বিশ্বজয়ের পর তিনি বললেন, ‘আমার বলার ভাষা নেই। শুধু বলতে চাই, সকলকে ধন্যবাদ এই অসাধারণ জার্নিতে আমাকে সঙ্গে নেওয়ার জন্য। এই মুহূর্তগুলো সবার আজীবন মনে থাকবে। আজ তোমাদের পরিবার এখানে উৎসব করছে। অনেকের পরিবার দেশে রয়েছে। শুধু মনে রেখো আজকের এই দিনটার জন্য তাঁরা প্রত্যেকদিন কত আত্মত্যাগ করেছে।’ ভারতের সাজঘরে এটাই তাঁর শেষ কথা। এখন তিনি প্রাক্তন। যুদ্ধজয়ের শেষে ক্লান্ত যোদ্ধার কণ্ঠে বন্ধুত্বের কথা, পরিবারের কথা। একসঙ্গে নিজেদের বেঁধে রাখার কথা।
তিনি শচীন তেন্ডুলকরের মতো ‘ক্রিকেটের ঈশ্বর’ নন। তিনি ‘মহারাজ’ কিংবা ‘স্পেশাল’ও নন। তাঁর নামের আগে কেউ ‘কিং’ জুড়ে দেয় না। রাহুল দ্রাবিড় ভারতীয় ক্রিকেটের ‘দ্য ওয়াল’। ‘মিস্টার ডিপেন্ডেবল’। নামে অনেক কিছুই যায়-আসে। একজন মানুষের ক্রিকেটীয় দক্ষতা, বলা ভালো ইমেজ তৈরি করে দেয় সমর্থক-মিডিয়ার তৈরি করে দেওয়া নাম। তাই দ্রাবিড় ভরসার প্রতীক। কোথাও গিয়ে একটা টিউন সেট হয়ে যায়, যাই করো না কেন, আসলে তুমি বিপদকালে রক্ষা করতে পারছ কি না, সেটাই দেখার।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বজয়ের পর সেই জোব্বাটা খুলে ফেলতে পেরে কি তিনি তৃপ্ত? এই প্রথমবার এতটা আলো তাঁর মুখের ওপর। অনভ্যস্ত চেহারায় কিছুটা বিস্ময় খেলা করে। হয়তো ফিরে দেখেন নিজের ক্রিকেট জীবনের ফেলে আসা ১৫টা বছর। অধিনায়ক হিসেবে চূড়ান্ত ব্যর্থ বলে ধরা হয় তাঁকে। সঙ্গে রয়েছে গ্রেগ চ্যাপেলের সেই বিতর্কিত অধ্যায়। ২০০৭-এ ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্বকাপের সেই বিভীষিকাময় অধ্যায়ের প্রধান মুখ ছিলেন রাহুল দ্রাবিড়। রাস্তায়-রাস্তায় তখন পুড়ছে তাঁর ছবি। রাতের অন্ধকারে, পুলিশি প্রহরায় থমথমে মুখে দেশে পা রাখে টিম ইন্ডিয়া।
আর আজ সেই ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ থেকেই বিশ্বজয় করে ফেরা। অতীতবিলাসী হাওয়া তাঁকে অশান্ত করে না। এই তো বিশ্বকাপ চলাকালীনই এক সাংবাদিক খোঁচা দিয়েছিলেন ২৭ বছর আগের এক ব্যর্থতার কথা মনে করিয়ে। দ্রাবিড় উত্তর দিলেন, ‘আমি যে কোনও কিছু থেকে দ্রুত এগিয়ে যেতে পারি। সেটাই আমার বৈশিষ্ট্য। পিছন ফিরে তাকাই না। এখন কী করছি, সেটাই আসল।’ ১৯৯৭ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজে এসে পরাজয় হোক কিংবা নিজের দীর্ঘ ছায়াময় কেরিয়ার– ঠিক এই কথাটাই বারবার বলে এসেছেন তিনি।
