সাদা থান পরা পরিচিত চেহারার হাসুদিদাকে দেখে অদম্য উৎসাহে পিছন থেকে ডাকলাম, ‘ও দিদা, বাড়ি ফিরছ?’ এরপর যা হল, তা বিশ্বাস না-ও করা যায়। স্পষ্ট দেখলাম, হাঁটা না থামিয়েই সাদা থান, ঘোমটা পরা সেই অবয়ব ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরিয়ে দিল মাথাটা। লিখছেন তিয়াস বন্দ্যোপাধ্যায়
তেনারা আছেন কি নেই– সে নিয়ে দ্বন্দ্ব আমার কোনও দিনই ছিল না। তবে হ্যাঁ, কৌতূহল ছিল। ছোট থেকে বনবাদাড়ে উঁকি দিয়েছি। প্রকৃতির গন্ধ চিনেছি। কলকাতার স্কুলে পড়লেও আমার বেড়ে ওঠার পরিধি ব্যাপ্ত ছিল।
স্কুলে পড়ি তখন। ক্লাস নাইন। ছুটিছাটা পেলে মাতামহের দুই বিঘা জমির বুনো বাগানে দুপুরবেলা একা ঘুরে বেড়াতাম। শহরের তেতে ওঠা কংক্রিটের স্পর্শ ফেলে শেয়াল-ডাকা বিকেল আর বাদুড়-ওড়া সূর্যাস্তের টানে চলে আসতাম একশো বছরের পুরনো সেই জমিদারবাড়িতে। খিড়কির দরজাটা খুললেই রহস্যের ঘ্রাণ। বাগানে যাওয়ার পথের দু’পাশে সার দিয়ে ফার্নের অভ্যর্থনা। তাদের আশ্রয়ে সাপখোপ এবং অন্যান্য প্রাণীও। সব মিলিয়ে গা-ছমছমে সহাবস্থানের পরিমণ্ডল। প্রকাণ্ড কোনও গাছের দেহ পাকে পাকে জড়িয়ে আকাশে মাথা তুলতে চাইত পরজীবী লতারাও। তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে লুকিয়ে অন্যের বাড়িতে উঁকি দেওয়ার অনুভূতি হত। বুকের মধ্যে গুড়গুড় করত উত্তেজনা, যদি কারও দেখা মেলে! বলা ভাল, অচেনা কারও। সে ছিল স্পন্দনহীন এক অন্বেষণ।
আরও পড়ুন: আঁধার রাতের অচেনা সঙ্গী
আনমনে পুকুরে গাছেদের ছায়া আর মাছেদের নাচ দেখছি একদিন, স্পষ্ট শুনলাম পাতার খসখস, মুচমুচ। হেঁটে যাওয়ার শব্দ। ভাবলাম, ও পাড়ার হাসুদিদা হয়তো! বয়সের গাছপাথর নেই, ঢ্যাঙা লম্বা সেই বুড়ি আমার দিদিমার কাছে প্রায়ই আসত বাগানের কলাটা-মোচাটা নিয়ে। দিদিমা যত্ন করে বসিয়ে তাকে চা খাওয়াত। হাতে ক’টা টাকা গুঁজে দিত। ভাবলাম, হাসুদিদা বাড়ি ফিরছে বাগানের পথ ধরে। পুকুরপাড়ে আলো পড়ে আসছে তখন। সাদা থান পরা একই চেহারার সেই মানুষটিকে দেখে পিছন থেকে ডাকলাম, ‘ও দিদা, বাড়ি ফিরছ?’ এরপর যা হল, তা বিশ্বাস না-ও করা যায়। স্পষ্ট দেখলাম, হাঁটা না থামিয়েই সাদা থান, ঘোমটা পরা সেই অবয়ব ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরিয়ে দিল মাথাটা। মুখের জায়গায় কী আছে, বলা শক্ত। জমাট কালোর মধ্যে শুধু একজোড়া চোখ! সেগুলো জ্বলছে না নিভছে বলা কঠিন। আমার পা মাটিতে গেঁথে গেল। পাঁজরের কাছে একটা চাপ অনুভব করলাম। সাদা থান, ঘোমটা পরা সেই ‘দিদা’ কি আমার অবস্থা দেখে একটু হাসল? তার মুখের জায়গায় একটা চেরা জিভ লকলক করছে। আমি পড়েই যাচ্ছিলাম অজ্ঞান হয়ে। কিন্তু কী হল জানি না, হুঁশ ফিরতে দেখলাম, খোলা আকাশের নীচে সজনে গাছের গায়ে হেলান দিয়ে বসে আছি। বাগান চৌহদ্দি থেকে নিরাপদ দূরত্বে, এক প্রতিবেশীর বাড়ির সামনে। পাছে বাগানে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়, সেই ভয়ে বাড়িতে কাউকে কিছু বলিনি।
আরও পড়ুন: মৃতদেহটা আজও খুঁজে পাওয়া যায়নি
আর একটু বড় হতে বাবা-মায়ের সঙ্গে চলে এসেছিলাম অনেক দূরে। সেখান থেকে দাদুর বাড়ি যাওয়া হত না আর। বাগানে বেড়ানোর দিনগুলো তখন স্মৃতি। মনে পড়লেও ছুটে যাওয়ার উপায় ছিল না। কারণ, ততদিনে সে জমির সব গাছ কাটা হয়ে গিয়েছে শহরায়নের থাবায়। উঁচু উঁচু বসতির চূড়া উঠবে সেখানেও। কিন্তু তেনারা কি আর দূরে থাকতে পারেন? কৌতূহলীদের জীবন চিরকাল ঘটনাবহুল।
আরও পড়ুন: আমার ঘরের সেই হঠাৎ অতিথি
কলেজ পাশ করে গেছি। ভূত চতুর্দশীর সন্ধ্যায় ফ্ল্যাটের ছাদে রাস্তার দিকে মুখ করে গান গাইছিলাম মনের সুখে। আকাশ মিশকালো। কেউ কোথাও নেই। হঠাৎ পিছন ঘুরতেই শিহরন খেলে গেল। ঠিক দেখছি? হ্যাঁ, কোনও ভুল নেই! ৫-৬টি দীর্ঘ ছায়ামূর্তি রামধনুর মতো সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে! আমার থেকে বেশ কয়েক হাত দূরে সেই রঙের বিস্ফোরণ। আমি হাঁ করে দেখতে না দেখতে কয়েক পলকে মিলিয়ে গেল। চাঁদশূন্য অতল আকাশ থেকেই নীরবে ঝরে পড়ল কাদের যেন আশীর্বাদ!
প্রচ্ছদশিল্পী: অর্ঘ্য চৌধুরী
বিমূর্ত অভিব্যক্তিবাদের শিল্পী হ্যারল্ড শ্যাপিনস্কিকে আবিষ্কার করেছিলেন এ দেশের আকুমল রামচন্দ্র। আকুমলের বহু চেষ্টার পর লন্ডনে প্রথম প্রদর্শনী হয় শ্যাপিনস্কির। বিখ্যাত ম্যাগাজিন ‘দ্য নিউ ইয়র্কার’ এই আবিষ্কারের গল্প নিয়ে ২০ পৃষ্ঠা জুড়ে বিশাল লেখা প্রকাশ করে।
ফটোগ্রাফির মস্ত শখ বিপুলদার। মাঝে মাঝেই ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন ছবি তুলতে পত্রপত্রিকার জন্য। নানা বিষয়ে আজগুবি সব ছবি দেখেছি সে ছবি খুব একটা কোথাও প্রকাশ করতেন না। অবাক হয়েছিলাম ওঁর পাবলিক টয়লেটের প্যান ভর্তি বিষ্ঠার ছবি দেখে। অনেক। গা ঘিনঘিন করেনি, বরং মনে হচ্ছিল যেন চমৎকার সব বিমূর্ত চিত্রকলা।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর আশ্রমবিদ্যালয়ের আশ্রমকন্যাদের অগাধ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। সেখানে আলাদা করে কোনও প্রহরী রাখতেও দেননি। মেয়েদের স্বাধীন সত্তাকে এতটাই মূল্য দিতেন তিনি। তাই চিত্রনিভার স্কেচ করতে যাওয়ার জন্য তিনি কোনও সীমানা নির্দেশ করেননি, ছবি আঁকার জন্য তিনি যতদূর খুশি যেতে পারতেন।