Robbar

মন্ত্রী হতে আমি আসিনি, হয় দাবা খেলব, নয় ভেনেজুয়েলায় বিপ্লব আনব– বলেছিলেন চে গেভারা

Published by: Robbar Digital
  • Posted:February 4, 2024 6:19 pm
  • Updated:February 4, 2024 6:19 pm  

কাস্ত্রো সরকারের উদ্যোগে স্কুলস্তরে দাবাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। সংবাদপত্র, টিভি এবং রেডিও-তে নিয়মিত দাবার গেম সম্প্রচার ও বিশ্লেষণ করা হত। ২০০২ সালে হাভানার হোসে মার্তি স্কোয়্যারে ১০,০০০-এর বেশি দাবাড়ু নিয়ে একটি ‘অনেকের বিরুদ্ধে একা’ ম্যাচ আয়োজন করেন কাস্ত্রো। ৫৫০ জন নামি দাবাড়ু ম্যাচগুলি খেলেছিলেন। কিউবার গ্র্যান্ডমাস্টার সিলবিনো গার্সিয়া ১৫ জনের বিরুদ্ধে খেলেছিলেন। সেই বিশ্বরেকর্ড ভেঙে ২০০৪ সালে সান্তা ক্লারায় ফের একটি ‘অনেকের বিরুদ্ধে একা’ ম্যাচ আয়োজিত হয়। ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’ সিরিজের দ্বিতীয় পর্ব।

প্রবুদ্ধ ঘোষ

২.

“You know, Comrade Pachman, I don’t enjoy being a minister. I would rather play chess, or make a revolution in Venezuela.”- Ernesto Che Guevara.

কিউবার রাজনীতিতে বহু অনিশ্চয়তা, অস্থিরতার পরে ১৯৫৯ সালে বিপ্লব সংঘটিত হয়। স্বৈরাচারী বাতিস্তাকে সরিয়ে সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে নতুন সরকার গঠিত হয়। আর, নতুন সরকারের অন্যতম উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল দাবার ওপরে বিশেষ গুরুত্ব ন্যস্ত করা। সোভিয়েত মডেলের অনুসরণে দাবার ক্লাব, দাবার প্রতিযোগিতা ইত্যাদি পরিচালিত হতে থাকে। আর, এই ব্যাপারে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা যিনি নেন, তাঁর নাম আর্নেস্তো রাফায়েল গেভারা দে লা সেরনা।

কৈশোর থেকে দাবার প্রতি ভালোবাসা, কিন্তু মাঝে পেশাদারি কাজকর্ম ও বিপ্লবকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে দাবা থেকে সরে ছিলেন। তবে, প্রথম ভালোবাসা কি ভোলা যায়? তাই ১৯৬০ থেকেই নতুন উদ্যমে দাবা চর্চায় এবং নতুন প্রজন্মের দাবাড়ু তুলে আনার ব্যাপারে মন দিলেন তিনি। ততদিনে তিনি সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের ত্রাস– তাঁর সংক্ষিপ্ত নাম– চে গেভারা। মূলত চে-র উদ্যোগেই ১৯৬২ সাল থেকে নিয়মিত ক্যাপাব্ল্যাঙ্কা স্মারক আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হতে থাকে। চে-র ‘শাহাদাত’-এর পরেও এই প্রতিযোগিতায় ইউরোপ ও সোভিয়েতের স্বনামধন্য দাবাড়ুরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। চে-র ‘আদর্শ’ ছিলেন মিগুয়েল ন্যাইডর্ফ। দাবার ডেটাবেসে ন্যাইডর্ফের সঙ্গে চে-র খেলা একটি গেমের হদিশ মেলে। ন্যাইডর্ফ হাভানা দাবা ক্লাবে অনেকের বিরুদ্ধে একা (সাইমালটেনিয়াস) খেলেছিলেন। অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন চে। স্প্যানিশ বা রুই লোপেজ ওপেনিং শাখায় খেলা হয়েছিল। ওপেনিং শাখার দান-পর্যায় শেষ হওয়ার আগেই ড্র-এর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ন্যাইডর্ফ আর চে। কোনও নির্দিষ্ট পরিণতির দিকে যাওয়ার আগেই ড্র করে নিয়েছিলেন দু’জন। হয়তো রাজনৈতিক কোনও কাজে খেলা অসম্পূর্ণ রেখেই চলে যেতে হয়েছিল চে-কে। আরেকটু ব্যক্তিগত সময় পেলে মন দিয়ে দাবার প্রশিক্ষণ নিতেন, এই আক্ষেপও তিনি নাকি করেছিলেন কমিউনিস্ট মতাদর্শে বিশ্বাসী চেক গ্র্যান্ডমাস্টার পাকম্যানের কাছে।

