রাত ১১টা, সিয়ামের শুরু হল শ্বাসকষ্ট আর হিচকি দিয়ে বমি। একদম ঠান্ডা হয়ে গেলাম। কখনও কেউ এমন পরিস্থিতিতে আমরা পড়িনি। দ্রুত ছুটলাম নীচে ডিউটি ডাক্তারের কাছে। কাউন্টার থেকে বলা হল, ওই যে এক ডাক্তার যাচ্ছেন নীল জামা পরা, তাঁকে ধরেন। ধরতে গিয়ে দেখি উনি কোথায় যেন হাওয়া। এরপর ডেস্ক ছেড়ে আরেক ডাক্তার চললেন। এক করিডরে দেখি একজন ছাত্রের বেনামি লাশ পড়ে আছে টেবিলে। বিছানার চাদরে ঢাকা। এখানে-ওখানে বসে আছে হাতে-পায়ে ব্যান্ডেজ করা ছাত্ররা।
১৫ জুলাইয়ের ঘটনা, হাসপাতাল থেকে ফিরে
দেশ উত্তাল! প্রতিদিনের মতো। সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয় যেন কড়াইতে টগবগ করে ফুটছে। আজ সারাদিন বাসায় ছিলাম।
সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্টের মেসেঞ্জার গ্রুপে একটা নোটিশ দেখলাম, সিয়ামের ব্লাড দরকার। মুমূর্ষু, ঢাকা মেডিকেল কলেজে আছে।
পড়ে অন্তরাত্মা ঠান্ডা হয়ে এল। অনেকেই, ভাই-বন্ধু আজকের আন্দোলনে ছিল— কিন্তু আমার পরিচিত কেউ এভাবে আক্রান্ত হবে, আমার ভাবনাতে ছিল না। এত ম্যাসিভ ইঞ্জুরি! এই উত্তাল আন্দোলন তখন কেবল শুরুর দিকে। সেদিনই প্রথম সাধারণ ছাত্রদের ওপর নির্লজ্জ আক্রমণ নেমে এসেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে, সারা দেশ স্তব্ধ হয়ে গেল এহেন বর্বরতায়। এরপর সারা দেশে লাশ পড়ল কোথাও কোথাও, আবু সাঈদ গুলির সামনে বুক পেতে দিয়ে হয়ে উঠলেন দেশের মানুষের বিস্ময়ের প্রতীক। এরপর দুই শতাধিক মানুষের লাশও ইতিহাস হল।
ঘটনায় ফিরে আসা যাক। কলমপেষা স্বভাবের মানুষেরা একরকম স্বরচিত নির্জনতায় বাস করেন বোধহয়। ক্যাম্পাসে তাই আমার তেমন বন্ধু নেই। আপন মানুষ বলতে হাতেগোনা কয়জন। সিয়াম তার মধ্যে এক। এই প্রজন্মের পড়ুয়া আর মেধাবীদের মধ্যে একজন সে, আমাদের আলাপ সবসময়ই জমে। খানিকটা ভক্তিও করে বোধহয়। এই ছেলেটা এভাবে পড়ে যাবে?
সন্ধ্যা অবধি অপেক্ষা করে হাসপাতালে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। যেতে যেতে থমথমে শহরের রাস্তাঘাটের সাক্ষী হলাম। যানবাহন বিশেষ নেই।
কোনও রিকশাই যেতে রাজি না মেডিকেলের এমার্জেন্সি গেট অবধি। অগত্যা হেঁটেই রওনা দিতে হল। এর মধ্যে হাসপাতালে হামলার খবরটি এল। সরকার সমর্থিত ছাত্রলিগ দলটি চড়াও হয়েছে হাসপাতালে! বিছানায় কাতরানো এতগুলো মুমূর্ষু ছাত্র— মরার ওপর এ কেমন খড়ার ঘা? অসুস্থ ছাত্রদের নিয়ে হাসপাতালের করিডর থেকে করিডরে ছুটছিল তাদের ভাই-বন্ধুরা। তারা আক্রান্ত হল দুই দফায়। ভয়ানক পরিস্থিতি তৈরি হল। ভয় আর নির্যাতন দিয়েই কি সব দমানো যায়?
রাস্তার এখানে-ওখানে একটু বসে, নয়টার দিকে পৌঁছলাম হাসপাতালে। পথে, দুইটা সাধারণ রাস্তার মোড়ে পুলিশের আর্মড কার দেখলাম। পুলিশ সদস্যরা কী নির্বিকার! স্মার্টফোন দেখে হাসছেন কেউ কেউ, খোশগল্পে মত্ত। কে বুঝবে দিনের বেলা কী রুদ্র ঝড় তৈরি করেছে তারা। অবশ্য মন থেকে কতটুকুই বা করেছে? নিছক চাকরির দাস বোধহয়।
এমার্জেন্সিতে গিয়ে দেখি নাহিদ আছে, নূর আছে, পিয়াস ভাই দাঁড়ানো।
দেশের সবচেয়ে বড় সরকারি হাসপাতাল— কী হাল তার! ফ্যান আছে না থাকার মতো। এ মাথায় একটা, ও মাথায় একটা। ভ্যাপসা গরম।
মাথায় মারাত্মক চোট আর সাদা ব্যান্ডেজ নিয়ে এক ছাত্র পাশের বেডেই কাতরাচ্ছে।
সিয়াম মাথা ঘুরে তাকাল। এমন তীব্র আহত মুখ আমি স্মরণকালে আর কোথাও দেখেছি, মনে পড়ে না। নূর আর নাহিদ আপন ভাইবোনের মতো অনবরত বাতাস করছে হাতপাখায়৷ আমরা সবাই ঘামছি তীব্র গরমে।
তার বাম চোখ ও আশপাশ-সহ কমপক্ষে তিন-চার ইঞ্চি ফুলে নীল হয়ে আছে। সারা গায়ে রক্তের ছোপ। শরীর এখানে-ওখানে ব্যথায় নীল। মাথার ওপরের একটা পাশ ফেটে গেছে। রক্ত জমাট হয়ে আছে ফাটা জায়গায়। হাতে ক্যানুলা, তীব্র স্যালাইন।
নূর বলল, সাদ আসছে— দেখো সিয়াম।
আমার দিকে তাকিয়ে হেসে সে বলল, ভাই আপনি একটা লেখায় লিখসিলেন না— ‘আজও কেউ মাঠে নামে… আজও কেউ কেউ ভর দুপুরে কাস্তে হাতে ধান কেটে যায়…’, আমি সেই ধান কাটা দলে ধান কেটে যাচ্ছি।
মনে মনে বললাম, ঠিক। কিছু লাভ নেই জেনেও তবুও কিছু মানুষ ধান কেটে যায়… আমার ভাগ্য, নিষ্ফলা মাঠের সেই কৃষকদের পায়ের কাছে এসে বসতে পারলাম।
বলল, ভাই গতকাল রাতে কয়টা মুভি সিরিজ নামায়ে রাখসিলাম। ভাবসিলাম আর মিছিলে যাব না। আজকে কী হয়ে গেল…
একরকম বিষাদক্লিষ্ট হাসি, মনে হইল কান্নার চেয়ে করুণ। বলল, আমার স্মৃতিশক্তি কি নষ্ট হয়ে যাবে ভাই?
মরুভূমির একাকী হাওয়ার মতো এক হাহাকার আমার বুকের ভেতর ছড়ায়ে পড়ল।
১৭ তারিখে এক প্রোগ্রাম ছিল বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে। সেখানে যাওয়ার দাওয়াত দিয়েছিল আমাকে সে। উত্তর করেছিলাম— প্রোগ্রাম কী, তা তো জানি না। তবে আপনাদের সঙ্গে দেখা হবে— সেই সঙ্গসুখের লোভে অবশ্যই যাব।
সেই ঘটনা মনে করিয়ে সে বলল— ভাই ১৭ তারিখের প্রোগ্রামে যাবেন কিন্তু।
এই মরো মরো পরিস্থিতিতেও সে তার কাজটা ভোলেনি৷ আমি খুব মলিন একটা হাসি ঠোঁটে ঝুলায়ে বললাম— সব ঠিক হয়ে যাবে ভাই।
……………………………………………………
পড়ুন সুমন মজুমদারের লেখা: রক্তক্ষয় করতে বাঙালি ছাত্রছাত্রীরা কোনওকালেই কোনও কার্পণ্য করেনি
……………………………………………………
সেদিন কী হয়েছিল
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি চত্বরে জমায়েত করেছিল ছাত্ররা। ইভান ভাই-সহ আরও কয়েকজন একসঙ্গে ছিল। এমন সময়ে হামলা হল ছাত্রলিগের। লাঠিসোঁটা, ধারাল অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল নিরস্ত্র ছাত্র, এমনকী ছাত্রীদের ওপর! আমরা সোশ্যাল মিডিয়াতে দেখলাম লাঠির সামনে এক ছাত্রীর আতঙ্কে বিবর্ণ মুখ, আর্ত চড়ুই পাখির মতো কাঁপছে যেন বা। সারা মুখ মেখে আছে লাল তাজা রক্তে। সে যেন আমার রক্তাক্ত বাংলাদেশ।
সিয়ামের সঙ্গে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৩তম ব্যাচের এক দিদি ছিলেন। ছাত্রলিগের ক’জন পাণ্ডা— দেখতেও বয়স্ক, মনেই হয় না ছাত্র এরা— কী মার মারল মেয়েটাকে।
সিয়াম এগিয়ে বলেছে— ভাই আমাকে মারেন, তবুও আপু রে কিছু বইলেন না।
দিদিকে ঢাল করে দাঁড়াতেই মাথার ওপর ইটবৃষ্টি নেমে এল। হাত দিয়ে মাথা ঢেকে সেভ করা গেলেও হাত ছুলে গিয়ে ক্ষতবিক্ষত হল। আমাকে ও দেখাল সেই ক্ষত। এই শেষ নয়, এরপর নেমে এল হকিস্টিকের এক আচমকা আঘাত। তার চোখের সামনে সব সাদা হয়ে গেল। অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যাওয়ার পরেও বুকে-পিঠে-পেটে সমানে লাথি চলেছে পাষণ্ডদের।
সেই পেটের ব্যথায় হল রক্তবমি। কিছুই মুখে দিতে পারছে না। বিছানা থেকে উঠে বসলেই বমি। ডাক্তার এসে দেখে গেল। ডিউটি ডাক্তারের কাছে এক্স রে রিপোর্ট জমা দিলাম, ভাগ্যিস মাথার ভেতর বুকের ভেতর ম্যাসিভ কোনও ইঞ্জুরি ধরা পড়ল না। ওষুধ আনতে হালকা ছোটাছুটি করলাম আমি আর পিয়াস ভাই। চোখের ড্রপ আর কী ইঞ্জেকশন দিল। স্যালাইন চলছিল। কিছু খাওয়া যাবে না। প্রচণ্ড পানি পিপাসাও পাচ্ছিল ওর। ভাবলাম ডাবের পানি আনি। সে পানিও সহ্য হয়নি পেটে, আবারও ভয়ানক বমি। একজন নিরীহ মানুষকে এমন যাতনার মুখে কী করে ফেলে আরেকজন মানুষ! সামনাসামনি না দাঁড়ালে বোঝা যায় না।
………………………………..
পড়ুন রুহুল মাহফুজ জয়ের লেখা: সাড়ে ৫ হাজার মুক্তিযোদ্ধার জন্ম ১৯৭১ সালের পরে!
………………………………….
ঢাকা মেডিকেলের সেই বদমেজাজি রুক্ষভাষী ডিউটি ডাক্তার আর নার্সরাও আজ কী কোমল আর আন্তরিক। অবাক হয়ে গেলাম। কয়েকবারই আসলেন তাঁরা। প্রেসক্রিপশন অদলবদল করলেন। স্যালাইনের গতি বাড়ালেন। এক অদ্ভুত কান্না যেন আজ সবাই বুকে নিয়ে আছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক এলেন, দেখে গেলেন বেডে বেডে অসুস্থ ছাত্রদের। কিছু কো-অপারেটিভ মানুষ ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা, দুয়েকটি রাজনৈতিক দলের ছাত্ররাও এসে খোঁজখবর করেছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন লেখক অধ্যাপক এলেন বেডের কাছে। তাঁর সঙ্গে কথা হল। বললেন, সকালে যখন আক্রমণ শুরু হল, আমি কয়েক জায়গায়— ডিসি, এসপি, কমিশনারকে ফোন করেছি। সবার ফোন বন্ধ। আমাদের হাত বাঁধা, আমরা থামাতে পারিনি।
আরও বললেন, তোমরা সবাই একসঙ্গে জড়ো হয়ে থেকো না। সব রিসোর্স একসঙ্গে শেষ হয়ে গেলে হবে না। পালা পালা করে রোগীর সঙ্গে থাকো। শক্তির অপচয় করা যাবে না। সামনে আরও অনেক দিন তোমাদের হাসপাতালে ছোটাছুটি করা লাগতে পারে।
মনে মনে ভাবলাম, বেঁচে থাকা জরুরি। সবাই ইঞ্জুর্ড হওয়া যাবে না।
রাত ১১টা বেজেছে, এর মধ্যে শুরু হল শ্বাসকষ্ট আর হিচকি দিয়ে বমি। একদম ঠান্ডা হয়ে গেলাম। কখনও কেউ এমন পরিস্থিতিতে আমরা পড়িনি। দ্রুত ছুটলাম নিচে ডিউটি ডাক্তারের কাছে। কাউন্টার থেকে বলা হল, ওই যে এক ডাক্তার যাচ্ছেন নীল জামা পরা, তাঁকে ধরেন। ধরতে গিয়ে দেখি উনি কোথায় যেন হাওয়া। এরপর ডেস্ক ছেড়ে আরেক ডাক্তার চললেন। এক করিডরে দেখি একজন ছাত্রের বেনামি লাশ পড়ে আছে টেবিলে। বিছানার চাদরে ঢাকা। এখানে-ওখানে বসে আছে হাতে-পায়ে ব্যান্ডেজ করা ছাত্ররা।
অক্সিজেন মাস্ক আনা হল, ইঞ্জেকশন আনা হল। প্রেসক্রিপশনে অদলবদল হল। আবার এক্স রে দেওয়া হল বুকের।
নূর আর পিয়াস ভাই চলে গেলেন।
সূর্যদা হাসপাতালে ছিলেন। আমি আর নাহিদ রইলাম। ধরাধরি করে নীচে নামাতে হল একবার। যেমন আলতোভাবে ধরে লাশ কবরে নামানো হয়, সেভাবেই তিনজন তিনদিক থেকে ধরে বিছানার চাদর-সহ ট্রলিতে ওঠাতে হয়েছিল। কী নাজুক!
এক্স রে রুমে আনা হল। লিফটে যখন আমরা নামাচ্ছি ট্রলি, সিয়াম জড়ানো কণ্ঠে ডাকল, সাদ ভাই, নাহিদ…। আমরা বললাম আছি ভাই আছি…। আহারে…।
একটু পর দেখলাম আরেক চমক। এক ছেলেকে এমার্জেন্সিতে ঢোকানো হল। হাতে সাদা ব্যান্ডেজ। হাত ভেঙে গিয়েছে। গায়ে বেতের দাগ। মুখের ভেতর একদলা রক্ত জমেছে। কানের পাশে কাটা। সেন্স আছে, উঠতে বসতে পারে, কথা বলে। জিজ্ঞেস করলে বলল, ভাই কোলাটেরাল ড্যামেজ। সঙ্গে একগাদা মানুষ। তারা কেমন অন্যরকম মানুষ।
জানলাম সে ছাত্রলিগের সদস্য। হলে বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা সন্ধ্যার পর আন্দোলন থেকে ফিরে মেরেছে। একজন অনুচর সবসময়ই তার সঙ্গে আছে। আমাদের আহতের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, কোটা আন্দোলনে আহত? তার চোখে সহমর্মিতা না করুণা— কী যে খেলা করল বুঝলাম না। সেও একইভাবে আহত আজ। সবসময়ই একজন ডাক্তার তার সঙ্গে দেখলাম। আরও তিন-চারজন অনুচর ঘিরে আছে। বোন এল তার, মা-ও এল।
মা নিশ্চয়ই খুব ধার্মিক। ছেলেকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। কাঁদছেন। উনি কি জানেন, আজ তার ছেলের মতো অনেক ছাত্রলিগের ছেলে এমন অনেক মায়ের কান্নার কারণ হয়েছে? তাদের চোখে আমরা আসলে কী? সে ভাষা কিছুতেই বুঝতে পারলাম না। সিয়াম যখন কাতরাতে কাতরাতে বমি করছে, ছাত্রলিগের ওই আহত সদস্যের বোনটি দেখলাম উৎসুক চোখে তাকাচ্ছে।
ওই মুহূর্তে সে আসলে কী ভাবছিল? সুন্দর একটা পরিপাটি মুখ। আমি শুধু ভাবছিলাম মানুষ এভাবে আহত করে?
