৭ বছর ধরে রাজস্থানের একাধিক আদালত এটাই প্রমাণ করেছে, রূপকে জোর করে ‘সতী’ করা হয়নি। রাজস্থান সরকারও তার প্রতিবাদ করেনি। কেন্দ্রীয় সরকার যে সক্রিয় হবে, সে আশা বৃথা। আজ শেষ অভিযুক্তও ছাড়া পাওয়ায় ‘সতী’ মায়ের মাহাত্ম্যই আরও দৃঢ় হল।
প্রচ্ছদ অর্ঘ্য চৌধুরী
ছোট্ট কোনও ঘটনা। কিন্তু তার অভিঘাত অনেক সময় ভয়ংকর হতে পারে। যেমন, কোনও সামান্য ক্ষত বিষিয়ে গিয়ে হতে পারে গ্যাংগ্রিন, সেপ্টিসেমিয়া। অঙ্গহানি থেকে শুরু করে প্রাণসংশয়ের সম্ভাবনাও থেকে যায়। গত মাসেই দুর্গাপুজো, নবরাত্রি, ধনতেরাস, দীপাবলির মতো দেশব্যাপী উৎসবের আবহে এমনই একটি ছোট্ট ঘটনা হয়তো অনেকের নজর এড়িয়ে গিয়েছে।
ভারতের সর্বশেষ সতীদাহ মামলায় অষ্টাদশী রূপ কানওয়ারের মৃত্যুকে ‘মহিমান্বিত’ করার ঘটনায় অভিযুক্ত ৮ জনকে প্রমাণের অভাবে বেকসুর মুক্তি দিয়েছে জয়পুরের একটি বিশেষ আদালত। ৩৭ বছর আগের যে ঘটনা গোটা দেশ তথা বিশ্বকে আলোড়িত করেছিল। বিশ্বের দরবারে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়েছিল ভারতের।
অনেকের হয়তো স্মরণে নেই। তাই একটু ফ্ল্যাশব্যাকে ফিরে যেতে হবে। বিয়ের মাত্র ৮ মাসের মধ্যে অসুস্থতার জেরে স্বামী মাল সিং শেখাওয়াতের মৃত্যু হয়। তারপর ১৯৮৭-র ৪ সেপ্টেম্বর স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় বসে প্রাণ ‘বিসর্জন’ দেন রূপ। অন্তত পরিবারের দাবি ছিল তেমনই। পরে পুলিশি তদন্তে উঠে আসে, ওই তরুণীকে ‘বাধ্য’ করা হয়েছিল। সাজিয়ে-গুছিয়ে দেওরালা এবং পার্শ্ববর্তী গ্রাম থেকে হাজার হাজার মানুষ ‘শোভাযাত্রা’ করে সতীদাহ করে।
পরের ঘটনা আরও মারাত্মক! গ্রামে ‘সতী মা’-র মন্দির তৈরি করে বার্ষিক চুনরি মহোৎসবের আয়োজন করা হয়। তখন বাধ্য হয়েই ৪৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে রাজস্থান সরকার। তারপর ৩৭ বছর কেটে গেল, কেউ শাস্তি পেল না! ২৫ জন ২০০৪ সালেই মুক্তি পেয়েছে, ৮ জন চলতি বছর। ৪ জন ফেরার, বাকি ৮ জন ভবলীলা সাঙ্গ করে পরপারে। পুলিশ, সরকারি আইনজীবী এটাই প্রমাণ করতে পারেনি যে, সতীদাহ হয়েছিল, ‘মহিমান্বিত’ করা তো অনেক পরের বিষয়! ১৯৯৬ সালেই রূপের শ্বশুর, দেওর-সহ ৩২ জনকে খুনের মামলা থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। এখনও বহাল তবিয়তে রয়েছেন রূপের দাদা গোপাল সিং রাঠোর। তাঁর সাফ কথা, ‘শুরু থেকেই বলছি, কোনও প্ররোচনা বা ভয় দেখানো হয়নি। ও স্বেচ্ছায় এটা করেছে। পরিবারের কোনও ভূমিকা নেই। সরকারও তো কিছু প্রমাণ করতে পারল না।’