Vintage 1962 Chess: Miguel Najdorf vs Ernesto Ché Guevara - YouTube
‘আদর্শ’ মিগুয়েল ন্যাইডর্ফের সঙ্গে দাবার লড়াইয়ে চে গেভারা

১৯৬২ সালে ‘হাভানা লিব্রে’ নামক যে হলে ক্যাপাব্ল্যাঙ্কা স্মারক দাবা প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়, তারও একটা ইতিহাস আছে। বাতিস্তার অনুগামীরা ‘হাভানা হিলটন’ নামে একটা বিলাসবহুল ক্যাসিনো বা জুয়াকেন্দ্র চালাত। বিপ্লবের পরে ওই জুয়াকেন্দ্র তুলে দিয়ে ‘হাভানা লিব্রে’ নামক হোটেলে রূপান্তরিত করে কাস্ত্রো সরকার। চে গেভারা, সরকারের কাছে আবেদন করে ওই হোটেলে একটি দাবার ক্লাব খোলেন। শুধু তাই নয়, ১৯৬২ সালের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতাটি আয়োজন করলেন, পুরস্কার-মূল্য ঘোষণা করলেন সরকারের তরফে। সেই সময়ের সবচেয়ে অভিজাত এই প্রতিযোগিতায় কে না খেলেছেন? ন্যাইডর্ফ, ভিক্টর করশনয়, বেন্ট লারসেন, এফিম গেলার, মিখাইল তাল, বরিস স্প্যাসকি, ভ্যাসিলি স্মাইস্লভ, উলফগ্যাং উলমার প্রমুখ বিখ্যাতরা। ১৯৬৫ সালে ববি ফিশারকে মোটা অঙ্কের ‘অ্যাপিয়ারেন্স ফি’ দিয়ে খেলানোর আয়োজন করেন কাস্ত্রো। রাজিও হন ফিশার। কিন্তু বাধ সাধে কিউবা-বিরোধী যুক্তরাষ্ট্রের সরকার। এবার উদ্যোগ নেন ক্যাপাব্ল্যাঙ্কার পুত্র। নিউ ইয়র্কের মার্শাল দাবা ক্লাবের সঙ্গে যোগাযোগ করে, টেলিমাধ্যমে ফিশারকে খেলানোর ব্যবস্থা করেন। ফিশারের মুভগুলো মুখে-মুখে কিউবার দাবার বোর্ডে বলে দিতেন তিনি। ইতিহাসের আশ্চর্য সমাপতন। একদা মার্শাল তাঁর প্রিয় প্রতিদ্বন্দ্বী ক্যাপাব্ল্যাঙ্কাকে সান সেবাস্তিয়ানের মতো অভিজাত দাবা প্রতিযোগিতায় তথা বিশ্বদাবায় পরিচিত করিয়েছিলেন। প্রায় ৫৪ বছর পরে ক্যাপাব্ল্যাঙ্কার পুত্র সেই উদ্যোগ নিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ফিশারের জন্য।

