ভারতীয় অর্থনীতিকে ‘হিন্দু রেট অফ গ্রোথ‘ থেকে বের করে আনার পুরো কৃতিত্ব যে মনমোহনের, সে বিষয়ে সংশয় নেই। তিনি অর্থমন্ত্রী হওয়ার আগে দেশ জানত না ৩ শতাংশের বেশি হারে দেশের আর্থিক বৃদ্ধি কীভাবে ঘটানো সম্ভব। স্বাধীনতার পর একের পর এক পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করেও দেশ আর্থিক বৃদ্ধি তথা জিডিপি বৃদ্ধির বার্ষিক হার ৩ শতাংশের উপর তুলতে পারেনি। যা কিনা অর্থনীতিবিদদের মহলে ‘হিন্দু রেট অফ গ্রোথ’ হিসেবে পরিচিত পেয়েছিল। ১৯৯১ সালে দেশের অর্থমন্ত্রীর চেয়ারে বসার পর ম্যাজিক দেখানো শুরু করেন মনমোহন। ম্যাজিক এই কারণে যে, তার পরের তিন দশকে দেশের অর্থনীতি বছরে গড়ে ৭ শতাংশ হারে বেড়েছে।
মনমোহন সিংয়ের নাম এলেই দেশের আর্থিক বৃদ্ধির প্রসঙ্গ চলে আসে। ৩৩ বছরের সংসদীয় জীবন থেকে অবসর নিয়ে তাঁর কার্যত রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ানোর সময়েও এই বিতর্ক সামনে এসে গিয়েছে। মনমোহন কত বড় মাপের রাজনীতিক ও প্রশাসক ছিলেন– সেসব নিয়ে আলোচনা ছেড়ে সমাজমাধ্যমে ছোড়াছুড়ি চলছে জিডিপির শুকনো পরিসংখ্যান নিয়ে। গত তিন দশকে জিডিপি বৃদ্ধির হারের নিরিখে কোন দেশ কোথায় দাঁড়িয়ে, সেসব নিয়েই চলছে ঝগড়াঝাটি।
ভারতীয় অর্থনীতিকে ‘হিন্দু রেট অফ গ্রোথ‘ থেকে বের করে আনার পুরো কৃতিত্ব যে মনমোহনের, সে বিষয়ে সংশয় নেই। তিনি অর্থমন্ত্রী হওয়ার আগে দেশ জানত না ৩ শতাংশের বেশি হারে দেশের আর্থিক বৃদ্ধি কীভাবে ঘটানো সম্ভব। স্বাধীনতার পর একের পর এক পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করেও দেশ আর্থিক বৃদ্ধি তথা জিডিপি বৃদ্ধির বার্ষিক হার ৩ শতাংশের উপর তুলতে পারেনি। যা কিনা অর্থনীতিবিদদের মহলে ‘হিন্দু রেট অফ গ্রোথ’ হিসেবে পরিচিত পেয়েছিল। ১৯৯১ সালে দেশের অর্থমন্ত্রীর চেয়ারে বসার পর ম্যাজিক দেখানো শুরু করেন মনমোহন। ম্যাজিক এই কারণে যে, তার পরের তিন দশকে দেশের অর্থনীতি বছরে গড়ে ৭ শতাংশ হারে বেড়েছে।
বাজার অর্থনীতির সমর্থকরা বলে থাকেন, নেহরু-ইন্দিরার আমলের মিশ্র অর্থনীতি ও সমাজতন্ত্রের ফানুসটা ফুটো করে দিয়েছিলেন মনমোহন। উদারিকরণ, বেসরকারিকরণ ও বিশ্বায়ন– বামপন্থীরা কটাক্ষ করে যাকে ‘এলপিজি’ বলত, দৈনন্দিন জীবনে সেই সব শব্দের উদয় সেসময় ঘটে। গ্যাট চুক্তি ও ডাংকেল প্রস্তাব তখন বিশ্বজুড়ে ঝড় তুলেছিল। যা ছিল গোটা বিশ্বকে একটাই বাজার ব্যবস্থায় বেঁধে ফেলার একটা প্রচেষ্টা। লাইসেন্স রাজ, পারমিট, বৈদেশিক বাণিজ্যে চড়া শুল্ক ইত্যাদি অর্থনীতিতে সরকারি নিয়ন্ত্রণের বেড়িগুলি রাতারাতি ভেঙেচুরে ফেলাই ছিল ওইসময় মনমোহনের আর্থিক সংস্কারের মূল চাবিকাঠি। ১৯৯০ সাল থেকে দেশে বিদেশি মুদ্রার ভয়াবহ সংকট ও বিপুল কোষাগার ঘাটতি মনমোহনকে এই সংস্কারের পথে হাঁটার রাস্তা করে দিয়েছিল। মনমোহনের পূর্বসূরিরা দেশের সোনা বিদেশে বন্ধক রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন। ভারত সরকারকে হাত পাততে হয়েছিল আইএমএফের কাছেও।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
পড়ুন মানস শেঠের লেখা: ভাইকম আন্দোলনের শতবর্ষ পরেও এ দেশ এখনও জাতিভেদে আক্রান্ত
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
কেমব্রিজ, অক্সফোর্ড হয়ে দেশে ফেরার পর সরকারের আর্থিক উপদেষ্টার চাকরি নিয়েছিলেন মনমোহন। ১৯৭২ সালে ইন্দিরা গান্ধী তাঁকে সরকারের প্রধান আর্থিক উপদেষ্টা করেছিলেন। ১৯৮২ সালে ইন্দিরার আমলেই তিনি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর পদে বসেন। ঘটনাচক্রে তখন দেশের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়। ১৯৮৫ সালে রাজীব গান্ধী মনমোহনকে প্ল্যানিং কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান পদে বসান। অধুনা লুপ্ত প্ল্যানিং কমিশন তখন সরকারের আর্থিক নীতি তৈরির ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ছিল। ১৯৮৭ সালে আচমকাই রাজীবের সঙ্গে মতপার্থক্যের জেরে মনমোহনকে প্ল্যানিং কমিশন ছাড়তে হয়। বিদেশে কাজ নিয়ে চলে যান। কিন্তু পিভি নরসিমা রাও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে বুঝেছিলেন সমাজতন্ত্রের পথ ছেড়ে দেশের অর্থনীতিকে বিশ্বায়ন, উদারিকরণ ও বেসরকারিকরণের পথে ছোটাতে অর্থমন্ত্রী পদে মনমোহনকেই প্রয়োজন।
এখানেই ইতিহাসের সবচেয়ে বড় পরিহাস। নেহরুর আদর্শে কংগ্রেসি ঘরানায় বড় হয়ে, ইন্দিরার সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির প্রধান পুরোহিতের ভূমিকা পালন করেও পিভির প্রশ্রয়ে ভারতের আর্থিক সংস্কারের প্রধান স্থপতি হয়ে গেলেন মনমোহন। এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে দেশে আর্থিক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা রাজীব গান্ধী প্রথম বুঝেছিলেন। তিনি টের পেয়েছিলেন, দেশের উদীয়মান মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভোগ্যপণ্যের চাহিদা মেটানো জরুরি। তাই দেশে শুধু বড় বড় কারখানায় লোহা-লক্কর ও যন্ত্রপাতি বানালেই চলবে না। ভোগ্যপণ্য উৎপাদনের জন্য বেসরকারি লগ্নি প্রয়োজন। টেলি যোগাযোগ ব্যবস্থার বিপুল সম্ভাবনাও তিনি প্রথম উপলব্ধি করেছিলেন। শ্যাম পিত্রোদাকে সামনে রেখে তাঁর আমলেই ভারত টেলি যোগাযোগে বিপ্লব ঘটায়। গ্রামে গ্রামে খুলে যায় এসটিডি, আইএসডি বুথ। তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের প্রসার ও কম্পিউটারের ব্যাপক প্রচলনও রাজীবের আমলে শুরু হয়। কিন্তু রাজীব দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের ব্যাপক বেসরকারিকরণ, বৈদেশিক বাণিজ্যকে সম্পূর্ণ উন্মুক্ত করে দেশের বাজার বাহুজাতিক সংস্থার জন্য হাট করে দেওয়া, বড়লোকদের আয়ে কর কমিয়ে দেওয়া, ইত্যাদি সংস্কারের পথে হাঁটার ঝুঁকি নিতে চাননি। রাজীবও যে সংস্কারের কথা ভাবতে পারেননি, একদা ইন্দিরার প্রধান আর্থিক উপদেষ্টা মনমোহন সেই কাজ অর্থমন্ত্রীর চেয়ারে বসে অনায়াসেই করে দিলেন।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
সুপ্রিয় মিত্রর লেখা: অপরাধে গলা শুকিয়ে গেলেও কি একঢোক জল পাব আমরা?
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
মনমোহনের সংস্কার নীতি দেশে সমাজতন্ত্রের বেলুন ফুটো করে দেওয়া ছাড়াও বামেদের গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতাকে খর্ব করেছে। বামেরাই ছিল এলপিজির সবচেয়ে বড় বিরোধী। তারাই বলেছিল, মনমোহনের নীতি বৈষম্য বাড়াবে। বেকার তৈরি করবে। গরিবকে আরও গরিব করবে। কালক্রমে বামেদের সব কথাই মিলেছে, অথচ সেই বামেদের সমর্থনেই মনমোহন প্রথমবারের জন্য দেশের প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসতে পেরেছিলেন। আবার মনমোহনের দশ বছরের সরকার মনরেগা তথা একশো দিনের কাজের প্রকল্প, বন সুরক্ষা আইন, খাদ্য সুরক্ষা আইন ইত্যাদি বৈপ্লবিক সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে। কিন্তু এইসব প্রকল্প যে তাঁর আর্থিক সংস্কার নীতির পরিপন্থী, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। মনমোহন সরকারের পতন ঘটেছিল দুর্নীতির অভিযোগে। কিন্তু তাঁর চরম বিরোধীরাও কখনও তাঁর ধবধবে সাদা কুর্তা, পাজামায় একছিটে কালির দাগ লাগাতে পারেনি। এক অদ্ভুত বৈপরীত্যের মধ্যে দিয়েই মনমোহনের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক পথ চলা।
বয়সজনিত কারণে ৩৩ বছর পর রাজ্যসভা থেকে অবসর নিলেও এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই যে, মনমোহন দেশের রাজনীতিতে ‘অপ্রাসঙ্গিক’ হয়ে যাবেন। আগামিদিনেও দেশের গুরুত্বপূর্ণ পথের বাঁকে তাঁর পরামর্শ ও মতামত বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। আর তাঁর চালু করে দেওয়া আর্থিক সংস্কার দেশের মঙ্গল করছে কি না, সেই বিতর্ক তো এই ভোটের পরেও জোরালোভাবে চলবে। মনমোহন এবার সংসদ থেকে কিছুটা দূরে বসেই সেসব উপভোগ করতে পারবেন।