স্বাধীনতার সংগ্রাম বহতা নদীর মতো। তাতে বহু স্রোত এসে মেলে। ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক, গাজা-সহ গোটা ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামও তেমনই। অসংখ্য স্রোত এসে মিলছে মুক্তি সংগ্রামের মহাসাগরে। ঠিক যেমন ছিল ভারতে, যেমন ছিল পূর্ব-বাংলার মুক্তিযুদ্ধে। আজ শেষ পর্ব।
এই লেখা যখন লিখতে বসছি, ঠিক তখনই খবর এল, জেনিন উদ্বাস্তু ক্যাম্পে হামলা চালিয়েছে ইজরায়েলের সশস্ত্র বাহিনী। চারজন খুন। তার মধ্যে দু’জন নাবালক। মনে রাখা দরকার, জেনিন কিন্তু গাজায় নয়, ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের একটি শহর। ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে কোনও যুদ্ধ চলছে না। সেখানে হামাস ক্ষমতায় নেই। শাসনকার্যের ভার প্যালেস্তাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) পরিচালিত, রাষ্ট্রসংঘ দ্বারা স্বীকৃত প্যালেস্তাইন অথরিটি-র (পিএ) হাতে। ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক থেকে একটি রকেটও উড়ে যায়নি ইজরায়েলের দিকে। কোনও ‘সন্ত্রাসবাদী হামলা’ হয়নি। অথচ গাজায় যুদ্ধবিরতি চলাকালীন নিয়মিত ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের বিভিন্ন শহরে বাড়ি বাড়ি ঢুকে হামলা করছে ইজরায়েলের সশস্ত্র বাহিনী।
জেনিন উদ্বাস্তু শিবিরের বাসিন্দা ৮ বছর বয়সি আদাম সামের আল ঘৌলেটকে একদম সামনে থেকে মাথায় গুলি করে ইজরায়েলি সেনা। ১৫ বছর বয়সি বাসিল সুলেমান আবু আল ওয়াফাকে বুকে গুলি করা হয়। দ্বিতীয় ভিডিওটি ইতিমধ্যেই গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। ইজরায়েলি সেনা যখন উদ্বাস্তু শিবিরের মধ্যে ঢুকে তাণ্ডব চালাচ্ছিল, তখন প্রতিবাদ করে বাসিল এবয়ল আদাম। তাদের হাতে কোনও অস্ত্র ছিল না, এমনকী, পাথরও নয়। তারা চিৎকার করে বলছিল, উদ্বাস্তু শিবিরের ভিতরে ঢুকে তল্লাশির নামে তাণ্ডব চালানো বন্ধ হোক। ইজরায়েলি সেনা জবাব দেয় মাথায় এবং বুকে গুলি চালিয়ে।
ইজরায়েল যুদ্ধের শুরু থেকে বলে আসছে, তাদের সামরিক অভিযানের লক্ষ্য হামাসকে নির্মূল করা। এই দাবির মধ্যে যে অনেকখানি মিথ্যা লুকিয়ে আছে, তার হাতেগরম প্রমাণ গত দেড় মাসে গোটা ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক জুড়ে চলা ইজরায়েলের ভয়াবহ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। কারণ ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে হামাসের কোনও অস্তিত্ব নেই। কিন্তু গত দেড় মাসে সেখানে ২৫০ জনেরও বেশি মানুষকে খুন করে ইজরায়েল। গ্রেপ্তার করে ভয়াবহ নির্বাচন করা হয়েছে কয়েক হাজার মানুষকে। রামাল্লা, জেনিন, নাবলুস-সহ গোটা ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক জুড়ে চলছে ইজরায়েলের ভয়াবহ অত্যাচার। এই নির্যাতনের দু’টি দিক: প্রথমত, সরাসরি ইজরায়েলি সেনাবাহিনীর তল্লাশির নামে নির্যাতন, গ্রেপ্তারি এবং নির্বিচারে খুন। দ্বিতীয়ত, ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে বসতি স্থাপন করে থাকা সশস্ত্র ইজরায়েলি দখলদারদের অত্যাচার। এই অবৈধ দখলদারদের মাধ্যমে ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের প্রায় ৬০ শতাংশ এলাকা দখল করে রেখেছে ইজরায়েল। তাদের অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করে ইজরায়েলি সেনা। খাতায়-কলমে এইসব এলাকা প্যালেস্তাইন অথরিটির নিয়ন্ত্রণে, কিন্তু কার্যত তাদের কোনও প্রভাবই নেই। নিজভূমে পরবাসীর মতো তাদের অবস্থান। ফিলিস্তিনিদের জন্য বিষয়টি ঠিক কতখানি ভয়াবহ, কল্পনা করাও মুশকিল! ধরা যাক, প্রতিবেশী রাষ্ট্র চিন বা পাকিস্তানের কয়েক লক্ষ নাগরিক কয়েক দশক ধরে ভারতের একাধিক রাজ্যের বিরাট এলাকায় বসতি স্থাপন করে আছেন। তাঁরা সশস্ত্র। কার্যত আধাসামরিক বাহিনীর মতো। তাঁদের নিজেদের দেশের সেনাবাহিনী তাঁদের নিয়মিত অস্ত্র জোগান দেয়। এই অবৈধ দখলদাররা কেবল বসতি স্থাপন করেই থেমে থাকছেন না, তাঁরা নিয়মিত আশপাশের ভারতীয়দের ওপর প্রাণঘাতী হামলা চালাচ্ছেন, তাঁদের তুলে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করছেন, এমনকী, হত্যাও করছেন। ঠিক এই কাজটাই করেন ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড দখল করে থাকা ইজরায়েলি দখলদাররা। বস্তুত ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের আর্ন্তজাতিকভাবে স্বীকৃত প্যালেস্তাইন অথরিটি মাত্র ১৮ শতাংশ এলাকা এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করে, ২২ শতাংশ এলাকা ইজরায়েলি সেনা এবং প্যালেস্তাইন অথরিটির যৌথ নিয়ন্ত্রণে চলে, ৬০ শতাংশ এলাকা ইজরায়েলের দখলে।
২.
দীর্ঘদিন ধরে গোটা ফিলিস্তিনে একচেটিয়া রাজনৈতিক আধিপত্য ছিল প্যালেস্তাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন বা পিএলও-র। পিএলও কোনও রাজনৈতিক দল নয়, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীর একটি ঐক্যবদ্ধ মঞ্চ, যারা ছয়ের দশক থেকে ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রামকে নেতৃত্ব দিয়ে এসেছে। পিএলও-র প্রধান শক্তি ফাতাহ্, যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ইয়াসের আরাফত। ফাতাহ্ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল। তারা ছাড়াও পিএলও-র গুরুত্বপূর্ণ শক্তি প্যালেস্তাইন পিপলস পার্টি, যারা মতাদর্শগতভাবে কমিউনিস্ট। এছাড়াও একাধিক কমিউনিস্ট ও বামপন্থী শক্তি বিভিন্ন সময়ে পিএলও-র মধ্যে থেকেছে, এখনও রয়েছে। বস্তুত দীর্ঘদিন পর্যন্ত ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রামে ইসলামপন্থীদের কার্যত কোনও অস্তিত্ব ছিল না। সংগ্রামের মূল ধারাটি ছিল প্রগতিশীল, ধর্মনিরপেক্ষ, জাতীয়তাবাদী। প্রধান নেতা ছিলেন ইয়াসের আরাফত। বস্তুত, পিএলও এবং ফতাহ্-র প্রভাব খর্ব করতে ইজরায়েলই আটের দশকে তৈরি করে হামাসকে। উদ্দেশ্য ছিল দু’টি– প্রথমত, ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রামকে বিভাজিত