Robbar

কলকাতা কি আছে কলকাতাতেই?

Published by: Robbar Digital
  • Posted:September 18, 2025 4:44 pm
  • Updated:September 18, 2025 8:18 pm  

বাঙালির মননে ছিল ‘আদাব’ গল্পের বোধ। যেখানে মাঝির প্রস্থানে সুতাকলের মজুর তার সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করে, মাঝি যেন এই দাঙ্গার পরিস্থিতিতে নির্বিঘ্নে বাড়ি যেতে পারে। ঈদের পরব একসঙ্গে কাটাতে পারে পরিবারের সঙ্গে। এই মঙ্গলকামনার বুনিয়াদি ভাবনায় নৈরাজ্য। তবে যতই দুই ভিন্ন মেরুতে অবস্থান করুক মৌলবাদ গলাগলি কোলাকুলি করে বিপন্ন করছে সুস্থ নাগরিক জীবন।

সেখ সাহেবুল হক

কলকাতা শহরের অলিগলিতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে জোম্বিরা! কুৎসিত-কদাকার চেহারা নয় তাদের। বরং বাহ্যিক প্রকাশে সাধারণ মানুষের মতোই। কিন্তু তাদের ঘিলু নষ্ট হয়ে গিয়েছে। হৃদয়ে পচন ধরেছে। বিবেক-বুদ্ধি এখন অন্যের মালিকানাধীন। সেই শক্তির অঙ্গুলিনির্দেশে অন্ধের মতো হেঁটে চলছে। কোথায় যাচ্ছে ধারণা নেই, কোথায় থামবে জানে না। ভালোমন্দ, সাদা-কালো বিচার করার শক্তি হারিয়েছে। তারা চায় প্রত্যেকে তাদের মতো হয়ে যাক। যদি কেউ তাদের মতো না হতে চায়, তবে তেড়ে এসে নিজেদের মতো করে নিতে চাইবে। তবেই শান্ত হবে।

জাভেদ আখতার

এটুকু পড়ে আপনি হয়তো ভাবছেন, দ্যাখো ভাই, এসব ‘ফিকশন’ হিসেবে ঠিক আছে, তবে কলকাতা শহরে এমনটা হওয়া কখনই সম্ভব নয়। যাই হোক কল্লোলিনী তিলোত্তমার আগামীর রূপ কেমন হবে তা ভবিষ্যতের গর্ভে রয়েছে, কিন্তু একের পর এক ঘটে যাওয়া ঘটনা ইঙ্গিত করছে আগামীর কলকাতা কেমন হতে শুরু করেছে।

‘কেয়ামতের আলামত’ বলে একটা ব্যাপার হয়। অর্থাৎ, পৃথিবী ধ্বংসের আগে কিছু কিছু চিহ্ন ধরা পড়বে। তারপর সব ভালো নষ্ট হয়ে গেলে দুনিয়াটা ধীরে ধীরে ফুরিয়ে যাবে। ঠিক একইভাবে সম্প্রতি মৌলবাদীদের হাতে জাভেদ আখতারের বিরোধিতা এবং কলকাতায় তাঁর অনুষ্ঠান হতে না দেওয়াও বাঙালি সমাজের অবক্ষয়ের একটি স্পষ্ট বার্তা। যেটা বুঝিয়ে দিচ্ছে কলকাতা দ্রুত বদলে যাচ্ছে– ‘ধ্বংস বেশি দূরে নেই।’

বাবরি মসজিদ। ১৯৯২

নিজ জীবনে জাভেদ আখতার নাস্তিকতার চর্চা করেন। সরাসরি মৌলবাদের বিরোধিতা করে মানবিকতার কথা বলেন, শুধু সেজন্যই একজন কবি এবং গীতিকারকে বয়কট করার ঘটছে খাস কলকাতায়। যে কলকাতার ভিন্নমতকে গুরুত্ব দেওয়ার ব্যাপারে প্রসিদ্ধ ছিল। নাস্তিকতাকে একঘরে করার পরিবর্তে সম্মান দেওয়া রপ্ত করেছিল সমাজ। বাঙালি এখন স্বজাতিকে ‘অ্যান্টিন্যাশনাল’, ‘ধর্মবিরোধী’ ইত্যাদি খেতাবে শুধুই ভূষিত করে না, বরং নিম্নস্তরের ব্যক্তি আক্রমণ উপহার দেয়। ভিনরাজ্যে বাঙালি আক্রান্ত হলে শাক দিয়ে মাছ ঢাকে। খুশি হয়।

কখনও কলকাতা শহর বৃদ্ধের মতো। জরাজীর্ণতায় আক্রান্ত হলেও অভিজ্ঞতা তাকে পুষ্ট করে। কত গল্প রাখা আছে তার সময়ের ঝাঁপিতে। যত্নে আগলে রাখা পুঁথির মতো সঞ্চয় করা শহরের ইতিকথা। আবার মনে হবে সব প্রাণহীন, অঞ্জনের গানে সে মিথ্যে কথার শহর। সেই হতাশাকে দূরে সরিয়ে প্রাণোচ্ছ্বল রঙে ময়দানে প্রেম করছে করছে কোনও যুগল। বিকেলের পড়ন্ত রোদ তাদের দিকে লাঠিসোঁটা নিয়ে তেড়ে যাচ্ছে না। জাতপাত মিলিয়ে দেখছে না। কঠোর কংক্রিটের মাঝে জেগে আছে কোনও গাছ। সবুজের উত্তরাধিকার নিয়ে। এই শহরের অলিগলি হেঁটে যেন নিয়ত ভবঘুরের বেশে এখনও সুচেতনা চিন্তা হাঁটে। নাম-পরিচয়-ধর্ম– সব কিছুর স্টিকার উপড়ে ফেলেছে শরীর থেকে। সে জানে মানুষ পরিচয়টাই পর্যাপ্ত। সেজন্য মুক্তভাবে ভাবতে পারে। তলিয়ে ভাবে– কী ঘটছে, কেন ঘটছে, নেপথ্যে কে! কিন্তু তার স্বরও কেমন মিলিয়ে যাচ্ছে কোলাহলে।

ইদানীং সুচেতনা অফিসফেরত থমকে দাঁড়ায়, দম নিতে চেষ্টা করে প্রাণভরে। হোয়াটসঅ্যাপ ফরোয়ার্ড দেখে বোকার মতো হাসে। যুক্তি-তর্ক দিয়ে কীসব মেলায়! তারপর ভাবে এভাবে আর কতদিন? যে কালো ছায়া ঘিরে ধরছে চারপাশ থেকে সেখানে কি সুস্থভাবে বাঁচা যাবে?

এই কলকাতাই তো শিখিয়েছিল মিলেমিশে থাকা। দেশভাগ, দাঙ্গার আগুন। শয়ে শয়ে লাশ। পোড়া দেহ। অনেক ক্ষত। সাদা ঘোড়া গল্পের সেই সাদা ঘোড়াটি মরেছিল এখানেই। সেই আক্ষেপ আর লজ্জা বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মুসলিমের ঝুপড়ির পাশে কোনও হিন্দুর ছোট এককামরা। তারা একে অন্যকে বুকে আঁকড়ে রাখতে চায়। সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়। সেই যে জ্বলেছিল, আবার কে জ্বলতে চায়। তবু ঘরবাড়ি যা বোঝে, ইতিহাস থেকে শেখে, মানুষ বোঝে না। শিক্ষা নেয় না। অনেক প্ররোচনা, ঘৃণার আগুনকে উসকে দেওয়া তবু এ শহর নব্বইয়ে বাবরির উত্তেজনায় পাহারা দিয়েছে পড়শির বাড়িঘর। মেটিয়াবুরুজ-গার্ডেনরিচ-বড়বাজার হোক বা বালিগঞ্জের কোনও বস্তি। বুক পেতে দিয়েছে শুধু একটি প্রাণ বাঁচাবে বলে। তারা ইতিহাসের কোনও মুখ্য চরিত্রে হয়ে ওঠেনি, কিন্তু তারাই যুগ যুগ ধরে আমাদের সহাবস্থানের ইতিহাস লিখেছে। সব কিছু তো হিংসার ছিল না, হানাহানির ছিল না। ছিল প্রাণ দিয়ে আগলে রাখাও। বাঙালির মননে ছিল ‘আদাব’ গল্পের বোধ। যেখানে মাঝির প্রস্থানে সুতাকলের মজুর তার সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করে, মাঝি যেন এই দাঙ্গার পরিস্থিতিতে নির্বিঘ্নে বাড়ি যেতে পারে। ঈদের পরব একসঙ্গে কাটাতে পারে পরিবারের সঙ্গে। এই মঙ্গলকামনার বুনিয়াদি ভাবনায় নৈরাজ্য। তবে যতই দুই ভিন্ন মেরুতে অবস্থান করুক মৌলবাদ গলাগলি কোলাকুলি করে বিপন্ন করছে সুস্থ নাগরিক জীবন।

কলকাতার আত্মায় ছিল কসমোপলিটান সংস্কৃতি। নানা রাজ্যের মানুষের বাস এক কলোনিতে। নানা ধর্মের। বৌদ্ধ-শিখ-পারসি-জৈনরাদের সঙ্গে বাস করতেন নেপালি-গোর্খারা। অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের উপস্থিতিও ছিল চোখে পড়ার মতো। চিনেপাড়ার খাবার বাঙালির প্রিয় হয়ে উঠেছে। গেরুয়া আর সবুজ পতাকা বুঝিয়ে দেয় বিচ্ছিন্নতার উপস্থিতি। গত কয়েক বছরে পাড়াভিত্তিক উৎসব, মিছিল বা জমায়েতে ধর্মীয় রং আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। হিন্দু-মুসলিম মিলিতভাবে যেসব পাড়া সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল সেখানে গলি ক্রিকেট, রেডিও-তে বাংলায় ধারাববরণী, প্রিয় ফুটবল দলের পতাকায় সজ্জিত মহল্লা। অহেতুক সন্দেহ, ভেদাভেদ, ‘আমার ধর্মই সেরা’ বলার অন্ধ আস্ফালন বাসা বেঁধেছে। এখন নিরামিষ কলোনি, অমুক কারণে আমিষ বারণ, তমুক ধর্মের মানুষের থাকা নিষেধ। সরাসরি না হলেও অলিখিতভাবে। গোলবাড়ির কষা মাংস, নিজামের ভরপেট কাবাব। শহরের নানা প্রান্তে ভোজনরসিকদের প্রিয় ঠেক। কে কোথায় খাবে, তা নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা ছিল না কারও। বর্তমান সময়ে কোনও বিশেষ রেস্তরাঁর বিরিয়ানিতেও সাম্প্রদায়িকতা লেপে দেওয়া হয়! অথচ সলিল চৌধুরীর গানে বাঙালি বিশ্বমানব হয়ে উঠতে চাইত।

‘আর নয় নিষ্ফল ক্রন্দন
শুধু নিজের স্বার্থের বন্ধন
খুলে দাও জানালা আসুক
সারা বিশ্বের বেদনার স্পন্দন…’

কলকাতা শহর সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নিত, পৃথিবীর কোথাও নিরীহ মানুষের ওপর অত্যাচার হলেই পথে নামত। আজ সে ধর্ম দেখে সিদ্ধান্ত নেয় জাগবে কি না! কলকাতার মানুষ ইদানীং একটি সাম্রাজ্যবাদী দেশের অন্য দেশ আক্রমণের খবরে উল্লাস করে। কারণ একটি বিশেষ ধর্মের মানুষ বিপন্ন হচ্ছে। এ শহর তখন অচেনা লাগে।

এ শহর আর মেহনতি মানুষের দাবিতে রেগে ওঠে না। মুখে ভাত তুলে দেওয়া, আর হাতে কাজের স্লোগানগুলির জায়গা নিয়েছে ধর্মীয় স্লোগান। হঠাৎ করেই সবাই ধর্ম বাঁচাতে তৎপর। হিন্দি বলয়ের চেনা এই ছবি কলকাতার অন্য মুখ হয়ে উঠছে। এককাল বাঙালির ঠাকুরদেবতারা নিজ নিজ জায়গায় সসম্মানে ছিলেন। বাঙালি কর্মকেই ধর্ম করেছিল। এখন ধর্মকে কর্ম বানানোর এই উদ্যোগ চালু হয়েছে। সেটা সোশ্যাল মিডিয়ার রিল হোক বা রাজনীতির মঞ্চ।

যে ছেলেটি ছোট্ট গলিতে ইট দিয়ে উইকেট করে ক্রিকেট খেলত পাড়ার সবার সঙ্গে, সে কোনও দিন ভেবে দেখেনি, ওপেনিং করতে যাওয়া ছেলেটির ধর্ম কী! এখন ক্লাসে মুঘলযুগ পড়ানো হলে ভিন্নধর্মীকে খোঁচা দিয়ে বলে, ‘তোদের জাতভাই…’। তাকে ভাবানো হচ্ছে, ধর্মপরিচয়টাই সব। ওটার ওপর ভিত্তি করেই সব হবে। ঠিক হবে কে ঘরভাড়া পাবে কি না, মেসে জায়গা হবে কি না!

এছাড়া ‘ওদের দোকানে কেনা যাবে না’, ‘ওদের সঙ্গে মেশা যাবে না’, ‘ওদের উৎসবে শামিল হবে না’– এই কথাগুলো এখন কলকাতা শহরে প্রকাশ্যে দাঁড়িয়ে বলা যায়। তাতে বড় অংশের মানুষ আপত্তির কারণ খুঁজে পায় না। এই মানসিকতার ব্যাপক সংক্রমণই একটা একটা করে জোম্বির জন্ম দিচ্ছে। আর এই জোম্বি হতে পারা নিয়ে গর্বের শেষ নেই। অথচ বাঙালির ঘরে ঘরে ‘মানুষ হইতে হবে’ এই পণ নিয়েই সন্তান বড় হত। আজ সন্তান মৌলবাদের হাত শক্ত করলে অভিভাবকরা ভাবেন, ‘এই তো বেশ ধর্মপালন শিখেছে।’ কলকাতার রাজপথে অস্ত্র নিয়ে মিছিল হলে মানুষ ধর্মের জয় দেখতে পায়।

ধর্ম আর ধর্মীয় মৌলবাদ গুলিয়ে দেওয়ার খেলাটাও উচ্চশিক্ষিতরা বুঝতে পারছেন না। একদিকে ‘জয় শ্রীরাম’, অন্যদিকে ‘নারায়ে তকবির’। হিন্দুরাষ্ট্রের জিগির আর অন্যদিকে মুসলমানিত্বের আস্ফালন। এতকাল বাঙালির এসবের প্রয়োজন পড়েনি। তার ভিত রবীন্দ্রনাথ-লালন-নজরুল দিয়ে গড়া ছিল। তবে আজ হঠাৎ দরকার পড়ল কেন? কেন তার খাঁটি হিন্দু বা মুসলমান প্রমাণের দরকার পড়ল? ‘ভাবো, ভাবা প্র‍্যাকটিস করো’ যাদের সাংস্কৃতিক মূলমন্ত্র। এই প্রশ্ন কি ভাবায়?

আগে রসিকতা ছিল। শিবরাম, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়রা ঠাকুরদেবতা নিয়ে রসিকতা করে গিয়েছেন। আলী সাহেবের লেখায় নানা রসিকতা ধরা পড়ে। ‘গণেশ দাদা পেটটি নাদা, সন্দেশ খায় গাদাগাদা’– এভাবেই বাঙালির দেবদেবী তাঁর নিজের বাড়ির সন্তান হয়ে উঠেছেন। তাঁদের নিয়ে রসিকতার নিদর্শনও বিস্তর। আগে কলকাতার সাহিত্য বা নাটকে ধর্ম নিয়ে খোলাখুলি ব্যঙ্গ বা সমালোচনা করা হত। বাঙালির এখন ভীষণ সিরিয়াস হয়ে গিয়েছে, ভাবাবেগের গুঁতোয় রসবোধ মৃতপ্রায়। এই বুঝি মামলা হল, এই বুঝি কেউ চড়াও হল! আর নইলে সেই ক্লিশে হয়ে যাওয়া খোঁচা, ‘ওদের ধর্ম নিয়ে কিছু বলতে পারবেন?’ তথাকথিত শিক্ষিত অংশের এত ঠুনকো ভাবাবেগ কলকাতা আগে দেখেনি।

ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের চিরাচরিত রেষারেষিতে এসেছে সাম্প্রদায়িক মনোভাব। রহিম নবি, মেহতাব হুসেন, লালকমল ভৌমিকদের ধর্ম দেখেনি বাঙালি। এখন সরাসরি ধেয়ে আসে ‘উদ্বাস্তু খোঁচা’। পোশাক উল্লেখ করে নোংরা আক্রমণ। পড়শিকে খুব সহজেই ‘পাকিস্তানি’ কিংবা ‘বাংলাদেশি’ দাগিয়ে দিতে শিখে গিয়েছে বাঙালি। গোবলয়ের আমিষ-নিরামিষ, ছোঁয়াছুঁয়ি এখন বাঙালি অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে তৎপর। কে কী খাবে-পরবে, তাতেও চৌকিদারি। সব মিলিয়ে কে কত পিছিয়ে যেতে পারে তারই প্রতিযোগিতা। রামমোহন-বিদ্যাসাগর-রোকেয়ার বাংলায় মহিলাদের হিজাব-সিঁদুরের রিগ্রেসিভ চিন্তাভাবনা বহু গুণে বেড়েছে। আশ্চর্যজনকভাবে ‘নারী আমাদের সম্পদ– ওরা দখল করছে’– এই ভাবনাও বাঙালির অন্তরে গেঁথে দেওয়া গিয়েছে।

