয়ে দিতে পারে বহু পশুই। কিন্তু, ওই যে মানুষ নিজেদের মধ্যে আড্ডা দিতে শিখল, গল্পগুজব ছড়াতে শিখল– সেখান থেকে একটা অন্যরকম বন্ধন তৈরি হয়ে গেল, মানুষ আর একা রইল না, একটা বৃহৎ কৌমের অন্তর্গত হয়ে গেল, যা তাকে ক্রমশ এগিয়ে দিল অন্য পশুদের তুলনায়। সেদিক থেকে দেখতে গেলে, ভারতীয়দের এই দলবদ্ধ হুল্লোড়-প্রবণতা সেই আদিম গোষ্ঠীবদ্ধতারই পরিবর্ধিত সংস্করণ। তাছাড়া এই বেঁধে থাকাটুকুর সঙ্গে কিছু অনিবার্য উষ্ণতাও জুড়ে যায়, যেখানে একে অন্যের বিপদে ছুটে আসা যায়, কাউকে একাকিত্বে ভুগতে হয় না।
কিন্তু যুগের সঙ্গে রুচিবোধ তো পালটায়। প্রাথমিক খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের চাহিদা মেটাতে শিখে যাওয়ার পর প্রাচীন মানুষের সমাজেও এসেছিল প্রীতি-সহমর্মিতা-শ্রদ্ধা জাতীয় সূক্ষ্মতর ধারণা। আমার আনন্দ যাতে অন্যের অসুবিধের কারণ না হয়, এটা নিশ্চিত করা আজকের যেকোনও সভ্যসমাজের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। নিজেরা গল্প করব, সমবেত আনন্দে যোগ দেব কিন্তু আওয়াজ রাখব নিচু; পাবলিক ট্রান্সপোর্টে গান শুনলে ইয়ারফোন ব্যবহার করব; যেখানে সেখানে আবর্জনা ফেলব না… এই রকম কয়েকটি নিয়মনীতি মেনে চললেই কিন্তু কাজ হয়ে যায়। সিভিক সেন্সের ন্যূনতম এই পাঠগুলো ছোটবেলা থেকেই শিশুদের মনে গেঁথে দেওয়া প্রয়োজন।
…………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………….