একটা সময় পর ইস্টবেঙ্গল বা মোহনবাগানের সঙ্গে তাদের ম্যাচের ক্ষেত্রে ‘ডার্বি’ শব্দটাই ব্যবহার করা হত না আর। বলা হত, ‘মিনি ডার্বি!’ ময়দানের তিন প্রধানের অন্যতম, ব্রিটিশদের হেলায় হারানো ক্লাবের জন্য এই তকমা তো আর কম অপমানের, কম লাঞ্ছনার নয়! তাই হয়তো আই লিগ জয়ের উৎসবের মধ্যেও চেনা সাংবাদিককে দেখে এক সাদা-কালো সমর্থক বলে ওঠেন, ‘এবার থেকে আর তোমরা মিনি ডার্বি লিখতে পারবে না!’
একটা হুডখোলা বাস এসে দাড়িয়েছে ফোর্ট উইলিয়ামের দক্ষিণ দ্বারে। রবিবার। ঘড়ির কাঁটায় রাত ন’টা বাজবে বাজবে করছে।
সেই গেট থেকে রেড রোড ধরে মহামেডান স্পোর্টিং তাঁবু পর্যন্ত যেতে কত সময় লাগতে পারে?
পাঁচ, বরজোর ছয় মিনিট। তাও আবার সেটা শম্বুকগতিতে হেঁটে গেলে।
সামাদ আলি মল্লিক, বিকাশ সিং, এডি হার্নান্ডেজদের সেই সরণে সময় লাগল মোটামুটি পৌঁনে একঘণ্টা! সমর্থকদের বাঁধভাঙা আবেগের সামনে যে বারবার, প্রতি মুহূর্তে রুদ্ধ হল ফুটবলারদের গতি। তা ঠেলেই কোনওরকমে ক্লাব তাঁবুতে এসে ঢুকলেন তাঁরা।
অবশ্য ফুটবলারদের প্রতীক্ষায় দৈর্ঘ্য তো কিছুই নয় মহামেডান অনুরাগীকুলের অপেক্ষার প্রেক্ষাপটে। তাঁরা তো সেই ক’বে থেকে অপেক্ষা করে আছে এমন একটা মুহূর্তের, এমন একটা উদযাপনের। যে উদযাপনে তাঁরা প্রকটভাবে প্রকাশ করতে পারবেন, ক্লাব নিয়ে তাঁদের গর্বের চালচিত্র। দেখাতে পারবেন ময়দানের অন্য দুই প্রধানের সমর্থক-শিবিরকে, তাঁরাও পারেন ভারতীয় ফুটবলের শীর্ষস্তরে সামিল হতে। কবে থেকে গোনা যেতে পারে সেই অপেক্ষার দিনলিপি? ২০১৩-’১৪ মরশুম? যেবার দীর্ঘ বিরতির পর ফের একবার ভারতীয় ফুটবলের শীর্ষপর্যায়ে উঠে এসেছিল মহামেডান? কিন্তু সমর্থকদের আশায় জল ঢেলে সেবারই তো মরশুম শেষে অবনমনের কালো তালিকায় নাম লেখায় তারা। নাকি ২০২০ সাল? যেবার ফের আই লিগে উঠে এল মহামেডান! ময়দানের অন্য দুই প্রধানের মতো কর্পোরেটের সঙ্গে নাম জোড়ার তাগিদ যেবার চাগাড় দিল সাদা-কালো কর্তাদেরও, সেই সুবাদে ইনভেস্টর হিসাবে তাঁবুতে ঢুকে পড়ল বাঙ্কারহিল।
সুধীজন, মনে রাখতে হবে, ততদিনে আইএসএল জাঁকিয়ে বসেছে ভারতীয় ফুটবলে। এএফসি-র একটা স্লট তখনও আই লিগের হাতে ছিল বটে। কিন্তু জাতীয় দল নির্বাচনই হোক বা দেশজোড়া প্রচার– সবটাই ছিল আইএসএলের ভাগ্যরেখায়। এ যেন মিরজাফরকে সামনে রেখে রবার্ট ক্লাইভের বাংলা শাসন করা! দীর্ঘদিন ক্লাবের কোনও সাফল্য নেই। কিন্তু মহামেডানের সমর্থনে জড়ো হওয়া চিরচেনা ভিড়ের ছবিটা ফিকে হয়নি একবিন্দুও। ক্লাবের সুদিনে উৎসবে গা ভাসানোর অপেক্ষায় থাকা মুখগুলির একটাই মনোকামনা ছিল– ভারতীয় ফুটবলের শীর্ষস্তরে ফিরিয়ে আনতে হবে মহামেডানকে। যেকোনও মূল্যে। তা সেকাজে সফল হয়েছে মহামেডান। আই লিগ এসেছে। বাদ্যি বেজেছে। সেজে উঠেছে তাঁবু। ক্লাব লাইসেন্সিংয়ের সামান্য ফ্যাকড়া আছে বটে। তবে ওটা না থাকার মতোই। সেসব ফর্মালিটি মিটিয়ে ফেললেই আগামী মরশুমে আইএসএলেও শোনা যাবে– ‘জান জান মহামেডান’!
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
ব্রিটিশ ভারতে মোহনবাগানের আইএফএ শিল্ড জয়ের কিংবদন্তি অজানা নয় আমাদের। কিন্তু সে সাফল্য শুধুই যেন সলতের গায়ে আগুন ছুঁইয়ে দিয়েছিল। এরপর মহামেডান যেটা করেছিল, তা ছিল আক্ষরিক অর্থেই দাবানল! যে বিধ্বংসী আগুন, থুড়ি ফুটবলের সামনে দাঁড়াতে বুক কাঁপত গোরাদের তাবড় তাবড় ফুটবলারের। প্রথম ভারতীয় ক্লাব হিসাবে কলকাতা লিগ জিতেছিল মহামেডান, ১৯৩৪ সালে। সেখানেই থেমে যায়নি। পরের চারটা বছরও লিগ ঢুকেছিল মহামেডান তাঁবুতেই।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আসলে জার্সির রংয়ের মতো মহামেডান ক্লাবটাও সাদা-কালো। কখনও সাফল্যের ধবল শৃঙ্গে, তো কখনও ব্যর্থতার অতল আঁধারে নিমজ্জিত! ব্রিটিশ ভারতে মোহনবাগানের আইএফএ শিল্ড জয়ের কিংবদন্তি অজানা নয় আমাদের। কিন্তু সে সাফল্য শুধুই যেন সলতের গায়ে আগুন ছুঁইয়ে দিয়েছিল। এরপর মহামেডান যেটা করেছিল, তা ছিল আক্ষরিক অর্থেই দাবানল! যে বিধ্বংসী আগুন, থুড়ি ফুটবলের সামনে দাঁড়াতে বুক কাঁপত গোরাদের তাবড় তাবড় ফুটবলারের। প্রথম ভারতীয় ক্লাব হিসাবে কলকাতা লিগ জিতেছিল মহামেডান, ১৯৩৪ সালে। সেখানেই থেমে যায়নি। পরের চারটা বছরও লিগ ঢুকেছিল মহামেডান তাঁবুতেই। তখনও পর্যন্ত ‘ডরহ্যাম লাইট ইনফ্যান্ট্রি’ ছাড়া অন্য কোনও দলই লিগ জয়ের হ্যাটট্রিকটুকুও করতে পারেনি। সেই অবস্থায় দাঁড়িয়ে টানা পাঁচটা লিগ জয়, তাও আবার একটা ভারতীয় ক্লাব হয়ে! কতটা কঠিন,পাঠক, নিজেরাই ভেবে দেখুন! শুধু তাই নয়, প্রথম ভারতীয় ক্লাব হিসাবে ডুরান্ড ট্রফি জেতার কৃতিত্বও রয়েছে মহামেডানের ঝুঁলিতে।
মহামেডানে কিছুটা আঁধার নামে দেশভাগের প্রভাবে। আসলে স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী ভারতে মুসলমান সম্প্রদায়ের আত্মার আত্মীয় হয়ে উঠেছিল কলকাতার এই ক্লাব। বেঙ্গালুরুর মুসলিম ইনস্টিটিউট এবং লাহোর ও ঢাকার কিছু ক্লাব ছিল বটে। কিন্তু ময়দানের এই প্রধানের মতো গরিমা ছিল না তাদের। কিন্তু দেশভাগের পর মুসলিম ফুটবলারদের অনেকেরই ঠিকানা বদলে যায়। ফলে ভালো প্লেয়ারের একটা আকাল হয় মহামেডানে। তা সত্ত্বেও ভালো দল গড়ার কাজটা চালিয়ে গিয়েছিলেন কর্তারা। কিন্তু ভালো কর্তার আকাল হওয়ায় গত শতাব্দীর শেষ দশক থেকে ক্রমেই নিম্নগামী হয়ে পড়ে ক্লাবের পারফরম্যান্স। কতটা খারাপ অবস্থায় চলে গিয়েছিল মহামেডান? একটা সময় পর ইস্টবেঙ্গল বা মোহনবাগানের সঙ্গে তাদের ম্যাচের ক্ষেত্রে ‘ডার্বি’ শব্দটাই ব্যবহার করা হত না আর। বলা হত, ‘মিনি ডার্বি!’ ময়দানের তিন প্রধানের অন্যতম, ব্রিটিশদেরে হেলায় হারানো ক্লাবের জন্য এই তকমা তো আর কম অপমানের, কম লাঞ্ছনার নয়! তাই হয়তো আই লিগ জয়ের উৎসবের মধ্যেও চেনা সাংবাদিককে দেখে এক সাদা-কালো সমর্থক বলে ওঠেন, ‘এবার থেকে আর তোমরা মিনি ডার্বি লিখতে পারবে না!’
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: খেলায় গতি থাকুক, জীবনে থাকুক বিরতিচিহ্নগুলি
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
যেটা বলছিলাম। মহামেডান সমর্থকদের অপেক্ষার টাইমলাইন কবে থেকে শুরু হবে? সেটা নিশ্চিতভাবে বলার উপায় নেই। কিন্তু অবসানের পথে চলাটা শুরু হয়ে গিয়েছিল ’২০-র অক্টোবর থেকেই। যেদিন ইনভেস্টর হিসাবে মহামেডানের সঙ্গে জুড়ল বাঙ্কারহিলের নাম। বাঙ্কারহিলের কর্তা দীপককুমার সিং অবশ্য ক্লাবে নতুন নয়, আগে থেকেই জড়িত ছিলেন। তাই সাদা-কালোর ভাগ্যবিধাতাদের বাগে আনতে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি তাঁকে। উল্টোদিকে, ক্লাবকর্তাদের মধ্যেও তেমন ‘লড়কে লেঙ্গে’ মানসিকতা ছিল না। ধীরে ধীরে, একটু একটু করে কর্পোরেট সংস্কৃতির সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে মহামেডান। যে মহামেডানে কর্তারা ঠিক করে দেন না, প্রথম একাদশে কে থাকবে আর কে থাকবে না। যে মহামেডানে হাতে হাত রেখে কাজ করেন ক্লাব কর্তা এবং বিনিয়োগকারীরা (মাথায় রাখবেন, কলকাতার এক প্রধানে ফুটবল টিমের দৈনন্দিন কার্যক্রম চালানোর ক্ষেত্রে ক্লাব কর্তারা একপ্রকার ব্রাত্য। আরেক প্রধানে বর্তমানে একটু ফিল গুড পরিবেশ থাকলেও বিনিয়োগকারীকে তাড়ানোর ক্ষেত্রে ক্লাবকর্তাদের ‘দক্ষতা’ ও ‘অভিজ্ঞতা’ প্রশ্নাতীত!) সেখানে কীভাবে একজোট হয়ে কাজ করতে হয়, গোটা ভারতীয় ফুটবলের কাছে মডেল হতেই পারে মহামেডান।
বাঙ্কারহিল আরও একটা কাজ করেছে। পুরোপুরি পেশাদারিত্বে মুড়ে ফেলেছে টিম পরিচালনার খুঁটিনাটি। এবারের আই লিগে যে দলটা খেলাল মহামেডান, সেদলের কেউই তো তারকা নন। মূল বিদেশিদের মধ্যে অ্যালেক্সিস গোমেজ এসেছেন সুদেবা দিল্লি এফসি থেকে, যে দলটা গতবারই নেমে গিয়েছে দ্বিতীয় ডিভিশনে। মিরাজলল কাসিমভ খেলতেন নেরোকায়। সাম্প্রতিক অতীতে আবিওলা দাউদা, স্টেফান ইলিচ, জামাল ভুঁইঞার মতো নামকরা বিদেশিদের এনে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য পায়নি মহামেডান। তাই এবার এডি হার্নান্ডেজ, ইভজেনি কজলভদের খুঁজে খুঁজে বার করেছে সাদা-কালোর স্কাউট টিম। যেভাবে দলে নেওয়া হয়েছে ডেভিড লালহ্লানসাঙ্গা, বিকাশ সিং, লালরেমসাঙ্গা, তন্ময় ঘোষ বা আঙ্গুসানা লুয়াংকে। আইজল, ট্রাউ, রাজস্থান ইউনাউটেড, গোকুলাম কেরালা বা ইস্টবেঙ্গল থেকে।
সঙ্গে বলতে হবে দীপেন্দু বিশ্বাসের কথা। যিনি ফুটবল সচিব আর টিম ম্যানেজারের দ্বৈত ভূমিকায় লড়ে গিয়েছেন দিনের পর দিন।
বছর পাঁচেক আগেও মহামেডানের অবস্থা ছিল তাদের তাঁবুর মতোই, ভাঙাচোরা। আসলে তখন মহামেডান ছিল প্রায় আড়াই-তিন দশকে একটা বলার মতো ট্রফি না জেতা ক্লাব। কর্তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বে জীর্ণ ক্লাব। ক্ষণে ক্ষণে কোচ তাড়ানো, ফুটবলারদের বেতন সময়ে না দেওয়া- এমন হাজার একটা অভিযোগ আর বিতর্ক একটা সময় যেন সমার্থক হয়ে উঠেছিল মহামেডানের। কিন্তু সেসব আজ অতীত। কর্পোরেট ম্যানেজমেন্ট, দোতলা ঝকঝকে তাঁবু। এ মহামেডানের সঙ্গে ইস্ট-মোহনের ম্যাচকে আর ‘মিনি ডার্বি’ বলা যাবে না! এ মহামেডান অন্য মহামেডান।
কবির কোনও ভ্যানিটি ছিল না। যেখানে সেখানে বসে পড়তেন চায়ের ঠেকে। কেউ চাইলেই এক টুকরো কাগজে কোনও কবিতার লাইন লিখে দিতেন। তারপর সেটার কী হত, জানতেও চাইতেন না। এমনিই ছিল তাঁর সরল জীবন-যাপন। সেই প্রয়াত কবি অরুণ চক্রবর্তীকে নিয়ে এই বিশেষ স্মৃতিচারণা।