নাপোলি ভক্তরা ভালোবেসে কাভারাস্কেইয়াকে ডাকেন ‘কাভারাদোনা’ বলে। গত বছর যেমন ‘স্কুডেটো’ জিতিয়ে ইতালির ক্লাবের স্বপ্নপূরণ করেছিলেন, এদিন করলেন নিজের দেশের হয়ে। তাও আবার ‘আইডল’ রোনাল্ডোর সামনে। ম্যাচ শেষে সেরার পুরস্কার আর ‘গুরু’-র জার্সি পাশাপাশি রেখে বিশ্বকে শিখিয়ে দিলেন, কীভাবে ‘স্বপ্ন’ পূরণ করতে হয়। এও তো এক গুরুদক্ষিণা!
ফুটবল মানচিত্রে জর্জিয়া নামটার তেমন পরিচিতি নেই। বিশ্বনাগরিকের দরবারে মিকাউতাদজে, কিতেইশভিয় নামগুলো যতটা অপরিচিত, ঠিক ততটাই খটমট। একমাত্র চেনা মুখ বলতে কাভারাস্কেইয়া। নাপোলিকে গতবার ইতালি চ্যাম্পিয়ন করার নেপথ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন এই জর্জিয়ান। আর তাঁরাই কি না হারিয়ে দিল রোনাল্ডোর পর্তুগালকে! ইউরোয় প্রথমবার নাম লিখিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে পড়লেন জর্জিয়ার একঝাঁক অখ্যাত ফুটবলার। এ তো স্রেফ ইতিহাস নয়, রূপকথা!
কিন্তু রোনাল্ডোর কাছে? তাঁর কাছে কি একেবারেই অপরিচিত নামগুলো? পর্তুগিজ মহাতারকা, তাঁর হাত ধরেই যে শুরু হয়েছিল জর্জিয়ার ফুটবল রূপকথা। স্মৃতির সরণি বেয়ে তিনি ফিরে যেতে পারেন ২০১৩ সালে। তখন সিআর সেভেন রিয়াল মাদ্রিদের ফুটবলার। বিপক্ষের কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক। স্বমহিমায় বিরাজ করছেন ফুটবল দুনিয়ার মধ্যগগনে। সেই সময় তিনি উপস্থিত জর্জিয়ার রাজধানী তবলিসিতে। সঙ্গে ইউক্রেনের প্রাক্তন ফুটবলার আন্দ্রে শেভচেঙ্কো। উদ্দেশ্য, ডায়নামো তবলিসির ফুটবল অ্যাকাডেমির উদ্বোধন।
চুলে সেই পুরনো মোহক স্টাইল, পরনে সাদা জামা। খুদে ফুটবলারদের সঙ্গে হাসিঠাট্টায় দারুণ কাটল দিনটা। তারপর জর্জিয়ার ফুটবল ক্লাব ডায়নামো তবলিসির সঙ্গে রাশিয়ার বিখ্যাত ক্লাব ডায়নামো মস্কোর প্রীতি ম্যাচও দেখলেন। সঙ্গে ছিলেন জর্জিয়ারই কিংবদন্তি ফুটবলার কাখা কালাদজে। ঘটনাচক্রে তখন তিনি সে দেশের ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু এ আর নতুন কী? সারা বিশ্বে এরকম বহু ক্লাবের অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছেন রোনাল্ডো। অসংখ্য অ্যাকাডেমির উদ্বোধন করেছেন। তাঁকে দেখতে উপচে পড়েছে স্টেডিয়াম। জর্জিয়ায় যাওয়ার ক’দিন আগেই সিঙ্গাপুর আর ফ্রান্সেও গিয়েছিলেন তিনি।
………………………………………………………………………………………………..
কী হলে কী হত, সেটা তো ফুটবলের চিরন্তন প্রশ্ন। বাস্তব যা, তা হল জর্জিয়ার জার্সিতে কাভারাস্কেইয়ার রূপকথার ইমারত গড়ে তোলাটা। একজন ভারতীয় ফুটবল ভক্ত হিসেবে আমরা শুধু দেখেই গেলাম। যাকে বলে নীরব দর্শক। ২০১৫-তে জর্জিয়ার র্যাঙ্কিং ছিল ভারতের আশেপাশেই। আর ২০২৪-এ এসে ভারত আফগানিস্তানের কাছে হারছে। কোচ বিতাড়ণ নিয়ে ডামাডোলে মেতে আছে। ভবিষ্যৎ রূপরেখা বিবর্ণ। আর সেখানে জর্জিয়া ইতিহাস গড়ছে পর্তুগালকে হারিয়ে! কুর্নিশ জানানোর সঙ্গে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাসও কোথায় যেন লুকিয়ে থাকে।
………………………………………………………………………………………………..
না, তফাত আছে। সেদিন জর্জিয়ায় যে-সব উঠতি ফুটবলার ঘিরে ধরেছিলেন রোনাল্ডোকে, তাঁদের মধ্যে এগারোজনের সঙ্গে এবার দেখা হয়ে গেল ইউরোয়। কাভারাস্কেইয়া, দাভিতাশভিয়ি, চাকভেতাদজে, কোচোরাশভিয়ি, গোলকিপার মামারদাশভিয়ি– তালিকা দীর্ঘ করা যায়। এঁদের মধ্যে পাঁচজন ছিলেন প্রথম দলে। আর তাঁদের সামনেই থমকে গেলেন রোনাল্ডো। থমকে গেল পর্তুগাল। জোড়া গোলে ম্যাচ জিতে ইউরোর নকআউটে পাড়ি জমাল জর্জিয়া। কে বলবে, খাতায়-কলমে টুর্নামেন্টের সবচেয়ে দুর্বল দল তাঁরা। র্যাঙ্কিং ৭৪। পর্তুগালের থেকে যারা ৬৮ ধাপ পিছিয়ে।
ফুটবলের মজা আসলে এটাই। ওই নব্বই মিনিটের ঘেরাটোপে হয়তো কেউই পিছিয়ে থাকে না। ফুটবলের রণাঙ্গনটা সব লড়াকু যোদ্ধার জন্য সমানভাবে খোলা। জীবনে যতটুকু অসাম্য, সেটারই যেন ব্যালেন্স ঘটে সেখানে। মহাশক্তিধরকে পিছনে ফেলে তুমি এগিয়ে যাওয়ার গ্রাফ শিট যেন ওই সবুজ মাঠ। সেটাই যেন করে দেখালেন কাভারাস্কেইয়া, তাঁর সতীর্থরা।
প্রথম গোলটায় মিকাউতাদজের থেকে যখন তিনি ঠিকানা লেখা পাস পেলেন, তখন প্রতিপক্ষের সবাইকেই টপকে গিয়েছেন তিনি। তারপর চেনা দৌড়। উইং দিয়ে যে দৌড়টা বড্ড চেনা নাপোলি সমর্থকদের। নাপোলি ভক্তরা ভালোবেসে কাভারাস্কেইয়াকে ডাকেন ‘কাভারাদোনা’ বলে। গত বছর যেমন ‘স্কুডেটো’ জিতিয়ে ইতালির ক্লাবের স্বপ্নপূরণ করেছিলেন, এদিন করলেন নিজের দেশের হয়ে। তাও আবার ‘আইডল’ রোনাল্ডোর সামনে। ম্যাচ শেষে সেরার পুরস্কার আর ‘গুরু’-র জার্সি পাশাপাশি রেখে বিশ্বকে শিখিয়ে দিলেন, কীভাবে ‘স্বপ্ন’ পূরণ করতে হয়। এ-ও তো এক গুরুদক্ষিণা!
…………………………………………………………………………………………………..
আরও পড়ুন প্রবুদ্ধ ঘোষ-এর লেখা: ক্রুজ-পেপেরা জার্সিকে ভালোবেসে কী কাণ্ডটাই না করছেন
…………………………………………………………………………………………………..
কথা হতেই পারে যে, দ্বিতীয় সারির টিম নামিয়েছিল ২০১৬-র ইউরো জয়ীরা। বলা যেতেই পারে, দুটো গোলই এসেছে পর্তুগিজ ডিফেন্ডারের ভুলে। তাতেও জর্জিয়ার কৃতিত্ব কি কমে? কোনওমতেই তা খাটো করা যায় না। কী হলে কী হত, সেটা তো ফুটবলের চিরন্তন প্রশ্ন। বাস্তব যা, তা হল জর্জিয়ার জার্সিতে কাভারাস্কেইয়ার রূপকথার ইমারত গড়ে তোলাটা। একজন ভারতীয় ফুটবল ভক্ত হিসেবে আমরা শুধু দেখেই গেলাম। যাকে বলে নীরব দর্শক। ২০১৫-তে জর্জিয়ার র্যাঙ্কিং ছিল ভারতের আশেপাশেই। আর ২০২৪-এ এসে ভারত আফগানিস্তানের কাছে হারছে। কোচ বিতাড়ন নিয়ে ডামাডোলে মেতে আছে। ভবিষ্যৎ রূপরেখা বিবর্ণ। আর সেখানে জর্জিয়া ইতিহাস গড়ছে পর্তুগালকে হারিয়ে! কুর্নিশ জানানোর সঙ্গে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাসও কোথায় যেন লুকিয়ে থাকে।
……………………………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………………………
তবে আশা-নিরাশার দাঁড়িপাল্লা সরিয়ে এ যেন এক ফুটবল-বৃত্তের পরিপূর্ণতা প্রাপ্তি। শুধু জর্জিয়ার জন্য নয়, রোনাল্ডোর জন্যও। কেরিয়ারের প্রায় শেষ লগ্নে দাঁড়িয়ে পর্তুগিজ মহাতারকা। দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে তাঁর ফুটবল জীবনের ছায়া। অসংখ্য সাফল্য নিয়ে একদিন তিনি মাঠ ছাড়বেন। চলে যাবেন অবসরের গ্রহে। থেকে যাবে এই ঘটনাগুলো। মাঠের বাইরে রোনাল্ডো অনুপ্রাণিত করেছেন নতুন প্রজন্মকে। এখনও করে চলেছেন। সাক্ষী গোটা ইউরোপ, ফুটবল দুনিয়া। জর্জিয়ার ফুটবল রূপকথায় তাই কাভারাস্কেইয়ারা অমরত্ব লাভ করুক, ক্ষতি নেই। কিন্তু সেই রূপকথায় রোনাল্ডোর অবদান অনস্বীকার্য, তা ভুললে চলবে না।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved