স্থায়ী উপাচার্য নিয়োগের ক্ষমতা যাতে রাজ্য নিজের হাতে রাখতে পারে, তার জন্য মুখ্যমন্ত্রীকে আচার্য করার প্রস্তাব পেশ হয়েছে বিধানসভায়। বিল গিয়েছে রাজভবনে। সেখানে কোল্ড স্টোরেজে পড়ে রয়েছে। উল্টোদিকে রাজ্যপালও স্থায়ী উপাচার্য নিয়োগ না করে অস্থায়ী উপাচার্য নিয়োগ করে খেলায় গতি এনে দিয়েছে। এই নিয়োগ করছেন, এই সরিয়ে দিচ্ছেন।
ফাঁসুড়ে। নতুন ভ্যাম্পায়ার। রাক্ষস প্রহর। ক্যাম্পাসের নরখাদক। পুতুলদের ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়ানো, মাফিয়া-রাজ। জেমস বন্ড। নিঃশব্দ প্রহেলিকা। বেশ একটা রহস্য-রোমাঞ্চ-অ্যাডভেঞ্চার গল্পে ব্যবহৃত সব শব্দ বলে বোধ হচ্ছে। গা শিউরে ওঠা! রোম খাড়া হয়ে যাওয়া। মেরুদণ্ড দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে যাওয়ার মতো। কিছু শব্দ আবার আপনাকে একটু কমিক রিলিফও দিতে পারে। এই যেমন গোপাল ভাঁড় কিংবা মহম্মদ বিন তুঘলকের কাজকর্ম। বল একবার এ-প্রান্তে। পরমুহূর্তেই বল অন্য দলের পেনাল্টি বক্সে!
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে রাজভবন বনাম শিক্ষা দপ্তর দড়ি টানাটানিতে একটা গতি এসেছে, সেটা খবরে চোখ রাখলেই বোঝা যাচ্ছে। টানটান উত্তেজনাও রয়েছে। এই মধ্যরাতে উপচার্য বদলে গেল তো পরের মধ্যরাতের গোপন চিঠি ঘিরে অ্যাড্রিনালিন রাশ। এই শিক্ষাজগতের লোকজন রাস্তায় নেমে প্রতিবাদে সরব, তো তার পরই কাউন্টার অ্যাটাকে রাজভবন থেকে ভিডিও বার্তা। এ বলে শেষ দেখে ছাড়ব, তো ও বলে টিট ফর ট্যাট। রাজ্যের শিক্ষা নিয়ে শিক্ষিত মানুষের এমন লড়াইয়ে শিক্ষার ভাবমূর্তি থেকে ভাব আর মূর্তি আলাদা হয়ে বাকিদের তুমুল কনফিউশনে ফেলে দিচ্ছে।
অবশ্য সলতে অনেক দিন থেকেই পাকছে। দড়ি টানাটানিতে সলতে মোটাও হয়ে গিয়েছে অনেকটাই। ফলে শিক্ষা নিয়ে রাজ্য ভার্সেস রাজ্যপাল দ্বন্দ্বের যে আশু সমাধান এখনই হচ্ছে না, তা স্পষ্ট। কিন্তু এর জেরে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাজকর্মে সমস্যা হচ্ছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এটা বোধ করি ভুল হবে না বলা যে, মাথার উপর এমন স্টার-ওয়র্স চললে, যাঁরা পড়বেন, বা যাঁরা পড়াবেন, তাঁদের মাথাও কিঞ্চিৎ ঝিমঝিম করতেই পারে। আচার্য কে হবে? কার কথায় কে উপাচার্য হবেন? রাজ্যপাল যা চাইবেন আচার্য হিসাবে, সেটাই মেনে নিতে হবে, না কি রাজ্যের ভূমিকাকে অস্বীকার করা যাবে না? আইন ও সাংবিধানিক সব চুলচেরা বিচার ও বিশ্লেষণ রয়েছে। চুম্বকে অবশ্য, কেন্দ্র বনাম রাজ্যের সেই চিরাচরিত লড়াই। কেন্দ্র টু নবান্ন ভায়া রাজভবন!
স্থায়ী উপাচার্য নিয়োগের ক্ষমতা যাতে রাজ্য নিজের হাতে রাখতে পারে, তার জন্য মুখ্যমন্ত্রীকে আচার্য করার প্রস্তাব পেশ হয়েছে বিধানসভায়। বিল গিয়েছে রাজভবনে। সেখানে কোল্ড স্টোরেজে পড়ে রয়েছে। উল্টোদিকে রাজ্যপালও স্থায়ী উপাচার্য নিয়োগ না করে অস্থায়ী উপাচার্য নিয়োগ করে খেলায় গতি এনে দিয়েছে। এই নিয়োগ করছেন, এই সরিয়ে দিচ্ছেন। অবস্থা এমনই যে শিক্ষা দপ্তরের খবর আসছে সবই রাত-বিরেতে। রাজভবন বনাম নবান্নের সংঘাতে নিত্যনতুন মাত্রা যোগ হচ্ছে নিত্যদিনই। পদাধিকার বলে রাজ্যপাল আচার্য। তাঁর নিয়োগ করা অস্থায়ী উপাচার্য নিয়োগ মানতে পারছে না নবান্ন। উল্টোদিকের অভিযোগও কম নেই। রাজ্য সরকার তাঁদের পছন্দমতো অধ্যাপকদের উপাচার্য করেছে, তাই রাজ্যপালের পদক্ষেপ। রাজভবনের নির্দেশ মেনে চললে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতন ও আর্থিক বরাদ্দ বন্ধ করে দেওয়ার হুঁশিয়ারিও মুখ্যমন্ত্রী দেওয়ার পরই শিক্ষামন্ত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারদের নিয়ে বৈঠকে বসে পড়েছেন। সেখানে উপস্থিত-অনুপস্থিতির বিষয়টিও এখন রাজনীতির রঙের চশমার নিচে।
শো-কজও করা হয়েছে অনুপস্থিতদের। এ বলছে, ও ভয় দেখাচ্ছে। ও বলছে, সে ভয় দেখাচ্ছে। কেউ পদত্যাগ করছেন, কেউ বৈঠকে যোগ দেবেন কি না বুঝতে পারছেন না। সেই পুরনো প্রবাদটা আর বললাম না বটে, কিন্তু মাঝখানে থাকা উলুখাগড়ার কি হচ্ছে সে-ই জানে!
রাজভবনের মতে, রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হলেন উপাচার্য। রেজিস্ট্রার থেকে সহ-উপাচার্য, প্রত্যেকে তাঁরই নির্দেশ মেনে চলবেন। সংবিধান, ইউজিসি এবং সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তেমনই বলা রয়েছে। কিন্তু রাজ্যের বক্তব্যও স্পষ্ট, কোনও আলোচনা বা অনুমোদন ছাড়াই যেভাবে একতরফা রাজ্যপাল আচার্য সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছেন এবং তা রূপায়ণ করার চেষ্টা চালাচ্ছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও আইনেই আচার্যের এমন ক্ষমতার কথা বলা নেই। ২০১৭ সালে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশোধিত আইন এবং ২০১৯ সালে তৈরি বিধিও সেটাই বলছে।
যুক্তি ও পাল্টা যুক্তির শেষ নেই। শেষ হওয়ারও কথা নয়। রাজনৈতিক টানাপোড়েনও থাকবে নিশ্চয়ই। কিন্তু এর ফাঁক গলে না আরও কিছু মেধা ফসকে বাইরে চলে যায়, সেটাই চিন্তার। আসলে সিঁদুরে মেঘ দেখলে যা হয় আর কী!