আপনার সেই হাত, এমিলিয়ানো। আমাদের ফ্ল্যাশব্যাকে ফুটবল নয়, ফুটবলের বাইরে আরও অনেক কিছু হাতের ব্যাটন কেড়ে নেয়। একটা অলৌকিক বায়োস্কোপ লাগিয়ে চোখের সামনে ধরায়। আমরা কাচ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখি। ১৯৩৮ সালে নিজের বাড়িতে হুইস্কির সঙ্গে সায়ানাইড মিশিয়ে গলায় ঢেলে দিচ্ছেন কবি লুইপল্ড লুগানেস। ১৯৫৩ সালের ৯ এপ্রিল বোন ইভা পেরনের ছবির দিকে মুখ করে কপালে পিস্তল ঠেকিয়ে ট্রিগার টিপছেন জুয়ান পেরন। ২০২০-র মে’তে সাইকেল চুরি আটকাতে গিয়ে রাস্তায় ছিটকে পড়ে কোমায় চলে যেতে হচ্ছে ৭৪ পেরনো টমাস ফিলিপ কার্লোভিচকে, কেরিয়ারের জন্য দেশ ছাড়তে চান কিনা প্রশ্ন করা হলে যাঁর কান্না ভেজা উত্তর ছিল, ‘নো স্যার, ডোন্ট আস্ক মি দ্যাট’।
অ্যান্থেম ডে’র কথা মনে পড়ছে এমিলিয়ানো। ১৮১৩-র ১১ মে ‘হিমনো ন্যাশিওনেল আর্জেন্টিনো’, ভিসেন্টে লোপেজের কলম, কম্পোজার ব্লাস পেরেইরার সুরের সেই হিমনো ন্যাশিওনেল, যা ১৯০০ সালে স্পেনবিরোধী অংশগুলিকে ছেঁটে আজকের শরীর পেল, নীল-সাদা ডোরাকাটা এবং সান অফ মে-র পতাকা থেকে সোচ্চারে উড়ল প্যাট্রিওটিক মার্চের লেগ্যাসি। এমিলিয়ানো, আপনারা গাইলেন– ‘হিয়ার, মর্টালস, দ্য সিক্রেড ক্রাই/ ফ্রিডম, ফ্রিডম, ফ্রিডম…!’ অথবা ম্যানুয়েল বেলাগ্রিনোর নকশায় তৈরি ট্রাইব্যান্ড! ১৮১২-র ২৭ ফেব্রুয়ারি রোজারিওর রাস্তায় ওড়ানো প্রথম নীল-সাদা-নীল। ১৮১৮-য় সেই ট্রাইব্যান্ডের সেন্টারে ঢুকে যাওয়া হলুদ ‘সান অফ মে’। ২২ ডিসেম্বর ভিকট্রি প্যারেডে ওবেলিস্কাসের সমুদ্র, নীল সাদা ক্যানভাসে কনট্রাস্ট অগ্রাহ্য করে ওড়া ‘হাই ইন দ্য স্কাই, দ্য ওয়ারিয়র ইগল’।
আরও পড়ুন: পা নিয়ে যত পাঁয়তারা
এমিলিয়ানো– এইসব সদ্য স্মৃতি, প্রাচীন স্মৃতি পেরিয়ে ২০২৩-এর নভেম্বরের মারাকানা– ২০১৪-র ম্যাসাকার পেরিয়ে একুশের ফাইনাল, একটা আঞ্জেলিক চিপ, ১-০ এবং তৈরি হওয়া চেন অফ লেগ্যাসি। এমিলিয়ানো, মারাকানার গ্যালারিতে ওভাবে হাতটা বাড়িয়ে দিলেন আপনি? ভয় করল না?
এমিলিয়ানো, আপনি না থাকলে ওবেলিস্কাস হতো না, বাইশে ডিসেম্বর হত না। একটা ১২২ মিনিট ৪১ সেকেন্ডের কালো মুয়ানি চিপ যেকোনও নির্ভরযোগ্য গোলরক্ষকের বাঁদিক দিয়ে বেরিয়ে ছিঁড়ে ফেলত অবিশ্বাসী জাল। অনন্ত যন্ত্রণা নিয়ে মাঠ ছাড়তেন লিও মেসি। ডিমারিয়া ফাইনালে গোল করেও হেরে যাওয়ার অবিশ্বাস নিয়ে, বৃষ্টি, ঠান্ডা আর অন্ধকারের লেগ্যাসি নিয়ে চলে যেতেন মাঠ ছেড়ে। ম্যাকালিস্টার, আলভারেজ, এনজো-দের কেউ বিশ্বাস করত না, গোটা টুর্নামেন্টের অবিশ্বাস্য ফুটবলের পরেও ওই একটা কালো মুয়ানি মুমেন্ট শেষ করে দিতে পারত সব কিছু। করেনি। এমিলিয়ানো, আপনি স্টেডিয়ামের ব্যারাকের ওপর সেইভাবে গ্রিপ পাচ্ছিলেন না। দু’-একবার উঠেও পড়ে যেতে যেতে সামনে একটা লাঠি পেলেন। কয়েকটা ব্যাটন পেলেন। ওরা চেঁচিয়ে আপনাকে কিছু বলল। আপনি সজোরে চিৎকার করে আরও কিছু বললেন। আপনার তখন কামুর কথা মনে হয়েছিল? ‘What I know most surely in the long run about morality and obligations, I owe to football.’ এমিলিয়ানো, গ্রহের সবচেয়ে নান্দনিক ফুটবল দলের শেষ রক্ষক আপনি, একবারও ব্যক্তিগত বিপদের কথা ভাবলেন না? তখন মাথায় শুধুই সমর্থক, দেশ, সান অফ মে? এমিলিয়ানো, আপনারা রক্তমাংসের তো?
দুটো দেশ এমিলিয়ানো, আর তাদের মাঝে রক্তের ইতিহাস। ১৯২৫ কোপা ফাইনালে স্পোর্টিভো বারাকাস স্টেডিয়ামে প্রথম দেখা। রোমান মুর্টিস এবং ফার্দিনান্দের ভেতর ট্যাকল, খণ্ডযুদ্ধ, ২-২। ‘বারাকাস ওয়ার’-এর পর ১১ বছর পারস্পরিক ক্রোধে মুখোমুখি হল না দুটো দল। ১৯৩৭-এর ফাইনাল। নীল-সাদা সমর্থকদের ‘মাঙ্কি কলিং’-এ গ্যালারি থেকে মাঠে রক্তের লেগ্যাসি, অনিয়মের লেগ্যাসি। ২-০ পিছিয়ে থাকা ম্যাচ বিতর্কিত গোলের পর ওয়াকওভার দিল ব্রাজিল। পাল্টা আর্জেন্টিনার ওয়াকওভার ১৯৩৯-এর কোপায়। ২-২ ড্র ম্যাচে রেফারির বিরুদ্ধে ক্রোধে মাঠ ছেড়ে চলে গেল আর্জেন্টিনা, ফাঁকা গোলে পেনাল্টি ঠেলে ৩-২-এ ম্যাচ শেষ করল সেলেকাওরা। ১৯৪৬-এর সাউথ আমেরিকান চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে ব্রাজিলের জায়ার রোসে পিন্টোর কুখ্যাত ট্যাকলে আর্জেন্টাইন ক্যাপ্টেন জোসে সালোমনের টিবিয়া ফিবিউলা ভেঙে গেল, কেরিয়ার শেষ হয়ে গেল কার্যত। আর কত এমিলিয়ানো? ১৯৭৮-এর সেই কুখ্যাত পেরু ম্যাচ, ১৯৮২-র বাতিস্তার গায়ে পা তোলা দিয়েগো, নব্বইয়ে ব্র্যাঙ্কোকে ট্রাঙ্কুইলাইজার মেশানো ‘পবিত্র জল’ খাওয়ানোর কালো অভিযোগ। এইসব দাগের পাশে সেদিনের ব্রাজিলীয় পুলিশ। লাঠি। আপনার ছুটে যাওয়া। দলের প্রায় ওয়াকওভার। ওয়ার অফ মারাকানা। এবং এইসব সাত-পাঁচ পেরিয়ে স্মৃতি-বিস্মৃতির জায়গা বদল। আলোর সন্ধান। ২০২১ কোপায় নিজের দলের জয়োল্লাসের মাঝে সহ-খেলোয়াড়দের ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে নেইমার ডি সিলভাকে সান্ত্বনায় বুকে জড়িয়ে ধরা ঈশ্বর। ভিভো টিভির সেই নীল আলোর রাজকীয় সাক্ষাৎকারে ট্যাঙ্গো গাওয়া দিয়েগো, গিটার তুলে একবুক হাসিতে উচ্চারণ করা পেলের সেইসব শব্দ: ‘Who am I, Maradona, who are you/ You want to be me and I want to be you.’ এবং ২০২০-র সেই অভিশপ্ত ২৫ নভেম্বর কালো মানিকের ঐশ্বরিক টুইট: ‘ওয়ান ডে, আই হোপ উই ক্যান প্লে টুগেদার, ইন হেভেন…’
আরও পড়ুন: সেই উপেক্ষার পৃথিবী পাওনা রইল দ্রাবিড়ের
এইসব স্মৃতির ভার নিয়ে এমিলিয়ানো, ২০২৩-এর শীতের সিজন আসে। এসিএল ছিঁড়ে গিয়ে নেইমার দল থেকে বেরিয়ে গেলে আরও রিক্ত হয় ব্রাজিল। শিল্প নয়, অসম্মানের রাস্তায় হাঁটতে হয় তাঁর সহ-খেলোয়াড়দের, বিরোধী অধিনায়ককে সম্মান না, ‘কাওয়ার্ড’ বলে দাগিয়ে দেন দেশের প্রমিসিং উইঙ্গার রডরিগো। ব্রাজিলিয়ান পুলিশকে ব্যাটন এগিয়ে দিতে দেখা যায় গুন্ডা সমর্থকদের দিকে। লকার রুমের দিকে যেতে যেতে বিরক্তি এবং ক্রোধে চোখ থেকে আগুন ঠিকরোনো ক্যাপ্টেনকে বলতে হয়, ‘We saw how they were hitting the people … We went to the locker room because it was the best way to calm everything down.’
এবং আপনার সেই হাত, এমিলিয়ানো। আমাদের ফ্ল্যাশব্যাকে ফুটবল নয়, ফুটবলের বাইরে আরও অনেক কিছু হাতের ব্যাটন কেড়ে নেয়। একটা অলৌকিক বায়োস্কোপ লাগিয়ে চোখের সামনে ধরায়। আমরা কাচ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখি। ১৯৩৮ সালে নিজের বাড়িতে হুইস্কির সঙ্গে সায়ানাইড মিশিয়ে গলায় ঢেলে দিচ্ছেন কবি লুইপল্ড লুগানেস। ১৯৫৩ সালের ৯ এপ্রিল বোন ইভা পেরনের ছবির দিকে মুখ করে কপালে পিস্তল ঠেকিয়ে ট্রিগার টিপছেন জুয়ান পেরন। ২০২০-র মে’তে সাইকেল চুরি আটকাতে গিয়ে রাস্তায় ছিটকে পড়ে কোমায় চলে যেতে হচ্ছে ৭৪ পেরনো টমাস ফিলিপ কার্লোভিচকে, কেরিয়ারের জন্য দেশ ছাড়তে চান কিনা প্রশ্ন করা হলে যাঁর কান্না ভেজা উত্তর ছিল, ‘নো স্যার, ডোন্ট আস্ক মি দ্যাট’। স্মৃতির ভেতর চকচক করছে রিভারপ্লেটের ড্রিম টিম ‘লা ম্যাকিনা’-র মিডফিল্ড জেনারেল জুয়ান মোরেনোর রেড ওয়াইনের শিশি, যা প্রত্যেক ম্যাচে ম্যাজিক দেখানোর আগে অল্প একটু খেয়ে মাঠে নামতেন জুয়ান। আমরা কাচ ঘোরাচ্ছি এবং দেখছি, কেরিয়ারে শেষ করে ১২২ মিনিটের ওই সেভটা ছাড়াও এমিলিয়ানো, আপনি মনে রেখে দিচ্ছেন পুলিশের ব্যাটন কেড়ে নেওয়া আপনার এই হাতটা। আর আমাদের মনে পড়ছে জোসে হার্নান্দেজের এপিক পোয়েম ‘মার্টিন ফিয়েরো’র সেইসব ঈশ্বর-সংলাপ:
‘হিয়ার দ্য সাউন্ড অফ ব্রোকেন চেইন্স, হিয়ার দ্য সাউন্ড অফ ব্রোকেন চেইন্স…’