নয়ের দশকের গোড়ার দিকে, বেকেনবাওয়ার-জার্মানি সমীকরণটি, আরও নাটকীয়ভাবে ফিরে এল। বার্লিন প্রাচীর ভেঙে যাওয়ার মুখে, ঠান্ডা যুদ্ধের শেষ, মধ্য ও পূর্ব ইউরোপে কমিউনিজমের পতন, সোভিয়েতের ভাঙন আবহে মারাদোনা এলেন রোমে– বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলতে। ’৮৬-র অ্যানিমেটেড মারাদোনার বিপুল টিভি ভিউয়ারশিপ, উত্তুঙ্গ জনপ্রিয়তা, আর্জেন্টিনার পরপর দু’বার বিশ্বজয়ের আশার পাশে, নিঃশব্দে বাজিমাত করলেন কাইজার।
‘We’ll meet again
Don’t know where
Don’t know when
But I know we’ll meet again some sunny day…’
বেকেনবাওয়ার চলে গেলেন। আর অদ্ভুতভাবে, এই গানটা কী ভীষণ প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে আজ। ব্রাজিলীয় ফুটবলের ইতিহাসের সঙ্গে যদি সবচেয়ে আষ্ঠেপৃষ্ঠে বেঁধে থাকা ফুটবলার হন মারিও জাগালো, তবে জার্মানির ইতিহাসের সঙ্গে, কেবল ফুটবল নয়– রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাসের সঙ্গে নিয়তি, কী অদ্ভুতভাবে বেঁধে দিয়েছিল ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার ওরফে ‘কাইজার’-এর জীবনকে! মৃত্যু হয়তো কাইজারের নশ্বর শরীরকে নিয়ে গেল, কিন্তু ৫০ বছরের জার্মানির বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ইতিহাসের সঙ্গে, কাইজারের অবিচ্ছেদ্য সুতোটি ফিকে করে, কার সাধ্যি!
বিশ্বযুদ্ধ আবহে, ভেরা লিনের গাওয়া, রস পার্কার আর হিউই চার্লসের লেখা গানটি, মুখে মুখে ফিরেছিল শান্তিকামী জনতার। লিন, পার্কার আর চার্লসের স্বপ্ন সত্যি হয়েছিল অবশেষে। ১৯৪৫ সালের ৮ মে জার্মানি আত্মসমর্পণের পর, মোটামুটিভাবে শেষ হল বিশ্বযুদ্ধ। যদিও হিরোসিমা-নাগাসাকির ভয়াবহতা তখনও বাকি, তখনও বাকি শেষ অবধি লড়ে যাওয়া জাপানের আত্মসমর্পণ; কিন্তু জার্মানির আর কিছু বাকি ছিল কি? পোল্যান্ড, ইস্ট প্রুশিয়ার মতো দেশগুলি থেকে হাজারে হাজারে জার্মানের উদ্বাস্তু হয়ে পড়া, সোভিয়েত-ব্রিটিশ সেনার বুটের আওয়াজে ত্রস্ত হয়ে থাকা বার্লিন-মিউনিখের পথঘাট আর প্রবল খাদ্যাভাব-মহামারীতে বিপর্যস্ত এক দেশ। ’৪৫-এ যেসব জার্মানের জন্ম, বলা হয়, জার্মানির ইতিহাসে সবচেয়ে অন্ধকার সময়ে জন্মেছিলেন তাঁরা। ‘ঘরের কোণে একটিমাত্র মোমের আলো’-র মতো কাইজারের জন্মও একেবারে অন্ধকারের অতলে থাকা ওই সময়েই– বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার ঠিক চারমাসের মাথায়।
অনেকে বলেন, বেকেনবাওয়ার ফুটবলের প্রথম ‘লিবেরো’। ‘লিবেরো’ শব্দটির ফুটবলীয় ব্যাখ্যা বলে, দুই ডিফেন্ডারের পিছনে থাকা একজন সচল ডিফেন্ডার, যিনি ডিফেন্স লাইন ভেঙে গেলে ডানে-বাঁয়ে সরে গিয়ে শেষ মুহূর্তে বলকে ক্লিয়ার করবেন। লিবেরো-র কোনও ম্যান মার্কিং-এর ভার নেই, নেই কোনও ডিফেন্স লাইন ধরে রাখার দায়, সে উঠে গিয়ে আক্রমণেও সাহায্য করতে পারে দরকারে। ‘লিবেরো’– ইতালীয় এই শব্দটির আক্ষরিক অর্থ, ‘মুক্ত’ বা ‘ফ্রি’; বেকেনবাওয়ার, থমথমে জার্মানির ভেতর জন্মানো সেই একফালি মুক্তাঞ্চলের মতো থেকে গেলেন সারাজীবন, জার্মান ঔদ্ধত্যের ভেতরেও স্বকীয় তাঁর মেজাজ। কার্ল হেইঞ্জ রুমেনিগে বলছেন– ‘হি ওয়াজ সো এলিগেন্ট, হি ওয়াজ নট রিয়েলি জার্মান…’