প্রমাণ নেই, তাই সাত খুন মাফ! রাজা রামমোহন রায় কি এই দিনের কথা ভাবতে পেরেছিলেন? বা উইলিয়াম কেরির মতো ধর্মযাজকরা? তাঁদের চেষ্টায় ঔপনিবেশিক আমলে ১৮২৯ সালের ৪ ডিসেম্বর বাংলার তৎকালীন গভর্নর লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক সতীদাহ প্রথা রদ করেন। ১৮৬১ সালে সতীদাহের বিরুদ্ধে সাধারণ নিষেধাজ্ঞা জারি করেন রানি ভিক্টোরিয়া। আইনত নিষিদ্ধ হলেও বিশ শতকের শেষপর্যন্ত ভারতে সতীদাহর বিচ্ছিন্ন ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে। স্বাধীনোত্তর ভারতে শুধু রাজস্থানেই সরকারি মতে ২৯টি সতীদাহের ঘটনা ঘটেছিল। রূপ কানোয়ারের ঘটনার পর ভারত সরকার সতীদাহ (প্রতিরোধ) আইন, ১৯৮৭ প্রণয়ন করে। বলা হয় যে, সতীদাহকে সাহায্য বা মহিমান্বিত করা অপরাধ। তারপরেও ২০০২-এ মধ্যপ্রদেশের পান্না জেলায় স্বামীর চিতায় প্রাণ দেন কুত্তু নামে এক মহিলা। ২০০৬-এ উত্তরপ্রদেশের ফতেপুরে রারি-বুজুর্গ গ্রামে সতী হন বিদ্যাবতী। সে বছরেই মধ্যপ্রদেশের সাগর জেলায় স্বামীর চিতায় প্রাণ দেন জনকরানি। ২০০৮-এ ছত্তিশগড়ের কাসডোল ব্লকে স্বামীর চিতায় ঝাঁপ দিয়ে আত্মঘাতী হন লালমতি ভার্মা। ২০২০ সাল পর্যন্ত ভারতে অন্তত ২৫০টি সতী মন্দিরের হদিশ মেলে, যেখানে নিয়মিত পূজাপাঠ হত। যদিও বৈদিক সাহিত্য, আদি ধর্মসূত্র বা ধর্মশাস্ত্রে সতীদাহের উল্লেখ নেই বলে জানিয়েছেন ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভিড ব্রিক, পান্ডুরঙ্গ বামন কানের মতো পণ্ডিত। কারণ বৈদিক মতে, আত্মহত্যা পাপ।
………………………………………………………
এখনও রাজস্থানে যথেষ্ট আকর্ষণীয় ও জনপ্রিয় প্যাকেজ। উদাহরণ? নিম কা থানা জেলায় দেওরালা গ্রামেই রূপের সতী হওয়ার জায়গায় গড়ে উঠেছে ‘অস্থায়ী’ সতী মন্দির। শোভা পাচ্ছে স্বামীর সঙ্গে রূপের ছবি। সেখানে আরও বিস্তৃত ও বৃহত্তর মন্দির তৈরির দাবি এখনও থিতিয়ে যায়নি। নতুন লাল চুনরি, নারকেল ও পোড়া ধূপকাঠি এখনও সেই অস্থায়ী মন্দিরকে ঘিরে থাকে। গোটা রাজস্থান তো বটেই, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাত থেকে নিয়মিত ভক্তদের আগমন হয়। আর তা দেখে আশাবাদী গ্রামবাসীরা বলেন, ‘মন্দির ওহি বনায়েঙ্গে।’
………………………………………………………
শুধু প্রাচীন অথর্ববেদে প্রতীকী সতীদাহের উল্লেখ রয়েছে। পরে অপরার্কের ভাষ্যতে বলা আছে, ওই ব্রত প্রত্যাহার করে প্রজাপত্য ব্রত উদযাপন করে পাপস্খালন করতে হবে। মনুস্মৃতি, যাজ্ঞবল্ক্যস্মৃতি ও নারদস্মৃতিতে সতীদাহের উল্লেখ নেই। অনেক পরে লিখিত বিষ্ণুস্মৃতি ও পরাশরস্মৃতিতে সতীদাহের সমর্থন মেলে। এরপর ধীরে ধীরে ধর্মব্যবসায়ী ও সম্পত্তিলোভী আত্মীয়দের আনুকূল্যে জাঁকিয়ে বসেছিল এই প্রথা। যদিও আইনি বাধায় ও কালের নিয়মে তা কার্যত ‘অবলুপ্ত’।
তাহলে ৩৭ বছর পর রূপ কানোয়ার মামলার আর কোনও প্রাসঙ্গিকতা আছে কি? একটু তলিয়ে দেখলে বিষয়টি কিন্তু খুব হালকাভাবে নেওয়ার উপায় নেই। হাজার হাজার লোকের সামনে ঘটে যাওয়া সত্ত্বেও কোনও সাক্ষী-সাবুদ পায়নি প্রশাসন। ভয়ে হোক বা ভক্তিতে, কুসংস্কারের বশে কেউ সাক্ষ্য দিতে এগিয়ে আসেনি। তারা এই ঘটনাকে ‘অপরাধ’ বলে মনেই করে না। রূপের নিজের পরিবারও সতীদাহকে ‘ন্যায্য’ মর্যাদা দিচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, ‘সতী অর্থনীতি’। যা এখনও রাজস্থানে যথেষ্ট আকর্ষণীয় ও জনপ্রিয় প্যাকেজ। উদাহরণ? নিম কা থানা জেলায় দেওরালা গ্রামেই রূপের সতী হওয়ার জায়গায় গড়ে উঠেছে ‘অস্থায়ী’ সতী মন্দির। শোভা পাচ্ছে স্বামীর সঙ্গে রূপের ছবি। সেখানে আরও বিস্তৃত ও বৃহত্তর মন্দির তৈরির দাবি এখনও থিতিয়ে যায়নি। নতুন লাল চুনরি, নারকেল ও পোড়া ধূপকাঠি এখনও সেই অস্থায়ী মন্দিরকে ঘিরে থাকে। গোটা রাজস্থান তো বটেই, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাত থেকে নিয়মিত ভক্তদের আগমন হয়। আর তা দেখে আশাবাদী গ্রামবাসীরা বলেন, ‘মন্দির ওহি বনায়েঙ্গে।’
৩৭ বছর ধরে রাজস্থানের একাধিক আদালত এটাই প্রমাণ করেছে, রূপকে জোর করে ‘সতী’ করা হয়নি। রাজস্থান সরকারও তার প্রতিবাদ করেনি। কেন্দ্রীয় সরকার যে সক্রিয় হবে, সে আশা বৃথা। আজ শেষ অভিযুক্তও ছাড়া পাওয়ায় ‘সতী’ মায়ের মাহাত্ম্যই আরও দৃঢ় হল।
প্রশ্ন হল, এ যুগেও কি সেকেলে ধ্যানধারণার শেকল কেটে বের হতে পেরেছে তথাকথিত আধুনিক সমাজ? আক্ষরিক অর্থে হয়তো সতীদাহ বন্ধ হয়েছে, কিন্তু এই প্রথা বন্ধের ভাবনা কি বাস্তবায়িত করা গিয়েছে? রক্ষণশীল হিন্দুদের কঠোর ও নৃশংস ধর্মীয় বিধি থেকে উদ্ধার করতে গিয়ে রামমোহন, বিদ্যাসাগরের মতো মনীষীকে কম আক্রমণের মুখে পড়তে হয়নি। স্বাধীন ভারতে? সেখানেও হিন্দু নারীদের আইনি অধিকার দেওয়ার বিরোধিতা করেছিলেন ভারতীয় জনতা পার্টির পূর্বসূরিরা। ভারতকে ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ ঘোষণা করতে জনমত তৈরির চেষ্টা চলছে। সেই হিন্দু রাষ্ট্রে নারীর ক্ষমতা কি সুরক্ষিত থাকবে?
রাষ্ট্র কোনও নৈর্ব্যক্তিক ব্যবস্থা নয়। দেশের মানুষ, সরকার মিলেই তৈরি হয় রাষ্ট্র। তারাই যদি অন্ধ হয়, ‘সতী’ মাহাত্ম্য প্রচারে পরোক্ষ সমর্থন জোগায়, তাহলে সমূহ বিপদ! রবীন্দ্রনাথ কবেই বলে গিয়েছিলেন, ‘ধর্মের বেশে মোহ যারে এসে ধরে, অন্ধ সে জন মারে আর শুধু মরে’। আশঙ্কা, বিশ্বকবির অন্তর্দৃষ্টি-ই হয়তো দেশে বাস্তবায়িত হতে চলেছে।
……………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………….
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved