তুই আটকে পড়েছিলি– ওই কমলালেবুর দেশ থেকে যতটা দূরে ছিলাম আমরা, ঠিক ততটাই দূরে, নিজের শৈশব থেকে। যে কমলালেবু গাছগুলোকে একজন কৃষক চলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এতদিন চাষ করে এসেছে, যত্ন করেছে, তাতে যদি আজ জল দিতে শুরু করে অন্য কেউ, তবে তো সেগুলো দুমড়ে যাবে, যাবেই। ঘাসান কানাফানি-র ‘ল্যান্ড অফ স্যাড অরেঞ্জেস’ গল্পটির অনুবাদ– ‘বিষণ্ণ কমলালেবুর দেশে’। ভাষান্তর বাসু আচার্য-র।
জাফা থেকে যখন আমরা একর্ রওনা হলাম, তখন আমাদের মধ্যে বিষণ্ণতার লেশমাত্র ছিল না। প্রতি বছর উৎসবের মরসুমে লোকে যেমন অন্য শহরে বেড়াতে যায়, আমাদের ব্যাপারটা ছিল ঠিক সেই রকম।
এমনিতে ওখানে সময়টা স্বাভাবিকভাবেই কেটেছিল আমাদের, তেমন কোনও অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটেনি। তখন আমি বেশ ছোট। স্কুল যাওয়ার ব্যাপার ছিল না, ফলে দিনগুলো উপভোগই করছিলাম।
কিন্তু একর্-এর ওই ভয়াবহ হামলার রাতে পুরো ছবিটা যেন ধীরে ধীরে পাল্টে যেতে লাগল, সমস্ত বিষয়গুলো পরিষ্কার হতে লাগল আমার চোখের সামনে। পুরুষদের সীমাহীন হতাশা আর মহিলাদের করুণ প্রার্থনার মধ্যে কেটেছিল সেই রাত। অত্যন্ত নিষ্ঠুর আর তেতো একটা রাত।
তুই বা আমি, কিংবা আমাদের বয়সি অন্য কেউ, এই গল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বোঝার জন্য তখন খুবই ছোট ছিলাম। কিন্তু সেই রাতে এই কাহিনির সমস্ত সূত্র আমাদের কাছে যেন আরও বেশি করে পরিষ্কার হতে শুরু করেছিল।
সকালের দিকে যখন ইহুদিরা বোমাবাজি বন্ধ করল, অবশ্যই হুমকি এবং ধমক সহযোগে, তখন একটা বড় দেখে লরি আমাদের বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল। বিছানা, বালিশ, চাদর… মানে বেডিংয়ের যা কিছু সরঞ্জাম, সবই এখান থেকে, ওখান থেকে দ্রুত ছুড়ে ফেলা হচ্ছিল সেই লরির ভিতর। আমি বাড়ির সেই ছ্যাতলা ওঠা পুরনো পাঁচিলটার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। দেখছিলাম। তোর মা লরিতে উঠল, লরিতে উঠল তোর পিসি আর বাড়ির বাচ্চারা। তোর বাবা তোকে আর তোর ভাই-বোনদের লরির জিনিসপত্রের মাথায় বসিয়ে দিল, তারপর আমাকে সটান গাড়ির ছাদে বাঁধা লোহার রেকের উপরে দিল তুলে। সেখানে দেখলাম আমার ছোটভাই রিয়াদ চুপচাপ বসে আছে। আমি একটু আরাম করে বসার আগেই লরিটা ছেড়ে দিল। একর্, আমার প্রাণের শহর, তার ছবি, তার দৃশ্য, দ্রুত পেছনে সরে যেতে লাগল, হারিয়ে লাগল রাস-নাকোরা যাওযার রাস্তার বাঁক আর ঢালের আড়ালে।
দিনটা ছিল মেঘলা। একটা বরফ-ঠান্ডা অনুভূতি আমার শরীর ভেদ করে ঢুকে পড়ছিল। রিয়াদ চুপচাপ বসেছিল। পা দুটো রেকের কিনারে ঝুলিয়ে, লাগেজে পিঠ ঠেকিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়েছিল ও। নিজের হাত দুটো দিয়ে একটা চৌকো মতো জায়গা বানিয়ে থুতনিটা হাঁটুর মাঝে রেখে আমিও চুপ করে বসে ছিলাম। রাস্তার পাশ দিয়ে একটানা সরে যাচ্ছিল কমলালেবু গাছের সারি। গাছের গুঁড়িগুলো যেন একে অপরকে অনুসরণ করছিল।
আমরা তখনও সবাই রীতিমতো ভীত ছিলাম। স্যাঁতসেঁতে মাটির ওপর দিয়ে আমাদের লরিটা চলছিল, দূর থেকে বিদায়বেলার সুরের মতো ভেসে আসছিল গুলির শব্দ।
দূরে যখন রাস-নাকোরা দেখা গেল, তখন নীল আকাশে মেঘ জমেছে। খানিক পরে থামল আমাদের লরিটা। মহিলারা মালপত্রের উপর থেকে নেমে গেল, এগিয়ে গেল সামনে, যেখানে একজন কৃষক কমলালেবুর পসরা সাজিয়ে বসে আছে। কমলাগুলো তুলে নিল তারা। তখনই তাদের ফোঁপানোর শব্দ কানে এল আমার। আমি ভাবছিলাম ওই বড় বড় চকচকে কমলাগুলো অত্যন্ত মহার্ঘ এবং অবশ্যই নয়নাভিরামও।
লেবু কেনা হয়ে গেলে মা-কাকিমারা ফিরে এল লরির কাছে। তোর বাবা তাই দেখে ড্রাইভারের সিটের পাশ থেকে নেমে এল, কমলা নিতে বাড়িয়ে দিল নিজের হাতটা। একটা কথাও না বলে মানুষটা তাকিয়ে রইলো লেবুগুলোর দিকে। দেখতে দেখতে শিশুর মতো কান্নায় ভেঙে পড়ল।
রাস-নাকোরায় আমাদের লরি আরও অনেকগুলো লরির পাশে এসে থামল। সবাই তখন সেখানকার পুলিশের হতে নিজেদের অস্ত্রগুলো জমা দিচ্ছে। আমাদের পালা এলে টেবিলের উপর দেখলাম ডাই করে রাইফেল আর মেশিনগানগুলো রাখা রয়েছে। তাকিয়ে রইলাম রাস্তার বাঁকগুলোকে গোল করে ঘিরে থাকা লেবাননের দিকে চলে যাওয়া লরিগুলোর দীর্ঘ লাইনের দিকে। নিজেদের আর কমলালেবুর দেশের মধ্যে দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছিল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলাম আমি।
তোর মা তখনও চুপচাপ তাকিয়ে ছিল লেবুগুলোর দিকে। আর তোর বাবা তো তার লেবুগাছগুলো ইহুদিদের জিম্মাতেই ছেড়ে এসেছিল; সেগুলো তখনও ওর চোখে ঝলমল করছে। একের পর এক যে সব গাছ কিনেছিল, সেগুলো যেন তার গোটা মুখটায় ছেপে আটকে গিয়েছিল, প্রতিফলিত হচ্ছিল তার অনিয়ন্ত্রিত বহমান অশ্রুধারায়– এমনকী খোদ পুলিশ পোস্টের অফিসারের সামনেও।
বিকেলে যখন সিডন পৌঁছলাম, ততক্ষণে আমরা উদ্বাস্তু হয়ে গেছি।
সারা রাস্তা যেন আমাদের গিলে খাচ্ছে। তোর বাবাকে দেখে মনে হচ্ছিল লোকটা যেন অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছে। পথের উপর স্তূপীকৃত জিনিসপত্রের সামনে অদ্ভুতভাবে দাঁড়িয়ে ছিল লোকটা। আমি বুঝতে পারছিলাম, যদি কিছু বলতে যাই, বিস্ফোরণ ঘটবে: ‘ধিক্কার, ধিক্কার তোমার বাবাকে! ধিক্কার…!’ এই শপথবাক্য তার মুখে যেন স্পষ্টভাবে খোদাই করা ছিল।