‘আমি যখন জীবনের দিকে পিছন ফিরে তাকাই আমার মনে হয়, আমি জন্মেছিলাম, কোনও পয়মন্ত নক্ষত্রের নিচে’– এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন বেকেনবাওয়ার। সে নক্ষত্রের হদিশ পাই না আমরা, পাই কেবল আলো। আর কিছু টুকরো টুকরো স্মৃতি। বার্লিন দেওয়াল তখন অটুট। পশ্চিম জার্মানির হয়ে খেলছেন বেকেনবাওয়ার। ইউরোপীয় ফুটবল থেকে, বহুদূরে থাকা আমাদের এই জনপদ, কাগজে পড়ছে ’৬৬-র বিশ্বকাপের গল্প, পড়ছে কীভাবে ববি চার্লটনের পিছনে মিডফিল্ডে আঠার মতো লেগে থাকছেন, এক অদ্ভুত সুন্দর দেখতে জার্মান কিশোর। ’৬৬-র বিশ্বকাপে জার্মানির জয়টা জরুরি ছিল খুব। রাজনৈতিক ও সামাজিক উত্থানের ক্ষেত্রেও ব্রিটিশদের বিশ্বজয়, অনেকাংশে ব্যাকফুটে পাঠিয়ে দিচ্ছিল জার্মানদের। তিন দশকে, জার্মানির ফুটবলের সঙ্গে তাঁদের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক যোগ হয়ে উঠেছিল প্রত্যক্ষ। কিন্তু সেই হারের পর কাইজারের জবাব ছিল– ‘ইংল্যান্ড আমাদের হারিয়ে দিল, কারণ ওইদিন ববি চার্লটন, আমার চেয়ে সামান্য ভালো খেলে দিয়েছিল…’
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
‘আমি যখন জীবনের দিকে পিছন ফিরে তাকাই আমার মনে হয়, আমি জন্মেছিলাম, কোনও পয়মন্ত নক্ষত্রের নিচে’– এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন বেকেনবাওয়ার। সে নক্ষত্রের হদিশ পাই না আমরা, পাই কেবল আলো। আর কিছু টুকরো টুকরো স্মৃতি। বার্লিন দেওয়াল তখন অটুট। পশ্চিম জার্মানির হয়ে খেলছেন বেকেনবাওয়ার। ইউরোপীয় ফুটবল থেকে বহুদূরে থাকা আমাদের এই জনপদ, কাগজে পড়ছে ’৬৬-র বিশ্বকাপের গল্প, পড়ছে কীভাবে ববি চার্লটনের পিছনে মিডফিল্ডে আঠার মতো লেগে থাকছেন, এক অদ্ভুত সুন্দর দেখতে জার্মান কিশোর।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
এই আত্মবিশ্বাস যখন দেখাচ্ছেন বেকেনবাওয়ার, তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৯, আর এই আত্মবিশ্বাসটিই আগামী আটবছরে কী বিপুলভাবে বদলে দেবে জার্মানির ইতিহাস, ভাবলে অবাক লাগে। ১৯৭০ বিশ্বকাপে ’৬৬-তে বিতর্কিত হারের বদলা নেবে জার্মানি, কিন্তু সেমিফাইনালে হাত ভেঙে যাওয়া কাইজার শরীরের সঙ্গে হাতকে বেঁধে অর্ধেক ম্যাচ খেলেও জেতাতে পারবেন না দলকে। হাল ছাড়বেন না, ঠিক চারবছর পর এই বেকেনবাওয়ারের হাত ধরেই, তাঁরই ক্যাপ্টেন্সিতে বিশ্বজয় করবে জার্মানি।
এই আটবছরে জার্মানি খেলল তিনটি পরপর বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল, তার মধ্যে একবার চ্যাম্পিয়ন ও একবার রানার্স আপ। এই যে বদল, যা জার্মানিকে বিশ্বমঞ্চে একটু একটু করে ফের শক্ত খুঁটির ওপর দাঁড় করাচ্ছিল, অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর একাধিক সূচকের একটি হয়ে উঠছিল– তা কিন্তু এসেছিল আভ্যন্তরীণ ক্লাব ফুটবলের সাফল্যের কারণে, শুধু সাফল্য না, কিছু বদলের কারণেও বটে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: ব্রাজিলীয় ফুটবলের সঙ্গে নাড়ির যোগ যদি কারও থাকে, তা মারিও জাগালোর
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
