নীতীশ কুমার বিধানসভায় দাঁড়িয়ে যেরকম অবলীলায় ‘বাইরে ফেলা-ভিতরে ফেলা’– এইসব শব্দের ব্যবহার করেছেন, তা অবশ্যই সভ্য সমাজের ভাষা নয়। যে নারী শিক্ষার গুরুত্ব নিয়ে নীতীশ বক্তব্য রাখছিলেন, তার উদ্দেশ্যটাই দিক্ভ্রষ্ট হয়ে গিয়েছে নীতীশের নারী সম্পর্কে ওই হীন মনোভাব থেকে।
‘খুদ কি নিন্দা করতা হুঁ’– বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের ভুল ভাঙতে ২৪ ঘণ্টা সময় লাগেনি। গোড়ায় অবশ্য নীতীশের দলের তরফে সাফাই দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। জনতা দল ইউনাইটেডের এক নেতা বলেছিলেন, ‘জনতাকে সহজ ভাষায় বোঝানোই ছিল নীতীশের লক্ষ্য।’ বিধানসভায় জন্মনিয়ন্ত্রণ নিয়ে বলার সময় নারীশিক্ষার গুরুত্ব বোঝাতে মন্তব্যগুলো নীতীশ করেছেন।
‘মানুষ এই ভাষা সহজে বুঝবে,’ এটা বলে নিজেদের বাজে কথার সাফাই দেওয়ার কৌশল ভারতে মোটেও নতুন নয়। হিন্দি বলয়ে সাধারণ গ্রামবাসীদের ‘দেহাতি’ বলে চিহ্নিত করা হয়। ‘দেহাতি’ বলতেই ধরে নেওয়া হয় যে, তারা হবে অশিক্ষিত এবং সংস্কৃতিহীন। কদর্য এবং অশালীন ভাষাই যেন তাদের একমাত্র বোধগম্য। মানুষকে ছোট করে দেখার অভ্যাস থেকেই যে এই ধরনের ভাবনা আসে, সেকথা শহরের রাজনীতিবিদরা হয়তো মাথায় রাখেন না।
জেলে যাওয়ার সময় লালুপ্রসাদ যাদব যখন তাঁর মুখ্যমন্ত্রীর পদটি সুরক্ষিত রাখার জন্য পত্নী রাবড়িদেবীর হাতে দিয়ে গেলেন, তখন প্রবল সমালোচনার মুখে লালু সমর্থকদের তরফে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছিল, ‘এতে রে রে করার কী আছে? রাবড়ি তো ভারতের, বিশেষত বিহারের সংখ্যাগরিষ্ঠ নারীর প্রতীক। একজন দেহাতি গৃহবধূ মুখ্যমন্ত্রীর পদে বসলে অত উদ্বিগ্ন হতে হবে কেন? তিনি শহুরে শিক্ষিত নারীদের তুলনায় দেশের বাস্তবকে অনেক ভাল জানেন।’ লালু-নীতীশ ঘরানার বিহারের রাজনীতিবিদরা সর্বদা গর্ব করে বলে থাকেন, তাঁরা রাজ্য-রাজনীতিতে বাবু সংস্কৃতির অবসান ঘটিয়েছেন। বিহারে আর কোনও উচ্চবর্ণ বাবু শ্রেণির কেউ মুখ্যমন্ত্রীর পদে আসীন হতে পারবেন না।
লালু-নীতীশের এই দাবির অবশ্যই সারবত্তা রয়েছে। কিন্তু বাবু সংস্কৃতির অবসান মানেই সমাজজীবনে ও রাজনীতিতে সৌজন্যহীন, শালীনতাহীন, কুৎসিত ভাষা বা মনোভাবের আমদানি নয়। নিম্নবর্গের সংস্কৃতির নাম নিয়ে অশালীনতা, কদর্যতা ও নানা ধরনের পিছিয়ে পড়া মানসিকতাকে চালিয়ে দেওয়ার প্রবণতা আমাদের দেশে কম নয়। বিশেষ করে হিন্দি বলয়ের রাজনীতিতে এই প্রবণতা প্রবলভাবে রয়েছে। নীতীশ কুমার বিধানসভায় দাঁড়িয়ে যেরকম অবলীলায় ‘বাইরে ফেলা-ভিতরে ফেলা’– এইসব শব্দের ব্যবহার করেছেন, তা অবশ্যই সভ্য সমাজের ভাষা নয়। যে নারী শিক্ষার গুরুত্ব নিয়ে নীতীশ বক্তব্য রাখছিলেন, তার উদ্দেশ্যটাই দিক্ভ্রষ্ট হয়ে গিয়েছে নীতীশের নারী সম্পর্কে ওই হীন মনোভাব থেকে।
আরও পড়ুন: অবসাদের বন্ধু যখন অবহেলায় বাঁচে
নীতীশ যখন বিধানসভায় কুৎসিত মন্তব্যগুলি করছিলেন, তখন ট্রেজারি বেঞ্চের পুরুষ বিধায়কদের হাসির রোল তুলতে দেখা গিয়েছে। মহিলা মন্ত্রী ও শাসক দলের মহিলা বিধায়করা অবশ্যই অস্বস্তিবোধ করছিলেন। নীতীশের পাশেই ছিলেন বিহারের উপমুখ্যমন্ত্রী ও রাষ্ট্রীয় জনতা দলের নেতা তেজস্বী যাদব। তিনি বাইরে বেরিয়ে নীতীশের সমর্থনে বলেন, ‘যৌনশিক্ষা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী কথা বলছিলেন। এর মধ্যে খারাপ কিছু নেই।’ জাতীয় রাজনীতিতে তেজস্বীর বাবা লালু চিরকাল বিদূষকের ভূমিকা পালন করেছেন। কিন্তু লালুকেও কখনও এইরকম যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য করে শ্রোতাদের আনন্দ দিতে দেখা যায়নি।
বিহারের মুখ্যমন্ত্রীর মসনদে বসার পর নীতীশ নিজেকে নারী সমাজের উন্নয়নের ক্ষেত্রে নিজেকে একজন সংস্কারক হিসেবে দেখেছেন। তাঁর আমলে বিহারে মদ নিষিদ্ধ হয়েছে। মদ নিষিদ্ধ হওয়ায় বিহারের গ্রামে গার্হস্থ্য হিংসা কমেছে। মদ নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নারীদের মধ্যে নীতীশের জনপ্রিয়তা বাড়িয়েছে বলেও বলা হয়। নীতীশের আমলে পাটনা-সহ বিহারের শহর ও গ্রামাঞ্চলে সাধারম আইনশৃঙ্খলার উন্নতি হয়েছে। মেয়েদের ওপর ঘটা অপরাধের সংখ্যা কমেছে। নারী শিক্ষার ক্ষেত্রেও বিহার নীতীশের আমলে অনেকটা এগিয়েছে। নীতীশ বিতর্কিত মন্তব্যের আগে বিধানসভায় দাবি করেছেন, নারীশিক্ষার অগ্রগতির ফলে বিহারে নারীদের প্রজনন হার ৪.৩ শতাংশ থেকে কমে ২.৯ শতাংশ হয়েছে। নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নে এই কাজগুলি করার পুরস্কার হিসেবে ভোটেও নীতীশের দল নারী সমাজের সমর্থন পেয়ে থাকে। সেকারণেই বিজেপি নীতীশের বিধানসভায় করা নারীবিদ্বেষী কদর্য মন্তব্যগুলি নিয়ে প্রচারে নেমে পড়তে দেরি করেনি। খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও মধ্যপ্রদেশের প্রচারসভায় নীতীশকে আক্রমণ করে জানতে চেয়েছেন, ‘আর কত নিচে নামবেন?’
নীতীশ তাঁর মন্তব্যের অভিঘাত বুঝতে পেরে দ্রুততার সঙ্গে ক্ষমা চেয়েছেন। কিন্তু এই ধরনের নারীবিদ্বেষী ও যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য থেকে আমাদের রাজনীতি কি আদৌ মুক্ত হতে পারবে? সাধারণ মানুষের বোধগম্য ভাষার নাম করে অশালীন ও অশ্রাব্য কথার ব্যবহার কি সমাজে ও রাজনীতিতে বন্ধ হবে? রাজনীতিতে সার্বিকভাবে সুস্থ মূল্যবোধের ক্ষয় হচ্ছে। আইনসভার ভিতরেও অপশব্দের প্রয়োগ বাড়ছে। বিতর্ক ও আলোচনার মান নামছে। নীতীশের মন্তব্য এখন পর্নোগ্রাফির মতো লাগছে। ভবিষ্যতে হয়তো এটাও গা সওয়া হয়ে যাবে।
প্রচ্ছদের ছবি: সোমোশ্রী দাস