কোথায় আর সবসময় দেওয়াল আঁকার তৈরি জায়গা পাওয়া যাবে। তৈরি করে নিতে হবে। প্রথমে ঘষে সমান করো। নারকেল দড়ি দলা পাকিয়ে নিয়ে ঘষো। মুখ, নাক ঢেকে নিয়ে, নইলে কাশতে কাশতে জীবন শেষ। যদি পারো একটু জল ছিটিয়ে নাও। বালতি থেকে মগ ভরে জল নিয়ে মগের মুখটা আঙুল দিয়ে চেপে ছিটিয়ে দাও। এবার শুকোতে দাও। পরদিন বালতিতে সাদা চুন গুলে নিয়ে, পাটের ব্রাশ দিয়ে রং লাগাও। সাদা রং লাগাতে গিয়ে দেখা যাবে দেওয়াল হুস হুস করে রং টেনে নিচ্ছে। যত পুরনো দেওয়াল, তত রং শুষে নেবে। বার তিনেক দেওয়ার পর লেখার মতো হবে দেওয়াল। শুরু হল নতুন সিরিজ– দেওয়াল লেখার কথা। আজ প্রথম পর্ব।
প্রচ্ছদের ছবি: অর্ঘ্য চৌধুরী
১.
দেওয়াল লেখা, দেওয়ালে লেখা। লেখার দেওয়াল সবসময় তৈরি থাকে না, তৈরি করে নিতে হয়। তৈরি করে নেওয়াটাই দেওয়াল লেখার প্রথম কাজ, কঠিন কাজ। কোন দেওয়াল? যে দেওয়াল বড়, যাকে পাঁচিল বলি। সব পাঁচিল নয়, যে পাঁচিল সমান। আঁকাবাঁকা, উঁচু নিচু, খাঁজ কাটা কাটা হলে হবে না। সব সমান পাঁচিলেও হবে না। খুব পুরনো, খরখরে, শ্যাওলা ধরা। হবে না।
হবে না বললে তো চলবে না। যা না-হওয়ার মতো, তাকে হওয়াতে হবে। কোথায় আর সবসময় দেওয়াল আঁকার তৈরি জায়গা পাওয়া যাবে। তৈরি করে নিতে হবে। প্রথমে ঘষে সমান করো। নারকেল দড়ি দলা পাকিয়ে নিয়ে ঘষো। মুখ, নাক ঢেকে নিয়ে, নইলে কাশতে কাশতে জীবন শেষ। যদি পারো একটু জল ছিটিয়ে নাও। বালতি থেকে মগ ভরে জল নিয়ে মগের মুখটা আঙুল দিয়ে চেপে ছিটিয়ে দাও। এবার শুকোতে দাও। পরদিন বালতিতে সাদা চুন গুলে নিয়ে, পাটের ব্রাশ দিয়ে (চুনকাম মিস্ত্রিরা বলে দেবে কোথায় পাওয়া যায়। ভাব-ভালোবাসা থাকলে এনেই দেবে)। সাদা রং লাগাতে গিয়ে দেখা যাবে দেওয়াল হুস হুস করে রং টেনে নিচ্ছে। যত পুরনো দেওয়াল, তত রং শুষে নেবে। বার তিনেক দেওয়ার পর লেখার মতো হবে দেওয়াল।
আবার যে-সে দেওয়াল হলেই তো হবে না। এই দেওয়ালের পাশ দিয়ে ক’জন লোক যায়। যাদের জন্য দেওয়াল লেখা তাদের চোখে পড়বে তো!
তাই চোখে পড়লেই দেওয়াল। দেওয়াল লেখার সাদা পাতা, ক্যানভাস। দেওয়াল যত উঁচু আর পাশাপাশি ছড়ানো, তত লাভ। অনেক কথা লেখা যাবে, অল্প কথা বড় করে লেখা যাবে।
চোখ তো শুধু দেওয়ালেই পড়ে না। যা দেওয়াল নয়, তাকেও দেওয়াল বানিয়ে নেওয়া। বাড়ির, দোকানের দু’পাশের দেওয়াল, দরজা, জানলার মাথায়, দু’পাশের দেওয়াল। দেওয়াল লেখার দেওয়াল থাকে না, খুঁজে নিতে হয়, বানিয়ে নিতে হয়। এটা এক ধরনের নেশা, আনন্দ। লেখার দেওয়াল খোঁজার নেশা। খুঁজে পেয়ে আনন্দ।
এ হল দেওয়ালের কথা। দেওয়াল লেখার মতো দেওয়াল পাওয়ার কথা।
এবার রং। রঙের কথা। দেওয়াল লেখার রং কী হবে, তা ঠিক হয় যারা লিখছে, যাদের জন্য লিখছে তাদের পয়সার অবস্থা অনুযায়ী। সাধারণত, কালো, লাল, পরে নীল, সবুজ এমন সব রঙেরা।
রং বানানো, মানে রং গোলা বেশ কঠিন। যারা এ বিষয়টা অনেকদিন ধরে করে আসছে, তাদের সাহায্য ছাড়া সম্ভব নয়।
খেয়াল রাখতে হয় বেশ কিছু। যে দেওয়ালে লেখা হবে, সে কতটা রং খেয়ে নেবে। মানে দেওয়াল পুরনো হলে তাতে চুনের কোট দিলেও রং বেশি খাবে, নতুন দেওয়াল কম রং খায়।
যে দেওয়াল লিখছে, সে কতদিন ধরে লিখছে, যত পুরনো হবে ব্রাশের মাপ মতো রং তুলবে, গড়াবে না। তার রং খুব একটা মোটা করে গোলার দরকার নেই। যে সবে লিখছে, তার বেলায় রং গড়াবে, তারটা ঘন করে গুলতে হবে। অন্য দিকও আছে। খরচের দিক। পয়সা কম হলে পাতলা করে গোলা। পয়সা বেশি থাকলে ঘন করে গোলা। আরও আছে। মিটিংয়ের দিন ক’দিনের মধ্যেই– পাতলা করে রং। ভোট বেশ কিছু দিন বাদে– ঘন করে রং।
এবার তুলি, ব্রাশ।
এখানেও নানা অঙ্ক কষা। জায়গা বেশি অক্ষর বড় করা যাবে, বড় অক্ষর অনেকটা। ব্রাশ চ্যাপটা, মোটা।
বড় অক্ষরের সঙ্গে ছোট অক্ষর। ছোট তুলি, ছোট তুলি বললেই হবে না, চ্যাপটা ছোট, না গোল ছোট। চ্যাপটা না গোল– ঠিক হবে অক্ষরের ধরন অনুযায়ী। লেখার স্টাইল অনুযায়ী।
আরও আছে। তুমি নতুন না পুরনো। পুরনো হলে ফ্রি ড্রইং। নতুন হলে আগে চক দিয়ে, কাঠ কয়লা দিয়ে অক্ষরের ছাঁদ বানিয়ে নেওয়া। তারপর রং লাগানো। বা সিনিয়র দাদা ছাঁদটা এঁকে দিল। জুনিয়ররা রং দিয়ে ভরাট করল। প্রশিক্ষণ, ট্রেনিং। মনে রাখবে, পিছনে দাদা দাঁড়িয়ে আছে, সহশিল্পীরা দেখছে, তারাও মাঠে নামবে। টিম ঠিক হয়ে আছে।
প্রথমে ভয়ে হাত কাঁপবে। দাদা রাগী হলে বকুনি, ভালো হলে উৎসাহ দেবে। ওই জায়গাটা আর একটু টেনে দে, ওখানটা সরু কর। বাঁ হাতে জলে ভেজা ন্যাকড়া, রং গড়ালে মুছে দাও। কিংবা সিনিয়রের ভরসা– ছেড়ে দে, আমি ম্যানেজ করে দেব, তুই এগিয়ে যা।
পিছনে যে শুধু সিনিয়ররা, জুনিয়র সহশিল্পীরাই থাকবে, তা নয়। পার্টির লোকেরা, চলতে চলতে দাঁড়িয়ে পড়া মানুষজন। আর ফ্রি মতামত। ওটা অমন না হয়ে তেমন হলে ভালো হত। অথবা, বেশ হচ্ছে, মন দিয়ে কর/করো।
এমনি ভাবেই আজ যার সামনে থেকে শুরু, একদিন সে পিছন থেকে শিক্ষক। দেওয়াল লিখিয়ের নির্মাণ।
কোথায় লিখবে, কে লিখবে, কীভাবে লিখবে, এসব তো হল।
কী লেখা হবে?
পার্টির দেওয়াল লেখা হলে, বয়ান পার্টি থেকে আসবে। তাই অনুসরণ করতে হবে। পার্টি আর প্রার্থীর নাম, কী ভোট– পঞ্চায়েত, বিধান, না লোকসভা কোনটা, সে অনুসারে লেখো, পার্টির ভোট চিহ্ন। জায়গা কম থাকলে শুধু এই ক’টি লিখে জানানো, জায়গা বেশি থাকলে কথা বেশি।
কেন একে, এই পার্টিকে ভোট দিতে লেখা হচ্ছে, কী করেছে পার্টি, বিপরীতে থাকা দলগুলোর তুলনায় কী কী এই দলের পক্ষে। জায়গা আরও একটু বেশি থাকলে প্রার্থী যদি সরকারি দলের হয়– তাহলে সরকার কী কী করেছে, প্রার্থী যদি বিরোধী দলের হয় সরকার কী কী কাজ করেনি, বিরোধী দল এলে কী কী করবে। জায়গা যতটা, কথারা ততটা।
জায়গা আরও থাকলে ছবি আঁকব। একটা কথা জায়গা মতো লিখতে ভুলে গেছি। এখানে এসে মনে পড়ল। এক একটা পার্টির চিহ্ন রং। রং দিয়ে যায় চেনা। সেই সেই রং দিয়ে সেই সেই পার্টির দেওয়াল লেখা। আপাতত, এই হল দেওয়াল লেখার প্রথম ভাগ।
কৃতজ্ঞতা: স্বাতী চট্টোপাধ্যায়, কমলিকা মুখোপাধ্যায়