টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে প্রায় দু’মাস ব্যাপী আইপিএল দেখেছে ক্রিকেটবিশ্ব। দেখেছে, মারমুখী ব্যাটারদের দাপট। রেকর্ডবুকে ঝড় উঠেছে। কখনও দলের রান আড়াইশো, এমনকী, তিনশোর কাছাকাছি অঙ্কে পৌঁছে গিয়েছে রাতারাতি। তা দেখে আপ্লুত দর্শকের মন আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছে। ট্রাভিস হেড, ক্লাসেনদের মারমুখী ব্যাটিং দেখে সবাই একবাক্যে স্বীকার করেছেন, ক্রিকেট খেললে এভাবেই খেলতে হয়। আরে বাবা, দিনের শেষে ম্যাচ জেতালে তো ব্যাটাররাই জেতাবে, বোলাররা আর ক’বেই বা ম্যাচ জেতায়!
ছোটবেলায় শুনেছি, ক্রিকেট নাকি বড়লোকের খেলা। আরেকটু বড় হয়ে জেনেছি, ক্রিকেট জেন্টেলম্যান’স গেম। আরও পড়ে বুঝলাম, ক্রিকেট খেলাটা ব্যাটারদের। পাড়ার মাঠে খেলতে গিয়ে আবিষ্কার করেছিলাম, ক্রিকেট আদপে একজনের খেলা। যে ব্যাটের মালিক, তার। বল-বোলার ও বাকিরা তার কেনা গোলাম। প্রথমে ব্যাট সে-ই করবে। আউট হওয়াটাও তার মর্জি! না-পসন্দ হলে, ব্যাট নিয়ে ব্যাটের মালিক সটান বাড়িমুখো। খেলা ভণ্ডুল! ক্রিকেট যে সাম্যবাদে বিশ্বাস করে না, সেটা টের পেয়েছিলাম ব্যাট কিনতে গিয়ে। তার আকাশছোঁয়া দামের পাশে, বলের মূল্য নেহাতই সামান্য।
এমসিসি-র ক্রিকেট সংবিধান যদিও বলছে, খেলাটা ব্যাট এবং বলের। অর্থাৎ ক্রিকেটে দ্বিজাতিতত্ত্ব শুরু থেকেই প্রতিষ্ঠিত। একদিকে ব্যাটার, অপরদিকে বোলার। শর্ত হল, বোলার বল করবে, ব্যাটাররা গদাধারী ভীমের মতো তা হাঁকাবে। টেনিদার ভাষায়, ওভার বাউন্ডারি! তাঁর স্রষ্টাও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন। ভবিষ্যতে যে টি-টোয়েন্টি নামক বিশ-বিশে নীলকণ্ঠ হয়ে উঠবে ক্রিকেট, তেমনটা বোধহয় আগাম আন্দাজ করতে পেরেছিলেন।
কিন্তু মাঝের সময়টাকে ভেবে দেখুন। শচীন যে শুধু নব্বইয়ে নড়বড়ে ছিলেন, তাই নয়, আমরাও আসলে নাইন্টিজে নড়বড়েই ছিলাম। ক্রিকেট ক্রমে ধর্মে পরিণত হয়ে ওঠার নেপথ্যে ছিল মানুষের জীবনের মতোই মাঠের ভেতরকার ফলাফল। হার-জিত এখনও আছে, তবে তখনকার সঙ্গে এখনকার ফারাক কী? এত হেলায় আমরা জিততাম না। আমাদের এত মাসল পাওয়ার ছিল না। খেলোয়াড়দের দৈহিক গড়ন পর্যন্ত আলাদা করে চিনতে পারার মতো ছিল না। তাঁরা ব্যর্থ হতে পারতেন যখন-তখন। সেই দলে দু’-একটা তারকা, আর বাকিরা ট্যালেন্টেড লড়াকু। আজকের মতো দূরদ্বীপবাসিনী ছক্কা তাঁরা মারতেন না বলেই, আমজনতার কাছাকাছি তাঁরা দিব্যি ছিলেন। পাড়ার মাঠে একটা ছক্কা মেরে মনে হত, এই তো অজয় জাদেজা, ওই তো রবিন সিং।
