‘এটা বাংলাদেশ নয়, ভারত। বাংলায় নয়, হিন্দিতে কথা বলুন।’ কোথায় ঘটছে এ ঘটনা? খাস কলকাতায়। যে কলকাতা বঙ্গসংস্কৃতির পীঠস্থান। যে কলকাতায় ছড়িয়ে আছে বাঙালির ঘাম-রক্ত, আশা ও আন্দোলন। যে কলকাতার গায়ে, দেওয়ালে দেওয়ালে এখনও ছেয়ে আছে বাংলা পোস্টার। ধর্মঘট, রাজনীতির পাশাপাশি সিনেমার পোস্টার, হাজারো বিজ্ঞাপন– খাস বাংলায়। যে কলকাতা বিপ্লবে বাংলায় দিব্যি স্লোগান তোলে। রাস্তায় বসে, বাংলায় চিৎকার করে। ‘অনশন মঞ্চ’ বড় বড় করে বাংলায় লেখা থাকে, ধর্মতলা পেরনো যুবক সেই ভাষার হরফের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে, ভালোবাসায়।
গ্রাফিক্স: দীপঙ্কর ভৌমিক
‘এটা বাংলাদেশ নয়, ভারত। বাংলায় নয়, হিন্দিতে কথা বলুন।’
কোথায় ঘটছে এ ঘটনা? খাস কলকাতায়। যে কলকাতা বঙ্গসংস্কৃতির পীঠস্থান। যে কলকাতায় ছড়িয়ে আছে বাঙালির ঘাম-রক্ত, আশা ও আন্দোলন। যে কলকাতার গায়ে, দেওয়ালে দেওয়ালে এখনও ছেয়ে আছে বাংলা পোস্টার। ধর্মঘট, রাজনীতির পাশাপাশি সিনেমার পোস্টার, হাজারো বিজ্ঞাপন– খাস বাংলায়। যে কলকাতা বিপ্লবে বাংলায় দিব্যি স্লোগান তোলে। রাস্তায় বসে, বাংলায় চিৎকার করে। ‘অনশন মঞ্চ’ বড় বড় করে বাংলায় লেখা থাকে, ধর্মতলা পেরনো যুবক সেই ভাষার হরফের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে, ভালোবাসায়। অনাদরে বড় হতে হতে একটা ভাষা যখন যুক্ত হয়ে যায় বিপ্লবের সঙ্গে, তার কি আয়ু বেড়ে যায়? এখনও উত্তর কলকাতা বা দক্ষিণ কলকাতার বাজারে গেলে, মাছের দিকে হাঁ করে যাঁরা তাকিয়ে থাকেন, তাঁরা, অধিকাংশই বাঙালি। অথচ এই কলকাতায়, যে কলকাতা সংস্কৃতিবান বাঙালির কলকাতা, যে কলকাতা গরিব ক্লান্ত বাঙালির কলকাতা, যে কলকাতা মুখভালো-মুখখারাপের বাংলার কলকাতা, আন্দোলন-বিপ্লবের কলকাতা– সেই আশ্চর্য নড়িতে নড়িতে চলা কলকাতায়, মেট্রোরেলে এক সহযাত্রীকে ওই কথা বললেন এক তরুণী। বাংলাদেশ নয়, তাই বাংলায় কথা বলা বারণ?
বাংলা ভাষার ‘ধ্রুপদী’ মর্যাদা প্রাপ্ত হয়ে মাত্র কিছু দিন হল। বাঙালিদের কাছে এ আনন্দের বিষয়ই বটে, যদিও ‘ধ্রুপদী’ কী ও কেন, সে পদক প্রাপ্তির পরে ভাষার গায়ে কতটা আশার হাওয়া লাগে, তা পরীক্ষিত সত্য নয়। বাঙালি সে নিয়ে তদ্বির করে দেখেছে বলেও মনে হয় না। এ-ও এক ধরনের উৎসব। বাংলা ভাষায় হাড়-কঙ্কাল যখন বেরিয়ে পড়েছে, বাংলা জানা, বাংলায় লেখালিখি করা যখন সম্মানের না, এমনকী, জীবনযাপনের জন্যও যথেচ্ছ নয়, তখন এই উৎসবই তো কাম্য! তাই মেট্রোর ওই তরুণীকে হিন্দিতে বলতে শোনা যায়, যা বাংলা অনুবাদে দাঁড়ায় এইরকম, ‘আপনি বাংলাদেশে থাকেন না, আপনি ভারতে থাকেন । পশ্চিমবঙ্গ ভারতের একটি অংশ, তাই আপনাকে অবশ্যই হিন্দিতে কথা বলতে হবে। ভারতে থেকে আপনি বাংলায় কথা বলছেন! হিন্দি বলতে পারেন না?”
…………………………………………….
খোদ কলকাতায় বাঙালির প্রতি হিন্দিভাষী তরুণীর এই ব্যবহার নিয়ে যেমন শোরগোল পড়েছে, তেমনই, বাংলা বললে ‘বাংলাদেশী’ হিসেবে দেগে দেওয়াও কিন্তু বিস্ময়কর! হিন্দি ভাষার আগ্রাসন ও সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক আধিপত্যের বিষয়টি নিয়ে অ-হিন্দিভাষী রাজ্যগুলিতে দীর্ঘ সময়ের অসন্তোষ রয়েছে, বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতের প্রায় সবক’টি রাজ্যেই হিন্দির বিরুদ্ধে প্রবল জনমত রয়েছে। বেঙ্গালুরুর রাস্তায় অটোওয়ালাদের ‘নো হিন্দি’ পোস্টার হোক কিংবা কয়েক দিন আগে, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রণবীত সিং-এঁর হিন্দি মেইলের জবাব মলায়লম ভাষায় দিতে দেখা গিয়েছে সিপিআই (এম) সাংসদ জন ব্রিটাস-কে।
…………………………………………….
সহযাত্রী, বলা বাহুল্য বাংলাভাষী, অপমানিত বোধ করেন। বলেন, ‘আমি পশ্চিমবঙ্গে থাকি, নিজের মাটিতে থাকি, তোর মাটিতে থাকি না।’ তর্কের মধ্যে অন্যযাত্রীরা কথা বলতে এলে, ওই হিন্দিভাষী তরুণী বলেন, ‘মেট্রো আপনার নয়, পশ্চিমবঙ্গ আপনার নয়।’ চাপান-উতরে অন্যপক্ষকেও বলতে শোনা যায়, ‘পশ্চিমবঙ্গ একটি ভাষাভিত্তিক রাজ্য, আমি অন্য ভাষায় কথা বলতে বাধ্য নই। এই মেট্রো আমার, এই পশ্চিমবঙ্গও আমার। এই মেট্রো বাংলার ট্যাক্সের টাকা দিয়ে বানানো হয়েছে, আপনার রাজ্যের লোকজনের টাকায় বানানো হয়নি।’ এরপরও ওই তরুণীকে বারবার বলতে শোনা যায়, ‘ভারতের ভাষা হিন্দি। ভারতে থেকে আপনি বাংলায় কথা বলছেন! হিন্দি বলতে পারেন না? ভারতীয় হয়ে হিন্দি বলতে পারেন না?’ পুলিশ ডেকে এনে, বাঙালি সহযাত্রীর বিরুদ্ধে কেস করা ও জেল খাটানোর হুমকিও দিতে শোনা যায় ওই তরুণীর মুখ থেকে।
খোদ কলকাতায় বাঙালির প্রতি হিন্দিভাষী তরুণীর এই ব্যবহার নিয়ে যেমন শোরগোল পড়েছে, তেমনই, বাংলা বললে ‘বাংলাদেশী’ হিসেবে দেগে দেওয়াও কিন্তু বিস্ময়কর! হিন্দি ভাষার আগ্রাসন ও সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক আধিপত্যের বিষয়টি নিয়ে অ-হিন্দিভাষী রাজ্যগুলিতে দীর্ঘ সময়ের অসন্তোষ রয়েছে, বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতের প্রায় সবক’টি রাজ্যেই হিন্দির বিরুদ্ধে প্রবল জনমত রয়েছে। বেঙ্গালুরুর রাস্তায় অটোওয়ালাদের ‘নো হিন্দি’ পোস্টার হোক কিংবা কয়েক দিন আগে, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রণবীত সিং-এঁর হিন্দি মেইলের জবাব মলায়লম ভাষায় দিতে দেখা গিয়েছে সিপিআই (এম) সাংসদ জন ব্রিটাস-কে। তুলনায় বাঙালিদের মধ্যে হিন্দি আগ্রাসন নিয়ে তেমন সোচ্চার প্রতিবাদ খুব একটা দেখা যায়নি, বরং দুই বাঙালির মধ্যে হিন্দিতে কথাবার্তা চালাতেও দেখা যায়।
অথচ হিন্দি কোনওভাবেই রাষ্ট্র ভাষা নয়, উত্তর ও পশ্চিম ভারতে এই ভাষা ব্যবহার করা হয় মাত্র। ভারতীয় জনসংখ্যার মাত্র ৪০% শতাংশ মানুষ এই ভাষায় কথা বলেন। ভারতীয় সংবিধানের অষ্টম তফসিলে বেশ কিছু সরকারি ভাষার উল্লেখ রয়েছে। ভারতে ১০০টির বেশি কথিত ভাষা রয়েছে কিন্তু দেশের সংবিধান ২২টি ভাষাকে সরকারি ভাষার মর্যাদা দিয়েছে। সরকারি ভাষা আইন, ১৯৬৩-এর ধারা ৩-এর উপধারা (১) এর (ক) এবং (খ) অনুসারে, কেন্দ্রের সমস্ত দপ্তরিক কাজে এবং সংসদে আলোচনার জন্য ইংরেজিও ব্যবহার করতে হবে। এই আইনে আরও বলা হয়েছে, যেসব রাজ্য হিন্দিকে সরকারি ভাষা হিসেবে গ্রহণ করেনি, কেন্দ্রের সঙ্গে সঙ্গে সেইসব রাজ্যের যোগাযোগের মাধ্যম হবে ইংরেজি ভাষা।
………………………………………………..
আরও পড়ুন রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়-এর লেখা: ‘ধ্রুপদী’ নয়, বাংলা ভাষা সর্বার্থে আধুনিক হয়ে উঠুক
………………………………………………..
সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া, ওই ভিডিও দেখে, বাঙালি ও বাংলা ভাষার দুর্দশা নিয়ে হতাশার সুরও শোনা গিয়েছে। তাঁদের মতে, বাংলা ভাষা ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু বাংলা ভাষার অর্থকরী সাফল্য কতটুকু? কাজের ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহার বাড়াতে হলে শিল্পের বিকাশ ঘটাতে হবে। তার ওপর ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের বাড়বাড়ন্ত, সেখানে পাঠ্য দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে হিন্দিকে বেছে নেওয়ায় প্রবণতাও বাঙালির ভাষা ভিতকে নড়বড়ে করে দিচ্ছে। সেই সঙ্গে রয়েছে সরকারি স্কুলগুলির বেহাল দশা। ‘আনবক্সিং বিএলআর ফাউন্ডেশন’ প্রকাশিত একটি অতি সাম্প্রতিক সমীক্ষা তুলে ধরে গত দশ বছরে, দিল্লি, মুম্বাই, হায়দরাবাদ, পুণে ও চেন্নাইয়ের তুলনায় কলকাতায় সবচেয়ে কম সংখ্যায় নতুন ব্যবসা ও কোম্পানি স্থাপন হয়েছে। যেখানে হায়দরাবাদে ২৫২% বৃদ্ধি দেখা গিয়েছে, সেখানে কলকাতায়, আগের তুলনায়, -৭.৮% আরও হ্রাস হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের বঞ্চনা, কিংবা গুজরাত মুম্বাইতে বিভিন্ন লগ্নি রাজনৈতিকভাবে টেনে নিয়ে যাওয়ায় প্রসঙ্গও তুলেছেন কেউ কেউ।
যে-ভাষা ভাত জোগাতে পারবে না, সে-ভাষা ক্রমে মলিন হবেই। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত হয়ে ধুঁকবেই। ভাষার রাজনীতি সে-কথাই বলে। বাংলা ভাষা, কলকাতার রাস্তায়, রক্তমাংসে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাকে দু’বেলার অন্নসংস্থান দেবেন না ধ্রুপদী ভাষার মুকুট, আপনারা দেখুন।
……………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………..
পাশাপাশি এ-ও বলতে হবে, রবীন্দ্রনাথের আঁকা নারীমুখে যেমন অনেকে নতুন বউঠানের মিল খুঁজে পান, তেমনই কারও চোখে সেখানে উদ্ভাসিত ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর আদল। এই দ্বিতীয় মতে, চিত্রী রবি ঠাকুরের চোখে ওকাম্পোর ছায়া নিঃসন্দেহে আরও প্রবলতর, কারণ নতুন বউঠান সেখানে দূর গ্রহান্তরের বাসিন্দা।