আগে বাঙালি কবিতা লিখত, সাংস্কৃতিক চর্চা করত। লিটিল ম্যাগাজিন ছাপাত। চায়ের দোকানে তর্ক হত রোনাল্ডো-মেসি নিয়ে, শাহরুখ-আমির নিয়ে। এখন তার আলোচনা বিষয় ধর্ম এবং ঘৃণার রাজনীতি। ফলে ফাঁকা মাঠ পেয়ে ক্রমশ ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি ধর্মভিত্তিকভাবে আরও তীব্র হয়েছে। হ্যাঁ, এর মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক মদত। দুই ধর্মের ধর্মান্ধ শ্রেণিকে উসকে দেওয়ার কৌশল। অহেতুক হিন্দু-মুসলমান বাইনারি তৈরি করে নেতা কিংবা দলের ফায়দা তোলার অভিপ্রায় এখন দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। কিন্তু বাঙালি ক্রমশ নির্বোধ হয়ে পড়েছে বলেই বারবার এই ফাঁদে পা দিচ্ছে। ধর্মাচরণকে ব্যক্তিগত পরিসরে না রেখে ধর্মীয় গুন্ডামির মাধ্যমে তার ‘ধর্মের ষাঁড়’ হয়ে ওঠার তাগিদই তাকে রসাতলে নিয়ে যাচ্ছে৷

এক সময় পাড়ায় পাড়ায় বসে আঁকো প্রতিযোগিতা, আলোচনাসভার আয়োজন হত। এই সকল অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সুস্থচিন্তা এবং বিজ্ঞানমনস্ক বোধ গড়ে উঠত। সহযোগিতা, সহমর্মিতা এবং এক জাতি হিসাবে এগিয়ে যাওয়ার চেতনা বাঙালির জীবনের সঙ্গে জুড়ে থাকত। এখন সেই সুস্থ সংস্কৃতির ধারা স্তব্ধ হয়ে ভোজপুরি গানে নাচাটাই যেন প্রধান হয়ে উঠছে। ফলে সাংস্কৃতিক দৈন্য গ্রাস করছে। ঋত্বিক ঘটক, সত্যজিৎ রায়ের পরবর্তী প্রজন্মের মেধার বহিঃপ্রকাশ এখন হিন্দি গানে ঠাসা বাংলা সিরিয়াল৷ সৎ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও অপ্রাসঙ্গিক খবর আর ক্লিকবেইট ভরসা। সব মিলিয়ে নিজস্বতা হারাচ্ছে। ভিনরাজ্যে বসেও বইপড়া, গানবাজনা, তুখড় রাজনৈতিক বোধ, স্পষ্টবাদিতা দিয়ে পৃথক করা যেত বাঙালিকে। সেই জাতি এখন যেন গোবলয়ের অন্ধ অনুকরণকেই ‘জাতে ওঠা’ বলে ধরে নিচ্ছে। নিম্নরুচির ফুড ভ্লগিং, নিম্নমেধার জয়জয়কারে বাঙালি যেন নিজের লাশ নিজেই বয়ে বেড়াচ্ছে। নানা বুজরুকি, আর ফেসবুকে বোকা বোকা ধার্মিক পোস্ট শেয়ার করে ভাগ্য বদলে মেতে থাকে মানুষ। ফেক ছবি বা ধর্মীয় সুড়সুড়ির পোস্টে ঠাকুরের নাম কিংবা ‘আমিন’ লিখে নিজেকে ধার্মিক প্রমাণ করতেই হবে…।

এখন সুস্থতা কিংবা ভাইচারার কথা বললে ক্রুদ্ধ হয় মানুষ। সততা আঁকড়ে বাঁচলে বিপাকে পড়তে হয়। মুক্তচিন্তা আক্রান্ত হয় দিনে-দুপুরে। শিল্প-সংস্কৃতি-ভালোবাসার শহর ধর্মান্ধদের শহর হয়ে উঠতে চাইছে। জোম্বিরা এই শহরের দখল নিয়েছে৷ বাঙালির এতকালে অর্জন, সহিষ্ণুতার অনুশীলন, আত্মার পরিচয় সব ধ্বংস করে দিচ্ছে। তা সম্পন্ন হচ্ছে একশ্রেণির বাঙালির মদতে। এ এক দুঃস্বপ্নের মতো, কখনও যেন সত্যি না হয়!

………………………….

রোববার.ইন-এ পড়ুন সেখ সাহেবুল হক-এর অন্যান্য লেখা

………………………….