অসুস্থ মানুষ ও প্রাণীর জন্য অ্যাম্বুলেন্স যেরূপ পরিষেবা প্রদান করে, তেমনি অসুস্থ ও ক্ষতিগ্রস্ত গাছের দেখাশোনা এবং উপড়ে যাওয়া গাছগুলিকে পুনরুজ্জীবিত করতে সাহায্য করা ‘ট্রি অ্যাম্বুলেন্স’-এর প্রধান উদ্দেশ্য। প্রাথমিক চিকিৎসার পাশাপাশি বীজ ব্যাংক, বীজ বিতরণ, উপড়ে ফেলা গাছ রোপণ, উদ্ভিদ বিতরণ, বৃক্ষরোপণে সহায়তা, গাছ স্থানান্তর, গাছের জরিপ এবং মৃত গাছ অপসারণ– এই প্রকল্পের মূল ফোকাস পয়েন্ট।
‘প্রকৃতি যদি তোমাকে নির্বাচন না করে, তাহলে তোমার ধ্বংস অনিবার্য’, বলেছিলেন বিজ্ঞানী ডারউইন। যে হারে বিশ্ব উষ্ণায়ন বাড়ছে, তাতে গোটা পৃথিবীটাই যেন প্রকৃতির নির্বাচন যোগ্যতা হারাচ্ছে ক্রমশ! সারা বিশ্বে ক্রমাগত গ্রিন বেল্ট সংকুচিত হচ্ছে। দূষণের মাত্রা সর্বকালের উচ্চতায় চড়ছে জেনেও ভবিষ্যতের পায়ে কুড়ুল মেরে রাস্তা সম্প্রসারণ, কলকারখানা ও বসতি স্থাপনের মতো নানা বাণিজ্যিক উন্নয়নের স্বার্থে বৃক্ষ নিধনের আয়োজন লাগাতার ঘটেই চলেছে! জলবায়ুর বদলে যাওয়ার মারাত্মক প্রভাবে বেঁচে থাকার অনুকূল পরিবেশ যে ধীরে ধীরে হারাচ্ছে, সেদিকে খেয়াল না রেখে গোটা বিশ্বই যেন আজ পরিবেশ ধ্বংসে মেতেছে!
আমাদের রাজ্যের কথাই ধরা যাক। যশোর রোড, লাটাগুড়ি, টাকি রোডে রাস্তা সম্প্রসারণের নামে অপরিকল্পিতভাবে শতাব্দীপ্রাচীন বহু সংখ্যক গাছ কেটে ফেলা হয়েছে, হয়ত সে সেসব রাস্তার কোথাও কোথাও সরকারি উদ্যোগে শতাধিক গাছের চারা লাগানোও হয়েছে। কিন্তু উপযুক্ত পরিচর্যার অভাবে সে সমস্ত চারাগাছেরা মারাও গেছে। আসলে বর্তমান সমাজব্যবস্থা এমন এক অবস্থানে দাঁড়িয়েছে যে, পরিচর্যা বিষয়টি অবলুপ্তির পথে, আমরা অনেক কিছুই হয়তো হুজুগে করে ফেলি, কিন্তু বিষয়টিকে ধারণ করা, লালন করা বা তারমধ্যে মানসিকতার টিকে থাকা নেই বলতে গেলে! তাই হয়তো বড় রাস্তার পাশের সুপ্রাচীন গাছগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অর্থ বরাদ্দ হওয়া সত্ত্বেও বন-দপ্তরের পক্ষ থেকে বছরের পর বছর কোনও নিয়মিত পরিচর্যা নেই, ফলত অহরহ গাছের ডাল ভেঙে মানুষের বিস্তর ক্ষয়ক্ষতি লেগেই আছে, আর দোষীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে সেই সব বৃক্ষরাজিকে!
আশ্চর্যের কথা, সম্প্রতি নাসা প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে ভারত ও চিন উভয়ই নাকি গ্রিন বেল্টের অধীনে এলাকা বাড়ানোর চেষ্টা করছে! পারতপক্ষে প্রতিবেদনটিকে মিথ্যে মনে হলেও কিছুকিছু ঘটনার সাপেক্ষে আশা জাগে। তেমনই একটি ঘটনা হল, চেন্নাইয়ের পরিবেশবিদ ডক্টর আব্দুল গনি, যিনি ‘গ্রিন ম্যান অফ ইন্ডিয়া’ হিসাবে পরিচিত, বৃক্ষ সংরক্ষণের জন্য তার মস্তিষ্কপ্রসূত এক অভিনব ধারণা ‘ট্রি অ্যাম্বুলেন্স’ প্রকল্পকে বাস্তবায়নে তৎপর হয়েছে SASA গ্রুপ।
……………………………………………………….
