Robbar

ট্রাফিকে চাকরি রূপান্তরকামীদের, সমাজের পক্ষে তা সবুজ সিগন্যাল?

Published by: Robbar Digital
  • Posted:January 5, 2025 8:43 pm
  • Updated:January 5, 2025 8:43 pm  

রূপান্তরকামীরা যে কাজই করতে চান না কেন, তাতে বাধাপ্রাপ্ত কেন হবেন? শিক্ষাঙ্গনে সকলের মধ্যে তাঁরা স্বস্তির অবস্থান কেন পাবেন না? টোকেনিজমের রাজনীতি করে কোনও গোষ্ঠীর উন্নতি সম্ভব নয়। সব সরকারকেই প্রকৃত অর্থে রূপান্তরকামী মানুষদের সমাজে গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে ভাবতে হবে। আর যদি সামাজিকভাবে তা না করা যায়, তবে সমাজটাকেই ঢেলে সাজাতে হবে।

গ্রাফিক্স: দীপঙ্কর ভৌমিক

ভাস্কর মজুমদার

‘কিসের ভাবনা লো কিসের ভাবনা,
স্বগ্গ এখন ঠাঁই করেছে ঘরে
আমার কিসের ভাবনা–’

মতিলাল পাদরীর বাসায় এক শিশুপুত্রের জন্ম হয়েছে শুনে বদন হিজড়ে তাকে দেখতে এসেছে। কিন্তু শিশুর মা ভামরকে দেখে, ভামরের শারীরিক পরিপূর্ণতা আর পাদরীর ঘরে তার যত্ন দেখে বদনের মন কেমন করে ওঠে। এ আবেগ ঠিক ঈর্ষা নয়। কিন্তু দিনের পর দিন অভাবী থাকার দুঃখবোধ। সে কোনওদিন না তথাকথিত পুরুষ হতে পারবে আর না ভামরের মতো মা হয়ে কারও ঘরে যত্ন পাবে। সে কেবল দুয়ারের লোক হয়ে থাকবে। বদনের চোখে জল এলে সে পাদরীকে বলে, ‘ভাবলুম দূত বাবুর কাছে গান গাই গা, যদি আসছে জন্মে মানুষ হই ছেইলার বাপ হই! এ জন্ম তো হাজা মজা গেল গো।’

কমলকুমার মজুমদার তাঁর এই ‘মতিলাল পাদরী’ (‘দেশ পত্রিকা’য় প্রকাশিত ১৯৫৮ সালে) গল্পে অপূর্ব সব চরিত্র চিত্রণের পাশাপাশি বদন হিজড়ার সকল ভেঙে-পড়াকে অসামান্য স্থান দিয়েছিলেন। দুয়ার থেকে বদন হয়তো উঠান অবধি এসেছে। কিন্তু কোনও ঘরেই যে তার স্থান কখনও হবে না, তা সে গভীরভাবেই জানে।

সম্প্রতি তেলেঙ্গানা রাজ্যে কিছু রূপান্তরকামী মানুষদের ট্রাফিক পুলিশের সহায়ক হিসেবে কাজে বহাল করা হয়েছে। খবরে প্রকাশ, ১০০ জন চাকরিপ্রার্থীর মধ্যে বেছে ৩৯ জন রূপান্তরকামী সেই কাজ পেয়েছেন। তবে এই চাকরিপ্রাপ্তির সংবাদ ও বিজ্ঞাপনে বারবার উল্লেখ থাকছে যে, ট্রাফিকে এই রূপান্তরকামী মানুষরা যে ভিক্ষাবৃত্তি করতেন তা থেকে সরিয়ে তাঁদের যেন-বা পুনর্বসিত করা হল।

কথা হল, ভিক্ষাবৃত্তি তো কোনও অপরাধ নয়। ভারতে অসংখ্য মানুষ ভিক্ষাবৃত্তি করে থাকে যুগ-যুগান্ত থেকে। প্রাচীনকালের মুনিঋষি থেকে শুরু করে আধুনিক কালের সাধুসন্তরা পর্যন্ত ভিক্ষাবৃত্তিকে উচ্চতর জীবনের অভিজ্ঞান বলে চিহ্নিত করেছেন। তাঁদের দানখয়রাত করে বহু মানুষ তথাকথিত পুণ্য সঞ্চয় করে। এমনকী ‘হিজড়া’ পেশার মানুষদের কিংবা ট্রাফিকে ভিক্ষাবৃত্তি করা রূপান্তরকামী মানুষদের অর্থসাহায্য করে কত লোক ‘আশীর্বাদ’ও চায়! তাহলে ভিক্ষাবৃত্তিতে অসুবিধা কোথায়?

Banning transgender persons from begging is cruel and illegal | The Indian Express
প্রতীকীছবি। সূত্র: ইন্টারনেট

আসলে অসুবিধা আমাদের ট্রান্সফোবিয়ার কারণে। রূপান্তরকামী মানুষদের প্রতি সমাজ-রাষ্ট্রের অবদমিত ঘৃণার নামই ট্রান্সফোবিয়া। বাবু-বিবিরা ট্রাফিকে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রূপান্তরকামী মানুষদের দেখতে অনীহা পোষণ করেন বলেই তাঁদের নিজেদের কাজ থেকে সরিয়ে অন্য কাজে লাগানোর চেষ্টা– সে কাজে তাঁরা টিকতে পারুক আর নাই পারুক। ২০১৮ সালে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের হিসাব অনুযায়ী, আমাদের দেশের ৯৬ শতাংশ রূপান্তরকামী মানুষদের কোনও কাজ দেওয়া হয় না এবং তাঁরা বাধ্য হন খুবই নিম্ন অর্থমূল্যের কাজ করতে, যা কখনও কখনও অসুরক্ষিতও হতে পারে। ৮০ শতাংশ রূপান্তরকামী মানুষ সব ধরনের যোগ্যতার মান পূরণ করলেও কাজ পান না তাঁদের লিঙ্গপরিচয়ের কারণে। সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের জন্য ২০১৮ সালে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা অবলুপ্তির পরে কর্পোরেট জগৎ ক্রমাগত বিজ্ঞাপন করে চলে যে, তারা সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষ-সহ সকল লিঙ্গযৌনতার মানুষদের কাজ দিয়ে থাকেন। তারা ‘ইনক্লুসিভিটি’ বা অন্তর্ভুক্তির দর্শন আওড়ায়। জুন মাসে ‘প্রাইড-মান্থ’ এলে তাদের কোম্পানি-লোগো রামধনু রঙে সেজে ওঠে। কিন্তু সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষরা কতদিন সেসব কাজে বহাল থাকতে পারেন, তাঁদের লিঙ্গপরিচয়ের জন্য কী কী বাঁধার সম্মুখীন তাঁরা হন কিংবা কর্মক্ষেত্রে তাঁদের হেনস্থার খতিয়ানটা কি– সেগুলো যাচাই করে দেখা হয় না। এমনকী লিঙ্গ-নিরপেক্ষ টয়লেটের ব্যবস্থাও সব জায়গায় থাকে না। যদি এগুলো ঘটত বা হত, তাহলে বোঝা যেত বাস্তবে অন্তত রূপান্তরকামী মানুষদের পক্ষে চাকরি ধরে রাখা কত কঠিন হয়ে ওঠে সামাজিক হেনস্থা-হিংসার কারণে।

ভারতীয় রেলে চাকরি পেয়েছিলেন কয়েকজন গত বছর এক রাজ্যে অনেকটা তেলেঙ্গানায় ট্রাফিক পুলিশের সহায়কের চাকরির মতো কিন্তু টানা একটি বছরও তাঁরা সেই চাকরি করতে পারেননি, কারণ রূপান্তরকামী হবার দরুন তাঁদের কেউ বাড়ি ভাড়াই দেয়নি! এমনকী সরকারি স্কুলে শিক্ষকের চাকরি পেয়েছেন অনুরূপ সমস্ত পরীক্ষায় পাশ করে অথচ চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন রূপান্তরকামী মানুষ তাঁর লিঙ্গপরিচয়ের কারণে– এমন উদাহরণও ভারতে আছে।

From seeking alms to managing traffic, incredible journey of 39 transgenders in Telangana
ছবিসূত্র: ইন্টারনেট

২০১৪ সালে প্রখ্যাত নালসা রায় মারফত দেশের উচ্চতম ন্যায়ালয় জানিয়েছিল যে, সরকারকে শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে রূপান্তরকামী মানুষদের জন্য সংরক্ষণ দিতে হবে। কিন্তু দেখা গেল, কেন্দ্রীয় সরকারি কাজে তো নয়ই, এমনকী দুয়েকটা রাজ্য ছাড়া (যেমন, কর্ণাটকে চাকুরিক্ষেত্রে এক শতাংশ সংরক্ষণ দেওয়া হয়েছে রূপান্তরকামী মানুষদের জন্য) অন্য কোনও রাজ্যের সরকারি চাকরিতেও সেই রায় অথবা কোনওরূপ ‘হরাইজ়ন্টাল রিজার্ভেশন’ (আনুভূমিক সংরক্ষণ) আজ অবধি কার্যকর হয়নি। ‘হিজড়ে’ পেশার মানুষদের ঐতিহ্যগত যে কাজগুলি ছিল (যেমন বধাই), সেগুলিও বিভিন্ন কারণে বন্ধ হবার মুখে না হলেও দিন দিন সমস্যা-সংকুল হয়ে উঠছে।

ভিক্ষাবৃত্তি অথবা দেহব্যবসাতে জড়িয়ে পড়ার বহু কারণ থাকে ভারতে একজন রূপান্তরকামী মানুষের। লিঙ্গপরিচয়ের জন্য তাঁরা স্কুল শিক্ষা সম্পূর্ণ করতে পারেন না। ক্লাসরুমে সহপাঠী এবং কখনও কখনও শিক্ষকদের হেনস্থা-হিংসা আর কটুক্তির জন্য তাঁরা স্কুলছুট হতে বাধ্য হন। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়েও এসবের ব্যতিক্রম হয় না। এভাবে রূপান্তরকামী মানুষদের চাকরি পাওয়ার সব রকম দক্ষতা অঙ্কুরেই বিনষ্ট করা হয়। তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে দেশে রূপান্তরকামী মানুষদের চাকরির এত অভাবের মধ্যে তেলেঙ্গানা সরকার যখন একটা অন্যরকম ব্যবস্থা করছে এবং তাতে প্রার্থীরা যথেষ্ট খুশি, সেই উদ্যোগকে বাঁকা চোখে দেখার কারণ কী?

Telangana: Journey of 39 transgenders who are inducted as traffic assistants in Hyderabad – India TV

আসলে প্রশ্নটা চাকরি পাওয়া বা সে-উদ্যোগের বিজ্ঞাপন বিষয়ক নয়। সব চাকরিতেই রূপান্তরকামী মানুষদের সমান অধিকার কেন থাকবে না, প্রশ্ন সেটাই। তাঁরা যে কাজই করতে চান না কেন, তাতে বাধাপ্রাপ্ত কেন হবেন? শিক্ষাঙ্গনে সকলের মধ্যে তাঁরা স্বস্তির অবস্থান কেন পাবেন না? টোকেনিজমের রাজনীতি করে কোনও গোষ্ঠীর উন্নতি সম্ভব নয়। সব সরকারকেই প্রকৃত অর্থে রূপান্তরকামী মানুষদের সমাজে গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে ভাবতে হবে। আর যদি সামাজিকভাবে তা না করা যায়, তবে সমাজটাকেই ঢেলে সাজাতে হবে।

কমলকুমার মজুমদারের ‘মতিলাল পাদরী’ গল্পে বদনের মতো কোনও মানুষকে যেন বলতে না হয় আগামী জন্মে যেন তার জীবন ভালো হয়।

………………………………………………….

ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল

………………………………………………….