আজকের দিনে পুরস্কার প্রাপ্তি যেমন সৃজনশীলতার একমাত্র মাপকাঠি, এবং সেই বস্তুটি বাগিয়ে নেওয়ার জন্য যে কত রকমের ছক, কত প্রতিযোগিতা, হিংসা, চাতুর্য, বাংলা ভাষাকে ধ্রুপদী বলায় যত উচ্ছ্বাস, ঠিক সেই আহৃত পুরস্কারের কথা মনে করিয়ে দেয়। বাংলা ভাষার জন্য কত কী করা হবে, সেই সব পরিকল্পনা দেখেশুনে মনে হয়, এই ভাষা কত মহার্ঘ, ধ্রুপদী তকমা না পেলে বোঝাই যাচ্ছিল না।
সম্মান প্রদান অথবা স্বীকৃতি দান কি সবসময়ই সৎ ও স্বচ্ছ? সম্যক মান ও কৃতিত্বের মাহাত্ম্য বরণ অনেক সময় শূন্যগর্ভ আনুষ্ঠানিকতায় ভরা থাকে। এখানে প্রাপক ও প্রদানকারীর মধ্যে কোথাও কোনও স্থায়ী সম্পর্কসূত্র তৈরি হয় না। মান ও মর্যাদা অতি ক্ষণস্থায়ী, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ব্যবস্থা মাত্র হয়ে থাকে।
পুজোর ঠিক আগে আগে বাংলা ভাষাকে, কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক ধ্রুপদী স্বীকৃতি দেওয়ার উদ্দেশ্য বেশ ঝাপসা লাগে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। যেমন, বাংলার সঙ্গে একইসারিতে মরাঠি ও অসমিয়াকে রাখা হয়েছে ও ‘ধ্রুপদী’ বলা হয়েছে, সে নিয়ে কোনও গোলমাল নেই, কিন্তু সেই একইসঙ্গে পালি ও প্রাকৃত আসে কোন যুক্তিতে?
বাংলা, মরাঠি, অসমিয়া আজও স্রবন্তী। সাধারণ মানুষের কথা ও কাজের ভাষা, শিল্প ও সাহিত্যের ভাষা। বাংলা একটি রাষ্ট্রের ভাষাও বটে এবং পৃথিবীর সর্বাধিক সংখ্যক ব্যবহার্য ভাষার প্রথম পাঁচটির মধ্যে বাংলার স্থান। এ ভাষার ইতিহাস হাজার বছরের পুরনো। এই সহস্র বছরে বাংলা ক্রমাগত শব্দে, উচ্চারণে, বর্ণের লিপিকারিতায় , শব্দসম্ভারে পরিবর্তিত হয়েছে, এখনও চলছে তার ভাঙাগড়া।
যে কোনও সচল, সজীব ভাষার সমস্ত লক্ষণ বাংলায় প্রকাশ পায়। এই ভাষাটি যে আদতেই ‘ধ্রুপদী’, তা কি কেন্দ্রের স্বীকৃতি পাওয়ার আগে জানা ছিল না? আজকের দিনে পুরস্কার প্রাপ্তি যেমন সৃজনশীলতার একমাত্র মাপকাঠি, এবং সেই বস্তুটি বাগিয়ে নেওয়ার জন্য যে কত রকমের ছক, কত প্রতিযোগিতা, হিংসা, চাতুর্য, বাংলা ভাষাকে ‘ধ্রুপদী’ বলায় যত উচ্ছ্বাস, ঠিক সেই আহৃত পুরস্কারের কথা মনে করিয়ে দেয়। বাংলা ভাষার জন্য কত কী করা হবে, সেই সব পরিকল্পনা দেখেশুনে মনে হয়, এই ভাষা কত মহার্ঘ, ‘ধ্রুপদী’ তকমা না পেলে বোঝাই যাচ্ছিল না।
অথচ, বেশ কিছু বছর হল, বাংলা ভাষা ক্রমাগত হয়ে উঠছে নীরক্ত, দীনহীন, অবহেলার পাত্র। এদেশের নদ-নদীর মতোই। প্রাণবান বা বেগবতী নদনদীর গায়ে আবর্জনা জমে, পলি পড়ে, বাঁধ কবলিত হয় এবং নদনদী ক্রমে গভীরতা কমিয়ে, কলুষিত হয়ে ক্ষীণধারা হয়ে অবলুপ্ত হয়। ভাষাও কি সেইরকম নয়? সারা পৃথিবীতে প্রতিদিন কি শত শত ভাষার মরণ ঘনিয়ে আসছে না? বাংলা ভাষার অসুখ যে অনেক কাল হল, তার কী নিদান, রোগারোগ্য সম্ভব কি না, ভাবার জন্য কি এই ‘ধ্রুপদী’ ফলকনামা প্রয়োজন ছিল? হঠাৎ কি তামাম বাঙালি এই বলে নড়েচড়ে বসল, আরে আরে, আমরা নাকি একখান ধ্রুপদী ভাষায় কথা কই?
বাংলা ভাষার রোজকার কথাকারীর বাইরে, যাঁরা এই ভাষার ব্যবহারিক দিকের সঙ্গে কিছুমাত্র জড়িত, যেমন শিল্পী, গীতিকার, কবি, সাহিত্যিক, সিনেমাওয়ালা, মিডিয়া, প্রকাশক, বাংলা মাধ্যম স্কুল ইত্যাদি, তাঁরা কি প্রত্যেকেই এই আভাস নিরন্তর পাচ্ছেন না, বাংলা ভাষা হয়ে উঠছে আবর্জনাময়, শ্লথ, অবহেলার পাত্র? বাঙালি জাতি স্বয়ং বাংলা ভাষার পরিপন্থী!
হাজার বছরের ভাষা বলে যতই আত্মগরিমা লাভ হোক না কেন, এ ভাষার ইতিহাস বরাবর রক্তাক্ত যুদ্ধের ইতিহাস। শাসকের ভাষার সঙ্গে সেই যুদ্ধ। শেষ অস্ত্র তুলেছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতা। জাতির মেরুদণ্ডের প্রত্যেক কশেরুকা বাঁকিয়ে-চুরিয়ে তারা চিন্তাপ্রক্রিয়ার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে হীনম্মন্যতা। ইংলিশ না জানলে কী ভীষণ লজ্জা, কত না পরাজয়, কত নিরাপত্তাহীনতা। এখন তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে হিন্দি। একটি সাত শব্দের বাংলা বাক্যে ঢুকে পড়ে তিনটে ইংলিশ, দু’টি হিন্দি। হ্যাঁ, এই আমাদের নব্য বাংলার গতিবিধি।
ব্রিটিশ উপনিবেশ উচ্ছেদ করতে বাঙালির উদ্যোগের অভাব ছিল না। তা সত্ত্বেও, ইংলিশ না জানার হীনম্মন্যতা, বাংলাকে অবহেলা করার দৈন্য কেন অতিক্রম করা গেল না? ব্রিটিশ রাজত্ব চলাকালীন বাংলা ভাষা চর্যা ও সৃজনে অতি উচ্চে পৌঁছে গিয়েছিল, তার অন্যতম কারণ, বিদেশি শাসকের বিরুদ্ধে আত্মমর্যাদার ধ্বজা তুলে ধরা। শিল্পে সাহিত্যে তার প্রভাব যতখানি, বাণিজ্যিক ও অন্যান্য পেশাদারি জীবনে ততখানি নয়। তাই ব্রিটিশ যখন ভারত ছেড়ে যায়, তখন থেকে আজও পর্যন্ত পেশাদারি ক্ষেত্রে বাংলার মর্যাদা কম।
………………………………………………….
বাংলা ভাষার রোজকার কথাকারীর বাইরে, যাঁরা এই ভাষার ব্যবহারিক দিকের সঙ্গে কিছুমাত্র জড়িত, যেমন শিল্পী, গীতিকার, কবি, সাহিত্যিক, সিনেমাওয়ালা, মিডিয়া, প্রকাশক, বাংলা মাধ্যম স্কুল ইত্যাদি, তাঁরা কি প্রত্যেকেই এই আভাস নিরন্তর পাচ্ছেন না, বাংলা ভাষা হয়ে উঠছে আবর্জনাময়, শ্লথ, অবহেলার পাত্র? বাঙালি জাতি স্বয়ং বাংলা ভাষার পরিপন্থী!
………………………………………………….
একথা মানতে হবে, দীর্ঘ সময়ের ব্যবহারে ইংলিশ ভারতের সংস্কৃতিতে অপ্রতিরোধ্য জায়গা কায়েম করেছে। তার অন্যতম কারণ, ভারত বহুভাষাভাষীর দেশ, বিভিন্ন প্রদেশ সংযুক্ত করতে একটি সাধারণ ভাষামাধ্যম প্রয়োজন ছিল, অপর কারণ, ইংলিশ আন্তর্জাতিক সংযোগ তৈরিতে সাহায্য করে। কিন্তু ভাষা শুধু পেশাদারিত্ব নয়, ভাষা চিন্তাপ্রকাশ ও পারস্পরিক সংযোগের মাধ্যম। ঐতিহ্য, পরিবেশ, প্রকৃতি, সংস্কৃতি দিয়ে যে ভাষা তৈরি হয়, যাকে আমরা ‘মাতৃভাষা’ বলি, সেই ভাষা আমাদের চেতনার বিকাশ ঘটায়। জন্মাবধি মাটির সঙ্গে সেই ভাষার যোগ। তাকে অবহেলা করার চেয়ে বড় মূঢ়তা আর হয় না। প্রশ্ন জাগতে পারে, ইংলিশ শিখে কি চেতনার বিকাশ ঘটানো যায় না? নিশ্চয়ই যায়। তবে ভাষা যে শুধু মুখের বুলি, তা নয়, ভাষা জ্ঞানের আকরও বটে। একটি ভাষার মৃত্যু মানে বিশাল জ্ঞান ও তথ্যভাণ্ডারের অবলুপ্তি। তাই ভাষাজ্ঞান যার যত বেশি, সে তত ঋদ্ধ। এবং, বাংলা ভাষার যে বিপুল সম্ভার, এ ভাষার যে মাধুর্য, যে ব্যাপ্তি, তা থেকে বঞ্চিত হওয়া খুব বড় প্রবঞ্চনা। স্বাধীন ভারতে বাংলার বিভিন্ন সরকার বিভিন্নভাবে বাংলার মান হরণ করেছে।
আজ বাংলার ধ্রুপদী শিরোপা নিয়ে তাই নিঃসন্দেহ হওয়া যাচ্ছে না। এক তো পালি ও প্রাকৃতের সঙ্গে এক সারিতে বাংলা বা অপর ধ্রুপদী ভাষার স্থান কী করে হয়, এ এক প্রশ্ন। এমনকী সংস্কৃতও এই সারিতে থেকে যাচ্ছে। গবেষণামূলক পঠনপাঠন ছাড়া সংস্কৃত, পালি ও প্রাকৃতের ব্যবহার নেই। এবং, প্রাকৃতের এক শাখা থেকে বাংলা ভাষার জন্ম, প্রাকৃত ভাষার অনেকটা এসেছে সংস্কৃত থেকে। এই প্রবহমানতা অনেক পথ পেরিয়ে ‘প্রাকৃত’, ‘বাংলা’ ইত্যাদি কাঠামো গড়ে উঠেছে। এভাবে বছরে বছরে কয়েকটি ভাষা ধরে ধরে ধ্রুপদী বলে সিন্দুকে পুরে ফেলা একেবারেই অকারণ বলে মনে হয়।
বাংলা ভাষার প্রতি যে অবহেলা ও উপেক্ষা, অন্যান্য প্রদেশের ভাষার পরিস্থিতি তার থেকে ভালো কিছু নয়। সে নিয়ে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলি খুব যে চিন্তিত তার প্রমাণ মেলেনি। ধ্রুপদী হয়ে ওঠার পর হয়তো এই ভাষায় গবেষণা ও অন্যান্য চর্চার জন্য কিছু অর্থ বরাদ্দ হবে, গড়ে উঠবে নানা প্রতিষ্ঠান। সেই উদ্যোগ কি সাধারণ জনগণের মধ্যে এই আশা-ভরসা জাগিয়ে তুলবে, যে, বাংলা ভাষা আয়ত্ত করে জীবনযাপনের মধ্যে কোনও গ্লানি নেই।
………………………………………………….
আরও পড়ুন স্বাতী গুহ-র লেখা: যাঁরা ভাবেন বাংলাভাষা নিভন্ত, তাঁরাই বাংলাভাষার শিকড়সন্ধানে সাহায্য করেছেন
………………………………………………….
বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার এই ‘ধ্রুপদী’ ভাষা বলতে ঠিক কী বোঝাতে চায়? সংগীত , যন্ত্রসংগীত, কাব্য, সাহিত্য, ক্রিকেট, ফিল্ম সর্বত্র লক্ষণীয়, আমজনতার প্রিয় ও একটি বিশেষ রুচি ও মেধাসম্পন্ন শ্রেণির প্রিয় বিষয়গুলি বিভাজিত। প্রথমটি জনপ্রিয় ধারা, দ্বিতীয়টি ধ্রুপদী ধারা। বাংলা কি সেই উপশ্রেণির ভাষা হয়ে উঠল?
এই কেন্দ্রীয় সরকার ব্রিটিশকৃত নামধাম মুছে হিন্দি প্রয়োগে বদ্ধপরিকর। আপাতত ভারতে হিন্দি শাসকের ভাষা। এমন ঘটা করে প্রাদেশিক ভাষাগুলি ধ্রুপদী বলার পরের পদক্ষেপ কি তবে হতে চলেছে, সারা দেশে বাধ্যতামূলক হিন্দি শিক্ষা? এক দেশ, এক ভাষার ডাক?
বাংলা ভাষা ঘরপোড়া গোরু, সিঁদুরে মেঘ দেখলে আজও ডরায়।
…………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………