গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের বিষ একজন নারীকেও শিখিয়ে দেয় অন্য গোষ্ঠীর নারীকে ধর্ষকাম পুরুষের হাতে তুলে দিতে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে র্যাগিং-এ মর্মান্তিক মৃত্যুকে কেন্দ্র করে আমাদের আলোচনাও ঘুরে গেল সেই গোষ্ঠী-দখলের লড়াইয়ে।
সূর্য ওঠে ডুবে যায়–
একটি সকালও সুস্থ নয়।
বাতাসে চিন্তার শুধু ছাইভস্ম,
কোথায় ফুলের রেণু, ফলের আঘ্রাণ?
কেবল শূন্যতা, ভয়, মানুষের অশ্রু ও বেদনা,
আকাশের মুখে আজ দূষিত কুয়াশা।
(শান্তিহীন দিন/ দেবারতি মিত্র)
নগর পুড়লে দেবালয় যে রক্ষা পাবে না, সে তো জানা কথাই। তবু দিনে দিনে হিংসার কাছে নিদারুণ ভাবে আমাদের ধরা পড়ে যেতে হল। চারপাশ জুড়ে এখন কেবলই নৃশংস দৃশ্যের জন্ম। আগুন এবং পোড়া গন্ধে বেঁচে থাকার স্বাভাবিক শ্বাস রূদ্ধপ্রায়। নিজের রাজ্য থেকে দূরের রাজ্য– যেদিকেই চোখ রাখা যাক না কেন, নৃশংসতার এই চক্রব্যূহের ভিতরই যে আমরা আছি, তা আর ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে না। কাগজ-টিভি-মোবাইল হয়ে সেই হিংসার পরিধি ঘনিয়ে উঠেছে আমাদের ব্যক্তিগত অবকাশটুকুতেও। সরাসরি চলে এসেছে আমাদের জেগে-থাকায়। আপাত ভাবে আমরা হয়তো সেই সব ঘটনায় যুক্ত নেই। তবু চারিদিকে যখন হিংসার আগুন এমন লকলকিয়ে ওঠে, তখন ব্যক্তিগত ভাবে প্রত্যেকে আমরাই বা আর কোন দেবালয়!
অতএব রক্ষা নেই। এই ক’-দিন আগেই আমরা দেখলাম ক্ষমতাদখলের লড়াই দুই নারীকে বিবস্ত্র করেছে। সে-দৃশ্য না চাইতেও উঠে এল আমাদের করতলে। দেখে কেউ ক্রুদ্ধ হলেন, কেউ তর্কে প্রবৃত্ত হলেন। সংসদ থেকে সোশ্যাল মিডিয়া– সর্বত্র একই চর্চা। ক্রমে বোঝা গেল, এই হিংসা পরিকল্পিত। বিদ্বেষ রাজনীতি যখন বহিরাগত কাঁটা উসকে দিয়ে দিনানুদিনের অর্থনীতির সঙ্গে জুড়ে দেয় ঘৃণাকে, তখন এই পরিণতি আর এড়ানো যায় না। এড়ানোর জন্য যা যা করা যেতে পারত, তার ঠিক উল্টো কাজগুলিই বরং করা হয়েছে। কারা করেছে? আমাদের অজানা নয়। কেনই বা নির্দিষ্ট একটা সময়ে সেই ভিডিও ছড়ানো হয়েছে! তা-ও আমাদের অনুমানের বাইরে নয়। সমগ্রের নকশাটা যখন ক্রমে স্পষ্ট হয়ে ধরা দিল, তখন যেন আর বিস্ময়াবিষ্ট হওয়াও সাজে না। মনে হয়, এই রাজনীতির অনুমোদন তো আমরাই দিয়েছি। অথবা দিইনি। এমন প্রতিরোধও অবশ্য গড়ে তুলিনি যাতে তা বন্ধ হয়। বরং মেতে থেকেছি অবান্তর আলোচনায়; এমন প্রশ্নোত্তর, কথোপকথনে যা সারশূন্য। হাজারও ইস্যুতে সোশ্যাল মিডিয়ার কমেন্টে-কমেন্টে নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করতে-করতে অযৌক্তিকতাকে লৌহবাসর ভ্রম করেছি। তারই ছিদ্রপথে একদিন ঢুকে পড়েছে এই দুষ্ট রাজনীতি। যে-রাজনীতি গোষ্ঠীর প্রশ্নে একজন নারীকেও শিখিয়ে দেয় অন্য গোষ্ঠীর নারীকে ধর্ষকাম পুরুষের হাতে তুলে দিতে। আমাদের লিঙ্গভিত্তিক সমস্ত প্রাগ্রসর আলোচনা যেন আচমকাই মুখ থুবড়ে পড়ে। অরুন্ধতী রায় ঠিকই বলেছেন, এ আসলে মনের ভিতরকার এক নারকীয় উন্মাদদশা। যা জন্ম দিয়েছে ওই রাজনীতি, তা-ও আমাদের চোখের সামনেই। তা থেকে আর পালানোর পথ নেই আমাদেরও। গোষ্ঠী সংঘর্ষের যে-বিষ এই অবমানবিক কাণ্ড ঘটিয়েছে, তা জ্ঞাত বা অজ্ঞাতে বিষিয়ে দেয় আমাদেরও।
সেই বিষ ফিরে আসে ঘরের কাছের কোনও ঘটনায়। সে-ও হৃদয়বিদারক, মর্মান্তিক। স্বপ্ন দেখার শুরুতেই স্বপ্নের অপমৃত্যু। রাজ্যের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে র্যাগিং-এর শিকার হয়ে এক ছাত্র চিরতরে চলে গেল। অন্যকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ পাওয়ার ভিতর যে জান্তব প্রবৃত্তির প্রকাশ, বিশেষত দুর্বলকে অত্যাচার করে সবলের যে তৃপ্তি– তা তো গভীর গভীরতর অসুখ। সেই অসুখের চিহ্ন সমাজের সারা গায়ে। আমাদের শিক্ষিত সমাজ নিরাপদ শৌখিন ঘরে বসেই দেখে নেয়, কীভাবে দলিতকে গাছে বেঁধে চামড়া ছাড়িয়ে নিচ্ছে বর্ণবাদী অহং। দেখে, সংখ্যালঘুর বুকের ওপর বন্দুকের খোঁচা দিচ্ছে সংখ্যাগুরু ঔদ্ধত্য। এ কি কেউ মানুষ হিসাবে করে! করে না। শুধু গোষ্ঠী, সম্প্রদায়ের ছোট ছোট সীমা আর ভেদকে যখন জল-হাওয়া দিয়ে বড় করে তোলা হয়, তখন মানুষ আর মানুষ থাকে না। তার বিকৃতি বেরিয়ে আসে স্বাভাবিকতার অনুমোদন পেয়ে। আমরা তা দেখি আর দেখতে থাকি। আলগোছে মনে হয় যে, সে সব আমাদের স্পর্শ করে না! কিন্তু সত্যিই কি করে না! একই রকম পরিস্থিতি এলে আমরাও যে অপেক্ষাকৃত দুর্বলের ওপর একই রকম অত্যাচার করব না– এতটুকু মানবিক জোরও যেন আমাদের আর অবশিষ্ট নেই। সেই দুর্বলকে দমিয়ে রাখার বিকৃতি, সমানুভাবের অভাবের ভিতরই কি র্যাগিং-এর বীজ! আমাদের পাঠ্যক্রম যে-শিক্ষা দেয়, তা কি আমাদের যথেষ্ট মানবিক করে তোলে না, নাকি, এই বিদ্বেষদুষ্ট সমাজই সে-পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। মর্মান্তিক এক মৃত্যুকে কেন্দ্র করে আমাদের আলোচনা ঘুরতে পারত সেদিকেই। বদলে আমরা ফিরে গেলাম সেই গোষ্ঠী-দখলের লড়াইয়ে। ক্যাম্পাস কোন রাজনীতির দখলে, যেন তার ফয়সলা হলেই নিরাময় নেমে আসবে। খবরের সন্ধ্যাবাজার এই সূত্রে রীতিমতো জমজমাট, যেমন হঠাৎ কম দামে মাছ বিক্রি হলে বাজারে সাড়া পড়ে যায়, সেরকমই। সেই অবিরাম চিৎকার ভনভনের ভিতর কিছুতেই যে-কথাটা উঠে আসতে চায় না, তা হল, ‘আকাশের মুখে আজ দূষিত কুয়াশা’। প্রশ্ন কত জোরে করা হল, কে জিতল– তা এই সময়ের মুখ্য বিবেচ্য ছিল না। বরং সকলে মিলে দু’-দণ্ডের স্তব্ধতায় ভাবা উচিত ছিল, প্রতিদিন প্রতি নিমেষে ছোট হতে হতে হেরে যাচ্ছে মানুষ।
এই সবকিছু বুঝেও না-বোঝার ভিতর অবধারিত কালকূট। হিংসা আর নৃশংসতার হাতে তাই আমরা ধরা পড়ে যাচ্ছি। উদাসীনতা, অরাজনৈতিক থাকার রাজনীতি, নিজের মত প্রতিষ্ঠা করার চিৎকৃত বাসনা ক্রমশ আমাদেরই ঘিরে ফেলেছে। এখন প্রচণ্ড বিবমিষায় যদি বলি স্তব্ধ হও, তা যেন আর সম্ভব নয়। দেখে যেতেই হবে। নিজের পতনের পর মহামতি ভীষ্ম চেয়েছিলেন, যুদ্ধটা এবার বন্ধ হোক। দুর্যোধন রাজি হননি। অতএব কুরুক্ষেত্রের প্রথম সেনাপতি শরশয্যায় শুয়ে সবটাই দেখলেন। যুদ্ধ শেষে গান্ধারী যখন কৃষ্ণকে দেখাচ্ছিলেন কুরুক্ষেত্রের বীভৎসতা– অগণন ধড়হীন মুণ্ড আর মুণ্ডহীন ধড়, শোণিতলিপ্ত ভূমিতে বসে প্রিয়জন হারানো নারীদের ক্রন্দন– তখন দেখাচ্ছেন শরশয্যায় শুয়ে থাকা ভীষ্মকেও। স্বেচ্ছামৃত্যুর বর আছে, তবু দক্ষিণায়ন না-হলে নিজের মুক্তির অনুমোদন নেই। অতএব তাঁকে দেখে যেতে হবে এই সকল নৃশংসতা।
স্বজনক্ষয়ী কুরুক্ষেত্রের পরিণতির জন্য গান্ধারীর থেকে আত্মধ্বংসের অভিশাপ পেলেন কৃষ্ণ। সে-অভিশাপ কি ভীষ্মও পাননি! যেমন পাচ্ছি আমরা। হিংসা আর নৃশংসতার শরশয্যাই পরিণতি, তবু স্বেচ্ছামুক্তি হাতে নেই আমাদেরও।