মেধাতালিকায় থাকা ছাত্রছাত্রীরা টিভির পর্দায় ঘোষণা করে দিচ্ছে তাদের পছন্দের কথা। পাশে দাঁড়িয়ে অভিভাবকরা রীতিমতো সমর্থন করছেন তাদের। কলকাতার পাঠভবন থেকে উচ্চমাধ্যমিকে নবম হওয়া ছাত্রটি যখন বলছে যে সে ভবিষ্যতে গায়ক হতে চায়, তখন তার বাবা-মা তো বটেই, তার ৯৩ বছরের বৃদ্ধ পিতামহও পর্যন্ত জোর গলায় তাঁর নাতির পাশে থাকার অঙ্গীকার করছেন।
আসলে কেউ বড় হয় না, বড়র মতো দেখায়। সত্যিকারের বড় হয়ে গেলে এসব ভাবতে যতই ভালো লাগুক, যাদের সদ্য বড়র মতো দেখাতে শুরু করেছে, তারা কিন্তু এসব শুনলে খুশি হবে না মোটেই। স্কুলপড়ুয়াদের কথা বলছিলাম। এই জেন জেড-এর মূলমন্ত্র ‘আমি আমার মতো’। বাবা-মা হিসেবেও এদের কাছে নম্বর বেশি পেতে গেলে ‘লিবারাল’ হতেই হবে। আপনি হয়তো ভাবছেন, আমি তো যথেষ্ট ছাড় দিই আমার ছেলেমেয়েকে, কিন্তু আপনি ভাবতেও পারবেন না, সে কিন্তু হেসেই উড়িয়ে দিচ্ছে সেকথা। ছাড় আবার দেওয়া যায় নাকি? স্বাধীনতা তখনই দেওয়া যায়, যদি স্বাধীনতা না থাকে। তাই, কী পরব থেকে শুরু করে, কী পড়ব পর্যন্ত সমস্ত সিদ্ধান্ত তারা নিচ্ছে নিজেরাই।
কিন্তু স্কুলপড়ুয়ারা কি আদৌ নিজের ভবিষ্যৎ প্ল্যানিং করতে সক্ষম? পাল্টা উঠে আসবেই এ প্রশ্ন। কথায় কথায় বিদেশ দেখাতে খারাপই লাগছে যদিও, তবু এ প্রসঙ্গে অতিসাম্প্রতিক একটি মার্কিন সমীক্ষার কথা না বলে পারলাম না। স্কুলে-পড়া ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে চালানো হয়েছিল এই সার্ভে, বেশ কয়েকটা সূচক সামনে রেখে। দেখা গেল, পড়ুয়ারা সবচেয়ে বেশি আগ্রহ প্রকাশ করছে, তাদের উদ্দীপনা রীতিমতো ফুটে বেরচ্ছে যে সূচকটিকে ঘিরে, তার নাম ‘কেরিয়ার দ্যাট ইউ এনজয়’। ‘উচ্চশিক্ষা’ বলতে তারা বোঝে– পছন্দমতো বিষয় বেছে নেওয়া। আর এই পছন্দটা প্রত্যেক ক্ষেত্রেই নির্ভর করছে এমন চারটে ফ্যাক্টর-এর ওপরে, যে চারটে বিষয়, তাদের মতে, জীবন সাজিয়ে তোলার জন্য সবচেয়ে জরুরি। কী সেই চারটে বিষয়? ১. ‘হ্যাপি ফ্যামিলি লাইফ’, ২. ‘হবিজ ইউ এনজয়’, ৩. ‘গুড ফ্রেন্ডস ইউ ক্যান কাউন্ট অন’ আর ৪. ‘পজিটিভ সোশাল কানেকশন’। অর্থাৎ প্রথাগত অর্থনৈতিক সুরক্ষার বদলে প্রায় সবাই বেছে নিচ্ছে পরিবার-বন্ধু-মেলামেশা আর শখশৌখিনতার নিশ্চিন্ত চতুষ্কোণ। সামাজিক প্রতিপত্তির প্রতি পক্ষপাতের কথা সরাসরি অস্বীকার করছে না একবারও, কিন্তু জীবনকে ভারাক্রান্ত করে কেউই সেসব সুখ আর পেতে চায় না।
পাশ্চাত্যে এই প্রবণতা হয়তো অনেক দিনের। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে এই একই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে আমাদের রাজ্যের ছেলেমেয়েদের মধ্যেও। এ নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক বা ব্যক্তিগত স্তরে কোনও সিরিয়াস সমীক্ষা হয়েছে কি না জানি না, কিন্তু গত কয়েক দিনে একের পর এক বোর্ড পরীক্ষায় মেধা তালিকায় থাকা ছাত্রছাত্রীদের কথা শুনলেও সেই একই কথা উঠে আসছে। পশ্চিমবঙ্গ উচ্চমাধ্যমিক সংসদের পরীক্ষার মেধাতালিকায় প্রথম দশ জনের মধ্যে থাকা অন্তত চার-পাঁচজন স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছে যে, তারা ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিং-এর বাইরে বেরিয়ে পড়াশোনা করতে চায়। সেই পড়াশোনার তালিকায় যেমন আছে অ্যাস্ট্রোফিজিক্স কিংবা রাশিবিজ্ঞান, তেমনই আছে নৃত্যশিল্প নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা বা ভবিষ্যতে নিজেকে পুরোদস্তুর গায়ক হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন। অন্য এক বোর্ডের প্রথম স্থানাধিকারী তো ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করে সাংবাদিক হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার পক্ষপাতী। এমনকী, যারা প্রথাগতভাবে ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার কথা বলছে তারাও সেটা বেছে নিচ্ছে ভালো লাগবে ভেবেই। কোনও সামাজিক বা পারিবারিক চাপের মুখে দাঁড়িয়ে বাঁধা বুকনি ঝাড়ছে না।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
অনেকেই উচ্চমাধ্যমিক স্তরে বিজ্ঞান পড়তে এসে বিপদে পড়ত, উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্ট হত বেশ খারাপ। যারা হাত পুড়িয়েছে, তারা সবাই-ই একথা স্বীকার করে যে, মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত বিজ্ঞান বা অঙ্কের যে কাঠামো, উচ্চমাধ্যমিকে এসে তার ধাঁচাটা একঝটকায় বদলে যায় অনেকটাই, কাঠিন্যমান বেশ অনেকটা উঁচু করে বাঁধা। ফলে শুধু মাধ্যমিকের ভালো মার্কশিট দিয়ে যাচাই করা যথেষ্ট মুশকিল, আদৌ পরবর্তী পর্যায়ে কোন বিষয়টা পড়ুয়ার ঠিকমতো ‘স্যুট’ করবে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
অথচ ছবিটা কিন্তু এমন ছিল না কয়েক বছর আগেও। গত শতকের আটের দশক থেকে একটা ট্রেন্ড শুরু হয়েছিল। মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট হলেই বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে হবে, আর বিজ্ঞান নিয়ে পড়লেই তার প্রধান গন্তব্য ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়া। অনেকেই উচ্চমাধ্যমিক স্তরে বিজ্ঞান পড়তে এসে বিপদে পড়ত, উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্ট হত বেশ খারাপ। যারা হাত পুড়িয়েছে, তারা সবাই-ই একথা স্বীকার করে যে, মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত বিজ্ঞান বা অঙ্কের যে কাঠামো, উচ্চমাধ্যমিকে এসে তার ধাঁচাটা একঝটকায় বদলে যায় অনেকটাই, কাঠিন্যমান বেশ অনেকটা উঁচু করে বাঁধা। ফলে শুধু মাধ্যমিকের ভালো মার্কশিট দিয়ে যাচাই করা যথেষ্ট