বেকেনবাওয়ারের অভিঘাতটিকে বুঝতে গেলে, একবার তাকাতে হবে বায়ার্ন মিউনিখের এই সময়ের উত্থানের দিকে। ১৯৬৬ সালে বায়ার্ন জিতল জার্মান কাপ। ইউরোপীয় ফুটবলে ‘চার-ব্যাক’-এর ধারণা যত স্পষ্ট হল, তত ‘লিবেরো’-কে আরও আধুনিক রূপ দিতে থাকলেন বেকেনবাওয়ার। ফুটবলের ইতিহাসে এনগ্যাঞ্চে-র মতো পজিশনকে যদি মারাদোনা বিবর্তন ঘটান, তবে লিবেরোর সার্থক বিবর্তন ঘটাতে পেরেছিলেন বিশ্বের সর্বকালের সেরা (?) ডিফেন্ডার বেকেনবাওয়ার। ১৯৬৮-’৬৯-এ বায়ার্নের ক্যাপ্টেন হয়ে জেতালেন লিগ। আর তারপর, ১৯৭২-’৭৪ অবধি পরপর তিনবার লিগ চ্যাম্পিয়নশিপ এবং ১৯৭৪-’৭৬-এ পরপর তিনবার ইউরোপিয়ান কাপ জেতার নজির গড়ল বায়ার্ন। জার্মানির আন্তর্জাতিক ফুটবল দলের উত্থানের পিছনে জার্মানির ক্লাব-ফুটবলে বায়ার্নের নিজেদের সর্বোচ্চ আসনে তুলে আনার ঘটনাদু’টি পরিপূরক– আর এই দুয়ের পিছনেই তো রয়েছেন বেকেনবাওয়ার, প্রশ্নাতীতভাবে।
সাতের দশকের গোড়ায় জার্মানির রাজনীতির আকাশে যখন মস্কো চুক্তির সূর্য, পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানির সম্পর্কের নতুন সমীকরণের সূচনা পর্ব– তখনই জার্মানির ফুটবলের ইতিহাস, বাঁক নিচ্ছে কাইজারের হাত ধরে।
নয়ের দশকের গোড়ার দিকে, বেকেনবাওয়ার-জার্মানি সমীকরণটি, আরও নাটকীয়ভাবে ফিরে এল। বার্লিন প্রাচীর ভেঙে যাওয়ার মুখে, ঠান্ডা যুদ্ধের শেষ, মধ্য ও পূর্ব ইউরোপে কমিউনিজমের পতন, সোভিয়েতের ভাঙন আবহে মারাদোনা এলেন রোমে– বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলতে। ’৮৬-র অ্যানিমেটেড মারাদোনার বিপুল টিভি ভিউয়ারশিপ, উত্তুঙ্গ জনপ্রিয়তা, আর্জেন্টিনার পরপর দু’বার বিশ্বজয়ের আশার পাশে, নিঃশব্দে বাজিমাত করলেন কাইজার। ডিফেন্ডার ও অধিনায়ক বেকেনবাওয়ার, ততদিনে কোচ হয়ে ফিরে এসেছেন জার্মানির হটসিটে, লোথার ম্যাথাউজের ক্যাপ্টেন্সি আর কাইজারের মস্তিষ্কে ৮ জুলাই বিশ্বকাপ জিতল জার্মানি। আর তার ঠিক চারমাস পর ভেঙে গেল বার্লিন প্রাচীর, এক হয়ে গেল পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানি। যে বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার চারমাসের মাথায় জন্মেছিলেন কাইজার, তাঁর-ই বিশ্বজয়ী কোচ হওয়ার চারমাসের মধ্যে ভেঙে গেল বার্লিন ওয়াল। মাঝে থেকে গেছে ৩৫ বছরের এক অধ্যায়, যার প্রতিটিতেই কাইজার আছেন স্বমহিমায়।
আধভাঙা চাঁদের বৃত্ত যেন নিখুঁত হাতে জুড়ে দেয় কেউ। বেকেনবাওয়ার চলে গেলেন। ফিরে আসি, সেই গানটির কথায়– ‘But I know we’ll meet again some sunny day…’
যুদ্ধ বিধ্বস্ত জার্মনিতে সেই রোদেলা ভোর এসেছিল একদিন। জার্মানির ইতিহাসের বাঁকে যখনই কেউ এসে দাঁড়াবে, তখন নিশ্চিতভাবেই তাঁর সঙ্গে মোলাকাত হবে ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ারের। তিনিই, বিশ্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ডিফেন্ডার কি না, তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, কিন্তু বিশ্বযুদ্ধোত্তর জার্মানির ইতিহাসের নরম মাটির ওপর কাইজারের বুটের ছাপ যে সর্বত্র, তা নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই কারও…
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved