Robbar

এই নীল রঙের গ্রহকে গান দিয়ে বদলে দিতে চাইতেন হ্যারি বেলাফন্টে

Published by: Robbar Digital
  • Posted:October 9, 2023 9:21 pm
  • Updated:February 4, 2024 6:14 pm  

প্রথমবার হ‌্যারি বেলাফন্টে শুনে আমার খুব ভাল লেগে গেল। কেন, তা স্পষ্টভাবে জানি না। একটা কারণ হতে পারে, আমি গণসংগীত শুনতে ভালবাসতাম। বেলাফন্টের বেশ কিছু গানই ছিল, যা গণসংগীত ধাঁচের। তারপর থেকে আলাদা করে ওঁর প্রতি আগ্রহ বাড়ে। বেলাফন্টে কী করেন, কোথায় থাকেন ইত‌্যাদি ইত‌্যাদি। গানের বাইরে বহু সাক্ষাৎকার, বহু তথ্য সারাক্ষণই আমি জোগাড় করতাম।

উপল সেনগুপ্ত

১৯৮৩ সালের ধারকাছে হবে। আমার ক্লাস এইট বা নাইন। আমাদের বাড়িতে এসে পড়ল একটা টেপরেকর্ডার। ক‌্যাসেটের তখন চড়া দাম। ৪৫ টাকা থেকে ৫৫-র মতো। সেই বয়সে, সেই সময়ে এটা অনেকটাই টাকা। তবু কিছু ক‌্যাসেট কেনা হল। দেবব্রত বিশ্বাস, কিশোর কুমার, মান্না দে– এইসব। ওই ক’টা ক‌্যাসেট এতবার চালাতে থাকলাম, শেষমেশ মনে হল– না, গান শোনার খিদে শুধু এতে মিটবে না। ফলে নতুন কিছুর খোঁজ।

খোঁজা শুরু হল কার কাছে ক‌্যাসেট প্লেয়ার আছে। সেসময় সকলের কাছে যে ক‌্যাসেট প্লেয়ার ছিল, এমন নয়। আমাদের পাড়ার দু’জন, দুই ভাই– অংশু আর আশিস, প্রচুর বিদেশি গান শুনত। ওদের কাছ থেকেই প্রথম বিদেশি কিছু গানের ক‌্যাসেট জোগাড় করলাম। তাদের মধ্যে ছিল সাইমন-গারফাঙ্কেল, বব ডিলান, এঙ্গেলবার্ড হাম্পারডিঙ্ক, জিম রিজ এবং হ‌্যারি বেলাফন্টেও।

এই হ‌্যারি বেলাফন্টে শুনে আমার খুব ভাল লেগে গেল। কেন, তা স্পষ্টভাবে জানি না। একটা কারণ হতে পারে, আমি গণসংগীত শুনতে ভালবাসতাম। বেলাফন্টের বেশ কিছু গানই ছিল, যা গণসংগীত ধাঁচের। তারপর থেকে আলাদা করে ওঁর প্রতি আগ্রহ বাড়ে। বেলাফন্টে কী করেন, কোথায় থাকেন ইত‌্যাদি ইত‌্যাদি। গানের বাইরে বহু সাক্ষাৎকার, বহু তথ্য সারাক্ষণই আমি জোগাড় করতাম। মার্টিন লুথার কিংয়ের সঙ্গে কীরকম সম্পর্ক ছিল, কেনেডির ইলেকশনের সঙ্গে কীরকম যোগ। জানতে পেরেছি, নানাবিধ মানুষের সঙ্গে তো বটেই, অন্য ভাষার গানও গেয়েছেন বেলাফন্টে।

হ্যারি বেলাফন্টে

বেলাফন্টে শুনতে শুনতে বড় হচ্ছি। আর এসে পড়েছি আর্ট কলেজে। ধর্মতলার কাছেই কলেজ। লিন্ডসে স্ট্রিট তখন পুরনো রেকর্ডের খনি। ছিল ‘সিম্ফনি’ নামে চমৎকার একটি ক‌্যাসেটের দোকানও। মাঝে মাঝে গিয়েই খোঁজ নিতাম বেলাফন্টের কোনও নতুন অ‌্যালবাম এসেছে কি না। সেখান থেকে প্রথম পাই ‘বেলাফন্টে অ‌্যাট কার্নেগি হল’। এছাড়াও বেশ কিছু বেলাফন্টের ক‌্যাসেট জোগাড় করি।

এইসব গান-পাগলামো করতে করতেই বাজারে খবর ছড়িয়ে পড়ে যে, আমি খুব বেলাফন্ট-মুগ্ধ। আমার এক বন্ধুর মামা, আমেরিকায় থাকতেন, তিনি কোথা থেকে বেলাফন্টের ভিডিও ক‌্যাসেট আমার জন্য জোগাড় করেছিলেন। সেটা দেখে আমি একেবারে থ্রিলড! কীভাবে স্টেজ করছেন বেলাফন্টে, তা দেখে। দেখতে দেখতে এখানেও আমি ওঁর গান গাইতে থাকি। শুধু তা-ই নয়, বেলাফন্টের গান বাংলায় অনুবাদ করারও চেষ্টা করি। একটা সময় দেখি, ওঁর গানের বেশ কিছু বাংলা অনুবাদও রয়েছে। ‘জামাইকা ফেয়ারওয়েল’ যেমন রঞ্জনপ্রসাদ করেছিলেন– ‘পথের প্রান্তে কোন সুদূর গাঁয়’। এই গানটাও গাইতে থাকি স্টেজে। হাততালি পাই, উৎসাহ বাড়ে। এভাবেই বেলাফন্টে আমার ভেতর ঢুকতে থাকেন ক্রমশ।

যখন ‘চন্দ্রবিন্দু’ হয়, আমি অন‌্যদের বেলাফন্টে শোনানোর দিকে নিয়ে যাই। অনিন্দ্যকে শোনাই, তখনও অনিন্দ্য সেভাবে গান গাইত না। সদ্য গান লিখেছে কিছু। ‘অ্যাঞ্জেলিকো’ নামের একটা গানের সুর নিয়ে আমরা একটা গান বাঁধি। ‘কেউ ভালবেসে জয় করে গোটা বিশ্ব/ কেউ ভালবেসে হয় বাবাজির শিষ্য’। এটা অনিন্দ্যরই করা।

শঙ্খ ঘোষকে শ্রীজাতর অক্ষর-তর্পণ: কবিতার জগৎ যে অন্ধকার নয়, শঙ্খ ঘোষ বুঝিয়েছিলেন এক মিইয়ে পড়া বিকেলে

২০০৩ সালে আমরা যাই আমেরিকায়, কনসার্ট করতে। সেসময় বঙ্গসম্মেলন লস অ‌্যাঞ্জেলস-এ। কিছু বন্ধু-ফ‌্যান বলে, ‘টিকিটটা একটু বাড়িয়ে নাও। সান ফ্রান্সিসকো থেকে আমরা গান শুনতে যাচ্ছি। ফেরার সময় কিছু জায়গা ঘুরিয়ে, আবার তোমাদের লস-এ পৌঁছে দেব।’ এ প্রস্তাবে নারাজ হওয়ার কিছু ছিল না। সদলবলে গেলাম তাদের বাড়ি। সেখানে বসে মেল চেক করছি। হঠাৎ কী মনে হল, বেলাফন্টে কি এখনও কনসার্ট করেন? দেখলাম, পরের দিনই লস অ্যাঞ্জেলস-এ তাঁর কনসার্ট আছে। অন্যদের সব প্ল্যান করা, নানা জায়গায় বেড়ানোর। এদিকে আমি বেলাফন্টের লাইভ শো হাতছাড়া করব না কোনওমতে! কিন্তু কে নিয়ে যাবে? প্রায় ৭-৮ ঘণ্টার ড্রাইভ! দরকারে বাসে করেই যাব। তখনও আমাদের হাতে হাতে সেলফোন নেই। শেষে আরও দু’জনকে বগলদাবা করে ব‌্যাপারখানা সত্যি হল। সামনে থেকে হ‌্যারি বেলাফন্টে! প্রায় আড়াই ঘণ্টার শো।

ক‌্যালিপ্সো আর্টিস্ট হিসেবে বড় জায়গা করে নিয়েছেন বেলাফন্টে। এই জঁরে ওঁর উচ্চতায় এখনও কেউই পৌঁছতে পারেননি। গুগলে সার্চ করলে দেখা যাবে, প্রথম দশটাই তাঁর। মোটের ওপর, তিনি একজন কমপ্লিট মিউজিশিয়ান। একজন পারফর্মার। একজন গায়ক। একজন পলিটিক্যাল অ‌্যাকটিভিস্ট। এবং থিয়েটার পার্সোনালিটিও। হয়তো এতরকম জীবনবোধ এসে পড়েছে বলেই তিনি দুরন্ত কথা বলেন। কথায় জুড়ে দেন হিউমার। রাজনৈতিকভাবে খুব সচেতন বলেই, তিনি পারেন। ওঁর চোখে কীভাবে ধরা পড়ছে এই নীল রঙের গ্রহের ভুলভ্রান্তি, কীরকম চাইছেন এই পৃথিবীটাকে, সমাজব‌্যবস্থাকে দেখতে, তিনি বলতে পারতেন খুব কম কথাতেই, মজাচ্ছলে।

বেলাফন্টে চলে গেলেন যখন, ভেবেছিলাম, এই পোড়া দেশে, কলকাতায় যদি ওঁকে নিয়ে একটা কনসার্ট করা যায়। করলামও। খুব ছোট আকারে। গোটা ৪০ জনের সামনে। দূরদেশ থেকে এই ছোট আকারের কনসার্টই ওঁর প্রতি আমার প্রথম প্রণতি। এটা দ্বিতীয়।