ববি ফিশার: বিশ্বসেরা দাবা প্রডিজি থেকে উন্মাদ হওয়ার গল্প - Roar বাংলা
ববি ফিশার

তবে, জটিলতা কম হল না ফিশারকে নিয়ে। ফিদেল কাস্ত্রো এবং লিন্ডন জনসনের মধ্যে রাজনৈতিক চাপান-উতোর হল, ফিশার হুমকি দিলেন এসব রাজনৈতিক বিতণ্ডায় তিনি খেলবেনই না। অবশেষ খেললেন। ২২ জন প্রতিদ্বন্দ্বী রাউন্ড-রবিন পদ্ধতিতে খেলার পরে খেতাব জিতলেন প্রাক্তন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন স্মাইস্লভ। ফিশার আধ-পয়েন্ট কম অর্জন করে চতুর্থ হলেন। কিন্তু লাতিন আমেরিকায় এই দাবা প্রতিযোগিতা সাড়া ফেলে দিল। আর্জেন্তিনা, ভেনেজুয়েলা, ব্রাজিলে দাবা প্রতিযোগিতার উৎসাহ বাড়ল। ১৯৬৬ সালে দাবা-ওলিম্পিয়াডের আয়োজন রাজনৈতিক দিক থেকেও বড় পদক্ষেপ ছিল কিউবার জন্য। ঠান্ডা যুদ্ধ এবং পরমাণু যুদ্ধের হুমকিকে শান্ত করে সোভিয়েত এবং যুক্তরাষ্ট্রের ক্রীড়াবিদদের নিয়ে সফল ওলিম্পিয়াড আয়োজন সামান্য ব্যাপার ছিল না। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এত বড় মাপের প্রতিযোগিতা দক্ষিণ আমেরিকার অন্য কোনও দেশ আয়োজন করতে পারেনি। প্রত্যেক দেশের দাবাড়ুদের বিমানভাড়া দেওয়া হয়েছিল। তাদের জন্য স্বতন্ত্র গাড়ির ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কাস্ত্রো প্রতিযোগিতার মাঝে অবসরে বিখ্যাত দাবাড়ুদের খুঁজে, তাঁদের বিপক্ষে খেলতে বসে যেতেন। তারপর সেই বোর্ডের খেলা ঘিরে অন্য দাবাড়ুদের মন্তব্য, দানের আলোচনা জমে উঠত।

ববি ফিশার ও ফিদেল কাস্ত্রো। হাভানা। ১৯৬৬ সাল।

তবে, আট ও নয়ের দশকে ক্যাপাব্ল্যাঙ্কা স্মারক প্রতিযোগিতা গুরুত্ব হারিয়েছিল। দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের শীর্ষস্থানীয় দাবাড়ুরা অংশ নিত। ২০০৫-’০৬ থেকে বিগত দেড় দশকে এই প্রতিযোগিতা হৃত শৌর্য পুনরুদ্ধার করেছে। সুপার গ্র্যান্ডমাস্টারদের অভিজাত প্রতিযোগিতায় পরিবর্তিত হয়েছে ফের। ইউক্রেনের ভ্যাসিলি ইভানচুক, ওয়েসলি সো, ভারতের কৃষ্ণাণ শশীকিরণ, আমেরিকার স্যাম স্যাঙ্কল্যান্ড, হ্যান্স নিম্যানরা প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়েছেন।

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….

শতরঞ্জ কে খিলাড়ি-র প্রথম পর্ব: তৃতীয় বিশ্ব থেকে উঠে আসছেন এক দাবাড়ু, যিনি আক্রমণাত্মক নীতির ধ্যানধারণা পাল্টে ফেলবেন

…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..

কাস্ত্রো সরকারের উদ্যোগে স্কুলস্তরে দাবাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। সংবাদপত্র, টিভি এবং রেডিও-তে নিয়মিত দাবার গেম সম্প্রচার ও বিশ্লেষণ করা হত। ২০০২ সালে হাভানার হোসে মার্তি স্কোয়্যারে ১০,০০০-এর বেশি দাবাড়ু নিয়ে একটি ‘অনেকের বিরুদ্ধে একা’ ম্যাচ আয়োজন করেন কাস্ত্রো। ৫৫০ জন নামি দাবাড়ু ম্যাচগুলি খেলেছিলেন। কিউবার গ্র্যান্ডমাস্টার সিলবিনো গার্সিয়া ১৫ জনের বিরুদ্ধে খেলেছিলেন। সেই বিশ্বরেকর্ড ভেঙে ২০০৪ সালে সান্তা ক্লারায় ফের একটি ‘অনেকের বিরুদ্ধে একা’ ম্যাচ আয়োজিত হয়। ১৩,০০০ দাবাড়ুর বিরুদ্ধে ৫০০ জন প্রতিষ্ঠিত দাবাড়ু খেলেছিলেন। আনাতোলি কারপভ ২০ জন দাবাড়ুর বিরুদ্ধে খেলেছিলেন সেই ম্যাচে।