আমার স্কুল ছিল কঠোর ধর্মীয় অনুশাসনে ঘেরা। কিন্তু তেমন এক পরিবেশে পড়াশোনা করেও সেই মুহূর্তে আমার মনে প্রশ্ন জেগেছিল, সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করেছিল— ঈশ্বর সত্যিই কি মানুষকে সুখী দেখতে চান? তিনি কি আদৌ সব শুনতে ও দেখতে পান? স্কুল চ্যাপেলে যে রঙিন ছবিগুলো আমাদের হাতে তুলে দেওয়া হত, যাতে স্বয়ং ভগবানকে দেখা যেত হাসি হাসি মুখে শিশুদের প্রতি করুণা প্রদর্শন করতে, সেগুলোকে মনে হচ্ছিল বেশি বেশি মাইনে নেওয়ার জন্য একদল লোকের তৈরি করা সীমাহীন মিথ্যার বেশাতি। আমি নিশ্চিত ছিলাম, প্যালেস্তাইনে আমরা যে ঈশ্বরকে চিনতাম, তিনিও আমাদেরই মতো উদ্বাস্তু হয়ে এই একই জায়গায় রয়েছেন– যে জায়গাটা আসলে ঠিক কোথায় আমি জানতাম না। হ্যাঁ, আমি নিশ্চিত ছিলাম যে, নিজের সমস্যার সমাধান তিনিও খুঁজে পেতে অক্ষম।
এদিকে আমরা, মানে এই মানব উদ্বাস্তুরা, ফুটপাথের উপর বসে নতুন কোনও অনৈসর্গিক অসম্ভবতার অপেক্ষায় ছিলাম, যাতে সামান্য হলেও আমাদের এই সমস্যার প্রতিকার হয়। আমাদেরই তো দায় সেই বিপুল ছাদ নির্মাণের, যার নীচে রাতটুকু কাটানো যায়।
হ্যাঁ, সেদিন এভাবেই এই যন্ত্রণানুভূটি শিশুদের সরল মনকেও দুর্বল করে দিতে শুরু করেছিল।
আসলে রাত সত্যিই একটা ভয়ের জিনিস। ধীরে ধীরে নেমে আসা অন্ধকার বুকের ভিতর কেমন যেন একটা আতঙ্কের সৃষ্টি করে। ফুটপাথে রাত কাটাতে হবে, এই ভাবনাটাই আমার মধ্যে এক অদ্ভুত ধরনের ভয় জাগিয়ে তুলেছিল। নিষ্ঠুর, কঠোর এক ভয়। কিন্তু কেউ সামান্য করুণাটুকুও করতে রাজি ছিল না। সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কাউকে পাইনি আমি সেদিন। তোর বাবার ওই নীরবে চেয়ে থাকা আমার বুকে যেন তাজা আতঙ্ক ছড়িয়ে দিচ্ছিল। তোর মা যে কমলালেবুটা হাতে ধরে দাঁড়িয়ে ছিল, সেটা আমার মাথায় আগুন ধরিয়ে দিচ্ছিল যেন। সবাই ছিল চুপচাপ; কালো পিচ-ধালা রাস্তার দিকে তাকিয়েছিল, অপেক্ষা করছিল ভাগ্যোদয়ের, যা আকস্মিক উপস্থিত হয়ে আমাদের সমস্যার সমাধান করতে আগ্রহী হবে, যাতে আমরা তাকে অনুসরণ করে কোনও না কোনও একটা আশ্রয়ে পৌঁছে যেতে পারি।
হ্যাঁ, হঠাৎই ভাগ্যোদয় হল আমাদের। তোর কাকা, যিনি আগেই শহরে পৌঁছেছিলেন, তিনিই স্বয়ং সৌভাগ্য স্বরূপ আবির্ভূত হলেন। জানিসই তো, এমনিতেই তোর কাকার কোনও দিনই নীতি-নৈতিকতার বালাই ছিল না, তার ওপর যখন সে নিজেকে আমাদের মতো ফুটপাথে খুঁজে পেল, তখন তাও যা ছিটেফোঁটা নীতিবোধ তার ছিল, সেটুকুও পুরোপুরি হারিয়ে গেল। একরকম জোর করেই সরাসরি একটা ইহুদিদের দখল করা বাড়ির দরজা খুলে নিজের জিনিসপত্র ভিতরে ছুড়ে ফেলে দিল সে; তাদের দিকে নিজের গোলপানা মুখ ঝাঁকিয়ে চিৎকার করে বলল: ‘তোরা ফিলিস্তিনে চলে যা!’ না, নিশ্চিতভাবেই ওরা সেখানে যায়নি, কিন্তু তোর কাকার ওই চূড়ান্ত মরিয়া ভাব দেখে ভয় পেয়েছিল এবং তাকে বাড়ির নিরাপদ ছাদ আর টালির গরম মেঝে উপভোগ করতে দিয়ে সুরুৎ করে সরে পড়েছিল পাশের ঘরে।
নিজের পরিবার ও জিনিসপত্র সহ তোর কাকাই আমাদেরকে সেই আশ্রয়ে নিয়ে গিয়েছিল। রাতে আমরা মেঝেতে শুয়েছিলাম, এবং সেটা সম্পূর্ণরূপে আমাদের ছোট ছোট দেহের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল। বাবা, কাকাদের গায়ের কোটগুলোকে মাটিতে বিছিয়ে নিয়েছিলাম আমরা, ঘুমে ঢলে পড়েছিলাম তারই উপরে। সকালে উঠে দেখলাম, যারা আমাদের শোয়ার ব্যবস্থা করেছিল, সেই বাপ-কাকারা বসে বসেই রাতটা পার করেছে। অপরিসীম দুর্ভাগ্য আর বিষাদগ্রস্থতা তখন ক্রমশ আমাদের অন্তরাত্মায় কামড় বসাতে শুরু করেছিল।
সিডনে অবশ্য আমরা বেশিদিন থাকিনি। তোর কাকা আমাদের জন্য যে ঘর জোগাড় করেছিল, তা আমাদের অর্ধেকের জন্যও যথেষ্ট ছিল না। কিন্তু সেই ঘরই তো আমাদের তিন তিনটে রাত আশ্রয় দিয়েছিল।
তোর মা তোর বাবাকে বলেছিল কোনও একটা চাকরির ব্যবস্থা করতে, না হলে ফিরে যেতে সেই কমলালেবু গাছে ঘেরা জমিতে। কথাটা শোনা মাত্রই তোর বাবা চিৎকার করে উঠেছিল, রাগে থরথর করে কাঁপছিল তার কণ্ঠস্বর। কিন্তু পরক্ষণেই মানুষটা চুপ করে গেছিল।
আমাদেরও পারিবারিক সমস্যা শুরু হয়েছিল। এক সুখী, ঐক্যবদ্ধ পরিবার আমরা পেছনে ফেলে এসেছিলাম, ফেলে এসেছিলাম আমাদের জমি-জমা এবং বাড়ি, তা রক্ষা করতে করতে যারা শহিদ হয়েছিলেন, আমরা পিছনে ফেলে এসেছিলাম তাদের স্মৃতি।
আমি জানি না তোর বাবা টাকা কোথা থেকে পেয়েছিল। শুধু এটা জানি যে তোর মাকে, নিজের স্ত্রী হওয়ার সুবাদে, সুখী এবং গর্বিত করতে যে সোনা একসময় মানুষটা কিনেছিল, তা তাকে বিক্রি করে দিতে হয়। কিন্তু, বলাই বাহুল্য, সেই সোনা আমাদের সমস্যা সমাধানের জন্য যথেষ্ট পরিমাণে টাকা আনেনি। অবশ্যই অন্য কোনও উপায় ছিল। ধার করেছিল কি? আমাদের চোখের আড়ালে নিয়ে আসা অন্য কিছু বিক্রি করেছিল? আমি জানি না। কিন্তু মনে আছে, আমরা সিডনের বাইরের একটা গ্রামে চলে গিয়েছিলাম, এবং সেখানে তোর বাবা উঁচু পাথরের বারান্দায় বসে প্রথমবারের মতো হাসছিল। ১৫ মে বিজয়ী বাহিনীর পিছু পিছু দেশে ফেরার অপেক্ষায় ছিলাম আমরা।
হ্যাঁ, কঠিন অপেক্ষার পর অবশেষে এল সেই দিন! ১৫ মে!
তখন মধ্যরাত। ঘুমিয়ে পড়েছি। ওই অবস্থাতেই পা দিয়ে সামান্য একটা খোঁচা মেরে আমাকে জাগিয়ে তুলল তোর বাবা, আশা ভরা গলায় বলে উঠল: ‘ওঠ, ওঠ! দেখ, নিজের চোখে দেখ কীভাবে আরব বাহিনী ফিলিস্তিনে ঢুকছে।’ আমি তড়িঘড়ি উঠে খালি পায়ে ছুটলাম; পাহাড়ের উপর দিয়ে গিয়ে গ্রাম থেকে এক কিলোমিটার দূরের বড় রাস্তায় নেমে পড়লাম। আমরা সবাই, বড়-ছোট সমানভাবে, পাগলের মতো দৌড়তে দৌড়তে হাঁপাতে লাগলাম।
রাস-নাকোরায় উঠতে থাকা লরির আলো দূর থেকে জ্বলজ্বল করছিল। রাস্তায় পৌঁছনোর পর আমাদের কেমন শীত শীত লাগছিল, কিন্তু তোর বাবার উত্তেজিত আনন্দ-চিৎকার আমাদের মন থেকে সবকিছু দূর করে দিল। মানুষটা বাচ্চা ছেলের মতো লরির পিছনে দৌড়চ্ছিল। ডাকছিল, গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছিল, হাঁপাচ্ছিল। কিন্তু ছোটা থামাচ্ছিল না। ছোট ছেলের মতো লরির সারি ধরে দৌড়চ্ছিল তোর বাবা। আমরা তার পাশে পাশে দৌড়চ্ছিলাম, তার সঙ্গে একযোগে চিৎকার করছিলাম।
সৈন্যরা হেলমেটের নিচের ফাঁক দিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিল, চুপচাপ, নিশ্চল ভাবে। আমরা শ্বাস নিতে হাঁপাচ্ছিলাম। অথচ তোর বাবা, ওই পঞ্চাশ বছর বয়সে, দৌড়চ্ছিল, পকেট থেকে সিগারেট বের করে সৈন্যদের দিকে ছুড়ে দিচ্ছিল, চিৎকার করে কীসব বলছিল তাদের। আমরাও তার পাশে পাশে দৌড়চ্ছিলাম, ছোট্ট ছাগলের পালের মতো।
কিন্তু হঠাৎই লরিগুলো থেমে গেল। আমরাও বাড়ি ফিরে এলাম। আমাদের নিঃশ্বাসে মিশেছিল এক অপরিসীম ক্লান্তি—হওয়ায় যেন হালকা বাঁশির আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। একমুঠো বাতাসের জন্য হাঁপিয়ে উঠেছিলাম আমরা। তোর বাবা একেবারে চুপ মেরে গিয়েছিল; আমরাও কথা বলতে পারছিলাম না। যখন একটা গাড়ির আলো তোর বাবার মুখে এসে পড়ল, দেখলাম তার গাল ভিজে গেছে চোখের জলে।
এরপর সব কিছুই ঘটতে থাকল ধীরে ধীরে। সরকারি বিজ্ঞপ্তিগুলো আমাদের প্রতারিত করল, এমনকী সত্যও তার সমস্ত তিক্ততা সহযোগে ঠকিয়ে ছাড়ল আমাদের। মানুষের মুখে ফিরে এল হতাশার ছাপ। তোর বাবাও যেন আর কথা খুঁজে পাচ্ছিল না। যে ফিলিস্তিনের কথা, সেখানকার ফল বাগান, খেত-খামার ও বাড়িতে কাটানো সুখী অতীত সম্পর্কে কথা সে বলত, সেগুলো সবই যেন হারিয়ে ফেলেছিল। উপরন্তু, আমরা তার জীবনে আধিপত্য বিস্তারকারী শোকাবহ ঘটনার এক বিশাল পাঁচিল তুলে দিয়েছিলাম। আমরাই ছিলাম সেই হতভাগার দল, যারা সহজেই আবিষ্কার করেছিলাম যে, তোর বাবার কথা মতো ভোরবেলা পাহাড়ে ওঠার পিছনের গল্পটা ছিল সকালের জলখাবারের দাবি থেকে বিরত করার কৌশল।
জটিলতা ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছিল। খুব সাধারণ জিনিসও তখন তোর বাবাকে উত্তেজিত করে দিত, এবং বেশ আশ্চর্যজনক ভাবেই। আমার মনে আছে একটা ঘটনা। কে ঠিক কী জিজ্ঞাসা করেছিল বা না-করেছিল, তা আর আজ মনে পড়ে না অবশ্য। কিন্তু কিছু একটা শুনে তোর বাবা কেঁপে উঠেছিল, যেন তাকে ইলেকট্রিক শক দিয়ে দেওয়া হয়েছে! আমাদের মুখের দিকে অস্থির ভাবে তাকাতে তাকাতে তার চোখ জ্বলে উঠেছিল। মাথায় যেন ঢুকে গিয়েছিল এক অদ্ভুত চিন্তা! লাফিয়ে উঠেছিল মানুষটা, যেন একটা সন্তোষজনক উপসংহার পাওয়া গেছে। তোর বাবা যেন সচেতন হয়ে উঠেছিল যে নিজের সমস্ত সমস্যার এবার সে অবসান ঘটাতে পারবে। নিজের মনেই বিড়বিড় করছিল আর এমন কিছু খুঁজছিল, যা আমরা দেখতে পাচ্ছি না। তারপর হঠাৎই তোর বাবা একটা বাক্সের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। বাক্সটা সেই একর্ থেকে আমাদের সঙ্গে ছিল। একজন উন্মত্ত স্নায়ুরোগীর মতোই তার সমস্ত জিনিসপত্র বের করে ছড়িয়ে দিতে শুরু করল সে।
তোর মা এক মুহূর্তেই বুঝতে পেরেছিল কী ঘটতে চলছে, এবং নিজের সন্তানকে বিপদের মুখে পড়তে দেখলে সব মা যা করে, সেও তাই করেছিল: আমাদের ঘর থেকে বের করে দিয়ে বলেছিল পাহাড়ে পালিয়ে যেতে। কিন্তু আমরা যায়নি। জানালার কাছে দাঁড়িয়েছিলাম। আমাদের ছোট ছোট কানগুলো তার কপাটে চেপে শুনেছিলাম তোর বাবার বুকফাটা আর্তনাদ: ‘আমি ওদের মেরে ফেলতে চাই। আমি নিজেকে মেরে ফেলতে চাই। আমি সবকিছু শেষ করে দিতে চাই… আমি চাই…’
কিছুক্ষণ পর সব থেমে গিয়েছিল। আমরা দরজার ফাঁক দিয়ে ঘরের ভেতরে তাকিয়েছিলাম। তোর বাবা মাটিতে শুয়ে ছিল, নিঃশ্বাস নিতে চেষ্টা করছিল, দাঁতে দাঁত চেপে কাঁদছিল। তোর মাকে দেখলাম বসে আছে পাশে, উদ্বিগ্নভাবে তাকিয়ে আছে তোর বাবার দিকে।
না, আমরা কিছুই বুঝতে পারিনি প্রথমে। কিন্তু যখন তার পাশে মেঝেতে পড়ে থাকা কালো রিভলভারটা দেখলাম, তখন বুঝতে পারলাম সবটাই। সীমাহীন নিষ্ঠুরতার প্রতিমূর্তি দেখে শিশুরা যেমন ভীত সন্ত্রস্ত বোধ করে, আমিও ঠিক তাই বোধ করেছিলাম, পালিয়ে গিয়েছিলাম, ঘর থেকে ছুট লাগিয়ে ছিলাম পাহাড়ের দিকে।
ঘর ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার শৈশবকেও পিছনে ফেলে এসেছিলাম আমি। বুঝতে পেরেছিলাম যে আমাদের জীবন আর আরামদায়ক নেই, শান্তিতে বসবাস করা আর সহজ নয় আমাদের পক্ষে। সমস্ত বিষয়ই এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে একমাত্র সমাধান হল আমাদের প্রত্যেকের মাথায় একটা করে বুলেটের ক্ষতচিহ্ন বহন করা। বুঝতে বাকি ছিল না যে, আমরা যা কিছুই করি না কেন, তা হতে হবে যথাযথ, পরিস্থিতির সঙ্গে মানানসই। ক্ষুধার্ত থাকলেও খাবার চাওয়া কিংবা খিদে পেয়েছে বলা যাবে না। যখন তোর বাবা তার অসুবিধার কথা বলবে, তখন মুখে কুলুপ এঁটে থাকতে হবে। যখন বলা হবে: ‘যাও, পাহাড় থেকে ঘুরে এসো, আর দুপুরের আগে ফিরবে না’, তখন তাই মেনে নিতে হবে হাসিমুখে।
যখন ঘরে ফিরলাম, তখন সন্ধে নেমেছে। তোর বাবা তখনও অসুস্থ। তোর মা তার পাশে বসে ছিলেন। তোর চোখ দুটো বিড়ালের চোখের মতো জ্বলজ্বল করছিল; তোর ঠোঁট দুটো এমনভাবে একে অপরের সঙ্গে চেপে বসেছিল যে, মনে হচ্ছিল সেগুলো কখনও খোলা হয়নি, যেন সঠিকভাবে না-সারা পুরনো ক্ষতের দাগ ঢেকে রাখছিল সেগুলো।
তুই আটকে পড়েছিলি– ওই কমলালেবুর দেশ থেকে যতটা দূরে ছিলাম আমরা, ঠিক ততটাই দূরে, নিজের শৈশব থেকে। যে কমলালেবু গাছগুলোকে একজন কৃষক চলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এতদিন চাষ করে এসেছে, যত্ন করেছে, তাতে যদি আজ জল দিতে শুরু করে অন্য কেউ, তবে তো সেগুলো দুমড়ে যাবে, যাবেই।
তোর বাবা তখনও বিছানায়। অসুস্থ। তোর মা চুপ করে বসে আছেন, গভীর বিষাদাশ্রু সামলে। সে চোখের জল আজও তার চোখ ছেড়ে যায়নি। আমি প্রায় এক অযাচিত, অস্পৃশ্যের মতোই ঘরে ঢুকেছিলাম। যখন আমার নজর পড়ল তোর বাবার মুখের ওপর, সে মুখ দেখলাম রাগে কাঁপছিল। কিন্তু তখনই চোখ গেল নিচু টেবিলের উপর রাখা কালো রিভলভার আর তার পাশে রাখা একটা কমলার উপর।
কমলাটা শুকিয়ে, মুচড়ে গিয়েছিল।
প্রচ্ছদের ছবি: অর্ঘ্য চৌধুরী