মুশকিল, আদৌ পরবর্তী পর্যায়ে কোন বিষয়টা পড়ুয়ার ঠিকমতো ‘স্যুট’ করবে। এমন কয়েকজনকে ব্যক্তিগতভাবেই জানি যারা অভিভাবকদের চাপে বিজ্ঞান পড়তে গিয়ে উচ্চমাধ্যমিকে রীতিমতো অকৃতকার্য পর্যন্ত হয়েছে। অনেকেই বছরের পর বছর দিয়ে চলত জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষা। কলেজে শুধু নাম লিখিয়ে রেখে বাড়িতে চলত প্রস্তুতি। তাতেও যদি শিকে না ছেঁড়ে, তখন ভিনরাজ্যে বা বেসরকারি কলেজে গিয়ে মোটা ক্যাপিটেশন ফি জমা দিয়ে পড়ত ইঞ্জিনিয়ারিং। একটা বিশেষ সময়ে এই ভিনরাজ্যে পরীক্ষা দেওয়ার এমনই ধুম পড়ে যেত যে, আলাদা করে একটি স্পেশাল ট্রেন পর্যন্ত দিতে হত সরকারকে। এর কোনওরকম অন্যথা মেনে নিতে পারতেন না অভিভাবকরা। উচ্চমাধ্যমিক স্তরে বিজ্ঞান পড়ে তারপর উচ্চশিক্ষায় সাহিত্য বা মানবিকীবিদ্যা পড়তে গেলে বাড়ি থেকে অর্থনৈতিকভাবে প্রায় ব্রাত্য করে দেওয়া হত। অভিভাবকরা মুখ দেখাতে পারতেন না পাড়া-প্রতিবেশীর কাছে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: ম্লান সাইকেলে চড়া আরও ম্লান গানের মাস্টার
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
ছবিটা বদলে দিয়ে এখন এই চাপ কমে এসেছে অনেকটাই। মেধাতালিকায় থাকা ছাত্রছাত্রীরা টিভির পর্দায় ঘোষণা করে দিচ্ছে তাদের পছন্দের কথা। পাশে দাঁড়িয়ে অভিভাবকরা রীতিমতো সমর্থন করছেন তাদের। কলকাতার পাঠভবন থেকে উচ্চমাধ্যমিকে নবম হওয়া ছাত্রটি যখন বলছে যে সে ভবিষ্যতে গায়ক হতে চায়, তখন তার বাবা-মা তো বটেই, তার ৯৩ বছরের বৃদ্ধ পিতামহও পর্যন্ত জোর গলায় তাঁর নাতির পাশে থাকার অঙ্গীকার করছেন।
এখন প্রশ্ন হল, অভিভাবকদের মানসিকতার এই বদল ঘটল কীভাবে! ব্যক্তিগতভাবে আমার একটা কথা মনে হয়। আট-নয় দশকের সেইসব ছাত্রছাত্রীই কিন্তু এখন অভিভাবকের ভূমিকায়। চাপিয়ে দেওয়া শিক্ষার যন্ত্রণার করুণ অভিজ্ঞতা থেকে হয়তো তাঁরা মনে করছেন, সেই নিদারুণ কষ্টের মধ্যে আর ফেলতে চান না তাঁদের সন্তানকে। নিজের পছন্দের বিষয় নিয়ে আনন্দের সঙ্গে এগিয়ে যাক, ভালোবাসুক নিজেদের পড়াশোনার জগৎটাকে।
এই পড়ে-পাওয়া স্বাধীনতার সঙ্গে তাল মিলিয়েছে নতুন প্রজন্মও। গুগল, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার, ওয়েবসিরিজ চোখের সামনে দেখে বড় হচ্ছে এরা। সমীক্ষায় এদের বলা হচ্ছে ‘হলমার্ক জেনারেশন’, যারা সম্পূর্ণত ‘অনলাইন, ডিজিটালি অ্যাসিস্টেড’ জীবনের স্বাদ পেয়েছে। যান্ত্রিক জীবনের প্রাথমিক মোহপর্বটা কেটে গেছে এদের অভিভাবকদের ওপর দিয়ে, এরা কিন্তু যন্ত্রের যন্ত্রণা বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন। তাই যন্ত্রের ভিড়ে নিজেও আর-একটা যন্ত্রমানব হয়ে যান্ত্রিক জীবন কাটাতে চায় না কেউই। খোলা গলায় বলে, আমি থাকব, আমি বাঁচব, ‘আমি, আমার মতোই’!