আব্বাস কিয়ারোস্তামি তাঁর ‘টেস্ট অফ চেরি’ ছবিতে বলেছিলেন, ‘আত্মঘাত পাপ সন্দেহ নেই, কিন্তু বিষাদে থাকাও তো একটা পাপ। বিষাদে থাকলে তুমি অন্যকে আঘাত করো। সেটাও কি পাপ নয়?’ এবং এভাবেই, সমাজের একটা বড় অংশ পারস্পরিক বিষাদে বিষণ্ণ এবং বিরক্ত হয়ে থাকছে। দাম্পত্যে প্রভাব ফেলছে সঙ্গীর ওপর। একই ছাদের তলায় দুটো আলাদা মানুষ ঘর করছে। ‘দুইজনে পাশাপাশি যবে/ রহে একা, তার চেয়ে একা কিছু নাই এ ভুবনে।’ এই কলহ-প্রভাব পড়ছে সন্তানের ওপর। তার ভবিষ্যতের ওপর। অ্যান্ড দ্য ফ্লো গো’জ অন…
মার্কিন কবি, মানসিক স্বাস্থ্যবিদ জেরেমি নোবেলের কথাগুলো শুরুতেই থাকুক, ‘Loneliness is natural alarm signals like thirst or cold. Thirst warns us we need hydration and loneliness warns us we need to connect more deeply to others…’ জেরেমি একাকিত্বের একটি শ্রেণিবিভাগ করেছিলেন, সাইকোলজিকাল, সোসাইটাল এবং স্পিরিচুয়াল বা এক্সিসটেনশিয়াল। সাইকোলজিকাল একাকিত্ব মূলত সরাসরি অ্যাকিউট মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত যা মানুষের তাৎক্ষণিক অসহায়ত্ব বা মেন্টাল ট্রমা থেকে হয়। সামাজিকভাবে অ্যালিয়েনেশন বা হীনম্মন্যতা থেকে সোসাইটাল লোনলিনেস আসে। স্পিরিচুয়াল লোনলিনেস তুলনায় চিরন্তন ভাবনার ফসল, অর্থাৎ কিছুতেই কিছু হয় না, এ ধরনের একটা দীর্ঘকালীন অবসাদের চিন্তা চলে আসে এখানে। একাকিত্বের কারণ হিসেবে জেরেমি ‘ফাইভ টেরিটোরিজ অফ লোনলিনেস’ হিসেবে দেখিয়েছেন ট্রমা, অসুস্থতা, বার্ধক্য, অন্যদের সঙ্গে শারীরিক বা মানসিক পার্থক্য এবং আধুনিকতা– এই পাঁচটিকে। এবং এই অসুখের ওষুধ? জেরেমি বলছেন, ‘Be curious. Make something. Have conversation.’ অর্থাৎ, একা হয়ে পড়লে একাকিত্বের কারণ সম্পর্কে কৌতূহলী হও, জানো কেন একা হয়ে পড়ছ। কিছু করতে চেষ্টা করো, সৃষ্টির পথে এগোও। কথাবার্তা বাড়াও।
একাকিত্ব সম্পর্কে জেরেমির এই ভাবনাচিন্তাগুলো বলে ওঠার নেপথ্যে একটাই কারণ, সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ‘কমিশন অন সোশ্যাল কানেকশন’ নামের একটি ১১ জনের কমিটি তৈরি করেছে, যেখানে পৃথিবী জুড়ে একাকিত্বের কারণ খুঁজে তা দূরীকরণের একটা পথরেখা তৈরি করা হবে। কমিটির যৌথ চেয়ারপার্সন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সার্জেন জেনারেল ডক্টর বিবেক মূর্তি এবং আফ্রিকান ইউনিয়ন ইউথ কনভয় চিডো পেম্বা। তাদের ‘Our Epidemic of Loneliness and Isolation’ শীর্ষক রিপোর্টে দিনে ১৫টি করে সিগারেট খাওয়ার মতো ফেটাল বলা হয়েছে একাকিত্বকে। পাশাপাশি গ্যালপ সংস্থার সাম্প্রতিক সমীক্ষা ‘মেটা-গ্যালপ স্টেট অফ সোশ্যাল কানেকশন ২০২২’-এ বলা হয়েছে, পৃথিবীর ২৪ শতাংশ মানুষ ‘যথেষ্ট একা’ বা ‘ফেয়ারলি লোনলি’। বয়স্কদের মধ্যে প্রতি চারজনের একজন একাকিত্ব বোধ করছেন এবং কৈশোর পেরনো প্রজন্মের ৫-১৫ শতাংশ একা হয়ে পড়ছেন। সমীক্ষাটির আরেকটু বিশদে গেলে দেখা যাবে, ৫ থেকে ১৫ বছরের মানুষের মধ্যে ২৪ শতাংশ, ১৯ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে ২৭ শতাংশ, ৬৫ বছর পেরনো নাগরিকদের মধ্যে ১৭ শতাংশ মানুষ একাকিত্ব বোধ করছেন, এবং আশ্চর্য হল, ৪৫ থেকে ৬৫ বছরের মধ্যে শতকরা হারটি তুলনামূলকভাবে অনেক কম। গ্যালপের এই রিপোর্টটি গ্রহের ১৪২টি দেশে অর্থাৎ ৭৭ শতাংশ জনসংখ্যার ভেতর চলা সমীক্ষার ভিত্তিতে প্রকাশিত। নারী-পুরুষ ভিত্তিতে একাকিত্ব বিচার করলে ৭৯টি দেশে মহিলাদের মধ্যে একাকিত্বের প্রভাব অনেক বেশি দেখা গেছে।
আরও পড়ুন: এই পৃথিবী শুধুমাত্র সাহিত্যের জন্যই বেঁচে আছে, একথা শেষ মনে করিয়েছিলেন বুদ্ধদেব বসু
ঠিক এইরকমই ‘কোনও এক বোধ কাজ করে’-র স্বরূপ আলোচনায় রাষ্ট্রপুঞ্জের ‘ডিকেড অফ হেলদি এজিং’ (২০২১-’২৩) রিপোর্টের একটি অংশ হিসেবে ভারতে বয়স্ক মহিলাদের ওপর বেশ কিছু সমীক্ষা হয়েছিল, যার ভেতর প্রতিটিতেই তাঁরা অসংক্রামক অসুখের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে সেখান থেকে নিরাময়ের দাবি জানিয়েছেন, এবং না বললেও চলে, যে সেই সমস্ত অসুখের ভেতর একাকিত্ব, স্ট্রেস এবং উচ্চ-রক্তচাপ অন্যতম। ব্রিটেন বা জাপানের মতো মিনিস্ট্রি অফ লোনলিনেস বা একাকিত্ব-মন্ত্রক না থাকলেও এদেশেও বেশ কিছু সমীক্ষায় একাকিত্বের স্বরূপ উদ্ঘাটনের প্রচেষ্টা নতুন নয়। বয়স্কদের ওপর সমীক্ষা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশিই হয়েছে। সেই অংশ যা রাস্কিন বন্ডের কথায় ‘ওল্ড অ্যান্ড গ্রে অ্যান্ড ফুল অফ স্লিপ’। ২০২২ সালে তামিলনাডুতে ন্যাশনাল ব্যুরো অফ ইকোনমিক রিসার্চের একটি গবেষণা বলছে, সে রাজ্যের বয়স্ক নাগরিকদের মধ্যে, একা জীবনযাপন করা, স্বামী বা স্ত্রীর সঙ্গে থাকা অথবা অন্য কারও সঙ্গে থাকা অংশের ভেতর যথাক্রমে ৬০, ৩০-৪০ এবং ২০-৩০ শতাংশ মানুষ একাকিত্ব অনুভব করছেন। ঠিক এরকমই একটি গবেষণার উদ্যোগ নিয়েছিল মুম্বইয়ের এনজিও হেল্প-এজ ইন্ডিয়া। তাদের রিপোর্ট বলছে, মুম্বইয়ের বয়স্ক নাগরিকদের ৮৬ শতাংশ তাঁদের পরিবারের সঙ্গে থাকেন। এই ৮৬ শতাংশের ভেতর ৭৫ শতাংশ নিজেকে পরিবারের এক বা একাধিক মানুষের থেকে অবহেলিত বা অসম্মানিত বোধ করছেন। ওই একই রিপোর্টে বলা হয়েছে, শহরের ৮০ শতাংশ বয়স্কদের কোনও স্বাস্থ্যবিমা নেই এবং ৬৭ শতাংশ বয়স্ক নাগরিক নানারকমভাবে অ্যাবিউজের শিকার বলে নিজেকে মনে করছেন, যার ভেতর মৌখিক, শারীরিক, আর্থিক অত্যাচার সবরকমই পড়ছে। এই বয়স্ক নাগরিকদের মধ্যে ঠিক কতটা অংশ সরাসরি কাজের মধ্যে আছেন? অর্থাৎ ওয়ার্কিং স্ট্যাটাস অফ দ্য এল্ডার্স? হিসেব করলে দেখা যায়, গোটা দেশে এর শতকরা হার ২৭.৬, অন্যদিকে দিল্লি, মুম্বই, কলকাতায় হার যথাক্রমে ১৭, ৩২.৫ এবং ২০.৫ শতাংশ, এবং বেঙ্গালুরুতে সবচেয়ে বেশি, যা ৪৪.৫ শতাংশ। অর্থাৎ, মুম্বইতে ওয়ার্কিং স্ট্যাটাস তুলনামূলক কম হওয়ার সঙ্গে এই মেন্টাল অ্যাবিউজের পরিমাণ বাড়ার একটি সরাসরি সম্পর্ক আছে ধরে নেওয়া যেতে পারে। কারণ এক্ষেত্রে সন্তান বা পরিবারের ওপর আর্থিকভাবে নির্ভরতা এসে যাওয়ায় তার পরিণতি ট্র্যাজেডির দিকে যাচ্ছে। দেখা গেছে কার্ডিওভাস্কুলার ডিজিজকে এই একাকিত্ব বাড়িয়ে দিচ্ছে ৩০ শতাংশ, ডিমেনশিয়া, অ্যালঝাইমারের প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে হু হু করে, যার সবক’টিই তেমন কোনও বড়সড় রোগ না থাকা বৃদ্ধকেও হঠাৎ মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এর পাশাপাশি আত্মঘাতের হারের ক্রমাগত বৃদ্ধি তো আছেই।
বয়স্কদের মধ্যে একাকিত্বের এই তীব্র প্রভাবের পাশাপাশি তরুণ প্রজন্মের ভেতর কতটা ট্র্যাজিক এই মেন্টাল এপিডেমিক? ঘটনা এটাই, তাঁদের ওপর সমীক্ষা বা গবেষণা তুলনামূলক একটু কম। ২০২২-এর ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ অ্যান্ড পাবলিক হেলথ-এ প্রকাশিত ‘Longitudinal Ageing Study in India’ শীর্ষক গবেষণায় ৪৫ বছর বা তার কম বয়সি ভারতীয়দের মধ্যে ২০.৫ শতাংশ এবং ১৩.৩ শতাংশ যথাক্রমে মডারেট লোনলিনেস ও সিভিয়ার লোনলিনেসের কথা জানিয়েছেন। এবং এখানেও ৪৫ থেকে ৬৫ বছরের মানুষদের ওপর একাকিত্বের সরাসরি প্রভাব অনেক কম। ২০১১ ও ২০১২ সালের দু’টি রিপোর্ট এখানে উল্লেখযোগ্য। ২০১১ সালের একটি গবেষণায় ২২ বছরের কাছাকাছি প্রজন্মের মধ্যে ৬০ শতাংশ একা হয়ে পড়ার আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন। ২০১২ সালে শহুরে এবং গ্রামীণ ভারতবাসীর মধ্যে যথাক্রমে ১৭.৩ ও ৯.৫ শতাংশ একাকিত্বের কথা জানিয়েছেন, খুব স্বাভাবিক যে নাগরিক মননে এক হার অনেকটাই বেশি।
আরও পড়ুন: শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের হারানো পাণ্ডুলিপি ও বুড়ো আঙুল বৃত্তান্ত
খুব স্বাভাবিকভাবেই এসে যাচ্ছে কোভিড নাইন্টিন প্রসঙ্গ। একটি মার্কিন গবেষণা দাবি জানাচ্ছে, ২০১৯-এর জুন ও ২০২০-র জুনের মধ্যে অতিমারীর কারণে সামাজিক যোগসূত্র সেই দেশে কমেছে প্রায় ১৬ শতাংশ। আবার পাশাপাশি অতিমারী অস্বাভাবিক বাড়িয়ে দিয়েছে সোশাল নেটওয়ার্ক ব্যবহারের সময়সীমা। প্রায় অধিকাংশ সমীক্ষা বলছে, দিনে অন্তত দু’ঘণ্টা সোশাল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করলে একাকিত্ব, অবসাদ ও স্ট্রেস ফ্যাক্টর বেড়ে যাচ্ছে সাংঘাতিক, যা উন্নত ও উন্নয়নশীল সমস্ত দেশের ক্ষেত্রেই একইরকমভাবে প্রযোজ্য এবং আশঙ্কার দিক।
এইসবের মাঝে তাহলে উত্তরণ কোথায়? সবক’টি আলোচনায় উঠে আসছে পাঁচটা দিক। কী কী? এক, সেলফ-কেয়ার এবং রুটিন অর্থাৎ প্রতিদিন নিজের জন্য কিছুটা করে সময় কাটানো এবং নির্দিষ্ট সময়সীমা তৈরি করা। দুই, নিজস্ব হবি বা ভালোলাগার দিকগুলোর প্রতি যত্নশীল হওয়া। তিন, সামাজিক কাজে অংশগ্রহণ, যা একাকিত্ব কাটাতে একটা বড়সড় ভূমিকা বহুদিন থেকেই নিয়ে আসছে। চার, মিনিংফুল রিলেশন অর্থাৎ নিজস্ব ভাললাগার মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ বিস্তার, যা সদর্থক দিকে আলোচনাকে প্রাধান্য দেবে। এবং পাঁচ, প্রয়োজনে থেরাপিস্টের পরামর্শ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই পাঁচ নম্বরে এসে সোশাল ট্যাবুর কাছে হার মানছে একটা বড় অংশ। মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে যত্নশীল হয়েও তা যখন ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে, খুব বাড়াবাড়ি না হলে ক’জন যাচ্ছেন চিকিৎসকের কাছে? যখন যাচ্ছেন দেরি হয়ে যাচ্ছে। বা হয়তো একেবারেই যাচ্ছেন না। বাড়িয়ে দিচ্ছে আত্মঘাত-সম্ভাবনা। অথবা তৈরি করছে নিকটবর্তী প্রত্যেকের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর একটা চেইন-রিঅ্যাকশন। যেমনটি বলেছিলেন আব্বাস কিয়ারোস্তামি তাঁর ‘টেস্ট অফ চেরি’ ছবিতে, ‘আত্মঘাত পাপ সন্দেহ নেই, কিন্তু বিষাদে থাকাও তো একটা পাপ। বিষাদে থাকলে তুমি অন্যকে আঘাত করো। সেটাও কি পাপ নয়?’ এবং এভাবেই, সমাজের একটা বড় অংশ পারস্পরিক বিষাদে বিষণ্ণ এবং বিরক্ত হয়ে থাকছে। দাম্পত্যে প্রভাব ফেলছে সঙ্গীর ওপর। একই ছাদের তলায় দুটো আলাদা মানুষ ঘর করছে। ‘দুইজনে পাশাপাশি যবে/ রহে একা, তার চেয়ে একা কিছু নাই এ ভুবনে।’ এই কলহ-প্রভাব পড়ছে সন্তানের ওপর। তার ভবিষ্যতের ওপর। অ্যান্ড দ্য ফ্লো গো’জ অন…
এইসব মিলিয়েই তিন বছর ধরে কাজ করার প্রতিশ্রুতি নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘কমিশন অন সোশাল কানেকশন’ কাজ করার সংকল্প নিয়েছে। তবে, ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে উদ্যোগ নেওয়ার দায়িত্ব অবশ্য সবার। ঘরের ভেতরে গিয়ে একাকিত্ব টেনে বের করে আনার কথা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলতে পারে না। তাঁরা একটা পথ দেখাতে পারেন। আসলে লোনলিনেস এবং সলিচিউড এই দুইয়ের সূক্ষ্ম পার্থক্যও করা দরকার। সৃষ্টিশীলতার জন্য সলিচিউড যতটা আশীর্বাদ হতে পারে, ততটাই ভয়ংকর হতে পারে লোনলিনেস। কবি অ্যানে সেক্সটন চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘Loneliness is a terrible thing and to be alone with people can be pretty horrible’। জীবনানন্দের ‘সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে, আমি একা হতেছি আলাদা’। রবীন্দ্রনাথের বীথিকা মনে পড়ছে, ‘চরের বালুতে ঠেকা/ পরিত্যক্ত তরীসম রহিল সে একা’।
গভীর অসুখ এখন। কেউ যেন একা না থাকে। কেউ যেন কখনওই ভেতরে ভেতরে একা না থাকে…