কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক, ত্রিশান্ত সিমলাই টানা ১৪ মাস ধরে জিম করবেট টাইগার রিসার্ভের ওপর গবেষণা চালিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন ‘এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড প্ল্যানিং (এফ)’ জার্নালে। তিনি কথা বলেছেন জঙ্গলের সীমান্তবাসী, বনদপ্তরের ভাষায় ‘বাফার জোন’ এবং লাগোয়া গ্রামের ২৭০ জন বাসিন্দার সঙ্গে। তার মধ্যে আছেন বহু মহিলাও। তাদের দিন যাপনের মধ্যে কীভাবে ক্যামেরার নজরদারি ঢুকে পড়ছে, তা নিয়ে মহিলারা সরব হয়েছেন। জঙ্গলের পশুপাখির গতিবিধির ওপর নজরদারির জন্য জঙ্গলের নানা জায়গায় ক্যামেরা লাগায় বনদপ্তর। কিন্তু প্রান্তবাসী মহিলাদের অভিযোগ, ইচ্ছে করেই সেইসব ক্যামেরা এমনভাবে বসানো হয়, যাতে গ্রামের মহিলাদের গতিবিধি ও ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি তাতে ধরা পড়ে।
গ্রাফিক্স: অর্ঘ্য চৌধুরী
‘আপনি সিসিটিভির সুরক্ষায় আছেন’– এই অভয়বাণীটি আজকাল হামেশাই চোখে পড়ে। বহুতল, আবাসন, অফিস, রেস্তরাঁ, কোথায় নয়! চোখে পড়লে আপনার তাৎক্ষণিক অনুভূতি কীরকম হয়? আপনি নিশ্চয়ই অযাচিত সুরক্ষা পেয়ে কৃতার্থ বোধ করেন না। বরং একটু সচেতন হয়ে পড়েন। একটু আড়ষ্টতা। ‘আমি অপরাধী নই’ গোছের একটা ভাব হাঁটা-চলা বা তাকানোর মধ্যে ফুটে ওঠে। আপনার মাথায় যে চিন্তার স্রোতটি বইছিল, তা ভালো বা মন্দ যাই হোক, তা যেন মুহূর্তের জন্যে থমকে যায়। আপন খেয়ালে হাঁটার ছন্দটাও যেন কেমন হোঁচট খায়। সবার না হলেও অনেকেরই এরকম হয়। আর আপনি যদি মেয়ে হন, তবে হয়তো আরও একটু বাড়তি অস্বস্তি হতে পারে। অবাঞ্ছিত নজরদারি আপনাকে, আপনার প্রতিটি পা ফেলাকে, প্রতিটি অভিব্যক্তিকে ধরে রাখছে। কে, কখন, কীভাবে আপনাকে ব্যবহার করবে, বা করছে– তা আপনি টের-ও পান না। আপনার মুখের হাসি, চোখের উদ্বেগ কিংবা কিঞ্চিৎ অবিন্যস্ত পোশাক কোথাও হয়তো কোনও প্রোপাগান্ডার অংশ হয়ে উঠবে। আপনি ক্রমাগত ‘ডেটা’ সরবরাহ করে চলেছেন এই বিশ্বব্যাপী ডিজিটাল বাজারের চাহিদা মেটাতে। আপনার অজান্তেই ‘নিয়ন আলোয় পণ্য হল, যা কিছু আজ ব্যক্তিগত’।
প্রশ্ন হল, আপনার কি ‘রাইট টু প্রাইভেসি’ বা গোপনীয়তার অধিকার আছে! সংবিধান কি আপনাকে সে অধিকার দিয়েছে? না, আলাদাভাবে তো দেয়নি। আর্টিকেল ২১ আমাদের ‘রাইট টু লিবার্টি’ বা ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার দিয়েছে। গোপনীয়তার অধিকার এবং আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচার অধিকারকে তারই নির্যাস থেকে আমরা বের করে নিয়েছি। তবে ২০১৭ সালে সুপ্রিম কোর্টের এক রায় গোপনীয়তার অধিকারকে মৌলিক অধিকারের মর্যাদা দিয়েছে। কিন্তু সে অধিকার পরিস্থিতি সাপেক্ষে লঙ্ঘন করার অধিকারও রাষ্ট্রের আছে। তাই যখনই আপনার গোপনীয়তা বিঘ্নিত হয়, তাকে রাষ্ট্রীয় প্রয়োজন বলে চালিয়ে দেওয়ার এক সহজ প্রবণতা দেখা যায়। আমাদের জীবনটা হিচককের বিখ্যাত সিনেমা ‘রিয়ার উইন্ডো’র মতো। জীবন যেন এক নামহীন শহরের পর্দাহীন জানলা। এডওয়ার্ড স্নোডেন ঘণ্টা না বাজালে কি আপনি জানতে পারতেন, আমার আপনার গোপনীয়তার বলয় ভেঙে, আমেরিকার ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি কী বিশাল তথ্যের পাহাড় গড়েছে! আপনার গাড়ির নিরীহ নম্বর প্লেটটি আপনার গতিবিধির যাবতীয় খবর নিখুঁতভাবে তুলে দিচ্ছে রাষ্ট্রের হাতে। আপনার হাতের স্মার্টফোনটি আপনার সব ইচ্ছে-অনিচ্ছে, শখ-আহ্লাদ, জমা-খরচের হিসেব দায়িত্ব নিয়ে পৌঁছে দিচ্ছে তথ্যের কারবারিদের কাছে, আপনারই আঙুলের ইশারায়! আপনি নিজের আঙুলকে শাসন করবেন কেমন করে! আপনি স্মার্ট টিভি দেখছেন। স্মার্ট টিভিও কিন্তু আপনাকে দেখছে। আপনার স্মৃতি দুর্বল, তা কিন্তু নয়।
সোশানা জুবফ-এর সাম্প্রতিক বই ‘দ্য এজ অফ সারভেইলেন্স ক্যাপিটালিজম্’ এই কঠিন সত্যিটাকে ভারি সহজ করে মেলে ধরেছে। আমার মুখের বলিরেখা কিংবা থুতনির তিলটাও ধরা পড়ছে নজরদারির যন্তরমন্তরে। জুবফ বলছেন, ‘আমার মুখের ওপর রাষ্ট্রের কোন অধিকার নেই।’ তা বললে হবে! আপনি তো ‘সারভেইলেন্স সোসাইটি’র নিরাপত্তার গ্রাহক!
ঘটনাটা বেশ ক’বছর আগের। ২০১৭ সাল। উত্তরাখণ্ডের জিম করবেট টাইগার রিজার্ভের লাগোয়া গ্রামের এক অটিস্টিক মহিলা জঙ্গলের ধারে প্রাকৃতিক কর্ম সারতে গিয়েছিল। জঙ্গলের ক্যামেরায় তা ধরা পড়ে। ব্যাপারটা এখানেই থেমে থাকেনি। ফরেস্ট অফিসের এক কর্মী সেই ছবি সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়। এক মহিলার নিতান্ত আড়ালের মুহূর্ত নিমেষে গণ-উপভোগের খোরাক হয়ে যায়। জানতে পেরে রাগে ফেটে পড়ে গ্রামের মেয়েরা। ভাঙচুর করে সংলগ্ন জঙ্গলের বেশ কিছু ক্যামেরা। কিন্তু তাতে আর কী হয়! দু’দিন পরে ভাঙা ক্যামেরার জায়গায় নতুন ক্যামেরা লাগে। পুরনো গাছ ছেড়ে অন্য কোনও গাছে তাদের বাসা বেঁধে দেয় বনদপ্তর। মেয়েদের ওপর নজরদারি তো বন্ধ হয় না।
সম্প্রতি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক, ত্রিশান্ত সিমলাই টানা ১৪ মাস ধরে জিম করবেট টাইগার রিসার্ভের ওপর গবেষণা চালিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন ‘এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড প্ল্যানিং (এফ)’ জার্নালে। তিনি কথা বলেছেন জঙ্গলের সীমান্তবাসী, বনদপ্তরের ভাষায় ‘বাফার জোন’ এবং লাগোয়া গ্রামের ২৭০ জন বাসিন্দার সঙ্গে। তার মধ্যে আছেন বহু মহিলাও। তাদের দিন যাপনের মধ্যে কীভাবে ক্যামেরার নজরদারি ঢুকে পড়ছে, তা নিয়ে মহিলারা সরব হয়েছেন। জঙ্গলের পশুপাখির গতিবিধির ওপর নজরদারির জন্য জঙ্গলের নানা জায়গায় ক্যামেরা লাগায় বনদপ্তর। কিন্তু প্রান্তবাসী মহিলাদের অভিযোগ, ইচ্ছে করেই সেইসব ক্যামেরা এমনভাবে বসানো হয়, যাতে গ্রামের মহিলাদের গতিবিধি ও ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি তাতে ধরা পড়ে। অনেক সময় গ্রামের ওপর ড্রোন উড়িয়ে আতঙ্কিত করা হয় গ্রামবাসীদের। আরও অনেক মামুলি ছবির সঙ্গে ড্রোন ক্যামেরায় ধরা পড়ে মেয়েদের অনেক স্বাভাবিক এবং অসতর্ক মুহূর্তের ছবি। আজকের প্রযুক্তি-নির্ভর যুগে পথেঘাটে বনে-জঙ্গলে ক্যামেরার নজরদারি নতুন কোনও বিষয় নয়। কিন্তু করবেটের মতো সংরক্ষিত উদ্যানগুলোতে গ্রামীণ মহিলাদের ব্যক্তিজীবনের গোপনীয়তা বেআব্রু করার হাতিয়ার হয়ে উঠছে এই সব লুকোনো ক্যামেরা। এ ভারি লজ্জার। না, এ লজ্জা কোনও মহিলার নয়, এ লজ্জা বিকৃত পুরুষতান্ত্রিকতার!
……………………………………
গ্রামের বেশিরভাগ পুরুষ, তা সে বাবা, স্বামী, বা সন্তান যে-ই হোক না কেন, সবার গলায় এক সুর, বাড়ির মেয়েরা নাকি ঘরের কাজ না করে জঙ্গলে ঘুরে সময় নষ্ট করছে। বেশ কিছু পুরুষ তাই নিয়মিত ফরেস্ট অফিসে গিয়ে ক্যামেরার ছবি দেখতে চায়। মেয়েদের ওপর পুরুষের এমন খবরদারির অধিকার কোন সংহিতায় লেখা আছে, কে বলে দেবে! কে টেনে দেবে মেয়েদের কাজ-অকাজের গণ্ডি! পুরুষ!
……………………………………
জঙ্গলকে ঘিরে যাদের জীবন, সেইসব প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সঙ্গে জঙ্গলের নিবিড় সখ্য। বিশেষ করে মহিলারা তাদের নিত্যদিনের সুখ দুঃখের শরিক করে নেয় জঙ্গলকে। সিমলাই-এর গবেষণায় উঠে এসেছে এমন অনেক অন্তরঙ্গতার গল্প। গ্রামের মেয়েরা যখন দলবেঁধে জঙ্গলে কাঠকুটো সংগ্রহ করতে যায়, তারা ভারি আনন্দে থাকে। খোশগল্প করে। গলা ছেড়ে গান করে। ঘরে তো সেই সুযোগ নেই। পুরুষেরা পছন্দ করে না, সমাজ ছি ছি করে। তাই বনের নির্জনতায় উপচে পড়ে তাদের না-বলা কথা, তাদের না-গাওয়া গান। কিন্তু হঠাৎই যখন ক্যামেরায় চোখ পড়ে, তারা সজাগ হয়ে যায়। কথার উচ্ছ্বাস সংযত হয়, গলার স্বর নেমে আসে, গলার সুর লুকিয়ে পড়ে গলাতেই। কেউ শুনে ফেলবে, কেউ দেখে ফেলবে, এই ভয় তাদের তাড়া করে ফেরে। মেয়েরা হারায় তাদের স্বাভাবিক অভিব্যক্তি। তাদের এই সংযত হয়ে যাওয়া তাদের কখনও কখনও বিপদের মুখেও ঠেলে দেয়। তাদের কথা বা গান জঙ্গলে তাদের আত্মরক্ষার অস্ত্র। কারণ তা বন্যপ্রাণীদের কাছে মেয়েদের দলবদ্ধ উপস্থিতির বার্তা দেয়। তাই বন্যপ্রাণীরা সহজে তাদের আক্রমণ করতে সাহস পায় না। কিন্তু ক্যামেরার জুজু মেয়েদের সেই সুরক্ষাটুকুও কেড়ে নেয়। নীরব মেয়েদের ওপর প্রায়শই হিংস্র বন্যপ্রাণী আক্রমণ শানায়। ক্যামেরার চোখ এড়াতে তারা কখনও বা বনের গভীরে পা বাড়ায়। তাতে ঘটে যায় আরও বড় বিপত্তি।
বনের শান্ত ছায়ায় বসে কখনও কখনও মহিলারা বিড়ি খায়, কিংবা কোনও অন্তরঙ্গ মুহূর্ত কাটায় তার প্রিয় সঙ্গীটির সঙ্গে। লোকচক্ষুর আড়ালে মেয়েদের এটুকু প্রশ্রয় দিতেও এখন জঙ্গল অপারগ। ক্যামেরবন্দি হয়ে সেসব মুহূর্ত দ্রুত ভাইরাল হয়ে যায়। গ্রামের নীতিপুলিশের চোখরাঙানি পিষে মারে মেয়েদের। ঘরে-বাইরে নির্যাতিত হয় মেয়েরা, শারীরিকভাবে, এবং আরও বেশি, মানসিকভাবে। সিমলাই-এর অভিজ্ঞতা, শুধু বন্যপ্রাণ নয়, গ্রামের মহিলাদের নিয়ন্ত্রণে রাখার কাজেও জঙ্গলের ক্যামেরা ব্যবহার করা হচ্ছে। গ্রামের বেশিরভাগ পুরুষ, তা সে বাবা, স্বামী, বা সন্তান যে-ই হোক না কেন, সবার গলায় এক সুর, বাড়ির মেয়েরা নাকি ঘরের কাজ না করে জঙ্গলে ঘুরে সময় নষ্ট করছে। বেশ কিছু পুরুষ তাই নিয়মিত ফরেস্ট অফিসে গিয়ে ক্যামেরার ছবি দেখতে চায়। মেয়েদের ওপর পুরুষের এমন খবরদারির অধিকার কোন সংহিতায় লেখা আছে, কে বলে দেবে! কে টেনে দেবে মেয়েদের কাজ-অকাজের গণ্ডি! পুরুষ! ‘আমরা যখন জঙ্গলে গিয়ে গান করি, মনে হয়, আমরা সত্যি বেঁচে আছি! সারাদিন ঘরের কাজ করি। শুধু মাত্র বিয়ের অনুষ্ঠান ছাড়া আমাদের গান গাইবার সুযোগ নেই। আমাদের গান গাওয়া সমাজের কেউ ভাল চোখে দেখে না। ক্যামেরায় ধরা পড়ার ভয়ে আমরা জঙ্গলেও আর গান গাইতে পারি না’।
……………………………………………..
আরও পড়ুন মৌসুমী ভট্টাচার্য্য-র লেখা: নিরুদ্দেশ কীটপতঙ্গ সম্পর্কে ঘোষণা
………………………………………………
করবেট রিসার্ভের প্রান্তবাসিনী এক মেয়ে যখন অক্সফোর্ডের গবেষককে একথা বলে, তখন মনে হয় একটা ক্যামেরা কতটা ক্ষমতার উৎস হয়ে উঠতে পারে! সে ক্ষমতার মালিকানা অবশ্যই পুরুষের। গান গেয়ে নিজেকে নিজের কাছে জীবিত প্রমাণ করার ইচ্ছেটুকুও সে মেয়ে বন্ধক দিতে বাধ্য হয় পুরুষ আর প্রযুক্তির গাঁটছড়ার কাছে। রবীন্দ্রনাথের সেই গানের কথাগুলো কেমন যেন করবেটের মেয়েদের কথা হয়ে উঠছে– ‘ঘরে আমায় রাখতে যে হয় বহু লোকের মন/ অনেক বাঁশি, অনেক কাঁসি, অনেক আয়োজন/ দেখাব যে সবার কাছে, এমন আমার কী-বা আছে/ সঙ্গে আমার আছে শুধু এই কখানি গান।।’
ও মেয়ে তুই গান ধর। তোর গানের সম্মোহনে থমকে যাক পৃথিবীর সব নজরদারি ক্যামেরার লেন্স। ঝাপসা হয়ে যাক সব লোলুপ চোখের চাহনি। ঝনঝনিয়ে ভেঙে পড়ুক ‘সারভেইলেন্স সোসাইটি’র কাচের দেয়াল। তুই গলা ছেড়ে গান ধর।
……………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………….