দক্ষিণ আমেরিকার ক্রীড়ায় আর্জেন্তিনার কথা উঠলে তো ব্রাজিলের কথা বলতেই হয়! হেনরিক মেকিং। ছয়ের দশকে তাঁকে ‘বিস্ময় বালক’ বলে ডাকা হত। কারণ ক্যাপাব্ল্যাঙ্কার পরে এমন অল্পবয়সি তুখোড় দাবামেধার ক্রীড়াবিদ আর আসেননি। সাতের দশকে ফিডে-রেটিং অনুযায়ী শীর্ষ চার দাবাড়ুর মধ্যে ছিল তাঁর অবস্থান। সাতের দশকে যখন ফিশার-যুগ চলছে, উদীয়মান খেতাবজয়ী হিসেবে কারপভ উঠে আসছেন, তখনই হেনরিক কোস্তা মেকিংয়ের উত্থান। কারপভ, করশনয়, রবার্ট বায়ার্নদের সঙ্গে সমান তালে লড়ে নিজের স্থান পাকা করে নিয়েছিলেন হেনরিক। ব্রাজিলের হয়ে দাবা ওলিম্পিয়াডে ভালো ফল করলেন ১৯৭৪ সালে। ১৯৭৪ সালের ক্যান্ডিডেটস দাবার কোয়ার্টার ফাইনাল– করশনয় বনাম হেনরিক। অভিজ্ঞতা (করশনয় তার আগে তিনটি ক্যান্ডিডেটস খেলে ফেলেছেন) বনাম তারুণ্যের (হেনরিকের বয়স মাত্র ২১) লড়াই। অভিজ্ঞতা জিতেছিল শেষ অবধি– ৭.৫-৫.৫ ফলাফলে। কিন্তু দ্বাদশ রাউন্ডে হেনরিক দারুণ খেলে হারালেন করশনয়কে। রুই লোপেজ এক্সচেঞ্জ শাখায় খেলে কালোর রাজার দুর্গে ফাটল ধরালেন পনের-ব্যূহ সাজিয়ে।

হেনরিক মেকিং-এর সেই গেমপ্ল্যান

হেনরিক নাইট দিয়ে কালোর d4-এর পনটিকে মেরেছিলেন। দুঃসাহসী কিন্তু সঠিক সিদ্ধান্ত। পরের দান-পর্যায়ের নিখুঁত গণনা ছাড়া এই দানটি খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। সাদা একটি গুরুত্বপূর্ণ পন জিতে নেয়, যা এন্ড-গেমে নির্ণায়ক হয়ে ওঠে।

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..

এখনও দক্ষিণ আমেরিকার দাবায় এই সমস্যাই প্রধান। আর্থিক প্রতিবন্ধকতার জন্য তরুণ প্রতিভারা বিদেশি গ্র্যান্ডমাস্টারদের কাছে প্রশিক্ষণ নিতে পারেন না। সরকারি সদিচ্ছার অভাবে শীর্ষস্থানীয় দাবাড়ুদের নিয়ে নিয়মিত দাবার প্রতিযোগিতা আয়োজন করা যায় না। তার ওপর বিষফোঁড়ার মতো জেগে থাকে প্রবহমান রাজনৈতিক টালমাটাল।

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..

১৯৭৮ সালে কেরিয়ারের সেরা রেটিং হেনরিকের, ২৬৩৫, যা এই সময়েও যথেষ্ট ঈর্ষণীয়। তারপরই হঠাৎ দাবা থেকে হারিয়ে গেলেন। শারীরিক অসুস্থতার সঙ্গে যোগ হল আর্থিক সমস্যা। দক্ষিণ আমেরিকার বহু দাবাপ্রতিভা বিকশিত হতে পারেনি আর্থিক অনটনের কারণে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে খেলতে যাওয়ার আর্থিক বাধার সম্মুখীন হতে হয় তাঁদের। কাস্ত্রো-চে-র মতো দাবায় উৎসাহী শাসক ক’জন হয়? যাঁরা ইশকুল-পড়ুয়াদের মধ্যে দাবাকে পৌঁছে দিয়েছিলেন এবং দাবায় বিপুল পৃষ্ঠপোষকতা করতেন।

এখনও দক্ষিণ আমেরিকার দাবায় এই সমস্যাই প্রধান। আর্থিক প্রতিবন্ধকতার জন্য তরুণ প্রতিভারা বিদেশি গ্র্যান্ডমাস্টারদের কাছে প্রশিক্ষণ নিতে পারেন না। সরকারি সদিচ্ছার অভাবে শীর্ষস্থানীয় দাবাড়ুদের নিয়ে নিয়মিত দাবার প্রতিযোগিতা আয়োজন করা যায় না। তার ওপর বিষফোঁড়ার মতো জেগে থাকে প্রবহমান রাজনৈতিক টালমাটাল। হুয়ান ব্ল্যাঙ্কো, ভেনেজুয়েলার একজন দাবাড়ু এবং দাবা-গবেষক। দাবা এবং শিক্ষাব্যবস্থার আন্তঃসম্পর্ক নিয়ে গবেষণা সন্দর্ভ লিখেছেন। বেসবলের পরেই দাবা ভেনেজুয়েলার দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্রীড়া– একথা উল্লেখ করেও তাঁর আক্ষেপ, ভেনেজুয়েলার ক্রীড়ামন্ত্রকের উদাসীনতা ও দুর্নীতির জন্য বিশ্বমানের দাবাড়ু তৈরি হচ্ছে না। আর্থ-রাজনৈতিক সংকট আর মাত্রাছাড়া অব্যবস্থার জন্য দাবাড়ুরা আন্তর্জাতিক স্তরের প্রতিযোগিতাগুলিতে যেতে পারেন না। অনেক সময় রুজি-রোজগারের চাপে দাবা চর্চা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন প্রতিভাবান দাবাড়ুরা। ব্ল্যাঙ্কো নিজেও দেশ ছেড়ে প্রথমে ইকুয়েডর, তারপর পেরুতে গেছেন। প্রশিক্ষণও দিয়েছেন। কিন্তু এইসব দেশেও দাবার উচ্চমানের পরিকাঠামোর অভাব লক্ষ্য করেছেন। মানবসম্পদের অপচয়ের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। ভেনেজুয়েলায় উগো সাভেজের জমানায় ক্রীড়ামন্ত্রক অনেক সদর্থক উদ্যোগ নিয়েছিল। দাবাড়ুদের আর্থিক সাহায্য করা হত সরকারি তরফে। ইশকুল, কলেজের পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল দাবা, ফলে জনপ্রিয়তাও বেড়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে সংকট আর দুর্নীতি সব গ্রাস করে নিয়েছে। আর্জেন্তিনার মোট গ্র্যান্ডমাস্টারের সংখ্যা ২৩ জন, ব্রাজিলের ১৫, পেরুর ৮, ভেনেজুয়েলা, ইকুয়েডর এবং বলিভিয়ার ১ জন করে এবং কিউবার ২৪ জন।

যাঁর অনুল্লেখে এই নিবন্ধ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে, তাঁর নাম রোজেলিও ওর্তেগা। ১৯৫২ সালে এবং ১৯৬২ থেকে ১৯৬৮ প্রত্যেকটি দাবা-ওলিম্পিয়াডে কিউবার প্রতিনিধিত্ব করেছেন ওর্তেগা। ক্যাপাব্ল্যাঙ্কা দাবা ক্লাবে তাঁর দাবা চর্চা শুরু হয়েছিল। একটু বেশি বয়সে দাবা খেলতে শুরু করেছিলেন, কিন্তু অল্পদিনেই নজর কেড়েছিলেন। ১৯৫২-র দাবা প্রতিযোগিতাতে অংশ নিয়েছিলেন বটে, তবে ভালো ফল করতে পারেননি। সেই বছরেই হেলসিঙ্কি ওলিম্পিয়াডে দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করলেন। ওর্তেগার দাবা-কেরিয়ারের উড়ান শুরু হল ১৯৫৮ সালে। কিউবার জাতীয় দাবায় বিজয়ী হলেন। ইউরোপের প্রতিযোগিতায় আমন্ত্রণ পেলেন। যুক্তরাষ্ট্র এবং কিউবার সম্পর্কের অবনতির সময়েও রুবিনস্টাইন স্মৃতি প্রতিযোগিতায় খেলার আমন্ত্রণ পেলেন ১৯৬৩ সালে। ১৯৬৬ সালে অবিস্মরণীয় রেকর্ড গড়লেন ওর্তেগা। জাতীয় দাবার শীর্ষ ২৫ দাবাড়ুর রাউন্ড-রবিন (প্রত্যেকে প্রত্যেকের বিরুদ্ধে খেলবে) পদ্ধতির প্রতিযোগিতায় অপরাজিত থাকলেন ২৪টি গেমে ২১ পয়েন্ট সংগ্রহ করে।

তুখোড় কৌশলসন্ধানী দৃষ্টি ছিল ওর্তেগার। কালো নিয়ে অধিকাংশ দাবাড়ু যেখানে রক্ষণাত্মক নীতি নেন, ওর্তেগা সেখানে পাল্টা আক্রমণের নীতি নিতেন। নিও-রোমান্টিক দাবানীতি। কিউবার দাবার ইতিহাসে ওর্তেগার আগে আর কোনও আফ্রো-কিউবান দাবাড়ু এমন সাফল্য অর্জন করতে পারেননি। ওর্তেগার দাবাপ্রতিভায় মুগ্ধ ছিলেন আর্নেস্তো চে গেভারা। ১৯৬১ সালে কিউবার শিল্পমন্ত্রকের উদ্যোগে ওর্তেগা একটি ‘অনেকের বিরুদ্ধে একা’ (সাইমালটেনিয়াস) ম্যাচে অংশ নেন। সেখানেই চে তাঁর বিরুদ্ধে খেলেন। খেলাটি এরকম হয়েছিল–

রোজেইও ওর্তেগা (সাদা) বনাম চে গেভারা (কালো)

1. Nf3 d5 2. e3 e6 3. d4 Nf6 4. Bd3 g6 5. O-O Bg7 6. b3 O-O 7. Bb2 b6 8. Nbd2 Na6 9. Ba3 c5 10. Ne5 Qc7 11. Rc1 Nd7 12. f4 Nb4 13. Bxb4 cxb4 14. e4 Qc3 15. Ndf3 dxe4 16. Bxe4 Qe3+ 17. Kh1 Qxe4 18. Ng5 Qd5 19. c4 bxc3 20. Rxc3 Bb7 21. Ngf3 Rac8 22. Rd3 Ba6 0-1

Rogelio Ortega: Afro-Cuban Maestro - The Chess Drum
দাবার লড়াইয়ে চে-র বিরুদ্ধে চাল দিচ্ছেন ওর্তেগা

কুইন পন ওপেনিং-এর কোলে শাখায় খেলাটি হয়েছিল। চে ওর্তেগার একটি রুক জিতে নেওয়ার পরে পরাজয় স্বীকার করে নেন ওর্তেগা। ১৯৬৬ সালে কিউবায় অনুষ্ঠিত দাবা ওলিম্পিয়াডে নিয়মিত হাজির থাকতেন চে। ওর্তেগা এবং কিউবার অন্য দাবাড়ুদের উৎসাহ দিতেন। সেবারই প্রথম এক কৃষ্ণাঙ্গ দাবাড়ুর নেতৃত্বে ওলিম্পিকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে কিউবা। তখন ওর্তেগার ৫১ বছর বয়স, কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর দাবা আরও পরিণত হয়েছে। ইউরোপের কয়েকটি দেশেও সাফল্য অর্জন করেছিলেন ওর্তেগা। চিগোরিন স্মৃতি প্রতিযোগিতা, রুবিনস্টাইন স্মৃতি প্রতিযোগিতা, লাস্কার স্মৃতি প্রতিযোগিতায় তৎকালীন সেরাদের বিরুদ্ধে খেলেছেন।