আসলে দ্রাবিড় জানেন, ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করা যায় না। তাই অতীতের দিকে ফিরে তাকাতে চান না। যা পেয়েছেন, তাতেই খুশি। শচীনকে নিয়ে একবার তিনি বলেছিলেন, ‘আমার পরের প্রজন্ম হয়তো মনেই রাখবে না যে, আমিও টেস্ট আর একদিনের ক্রিকেটে ১০ হাজার রান করেছি। কিন্তু এটুকু বিশ্বাস রাখি, তাঁরা বলবে আমি শচীন তেন্ডুলকরের সঙ্গে খেলেছি।’ মজা করেই বলা। কিন্তু নিয়তি মুচকি হাসেন একথা শুনে। বরাবর তো এভাবেই কাটল। সমালোচনা শুনতে হয়েছে ইনিংসের ধীরগতি নিয়ে। সে অর্থে নিজের নামে কোনও বিশেষ শট লিখতে পারেননি। শুধুই ডিফেন্স আর ডিফেন্স।
প্রতিবারই জবাব দিয়েছে তাঁর ব্যাট। বিপদকালে ক্রমশ চওড়া হয়েছে ক্রিজে ছড়িয়ে পড়া ‘ওয়াল’ দ্রাবিড়ের ছায়া। মনে পড়তে পারে ২০০১-এ ইডেনে সেই ঐতিহাসিক ভারত-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচ। বর্ডার-গাভাসকর ট্রফির টেস্টে ফলো অন করে যে ম্যাচ পকেটে পুরেছিল ভারত। ইডেনের বাইরে যে ছবিটা রয়েছে, সেখানে স্বাভাবিকভাবেই নজর পড়বে ভিভিএস লক্ষণের দিকে। আকাশে তুলে ধরা দৃপ্ত ব্যাট, মুখে চওড়া হাসি। ২৮১ রানের ইনিংস খেলেছিলেন তিনি। আর পিছনে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন, সেদিন প্রবল জ্বর নিয়ে তিনিও করেছিলেন ১৮০। তবু যেন সেই ছবিতে দ্রাবিড়ের দিকে চোখ যায় না।
আন্তর্জাতিক কেরিয়ারের প্রথম দিন থেকেই নিজের কবচ-কুণ্ডল দান করে এগিয়েছেন তিনি। ১৯৯৬ সালের ২০ জুন লর্ডসে অভিষেক ঘটেছিল দুই কিংবদন্তির। আজও মানুষের মুখে-মুখে ফেরে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের ১৩১ রানের ইনিংস। কিন্তু ক’জন মনে রেখেছেন, ৭ নম্বরে নেমে দ্রাবিড়ের ৯৫ রান? কিংবা ১৯৯৯ বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কার টনটনে সৌরভের ১৮৩ রানের ‘বাপি বাড়ি যা’ ইনিংস। সেদিনও ছায়ার মতোই সঙ্গে ছিল দ্রাবিড়ের ১৪৫ রান। দ্বিতীয় উইকেটে উঠেছিল রেকর্ড ৩১৮ রান।
ক্রিকেটের খাতায় ঝলমল করে তাঁর অজস্র রেকর্ড। অথচ জনতার মাতামাতিতে নাম নেই। প্রচারের যতটা আলো নেমে আসে ভারতীয় ক্রিকেটের নায়কদের ওপর, তার তুলনায় তিনি কাব্যে উপেক্ষিত। মাইলস্টোন নিয়ে পরোয়া নেই। ক্রিকেটীয় তালিকায় প্রথম টিক মারা থাকে দলের স্বার্থে। অবসরের পর বিজ্ঞাপন বা ধারাভাষ্যের জগতেও তাঁকে দেখা যায়নি। বরং নীরবে তালিম দিয়েছেন একের পর এক উঠতি ক্রিকেটারদের। বিরাট-রোহিতদের অবসরের পর যাঁরা তৈরি নীল জার্সিতে মঞ্চ মাতাতে। ক্রিকেটার হিসেবে পারেননি, কোচ হিসেবে বিশ্বকাপ প্রাপ্তি যেন সেই নীরব সাধকের প্রতি বরাদ্দ ন্যায়বিচার। যিনি বারবার বলে এসেছেন, ‘আশা ছাড়তে নেই। আপনি যে জিনিসে ভাল তাকেই আঁকড়ে ধরতে হয়। আপনি যেটা ভাল পারেন সেটা মনপ্রাণ দিয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে করুন। দেখবেন হয়তো কোথাও একটা ন্যায়বিচার অপেক্ষা করে আছে। আসবেই এমন গ্যারান্টি নেই। কিন্তু আপনাকে পড়ে থাকতে হবে নিজের নিষ্ঠা নিয়ে।’
বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে হার, একদিনের বিশ্বকাপের ফাইনালে হার। গোটা দেশের মুখ থমথমে। ‘চোকার্স’ তকমা যেন জুড়তে চলেছে ভারতের গায়ে। তবু একজন মানুষ স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছেন। রোহিত শর্মার একটা ফোনে ফিরে এসেছিলেন দ্রাবিড়। জানতেন এবারই শেষ। তার আগে অনেক কিছুই প্রমাণ করার ছিল। না, শুধু বিশ্বকাপ জয় নয়। তাঁর প্রধান লক্ষ্য জানতে হলে নজর রাখতে হয় ভারতের সাজঘরে।
বিশ্বজয়ের পর তিনি বললেন, ‘আমার বলার ভাষা নেই। শুধু বলতে চাই, সকলকে ধন্যবাদ এই অসাধারণ জার্নিতে আমাকে সঙ্গে নেওয়ার জন্য। এই মুহূর্তগুলো সবার আজীবন মনে থাকবে। আজ তোমাদের পরিবার এখানে উৎসব করছে। অনেকের পরিবার দেশে রয়েছে। শুধু মনে রেখো আজকের এই দিনটার জন্য তাঁরা প্রত্যেকদিন কত আত্মত্যাগ করেছে।’ ভারতের সাজঘরে এটাই তাঁর শেষ কথা। এখন তিনি প্রাক্তন। যুদ্ধজয়ের শেষে ক্লান্ত যোদ্ধার কণ্ঠে বন্ধুত্বের কথা, পরিবারের কথা। একসঙ্গে নিজেদের বেঁধে রাখার কথা।
বিশ্বকাপ জয়ের আনন্দধ্বনি চলতেই থাকবে। কিন্তু দ্রাবিড়ের এই কথাগুলো যেন তাঁর কেরিয়ারের মতো ছায়ায় না ঢাকা পড়ে যায়। সাফল্য একদিনে আসে না, কিন্তু একদিন ঠিক আসে। প্রতিটা মানুষের জন্য বিশ্বাসের হাত এগিয়ে দেওয়া। সমালোচনা সত্ত্বেও ভরসা রাখতে শেখা। কোচ হিসেবে এটাই দ্রাবিড়ের সবচেয়ে বড় শক্তি। নিজেকে পিছনে রেখে সবাইকে নিয়ে চলতে শেখার মন্ত্রগুপ্তি। এক থেকে এগারো হয়ে ওঠার শক্তি। গোটা কেরিয়ার জুড়ে যেভাবে ছায়ায় থেকে লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন, এবার সেটাই তাঁকে কোচ হিসেবে পৌঁছে দিল ক্রিকেটবিশ্বের শীর্ষে। গত কয়েক বছর ধরে যে সাধনার সূত্রপাত, তা অবশেষে পূর্ণতা পেল বিশ্বকাপ জয়ে।
এর পর? তিনি ফের চলে যাবেন অন্তরালে। সময় কাটাবেন পরিবারের সঙ্গে। মাঝেমধ্যে তাঁকে দেখা যাবে, দেশের কোনও নাম-না-জানা স্টেডিয়ামে বসে সন্তানের খেলা দেখছেন। হয়তো মাঠে নেমে এক কিশোর ক্রিকেটারের স্টান্স ঠিক করে দিলেন। দেখিয়ে দিলেন প্রচণ্ড গতিতে ছুটে আসা বলকে কীভাবে শাসন করে নিঃশব্দে মাটিতে নামিয়ে দিতে হয়। তার পর হাসিমুখে নীরব প্রস্থান। পরিবারের সঙ্গে, পরিবারের জন্য। নিজের বিদায়ী ভাষণের মতো। রাহুল দ্রাবিড়, আপনি ভারতীয় ক্রিকেটের ‘ফ্যামিলি ম্যান’।