Robbar

অজস্র ট্রফি-সহ, জলসংকটের বার্সেলোনায় কয়েক ফোঁটা অশ্রু রেখে গিয়েছিলেন মেসি

Published by: Robbar Digital
  • Posted:November 4, 2023 5:59 pm
  • Updated:November 4, 2023 6:54 pm  

শৈশবের মেসি যখন অর্থাভাবে ফুটবল ছেড়ে দেবেন ভাবছেন, তখন স্বপ্নে দেখা দিচ্ছেন, ভবিষ্যতের মেসি। তিনি বলছেন, ‘ফুটবলই তোমার সম্বল, তাকে ছেড়ো না।’ বহু সময় পেরিয়ে, ক্লাবের জার্সিতে কিংবদন্তি হয়েও, দেশের জার্সিতে ট্রফির ভাঁড়ার শূন্য। বিশ্বকাপ, কোপা ফাইনাল হার। সঙ্গে পেনাল্টি মিস। আর্জেন্টাইন সংবাদমাধ্যম বলছে– মেসি আসলে ঠগ। ক্লাবের হয়েই শুধু খেলেন। অর্থের জন্য খেলেন। হতাশায় মেসি অবসর নিচ্ছেন অকালে। তখন সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে শৈশবের মেসি। হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে ফুটবল।

রোহণ ভট্টাচার্য

অষ্টম ব্যালন ডি’অর জিতলেন লিওনেল আন্দ্রেস মেসি। জায়ান্ট স্ক্রিনে লেখা: ‘মেসি ইজ ইনফিনিটি’। ইংরেজিতে ‘আট’ (8) লিখে শুইয়ে দিলে যে চিহ্ন পাওয়া যায়, সেই ইনফিনিটির মতোই তাঁর ফুটবল-জীবনচক্রের কোনও শুরু বা শেষ নেই।

২০১৮ বিশ্বকাপের আগে এসেছিল, সাড়ে-পাঁচ মিনিটের অ্যানিমেশন ফিল্ম– ‘হার্ট অফ এ লিও’। শৈশবের মেসি যখন অর্থাভাবে ফুটবল ছেড়ে দেবেন ভাবছেন, তখন স্বপ্নে দেখা দিচ্ছেন, ভবিষ্যতের মেসি। তিনি বলছেন, ‘ফুটবলই তোমার সম্বল, তাকে ছেড়ো না।’ বহু সময় পেরিয়ে, ক্লাবের জার্সিতে কিংবদন্তি হয়েও, দেশের জার্সিতে ট্রফির ভাঁড়ার শূন্য। বিশ্বকাপ, কোপা ফাইনাল হার। সঙ্গে পেনাল্টি মিস। আর্জেন্টাইন সংবাদমাধ্যম বলছে– মেসি আসলে ঠগ। ক্লাবের হয়েই শুধু খেলেন। অর্থের জন্য খেলেন। হতাশায় মেসি অবসর নিচ্ছেন অকালে। তখন সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে শৈশবের মেসি। হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে ফুটবল।

‘হার্ট অফ এ লিও’ ফিল্মের দৃশ্য

 

১৪ ডিসেম্বর, ২০২২। বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল। ক্রোয়েশিয়ার গোলপোস্টের দিকে এগোচ্ছেন লিওনেল মেসি। সামনে বিশ্বের তাবড় ডিফেন্ডার। সামনে আরও একটা বিশ্বকাপ ফাইনাল! আর পিছনে? পিছনে, সেই ২২ বছর। তিনজন ডিফেন্ডার প্রেস করছে তাকে। পিছিয়ে আসছেন লিও। পিছিয়ে যাচ্ছে সময়।

১৪ ডিসেম্বর, ২০০০। দুশ্চিন্তায় জর্জরিত জর্জ মেসি। কী হবে ছেলের ভবিষ্যত? বার্সেলোনার স্পোর্টিং ডিরেক্টরকে ফোন করে চলেছেন। আর্জেন্টিনা থেকে স্পেন। যাত্রাটা নেহাত ছোট নয়। বার্সা জানিয়েছে, লিওকে দেখতে চায় তারা। ১৩ বছরের বালক। রোগা-অসুস্থ। অথচ বাঁ-পায়ে বল পড়লেই বিদ্যুৎ। নিজের থেকে এক-হাত লম্বা তাগড়া ছেলেদেরও ছিটকে ফেলে দিচ্ছে এদিক-ওদিক। তার জন্যই তো উড়ে আসা, এতদূর। অথচ, এখনও কি-না, তৈরিই হয়নি আইনি দস্তাবেজ! আসলে প্রতিভার সঙ্গে এসেছে মারাত্মক ব্যাধি। এত চিকিৎসার খরচ কোন ক্লাবই বা নিতে চাইবে? ঘিরে ধরছে অনিশ্চয়তার মেঘ।

Argentina 3-0 Croatia: Player ratings as Messi & Alvarez lead Albiceleste to World Cup final
এদিকে ক্রোয়েশিয়ার ডিফেন্ডাররা ঘিরে ধরেছে লিওকে। আরেকটু পিছিয়ে এলেন লিও। এখন তার বয়স ১১। শরীরে নেমে আসছে বিরল রোগ। গ্রোথ হরমোন ডেফিসিয়েন্সি। বামনত্ব। বয়স বাড়ছে, শরীর নয়। তবে ফুটবল কি ছেড়ে যাবে তাকে? যেমন ছেড়ে গিয়েছেন দিদিমা। দিদিমাই তো ফুটবল তুলে দিয়েছিলেন পায়ে। কোচের সঙ্গে ঝগড়া করেছিলেন লিওকে দলে নিতে। তারপর সমুদ্র দেখিয়েছিলেন– জীবনের মতোই ওঠানামা। লিও তখন বলকে পোষ মানাচ্ছেন একমনে। দিদিমাও ম্লান হয়ে যাচ্ছেন দিগন্তরেখায়। গোলের পর আকাশের দিকে আজও ইশারা করেন লিও।

আর্জেন্টিনার রোজারিও শহরে ‘নিউওয়েলস ওল্ড বয়েজ ক্লাব’। এখানে লিওর নাম ‘দ্য মেশিন অফ এইট্টি সেভেন’। ’৮৭ সালে জন্ম এই মেশিনের। মাঠের একদিকে ছায়া পড়েছে। অন্যদিকে রোদ। অন্ধকার দিক থেকে আলোর দিকে দৌড়ে যাচ্ছে ছোট্ট লিও। একজন-দু’জন-তিনজন-চারজনকে ড্রিবল করে চলে যাচ্ছে সে। মাঠের বাইরে দাঁড়িয়ে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না কার্লেস রেক্সাস– বার্সেলোনার স্পোর্টিং ডিরেক্টর। মনে মনে ভাবছেন, এই ছেলেকে নিতেই হবে বার্সায়। কিন্তু ঝক্কি কম নয়। তার সঙ্গে নিতে হবে পুরো পরিবারের স্পেনে থাকার খরচ।

কোমরটা দুলে উঠল লিওর। বলে আলতো টোকা। তিনজন ক্রোট ডিফেন্ডারের ফাঁক দিয়ে বল নিয়ে গলে গেলেন। সারা গ্যালারি হতবাক। ঠিক ২২ বছর আগে যেমন হয়েছিলেন কার্লেস রেক্সাস। তিনজন নয়, তিনটি প্রতিকূলতা। অর্থাভাব, রোগ, অনিশ্চিত ফুটবল ভবিষ্যৎ। সবকিছুকে ড্রিবল করে, রোজারিও থেকে বল পায়ে ছুটে চললেন বার্সেলোনার দিকে। শেষমেশ, কাগজপত্র কিছুই না থাকায়, একটা ন্যাপকিনে লিওকে দিয়ে সই করিয়ে নেন রেক্সাস। সেই চুক্তিপত্র এখনও ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখা আছে বার্সা ফুটবল মিউজিয়ামে।

The napkin that started Leo Messi's career is 12 years old
বার্সা ফুটবল মিউজিয়ামে বাঁধানো মেসির চুক্তিপত্রর সই

মেসির প্রতিটা দৌড় আদতে ছায়া থেকে রোদের দিকে দৌড়। ফুটবল তার জিয়নকাঠি। একবার পায়ে ছুঁয়ে দিলেই আপাতজীর্ণ দুর্বল এক মানুষ দেবতা হয়ে যান। যেন থরের হাতুড়ি। স্পর্শ করলেই, ‘গড অফ থান্ডার’।

২২-এর সেমিফাইনালে, ৬৮ মিনিটের মাথায় বল পেলেন মেসি। সামনে জোস্কো ভার্দিওল। বিশ্বের সবচেয়ে দামি ডিফেন্ডার। সুঠাম গড়ন। সদ্য যুবক। বছর পঁয়ত্রিশের ‘বৃদ্ধ’ মেসিকে আটকেই রেখেছেন বহুক্ষণ। মেসি চেষ্টা করলেন। কিন্তু তরুণ ভার্দিওলের রিফ্লেক্স দারুণ। অগত্যা পিছন ফিরলেন মেসি।

ঠিক সাত বছর আগে। ২০১৬। কোপা-আমেরিকা ফাইনালে হেরে দেশের জার্সি তুলে রাখছেন মেসি। অবসর ঘোষণা করে দিয়েছেন। বার্সেলোনায় এত বছর খেলার দৌলতে স্পেনের নাগরিকত্ব আছে। স্পেনের জাতীয় দল থেকে ডাক এসেছিল বিশ্বকাপ খেলার। ‘হ্যাঁ’ বললে, ২০১০ সালেই জেতা হয়ে যেত বিশ্বকাপ। অথচ, তিনি বেছে নিয়েছিলেন, আর্জেন্টিনাকে। লোভের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিলেন। সেই আর্জেন্টাইন সমাজ-মাধ্যম তোপ বর্ষণ করে চলেছে ক্রমাগত।

এভাবেই পিছন ফিরে দাঁড়িয়েছিলেন মেসি। সামনে এক আফগান শিশু। তালিবান শাসক কেড়ে নিয়েছে ঘর-বাড়ি। বোমা-বর্ষণ চলছে দেশে। উদ্বাস্তু ছোট্ট ছেলেটার একটাই শখ, ফুটবল। জার্সি কেনার পয়সা নেই। ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক কেটে একটা জার্সি বানিয়েছে সে। দশ নম্বর জার্সি। নামের জায়গায় লেখা ‘মেসি’। বালকের নাম মুর্তাজা আহমদি। কিন্তু নাম জিজ্ঞেস করলে সে বলে, মুর্তাজা মেসি। ২০১৬ সালের ঠিক এইদিনে মুর্তাজা মেসি জড়িয়ে ধরেছিল লিওনেল মেসিকে, কিছুতেই ছাড়ছিল না। তালিবান শাসক বলেছিল, সে-দেশে ফুটবল হারাম। ঘর ছেড়ে পাকিস্তানে চলে যায় তার পরিবার।

Score! Afghan Boy With Homemade Lionel Messi Jersey Just Got A Real One : The Two-Way : NPR
আফগান বালক মেসি-মুগ্ধ মুর্তাজা

লিও ঘুরলেন। ভার্দিওল অবাক। ভেবেছিলেন ব্যাকপাস করবেন মেসি। কিন্তু আচমকা গোলের দিকে দৌড়। খেলার বয়স প্রায় ৬৯ মিনিট। মুর্তাজা মেসি দৌড়াচ্ছে। রকেট-বোম উড়ে এসে পড়ছে বাড়ির চালে। সে ড্রিবল করে যাচ্ছে। ধর্ম এসে টেনে ধরছে জার্সি, সে প্রাণপন ছুটছে। ক্রোট ডিফেন্সকে তছনছ করে এগিয়ে যাচ্ছেন লিও মেসি। তার নাগাল পাচ্ছে না কেউ। অ্যাসিস্ট করলেন। আর্জেন্টিনা ফাইনালে।

মেসি যেখান থেকে আসেন, সেখানেই ফিরে যান। কোপা আমেরিকা ফাইনাল ও বিশ্বকাপ ফাইনাল জিতে সম্পূর্ণ করেন কালচক্র। তৈরি করেন, ‘লিও মেসি ফাউন্ডেশন’। অসুস্থ ও দুঃস্থ শিশুদের বিনামূল্যে চিকিৎসা, শিক্ষা দিয়ে মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনাই যার কাজ। শেষবেলায় বার্সায় ফিরতে চেয়েছিলেন আরেকবার। এই বয়সে, তার ওপর আবারও অর্থ বিনিয়োগ করতে চায়নি ক্লাব। দিনের শেষে শ্রেষ্ঠ ফুটবলারও তো পণ্যই। অথচ, বিলিয়ন ডলারের থলি নিয়ে অপেক্ষায় ছিল আরব। হাতছানি উপেক্ষা করে, চলে গেলেন আমেরিকা। জাদুস্পর্শে জাগালেন, ইন্টার মায়ামিকে। লিগ টেবিলের তলানিতে থাকা ক্লাবকে জেতালেন প্রথম কাপ। যেভাবে টেনে তুলেছিলেন আর্জেন্টিনাকে ৩৬ বছর পর। অবসরকালে, ফিরে যাবেন রোজারিওর নিউওয়েলস ওল্ড বয়েজে। ছেলেবেলায়।

মেসির কোনোওকাল-ক্রম নেই। যা হারিয়েছেন, তাই ফিরে পাওয়ার জন্য তিনি ঘুরে চলেছেন অনন্ত ইনিফিনিটিতে। বার্সার সঙ্গে লিওর সম্পর্ক শুরু হয়েছিল ন্যাপকিন দিয়ে। বার্সাকে অলবিদা বলার সময়ও হাতে ছিল একটা ন্যাপকিন। অশ্রুসিক্ত। অজস্র ট্রফি-সহ, জলসংকটের বার্সেলোনায় কয়েক ফোঁটা অশ্রু রেখে গিয়েছিলেন মেসি।