সিয়ামের মা অসুস্থ। ভুলেও তাই ওর বাসায় জানানো হয়নি। পরিবারের কেউ আসেওনি তাই। বিজন হাসপাতালের বেডে একাই কাতরাচ্ছে, অস্পষ্ট ছায়ার মতো ওর আশপাশে আছে দুয়েকজন বন্ধু।
সিয়াম জানাল, ওর সামনেই আজ এক সাধারণ শিক্ষার্থীর হাতের রগ কেটে ফেলে কোপানো হয়েছে।
আজ রাতে কত হাসপাতালে কত ছেলেমেয়ে এইভাবে কাতরাচ্ছে। গরমে, অযত্নে অবহেলায়।
এই কাতরানোর যারা কারণ, তারা কি এখন শান্তিতে ঘুমাচ্ছে? সে কি জানে তার একটা আঘাতের কারণে এই মুহূর্তে একটা মানুষ আইসিউ-তে জীবনমৃত্যুর মাঝামাঝি আছে? হাতের ভেতর এমন গাঢ় রক্তের দাগ মেখে কীভাবে কারও ঘুম আসে?
আমি আর সূর্যদা একটার সময় ফিরে আসলাম। নাহিদ একা থাকবে বন্ধুর পাশে। রণজিৎ দাশের একটা কবিতার লাইন মনে পড়ে গেল আমার—
দুরকম বন্ধু আছে পৃথিবীতে; একজন
ভিজিটিং আওয়ারে আসে, ফিরে যায় সূর্যাস্তের আগে।
অন্যজন বসে থাকে হাসপাতালের গেটে,
অনন্ত দুঃখের রাত জাগে।
নাহিদ ছেলেটা আজ অনন্ত দুঃখের রাত জাগবে বন্ধুর পাশে। কী অসাধারণভাবে সে নিজেই এক কবিতার চরিত্র হয়ে উঠল। কবিতা এভাবেই আমাদের সমস্ত আন্দোলনকে আন্দোলিত করে।
আমার বাইক যখন চানখার পুল দিয়ে বের হচ্ছে, দেখি রাস্তার মাথায় লাঠিসোঁটা হাতে লোকজন দাঁড়িয়ে আছে। সবগুলো রাস্তার মাথা এভাবে বন্ধ। একদম চোখাচোখি হয়ে গেল কয়জনের সঙ্গে। এই প্রথম অনুভব করলাম ধারালো লাঠি হাতে কেউ সামনে দাঁড়ালে, তার সঙ্গে চোখাচোখি হলে কেমন লাগে। বুকের ভেতর একটা ভয়ের সাপ হিসহিস করে ওঠে।
বাইকারকে বললাম, ভাই গাড়ি ঘুরান। আমার বেঁচে থাকতে হবে। এমন হাজার হাজার মুমূর্ষু ভাইয়ের শরীর বুকের ভেতর বহন করতে হলেও আমাকে বেঁচে থাকতে হবে। বেঁচে থাকতে হবে গল্পটা বলার জন্য…
প্রচ্ছদের ছবি: কমল দাস