তামিলনাড়ুতে ২০১৬ সালে ঘূর্ণিঝড় ‘ভারদা’ এবং ২০১৮ সালে ঘূর্ণিঝড় ‘গাজা’র মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে লক্ষ লক্ষ গাছ উপড়েছিল। এই ট্রি অ্যাম্বুলেন্সের সাহায্যে গনি ও তার দল দুর্বল হয়ে পড়া গাছের গোড়ায় মাটি দিয়ে রাজ্যের সবুজ বলয় সংরক্ষণের প্রচেষ্টা শুরু করেছিলেন, গনির আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে SASA গ্রুপের পরবর্তী উদ্দেশ্য ছিল, ভারতের প্রতিটি জেলায় একটি ট্রি অ্যাম্বুলেন্স স্থাপন করা এবং এই প্রোগ্রামটিকে সমর্থন করার জন্য শক্তিশালী স্বেচ্ছাসেবক সম্প্রদায় গড়ে তোলা।
……………………………………………………….
কী এই ‘ট্রি অ্যাম্বুলেন্স’?
অসুস্থ মানুষ ও প্রাণীর জন্য অ্যাম্বুলেন্স যেরূপ পরিষেবা প্রদান করে, তেমনি অসুস্থ ও ক্ষতিগ্রস্ত গাছের দেখাশোনা এবং উপড়ে যাওয়া গাছগুলিকে পুনরুজ্জীবিত করতে সাহায্য করা ‘ট্রি অ্যাম্বুলেন্স’-এর প্রধান উদ্দেশ্য। প্রাথমিক চিকিৎসার পাশাপাশি বীজ ব্যাংক, বীজ বিতরণ, উপড়ে ফেলা গাছ রোপণ, উদ্ভিদ বিতরণ, বৃক্ষরোপণে সহায়তা, গাছ স্থানান্তর, গাছের জরিপ এবং মৃত গাছ অপসারণ– এই প্রকল্পের মূল ফোকাস পয়েন্ট। SASA গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা, সুরেশকৃষ্ণ যাদব আরও জানিয়েছিলেন, ‘বাগানের সরঞ্জাম, জল, সার এবং কীটনাশকের পাশাপাশি দক্ষ সহায়িকাদের সঙ্গে একজন উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞও ট্রি অ্যাম্বুলেন্সে ভ্রমণ করবেন। আমাদের কাছে সর্বাধুনিক যান্ত্রিক সরঞ্জাম, ছত্রাকনাশক এবং সার-সহ সম্পূর্ণ সরঞ্জাম রয়েছে’।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন অভীক পোদ্দার-এর লেখা: এবার মরলে গাছ হব আমি, সবুজ সারা গায়ে
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
তামিলনাড়ুতে ২০১৬ সালে ঘূর্ণিঝড় ‘ভারদা’ এবং ২০১৮ সালে ঘূর্ণিঝড় ‘গাজা’র মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে লক্ষ লক্ষ গাছ উপড়েছিল। এই ট্রি অ্যাম্বুলেন্সের সাহায্যে গনি ও তার দল দুর্বল হয়ে পড়া গাছের গোড়ায় মাটি দিয়ে রাজ্যের সবুজ বলয় সংরক্ষণের প্রচেষ্টা শুরু করেছিলেন, গনির আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে SASA গ্রুপের পরবর্তী উদ্দেশ্য ছিল, ভারতের প্রতিটি জেলায় একটি ট্রি অ্যাম্বুলেন্স স্থাপন করা এবং এই প্রোগ্রামটিকে সমর্থন করার জন্য শক্তিশালী স্বেচ্ছাসেবক সম্প্রদায় গড়ে তোলা। সুরেশকৃষ্ণ যাদব তাই ডাক দিয়েছিলেন, ভারতের যেকোনও প্রান্তের মানুষ, যারা এই আন্দোলনের অংশ হতে চান এবং এটি সম্পর্কে আরও জানতে চান, তারা সহজেই তাদের ওয়েবসাইট– www.treeambulance.org-এ স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে নিজেদের নিবন্ধন করতে পারেন। ‘আসুন সংযুক্ত হই, অন্তত নিজ অঞ্চলসমূহে বৃক্ষ পরিচর্যা ও সংরক্ষণ দিন যাপনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠুক আমাদের’। এই লেখার মুখ্য উদ্দেশ্য হয়তো এই সবুজ মানবের ডাকটিকে ছড়িয়ে দেওয়া।
যে উদ্যোগ সরকারের নেওয়া আশু কর্তব্য ছিল, তা প্রায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে সম্পাদিত হচ্ছে! তবু এমন ঘটনা যে ঘটেছে এটাই পরম প্রাপ্তি, এ মতো সচেতন হওয়ারই কথা হয়তো প্রতিটি ঘুম ভাঙা মানুষের। গাছকেন্দ্রিক প্রতিপালিত সন্তান এই মানবজাতি-সহ সমস্ত প্রাণীকুল, গাছেরা যেহেতু নীরব, তাই তাদের হয়ে আমাদের নিরন্তর কথা বলে যেতেই হবে। সতত যাপনে লালিত হোক এই মন্ত্র, এই শতাব্দী হোক গাছের শতাব্দী।
…………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………….