জন্মলগ্ন থেকেই অবশ্য টি-টোয়েন্টি মারমুখী। বাকি দুই ফরম্যাট থেকে সে যে আলাদা, বুঝিয়ে দিতে কসুর করেনি। আইপিএলের আবির্ভাবের পর সেই ছবিটা আরও নির্মম হয়েছে। তখন থেকে ব্যাটারদের রাজপাট। মার্কামারা বলিউড ফিল্মের মতো তারাই বাদশা, বোলাররা ভিলেন। মার খাওয়াটা বোলারদের স্বভাবধর্ম। পাওয়ার প্লে থেকে ফ্রি-হিট– শূলে চড়ানোর সমস্ত বন্দোবস্তই সেরে রেখেছিলেন নিয়ামকরা। তাদেরই বা কী দোষ! টেস্ট নামক মহীরুহ পাঁচদিনের ধকল নিতে গিয়ে ধুঁকছে। ওয়ান ডে নামক রঙিন ক্রিকেটকে ভীষণ রকম ম্যাড়ম্যাড়ে দেখাচ্ছে। অতএব, রুজি-রোজগারের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বিশল্যকরণী খুঁজতে হবে যে। আর সেটা খুঁজতে গিয়েই পাওয়া গিয়েছে বিষবৃক্ষ। টি-টোয়েন্টি যার নাম। পাটা পিচে বোলারদের বিরুদ্ধে ‘তাবড়তোড় বল্লেবাজি’ না দেখলে যে দর্শকের পেটের ভাত হজম হয় না। তাই ‘দে ঘুমাকে’!
………………………………………………………………………..
ক্রিকেট ক্রমে ধর্মে পরিণত হয়ে ওঠার নেপথ্যে ছিল মানুষের জীবনের মতোই মাঠের ভেতরকার ফলাফল। হার-জিত এখনও আছে, তবে তখনকার সঙ্গে এখনকার ফারাক কী? এত হেলায় আমরা জিততাম না। আমাদের এত মাসল পাওয়ার ছিল না। খেলোয়াড়দের দৈহিক গড়ন পর্যন্ত আলাদা করে চিনতে পারার মতো ছিল না। তাঁরা ব্যর্থ হতে পারতেন যখন-তখন। সেই দলে দু’-একটা তারকা, আর বাকিরা ট্যালেন্টেড লড়াকু।
………………………………………………………………………..
কথিত আছে, কোনও এক প্রদর্শনী ম্যাচে প্রথম বলে বোল্ড হয়ে যাওয়ার পর ফের পড়ে যাওয়া স্টাম্প ঠিক করে ব্যাট করতে রেডি হচ্ছিলেন ডব্লুউ জি গ্রেস। আম্পায়ার ‘আউট’ বলাতে তাঁর জবাব ছিল, ‘তোমার আম্পায়ারিং নয়, দর্শক আমার ব্যাটিং দেখতে এসেছে। যাও, আম্পায়ারিং করো।’ গ্রেসের সেই কালজয়ী উক্তি বোধহয়, ক্রিকেটের পরিণতির ভাষ্য রচনা করে দিয়েছিল সকলের অগোচরে। বুঝিয়ে দিয়েছিল, অদূর ভবিষ্যতে ক্রিকেটে ব্যাটাররাই রাজ করবে। বোলাররা থাকবেন, তবে ২২ গজ নামক বধ্যভূমিতে স্রেফ কচুকাটা হওয়ার জন্য।
চেয়ে দেখুন, ক্রিকেটে আজ বিনোদন আছে, রানের ফুলঝুরি আছে, ছয়ের ফোয়ারা আছে, যেটা নেই তা হল বোলারদের স্বীকৃতি। যেন অলিখিত নিয়ম চালু ক্রিকেট সমাজে– ব্যাটার মানেই উচ্চবংশজাত, বোলার মানেই উপেক্ষিত, অপাঙক্তেয় অন্ত্যজ।
……………………………………………………………………….
আরও পড়ুন রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়-এর লেখা: বাউন্সারে উপড়ে ফেলা দাঁত ব্যাটারকে দিয়ে বলেছিলেন পরে লাগিয়ে নিতে
……………………………………………………………………….
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে প্রায় দু’মাস ব্যাপী আইপিএল দেখেছে ক্রিকেটবিশ্ব। দেখেছে, মারমুখী ব্যাটারদের দাপট। রেকর্ডবুকে ঝড় উঠেছে। কখনও দলের রান আড়াইশো, এমনকী, তিনশোর কাছাকাছি অঙ্কে পৌঁছে গিয়েছে রাতারাতি। তা দেখে আপ্লুত দর্শকের মন আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছে। ট্রাভিস হেড, ক্লাসেনদের মারমুখী ব্যাটিং দেখে সবাই একবাক্যে স্বীকার করেছেন, ক্রিকেট খেললে এভাবেই খেলতে হয়। আরে বাবা, দিনের শেষে ম্যাচ জেতালে তো ব্যাটাররাই জেতাবে, বোলাররা আর ক’বেই বা ম্যাচ জেতায়!
কিন্তু উপমহাদেশ টপকে টি-টোয়েন্টি হাডসন তীরে আসতেই চোখ কপালে ওঠার জোগাড়! ব্যাটাররা হালে পানি পাচ্ছেন না। রান একশোর গণ্ডি পেরনোর আগেই লুটিয়ে পড়ছে তাঁদের যাবতীয় দাপাদাপি। সেখানে ছড়ি ঘোরাচ্ছেন বোলাররা। প্রতি ম্যাচে নিয়ম করে অল্প রানের পুঁজি নিয়ে লড়তে হচ্ছে রোহিত শর্মাদের। জয়ের জন্য তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে বোলারদের দিকে। মনে মনে স্মরণ করতে হচ্ছে ইষ্টদেবতাকে। এ যে একপ্রকার অধর্ম! ক্রিকেটকে ধর্ম মেনে চলা মনুষ্য প্রজাতির পক্ষে তা যে বড়ই কষ্টকর!
উলটপুরাণ হতেই পিচের ওপর দূরবিন নিয়ে উপুড় হয়ে পড়েছে ক্রিকেটকুল। মার্কিন মুলুকে ২২ গজে আদৌ খেলার উপযুক্ত কি না, তা নিয়ে মেল-বর্ষণ শুরু হয়ে গিয়েছে আইসিসি দপ্তরে। আইসিসি আশ্বাস দিয়েছে, চেনা ছবি বদলাবে। পিচ বদল হবে। অর্থাৎ, চোখের আরাম হবে দর্শকদের, ফের ছড়ি ঘোরাবেন ব্যাটাররা। কিন্তু প্রতিশ্রুতি সার। কোথায় কী! ভারতকে ১১৯ রানে বেঁধেও ম্যাচ বের করতে পারেননি বাবর আজমরা। কোনও এক জসপ্রীত বুমরার সৌজন্যে। হাইভোল্টেজ ম্যাচে স্নায়ুর চাপ থাকে, এমন গুরুগম্ভীর বার্তা দিয়ে সেটাকে ব্যতিক্রম প্রমাণ করা যেতেই পারে। কিন্তু সেই মহারণের ২৪ ঘণ্টা কাটতে না কাটতে দক্ষিণ আফ্রিকা-বাংলাদেশ ম্যাচ, সেখানেও একই দৃশ্য। সাকিব, মাহমুদুল্লাহদের মুখের গ্রাস কেড়ে নিলেন কেশব মহারাজরা। জাতে তাঁরা বোলার।
………………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………………..
তাহলে ক্রিকেট উপপাদ্যে কী প্রমাণিত হল? শুধু ব্যাটাররা নয়, বোলারও ম্যাচ জেতায়। ক্রিকেট যে ব্যাট-বলের খেলা।
জাতি হিসেবে বাঙালি নির্বাক ছিল না কখনও, তার শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির দিকচিহ্নগুলিকে আবারও নতুন করে ফিরে দেখা সম্ভব হবে, বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে। পৃথিবীর তাবৎ সংস্কৃতি গবেষণার চিন্তন-ভূগোলে বাংলা ভাষা এবং বাঙালি সাংস্কৃতিক নতুনতর মাত্রা যোগ করবে– এ দাবি অহেতুক নয়।