করা। দ্বিতীয়ত, হামাসকে সামনে নিয়ে আসার মাধ্যমে ফিলিস্তিনের পক্ষে থাকা আর্ন্তজাতিক সমর্থন সংকুচিত করা। কারণ ধর্মনিরপেক্ষ পিএলও ফিলিস্তিনের জাতীয় স্বাধীনতার দাবিতে যে বিপুল আর্ন্তজাতিক সমর্থন পাচ্ছিল, তা ইসলামপন্থী হামাসের পক্ষে পাওয়া মুশকিল। কালক্রমে এই হামাসই পরিণত হয় ইজরায়েলের গলার কাঁটায়। হয়ে ওঠে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। ঠিক যেমন আটের দশকে আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের আধিপত্য রুখতে আমেরিকার মদতে জন্ম হয়েছিল ওসামা বিন লাদেনের আমেরিকার, যার অভিঘাতে দেড় দশক পর ধ্বংস হবে টুইন টাওয়ার, বদলে যাবে গোটা পৃথিবীর রাজনৈতিক অভিমুখ।
আটের দশকের প্রথমে পিএলও-র নেতৃত্বেই শুরু হয় ফিলিস্তিনিদের প্রথম মুক্তিগ্রাম বা ইন্তিফাদা। একদিকে বিপুল জনসমাবেশ, অন্যদিকে গেরিলা লড়াইয়ে এই দুয়ের সম্মিলনে ইন্তিফাদার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আরাফত। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল কমিউনিস্ট গেরিলা বাহিনী পিএফএলপি। ১৯৯৩ সালে পিএলও এবং ইজরায়েলের মধ্যে অসলো চুক্তির মাধ্যমে প্রথম ইন্তিফাদার অবসান হয়। এই অসলো চুক্তিই ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি বড়সড় জলবিভাজিকা। অসলো চুক্তি অনুসারে স্থির হয় ইজরায়েল এবং প্যালেস্তাইন দু’টি রাষ্ট্রই একে অন্যকে স্বীকৃতি দেবে। ইজরায়েল নির্যাতন এবং প্যালেস্তাইন ভূখণ্ডে দখলদারি বন্ধ করবে। বাস্তবে পিএলও নেতৃত্বাধীন প্যালেস্তাইন অথরিটি ইজরায়েলকে স্বীকৃতি দিলেও ইজরায়েল প্যালেস্তাইনকে স্বীকৃতি দেয় না। প্যালেস্তাইন ভূখণ্ডে দখলদারি আগের তুলনায় বাড়িয়ে তোলে। সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে নির্যাতন এবং হত্যা।
পড়ুন ‘যুদ্ধপরিস্থিতি’-র প্রথম পর্ব: মৃত শিশুদের মিছিলের মুখে অসহায় বেঁচে থাকা
স্বাভাবিকভাবেই অসলো চুক্তির ব্যর্থতা পিএলও নেতৃত্বের প্রতি জনসমর্থন খানিকটা কমিয়ে দেয়। প্যালেস্তাইন অথরিটির প্রতি ফিলিস্তিনিদের বিরক্তি এবং হতাশা বাড়তে থাকে। একে পুঁজি করে শক্তিবৃদ্ধি করতে থাকে হামাস। একুশ শতকের শুরুতে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে ফেটে পড়ে ফিলিস্তিনিদের দ্বিতীয় ইন্তিফাদা। এবার আর আন্দোলনের সম্পূর্ণ নেতৃত্ব পিএলও-র হাতে থাকল না। ২০০৬ সালের নির্বাচনে গাজা স্ট্রিপে ফাতাহ্কে হারিয়ে ক্ষমতায় আসে হামাস। তার পরের বছর হামাস গায়ের জোরে গাজা থেকে পিএলও-কে বিতাড়িত করে। এ-কথা অস্বীকার করা ভুল হবে যে গাজার জনগণের বিরাট অংশের সমর্থন হামাসের পিছনে আছে। অসলো চুক্তির মাধ্যমে পিএলও কার্যত ইজরায়েলের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে– হামাসের এই প্রচার মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়।
প্যালেস্তাইনের রাজনৈতিক পরিসর ২০০৭ সাল থেকেই কার্যত আড়াআড়ি দু’টি ভাগে বিভক্ত। গাজার নিয়ন্ত্রণ হামাসের হাতে, অন্যদিকে রামাল্লায় রয়েছে পিএলও পরিচালিত প্যালেস্তাইন অথরিটির শাসন। গত দেড় দশকে পিএলও ক্রমাগত জনসমর্থন হারিয়েছে। ইয়াসের আরাফতের প্রয়াণের পর ফাতাহ্, পিএলও এবং প্যালেস্তাইন অথরিটির কর্ণধার এখন ৮৮ বছরের অতিবৃদ্ধ মাহমুদ আব্বাস। একদিকে ইজরায়েল এবং পশ্চিমি দুনিয়ার প্রবল চাপ, অন্যদিকে তাঁর প্রশাসনের প্রতি সাধারণ ফিলিস্তিনিদের বিপুল অসন্তোষ– সবমিলিয়ে আব্বাস রীতিমতো নাস্তানাবুদ। সমীক্ষার ফল বলছে, ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের ৮৮ শতাংশ মানুষ মনে করেন আব্বাসের নেতৃত্বাধীন পিএলও বা পিএ ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা আদায় করতে পারবে না। একসময় পিএলও-র গুরুত্বপূর্ণ শক্তি কমিউনিস্ট গেরিলা বাহিনী পিএফএলপি-ও এখন আর পিএলও-র সঙ্গে নেই। ৭ অক্টোবরের অপারেশন আল আকসা ফ্লাডের আগে দুই ইসলামিক শক্তি হামাস এবং পিআইজে-র সঙ্গে কমিউনিস্ট গেরিলা পিএফএলপি-ও ঐক্যবদ্ধভাবে বৈঠক করে লেবাননে। বস্তুত গোটা প্যালেস্তাইন জুড়েই স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলি ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। তার মধ্যে ইসলামপন্থীরা যেমন আছেন, ঠিক তেমনই ধর্মনিরপেক্ষ এবং বামপন্থীরাও আছেন।
৩.
ফিলিস্তিনের সশস্ত্র সংগ্রামের বর্তমান চরিত্রটিকে বুঝতে হবে তার বহুমাত্রিকতায়। যাঁরা ইজরায়েলের কবল থেকে ফিলিস্তিনকে মুক্ত করতে চান, তাঁদের মধ্যে মতাদর্শগত ঐক্য নেই। আছে একটি অভিন্ন পাখির চোখ: স্বাধীন ফিলিস্তিন কায়েম করা। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে যেমন মা কালীর সামনে বুকের রক্ত দিয়ে শপথ নেওয়া সশস্ত্র সংগ্রামীরা ছিলেন, ঠিক তেমনই ছিলেন ভগৎ সিংদের মতো বামপন্থীরা, যাঁরা ঘোষিতভাবেই নাস্তিক। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও যেমন প্রধান ধারা ছিল আওয়ামী লিগ, কিন্তু তার বাইরেও ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা বাহিনী, সিরাজ শিকদারের কমিউনিস্ট গোষ্ঠী-সহ আরও অসংখ্য শক্তি ছিল, ঠিক তেমনই ফিলিস্তিনেও বিভিন্ন ধারার সশস্ত্র সংগ্রামীরা মতাদর্শগত ভিন্নতা সত্ত্বেও ঐক্যবদ্ধ লড়াই করছেন দখলদার ইজরায়েলের বিরুদ্ধে।
ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত বাংলার বিপ্লববাদীদের মতোই ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের আরবান গেরিলাদেরও অনেকগুলি ছোট ছোট গোষ্ঠী। কোনওটির নাম ‘লায়নস ডেন’, কোনওটি ‘আল আকসা মার্টিয়ার্স ব্রিগেড’, কোনওটি ‘জেনিন’ বা তুবাস শহরের ‘গেরিলা ব্রিগেড’। কোনও নির্দিষ্ট মতাদর্শে বাঁধা যাবে না সবগুলিকে। কমিউনিস্ট পিএফএলপি গেরিলারা যেমন আছেন, তেমনই আছেন ধর্মনিরপেক্ষ আল আকসা মার্টিয়ার্স ব্রিগেডের যোদ্ধারা। আছেন ফাতাহ্-র সঙ্গে এখনও খাতায়-কলমে জুড়ে থাকা অনেকে। আছেন ফাতাহ্-র নিষ্ক্রিয়তায় বিরক্ত হয়ে বেরিয়ে আসা যোদ্ধাদের বড় অংশ। এখনও ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক শক্তিগুলির মধ্যে সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ফাতাহ্। তারাই পিএলও-র মূল শক্তি। ফিলিস্তিনের কমিউনিস্ট পার্টি, যারা প্যালেস্তাইন পিপলস পার্টি বা পিপিপি নামে কাজ করে, তাদের শক্তিও কম নয়। আরবান গেরিলাদের মধ্যে এই দলগুলির সমর্থকরা যেমন আছেন, তেমনই আছেন মূলধারার রাজনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ স্বাধীনতা সংগ্রামীরা।
পড়ুন ‘যুদ্ধপরিস্থিতি’-র দ্বিতীয় পর্ব: এই গণহত্যার রক্ত কেবল জায়নবাদীদের হাতেই লেগে রয়েছে, সব ইহুদির হাতে নয়
পিপিপি নেত্রী নওল মুসার সঙ্গে কথা হচ্ছিল। মুসা বলছিলেন, ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের অধিকাংশ আরবান গেরিলাই ধর্মনিরপেক্ষ বা বামপন্থী। কারণ রামাল্লা বা জেনিনে ইসলামপন্থীদের প্রভাব খুব কম। নাবলুসেও তাই। মুসা বারবার করে বলছিলেন ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের গুরুত্বপূর্ণ গেরিলা বাহিনী আল আকসা মার্টিয়ার্স ব্রিগেডের কথা। খাতায়-কলমে তারা এখনও ফাতাহ্-র সঙ্গে জড়িত, কিন্তু আদতে ফাতাহ-র রাজনৈতিক কমান্ডের বাইরে থেকেই কাজ করে। আদ্যন্ত ধর্মনিরপেক্ষ একটি শক্তি এই ব্রিগেড। সদস্যদের প্রায় প্রত্যেকেই শহুরে তরুণ। মুসার কথায়, ‘এই তরুণ গেরিলারা ইসলামি শাসন চায় না। তারা মদ খায়, ধূমপান করে, অনেকে পর্ক খায়। এদের স্বপ্ন ফিলিস্তিনকে স্বাধীন করা। এই তরুণরা পিএলও, ফাতাহ্-র প্রতি বীতশ্রদ্ধ। এদের লড়াই ইজরায়েলের বিরুদ্ধে, সেই লড়াইয়ের সহযোগী হিসাবে এরা যে কোনও শক্তির সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হতে প্রস্তুত।’
মুসা বলছিলেন, ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক জুড়ে এমন অজস্র শহুরে গেরিলা দল গড়ে উঠছে। এই আরবান গেরিলাদের অনেকেই কোনও রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাস করে না। অধিকাংশেরই বয়স ১৫ থেকে ৩০ বছর। এদের একাংশের ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের বড় দল হিসাবে ফাতাহ্-র সঙ্গে যোগ থাকলেও এইসব গেরিলা ব্রিগেডের কাজকর্মের সঙ্গে পিএলও বা ফাতাহ্ নেতৃত্বের মিল পাওয়া মুশকিল। এই ব্রিগেডের তরুণ স্বাধীনতা সংগ্রামীরা নিয়মতান্ত্রিক পথে হাঁটতে চান না। তাঁদের স্বপ্ন পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলা। শুনতে শুনতে মনে পড়ছিল সশস্ত্র বিপ্লববাদীরাও তো ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যে কাজ করতেন। একটা সময় পর্যন্ত চট্টগ্রামের কংগ্রেস অফিস ছিল সূর্য সেনদের নিয়ন্ত্রণে।
আল আকসা ব্রিগেডের একজন কমান্ডার ছিলেন শহিদ ইব্রাহিম নাবলুসি। ২০২২ সালে ১৯ বছরের নাবলুসিকে ঘরে ঢুকে খুন করে ইজরায়েলি সশস্ত্র বাহিনী। তার আগেও বেশ কয়েকবার খুনের ব্যর্থ চেষ্টা করা হয়। ১৯ বছরের ছেলেটি নাজেহাল করে তুলেছিল দখলদার ইজরায়েলিদের। ঠিক আমাদের অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের মতোই। মৃত্যুর আগেই নাবলুসি ছিলেন জনপ্রিয়। শহিদ হওয়ার পরে তাঁর জনপ্রিয়তা আকাশ ছুঁয়ে ফেলে। নাবলুসি শহিদ হওয়ার আগে ফিলিস্তিনি তরুণদের কাছে আর্জি জানান, মাতৃভূমি মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত যেন সংগ্রামে বিরতি না পড়ে। গোটা ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের তরুণদের প্রাণে ঝড় তুলে দেন এই তরুণ শহিদ। তাঁকে বলা হতে থাকে, লায়ন অফ নাবলুস– নাবলুসের সিংহ, যাঁর গর্জনে কেঁপে উঠত দখলদার ইজরায়েল। নাবলুস শহিদ হওয়ার পর তাঁর অনুসারীরা তৈরি করেছেন ‘লায়নস ডেন’ নামে একটি আরবান গেরিলা দল। এই দলের অধিকাংশ সদস্যই সেকুলার। অনেকে মার্কসবাদী। প্রাক্তন ফাতাহ্ সদস্যরা যেমন আছেন, তেমনই আছেন পিপিপি, পিএফএলপি সমর্থকরাও।
পড়ুন ‘যুদ্ধপরিস্থিতি’-র তৃতীয় পর্ব: যুদ্ধবিরতি, তরমুজ ও প্যালেস্তাইন
এরকমই ছোট ছোট গেরিলা বাহিনী ছড়িয়ে আছে ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক জুড়ে। কোনও কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক কমান্ড নেই, বিভিন্ন গোষ্ঠীগুলি পারস্পরিক মতপার্থক্য এবং মতাদর্শগত ভিন্নতা সত্ত্বেও নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রেখে চলে। কখনও কখনও সংঘাত হয়। কিন্তু সকলেরই মূল শত্রুটি এক: দখলদার ইজরায়েল। এই গেরিলা শক্তিগুলি একদিকে যেমন বড় বড় জমায়েতে অংশ নিচ্ছে, অন্যদিকে তেমনই ইজরায়েলি চেক পোস্ট এবং অবৈধ দখলদার সশস্ত্র বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। গোটা ২০২২ সাল জুড়ে এদের খতম করতে বিশেষ অপারেশন চালিয়েছে ইজরায়েল। তাতেও দমানো যায়নি।
সাইমন কমিশন বিরোধী গণআন্দোলনে ব্রিটিশ পুলিশের হাতে মার খেয়েছিলেন লালা লাজপত রায়। কিছুদিন পরে মৃত্যু হয়েছিল তাঁর। সেই ঘটনা বুকে আগুন জ্বেলে দিয়েছিল হাজার হাজার ভারতীয় তরুণের। শক্তিবৃদ্ধি হয়েছিল ভগৎ সিংদের। তারও দেড় দশক আগে বন্দেমাতরম স্লোগান দিয়ে কিংসফোর্ডের নির্দেশে ব্রিটিশ পুলিশের ১৫ ঘা বেতের বাড়ি খেয়েছিলেন সুশীল সেন। পরের বছর ১৮ বছরের ক্ষুদিরাম বসু মুজফফরপুরে বোমা মেরেছিলেন সাম্রাজ্যবাদের গাড়িতে। ঠিক তেমনই ইজরায়েলি জেল থেকে পালানো ৬ ফিলিস্তিনি বন্দির সুরক্ষার দাবিতে বিপুল গণআন্দোলনের জোয়ার উঠেছিল জেনিনে। সেই আন্দোলনের মধ্য থেকে গড়ে উঠেছে একাধিক গেরিলা ব্রিগেড। তাদের কারও মতাদর্শ প্রগতিশীল, ধর্মনিরপেক্ষ, কারও মতাদর্শ ইসলামপন্থী।
স্বাধীনতার সংগ্রাম বহতা নদীর মতো। তাতে বহু স্রোত এসে মেলে। ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক, গাজা-সহ গোটা ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামও তেমনই। অসংখ্য স্রোত এসে মিলছে মুক্তি সংগ্রামের মহাসাগরে। ঠিক যেমন ছিল ভারতে, যেমন ছিল পূর্ব-বাংলার মুক্তিযুদ্ধে।
গাজায় চলমান যুদ্ধ হয়তো সাময়িকভাবে থামবে। ফের শুরু হবে কিছুদিন পর। ফিলিস্তিনের মুক্তির লড়াই থামবে না। যতদিন না স্বাধীনতা অর্জিত হয়, এই লড়াই থামার নয়।
(সমাপ্ত)