শুধুই কি প্রতিবেশী রাজ্য, দিল্লি ও কেন্দ্রের সরকারকে গালমন্দ করলে হবে? দিল্লিবাসী নিজেদের মধ্যে সচেতনতা আনবেন কবে? আরে মশাই দাঁড়ান। দেড় হাজার কিলোমিটার দূরের দিল্লির ভয়াবহতা দেখে তাঁদের গালমন্দ আর নিজেদের স্বস্তি পাওয়ার কোনও অবকাশ নেই। একটু গুগলকাকুর কাছে যান। দেখবেন, আনন্দের আতিশয্যে আমার-আপনার তিলোত্তমাও নিজেদের পায়ে কম কুড়ুল মারেনি।
দিল্লি: দিলওয়ালো কা শহর।
দিল্লি: দেশের রাজধানী।
দিল্লি: বিশ্বের দূষণ রাজধানী।
বছর চারেক আগের কথা। ওয়েনাড়ে নিজের লোকসভা কেন্দ্রে দিল্লিকে বিশ্বের ‘ধর্ষণ রাজধানী’ বলে কেন্দ্রীয় সরকারকে কটাক্ষ করেছিলেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী। যা নিয়ে কম বিতর্ক হয়নি। সোনিয়া পুত্রের দিকে রে-রে করে তেড়ে এসেছিল শাসকদল। বিশ্ব দরবারে দেশকে কলুষিত করার অপরাধে তাঁর দিকে ধেয়ে এসেছিল তোপ। বক্তব্য, কং জমানাতেই তো দিল্লিতে হয়েছিল নির্ভয়া কাণ্ড! তিনি ভুল বলেছিলেন, না ঠিক? দেশের রাজধানীতে কতটা নিরাপদ দেশের মা-বোনেরা? তাই নিয়ে সেই সময় হয়েছে প্রচুর চায়ে-পে-চর্চা। তবে আশা করা যায়, এই লেখা পড়ার পর বিতর্কের অতখানি সুনামি উঠবে না। আমার-আপনার সাধের রাজধানীকে এই (অ)সম্মানই দিয়েছে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকা। তাদের সমীক্ষায় উঠে এসেছে আলোর উৎসব, দীপাবলির পর দিল্লির দূষণ এখন তালগাছের মতো সবাইকে পিছনে ফেলে দিয়েছে।
আরও পড়ুন: শুধু বলিউড না, টলিউডও ডিপফেকের টার্গেট হতে পারে
গত রবিবারের কথা। পূর্ব-দিল্লির একেবারে শেষ প্রান্তের আবাসনের ছাদে উঠে মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে গিয়েছিল! তার আগের ক’দিন কাছেরই এক পার্কে উড়তে থাকা ইয়াব্বড় তেরঙ্গা স্পষ্টভাবে দেখতে পাইনি। যার দূরত্ব মেরেকেটে ৫০০ মিটার। বা তারও কম। ধোঁয়াশাসুরের গ্রাসে ঢাকা পড়েছিল দৃশ্যমানতা। অথচ শনি রাতে লাগাতার বৃষ্টির পর সকালে ছাদে গিয়ে সেই জাতীয় পতাকার দর্শন করেই দিল খুশ হয়ে গিয়েছিল। শুধু কি ওই পতাকা? অনেক দূরের অচেনা অনেক বিল্ডিংয়ের সঙ্গে এক্কেবারে পরিষ্কার দেখেছিলাম সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরে নয়ডা সেক্টর ১৮-তে গিন্নির অফিসের ঠিক গা ঘেঁষে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা বহুতল। কিন্তু তার ঠিক একদিন পর?
শনি সকালে অস্পষ্ট হলেও চোখ ছোট করে বাড়ির কাছের তেরঙ্গাটাকে দেখতে পাচ্ছিলাম। সোম সকালে শুধু মনে হল, কোনও একটা পোস্টে কিছু একটা উড়ছে। অনভ্যস্ত চোখ তাও বুঝত কি না সন্দেহ!
আরও পড়ুন: শীতের মধ্যে আরেকরকম শীত, যে অপেক্ষার কথা বলে
এই যে এতখানি লিখলাম, এর নির্যাস হল, দিল্লিবাসীর দিল নিশ্চয়ই বড়। কিন্তু তাঁদের মস্তিস্ক? সরি, শূন্যর বেশি নম্বর দিতে পারলাম না। কড়া পরীক্ষকের মতো কেন এত বাজে নম্বর দিলাম?
কলকাতাকে আড়াল করতে চাওয়া প্রাদেশিক? চোখে ঠুলি লাগানো সেকুলার? নিজেদের মতো করে নিন্দুকরা যা খুশি তকমা সেঁটে দিতেই পারেন। সেদিন কাগজের জন্য নিজের প্রতিবেদনে লিখেছিলাম, পাগলেও নিজের ভাল বোঝে। দিল্লিবাসী বুঝলেন না। আজ আবার সেই কথাই লিখছি। কারণ এটাই যে সত্যি।
সুগারের রোগীর চিনি খেলে যা হয়। হাই ব্লাড প্রেশারের রোগীর কাঁচা নুন বা রেওয়াজি খাসির মাংস খেলে যা হয়– দিল্লিবাসীরও তো বাজি ফাটালে তাই হয়! সুগারের রোগী মিষ্টি খাওয়ার দুর্দমনীয় ইচ্ছাকেও কিন্তু অনেক কষ্টে চেপে যান। গত সাত বছর ধরে প্রিয়তমা খাসির থকথকে সাদা চর্বিকে মুখে পাচার করার আগে একটু চুমু দেওয়া এই অধম যেভাবে চেপে গিয়েছে, দিলওয়ালে কা নগরী তা পারল কই?
আরও পড়ুন: নীতীশকে বুঝতে হবে, যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলে যৌনশিক্ষা দেওয়া যায় না
মাত্র কয়েকঘণ্টা আগে চাদরের নীচ থেকে বেরিয়ে দিল্লিবাসী যে ঝকঝকে আকাশ দেখেছিল, নিজেরাই তো সেই আকাশে সিঁদুরে মেঘ লেপ দিতে কোনও কসুর রাখলেন না। বসতি থেকে বহুতল। দিনমজুর থেকে শিল্পপতি। প্রত্যেকে নিজেদের মতো করে দেদার বাজি ফাটালেন। ভুলে গেলেন, দীপাবলি আসলে আলোর উৎসব। শব্দ বা ধোঁয়ার নয়। কেউ কেউ তো আবার রেস লাগালেন। সোশাল মিডিয়ায় জাহির করে বললেন, এটা হিন্দুস্থান। সকলের শব্দদূষণে যদি কোনও সমস্যা না হয়, তবে বায়ুদূষণেও কুছ পরোয়া নেহি।
আরে মশাই, আপনি কি জানেন বোকা বোকা এই ধর্মের লড়াইয়ে, নিজেকে জাহিরের লড়াইয়ে নিজের, নিজের পরবর্তী প্রজন্মের কী ক্ষতি করছেন? হয় জানেন না, অথবা জেনেও ধৃতরাষ্ট্র হয়ে আছেন। জানেন না, এটা হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। আর জেনেও ধৃতরাষ্ট্র হয়ে থাকলে…?
চলতি মাসের শুরুতে এক বহুল প্রচারিত ইংরেজি দৈনিকের একটা প্রতিবেদন পড়ছিলাম। সেই সময় দিল্লির বাতাসের দূষণ সূচক ছিল ৪০০-র ওপর। গুরুগ্রামের এক বিখ্যাত বেসরকারি হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বলেছিলেন, ওই আবহে ফুসফুসের যা ক্ষতি হচ্ছে, তা যারা দিনে ২৫ থেকে ৩০টি সিগারেট পান করেন, তার সমান। তবেই বুঝুন! সব জেনে-বুঝেও দিল্লিবাসী নিজের পরিজনদের দীপাবলিতে কী ‘উপহার’ দিলেন?
এই তো সেদিন। সুপ্রিম কোর্টে বেজায় ধমক খেল দিল্লি ও কেন্দ্র– দুই সরকার। তারপর কিছুটা নড়ে ছিল তারা। দিল্লি পুরসভা দেদার ফাইন করেছে দূষণ নিয়ম লঙ্ঘনকারীদের। কিন্তু সব দায় কি আর প্রশাসনের ওপর ছেড়ে দেওয়া যায়? কেন্দ্র যতই স্বচ্ছ ভারত অভিযান করুক, বঙ্গ সরকার যতই বাংলাকে নির্মল করতে চাক, মানুষ যদি জাগ্রত না হয়, কিছুই কি সম্ভব? দিল্লিবাসী কি জাগতে পারল? শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রের অধীনে থাকা ‘সেন্ট্রাল পলিউশন কন্ট্রোল বোর্ড’ও কড়া বকুনি খেল ‘দ্য ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনাল’-এর কাছে। এনজিটি জানতে চাইল দূষণ রোধে সিপিসিবি আদৌ কি কিছু করছে? নাকি শুধুই দর্শকের ভূমিকায়?
গত কয়েকবছরে দূষণ নিয়ন্ত্রণে অবশ্য অনেক চেষ্টাই করেছে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের সরকার। শীলা দীক্ষিত যে কাজ শুরু করেছিলেন, তা আরও এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন দিল্লির বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী। ডিজেল গাড়ি, নির্মাণ কার্যে লাগাম টেনে দূষণের পরিমাণ কমাতে চেয়েছে কেজরিওয়াল সরকার। এবার তো দূষণে নিয়ন্ত্রণ পেতে প্রযুক্তিকে অন্যভাবে ব্যবহার করতে চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিল দিল্লি সরকার। আবেদন করেছিল কৃত্রিম বৃষ্টির। কিন্তু প্রকৃতি নিজেই যেন টের পেয়েছিল তাঁর সন্তান-সন্ততিদের কষ্ট। তাই তো ঝমঝমিয়ে অমৃতধারা বর্ষণ করেছিল দিল্লির আকাশ। কিন্তু দিল্লিবাসী যদি নিজেরাই পায়ে কুড়ুল মারে, তবে আর প্রকৃতি কী করতে পারে? বিশেষজ্ঞদের মতে, দূষিত বাতাসের ধূলিকণায় ব্যাপক হারে থাকে নাইট্রেট, কার্বনের মতো নানা বিষ। যা নাকের মাধ্যমে রক্ত হয়ে ধমনিতে প্রবেশ করে রক্ত সরবরাহে ব্যারিকেড তৈরি করে। যার জেরে বাড়ে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম, হাইপোথাইরয়েডের মতো রোগের আশঙ্কা। তবে দূষণের রক্তচক্ষুর ভয়াবহতা বুঝতে এত চিকিৎসাবিদ্যার কচকচানির প্রয়োজন নেই। এর জন্য সাধারণ জ্ঞানই যথেষ্ট। কিন্তু সেই জ্ঞান কোথায় হারাল দিল্লি?
দিল্লির দূষণের মস্ত বড় কারণ হল দিল্লি ও প্রতিবেশী রাজ্যগুলির চাষিদের ফসল তুলে নেওয়ার পরে বিচালিতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া। কিন্তু চাষিদের চটাবে কে? তাঁদের কাছে হাত জোড় করে আবেদন করা ছাড়া অন্য উপায় যে নেই। তাদের ভোটব্যাঙ্ক একটা বিশাল ব্যাপার। যেভাবে লাগাতার আন্দোলন করে নরেন্দ্র মোদিকে ঢোক গিলতে বাধ্য করেছিলেন কৃষকরা, তারপর তো দুঃস্বপ্নেও কৃষকদের চটানোর কথা ভাবে না কোনও রাজনৈতিক দল। তবু চেষ্টা করেছে কেজরি সরকার। খড়গপুর আইআইটি-র প্রাক্তনী বুঝেছিলেন শুধুমাত্র প্রশাসনিক কড়াকড়িতে এই সমস্যার সমাধান হবে না। তাই ‘ইন্ডিয়ান এগ্রিকালচারাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ (এআইআরআই)-এর সাহায্যে ২০২০ সালে এক নতুন প্রযুক্তি নিয়ে আসে দিল্লি সরকার। বিচালি না পুড়িয়ে তার গোড়া নরম করে মাটিতে মিশিয়ে দিতে এক ডিকম্পোজার মেশিনের ব্যবহার চালু করা হয়। এই প্রযুক্তিতে এক বিশেষ ক্যাপসুল জলে মিশিয়ে স্প্রে করলে কয়েক দিনের মধ্যেই মাটিতে মিশে যায় বিচালি। যার ফলে যেমন কমে দূষণ, তেমনই সারের জন্য কৃষকদের খরচও কমে। কেজরি সরকারের এই উদ্যোগকে সেই সময় সাধুবাদ জানিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় পরিবেশমন্ত্রকের তৎকালীন রাষ্ট্রমন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়ও। কিন্তু শুধু দিল্লির কৃষকদের এই প্রযুক্তি দিয়ে তো লাভ নেই। পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যগুলিকে কে বোঝাবে? ২০২২-এর আগে পর্যন্ত দূষণের সময় এই রাজ্যগুলির ওপর দায় চাপিয়ে ঝামেলা মেটাত কেজরি অ্যান্ড কোং। গত বছর পাঞ্জাবের মসনদে বসেছে আম আদমি পার্টি। ফলে অতটা খুল্লামখুল্লা অন্যের কোর্টে বল ঠেলতে পারছে না দিল্লির আপ সরকার। যদিও এবার পাঞ্জাব থেকে আগুন লাগার খবর অনেক কমই এসেছে। সেখানেও প্রযুক্তি ব্যবহার শুরু করেছে ভগবন্ত মান সরকার।
তবু দিল্লি স্বস্তি পেল কোথায়? কথায় বলে, চ্যারিটি বিগিনস অ্যাট হোম। শুধুই কি প্রতিবেশী রাজ্য, দিল্লি ও কেন্দ্রের সরকারকে গালমন্দ করলে হবে? দিল্লিবাসী নিজেদের মধ্যে সচেতনতা আনবেন কবে?
আরে মশাই দাঁড়ান। দেড় হাজার কিলোমিটার দূরের দিল্লির ভয়াবহতা দেখে তাঁদের গালমন্দ আর নিজেদের স্বস্তি পাওয়ার কোনও অবকাশ নেই। একটু গুগলকাকুর কাছে যান। দেখবেন, আনন্দের আতিশয্যে আমার-আপনার তিলোত্তমাও নিজেদের পায়ে কম কুড়ুল মারেনি। দূষণের নিরিখে দেশে দিল্লির ঠিক পরেই কলকাতা।
কিছু কি বুঝলেন? এখনও সময় আছে বুঝুন। ভাবুন। ভাবা প্র্যাকটিস করুন।