চে গেভারা ১৯৬৬ দাবা- ওলিম্পিয়াডের ম্যাচ দেখছেন

লাতিন আমেরিকার দাবার আইকন ক্যাপাব্ল্যাঙ্কা, ন্যাইডর্ফ, ওর্তেগার মতো দাবাড়ুরা। কাস্ত্রো এবং চে-র মতো শাসকের বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি কিউবার দাবাকে বহুদূর এগিয়ে দিয়েছে। কিন্তু, কিছু সমস্যা প্রকট হয়ে রয়ে গেছে এখনও। আর্থিক সংকট, রাজনৈতিক অশান্তি-অনিশ্চয়তা এবং উন্নত পরিকাঠামোর অভাব তো রয়েছেই, আরেকটি বড় সমস্যা আধুনিক দাবাচর্চার রীতিনীতিতে সড়গড় না হওয়া। ইন্টারনেট এবং দাবা-ইঞ্জিনের অত্যাধুনিক রকমফের দাবা অনুশীলনের খোলনলচে পাল্টে দিয়েছে। অথচ কিউবায় খুব কম মানুষের বাড়িতে ইন্টারনেট সংযোগ রয়েছে। আর্থিক ব্যয়ভারও যথেষ্ট বেশি। বিদেশি প্রশিক্ষকদের কাছে প্রশিক্ষণ নেওয়া সম্ভব হয় না অনেকের পক্ষে। তাছাড়া বিদেশের নামি প্রতিযোগিতায় খেলে রেটিং বাড়ানো এবং নর্ম পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ন্যূনতম অর্থ জোগাড় করতে পারেন না অনেকেই। ব্রাজিলের তরুণ প্রতিভা রায়ান ওয়েসলি কায়তানোর স্বপ্ন ইউরোপে খেলতে যাওয়া, গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়া। জাতীয় জুনিয়র দাবা চ্যাম্পিয়ন কায়তানো দু’বছর আগে চেস-ডট-কমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে একথা জানিয়েছিলেন। পরিবারের সামর্থ্য থাকলে অনেক দাবাড়ু যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব নিয়ে নেন। উন্নত সুযোগসুবিধা আর উন্নত প্রশিক্ষণের আশায় তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করেন বাধ্যত। সমস্ত প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করেও লেইনার ডোমিনিগেজ পেরেজের মতো দাবাড়ু উঠে এসেছেন, যিনি ২০০৮ সালে ব্লিৎজ বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। বিশ্ব র‍্যাঙ্কিংয়ে অষ্টম স্থানার্জন করেছেন। তবে, ২০১৮ থেকে আমেরিকার স্থায়ী নাগরিকত্ব নিয়েছেন তিনি। দক্ষিণ আমেরিকায় রেজিনা রিবেরিও-র লড়াই রয়েছে। ব্রাজিলের মহিলা আন্তর্জাতিক মাস্টার রেজিনা ৮ বার ব্রাজিলের জাতীয় দাবায় বিজয়ী। স্বদেশীয় দাবাড়ুদের প্রশিক্ষণ দিয়ে ওলিম্পিয়াডের দল প্রস্তুত করেছেন। তালিয়া সেরভান্তেস লান্দেইরো হাভানার রাস্তায় দাবা খেলতে খেলতে শিখেছেন। প্রায়শই ‘মেয়েরা দাবা খেলতে পারে না’– এমন বোধহীন মন্তব্যকে প্রত্যাহ্বান জানিয়ে জিতেছেন, ২৩০০ রেটিং পার করেছেন, ফিডে মাস্টার হয়েছেন। বিশ্ব দাবা সংস্থা সম্প্রতি দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশে ঘুরে দাবা ফেডারেশনের অবস্থা, দাবাড়ুদের সম্ভাবনা ইত্যাদি খতিয়ে দেখেছেন। প্রয়োজনীয় সাহায্য করার কথাও জানিয়েছে। এখন অপেক্ষা দাবায় উৎসাহী দুর্নীতিমুক্ত সরকারের এবং ক্যাপাব্ল্যাঙ্কা বা ন্যাইডর্ফের মতো কোনও আইকনের। তাহলে হয়তো দক্ষিণ আমেরিকা থেকে আরও অনেক গ্র্যান্ডমাস্টার উঠে আসতে পারবেন। ছন্নছাড়া মিডলগেম আর পরিকল্পনাহীন দান-পর্যায় চলছে। এটুকু সামলে উঠতে পারলে এন্ড-গেমে দক্ষিণ আমেরিকা দারুণ ফলাফল দেবেই– কারণ, বিশ্বের অন্যতম সেরা এন্ড-গেম বিশারদ ক্যাপাব্ল্যাঙ্কা তো দক্ষিণ আমেরিকারই!

(চলবে)

 

তথ্যঋণ

এডওয়ার্ড উইন্টার, রিকার্ডো পামা, হোসে রাউল ক্যাপাব্ল্যাঙ্কার লেখা বই

চেস-ডট-কম, চেসড্রাম, চেসগেমস-ডট-কম, দ্যকিউবানহ্যান্ডশেক প্রভৃতি ওয়েবসাইট

হুয়ান ব্ল্যাঙ্কো, রায়ান কায়তানো, তালিয়া সের্ভান্তেসের সাক্ষাৎকার