কীসের জন্য এই নামবদল? দুই বোর্ডের তরফে যুক্তি, তেণ্ডুলকর ও অ্যান্ডারসন সাম্প্রতিক কালের হওয়ায় নবীন প্রজন্মের কাছে এই সিরিজ আরও বেশি আকর্ষক ও প্রাসঙ্গিক হবে। কিন্তু এই যুক্তি মানতে নারাজ বহু ক্রিকেটীয় ব্যক্তিত্ব। সুনীল গাভাসকর তাঁর নিজের কলামে লিখেছেন, এই সিদ্ধান্ত প্রকৃতপক্ষেই বিরক্তিকর। সানি আরও বলেছেন যে, এই প্রথম শুনলাম কোনও ব্যক্তির নামাঙ্কিত ট্রফির নামবদল করা হল। গাভাসকরের ইঙ্গিত, যাঁদের নামে নতুন করে এই ট্রফির নামকরণ হল, তাঁরা তা প্রত্যাখ্যান করতেই পারেন। কারণ, একই যুক্তিতে একসময় আবার নামবদলে যাবে!
বডিলাইন সিরিজের প্রথম টেস্ট সিডনিতে। বছর ২২-এর এক ভারতীয় বংশোদ্ভূত যুবক ব্যাট করতে নামলেন ইংল্যান্ডের হয়ে। বিল ওরিলি, ক্ল্যারি গ্রিমেটদের মতো তারকা অস্ট্রেলীয় বোলারদের বিপক্ষে নিজের স্বাভাবিক স্ট্রোক প্লে-নির্ভর খেলা না খেলে উইকেট কামড়ে পড়ে রইলেন সাড়ে ছ’-ঘণ্টা এবং নিজের অভিষেক টেস্টেই শতরান করে ফিরলেন। সেই যুবকের নাম ইফতিখার আলি খান পতৌদি।
প্রথম টেস্টে ১০ উইকেটে জিতল ডগলাস জার্ডিনের ইংল্যান্ড। মেলবোর্নে দ্বিতীয় টেস্টেও স্বাভাবিক ভাবেই দলে ছিলেন পতৌদি, কিন্তু তৃতীয় টেস্ট থেকে পুরো সিরিজে আর দেখা গেল না নবাবকে! কেন ব্যাটে রান থাকা সত্ত্বেও বাদ পড়লেন পতৌদি-সিনিয়র? এর উত্তরে ডগলাস জার্ডিন বলেন, ‘মনে হয়েছিল ওঁর লেগ-সাইড ফাঁদে ফিল্ডিং করার বিষয়ে নৈতিক আপত্তি রয়েছে।’ এই কারণেই জার্ডিনের মতো উদ্ধত অধিনায়ক ওই সিরিজে বডিলাইন সিরিজে আর খেলাননি তাঁকে!
অনসাইডে ৭ জন ফিল্ডারের ফাঁদ পেতে জার্ডিনের ডন ব্র্যাডম্যানদের বডিলাইন বোলিং করানোর এই কৌশল মানতে পারেননি পতৌদি। ওই বছরই ইংল্যান্ডের মাটিতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ইংল্যান্ড ও পরাধীন ভারতের মধ্যে প্রথম টেস্ট। ২০০৭-এ তারই ৭৫ বছর পূর্তিতে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ভারত-ইংল্যান্ড টেস্ট সিরিজের ট্রফির নামকরণ করা হয় ‘পতৌদি ট্রফি’। তবে ইংল্যান্ডের হয়ে খেলার আশায় পতৌদির তখন ভারতীয় দলের হয়ে খেলা হয়নি। যা শেষ পর্যন্ত সম্ভব হয় যুদ্ধের পর, ১৯৪৬-এর ইংল্যান্ড সফরে ভারত-অধিনায়ক হিসেবে তাঁর শেষ টেস্ট সিরিজে। এর মাঝখানে ৩৪-এর ট্রেন্টব্রিজ টেস্টে শেষবার ইংল্যান্ডের হয়ে খেলার ডাক পান তিনি, ইংল্যান্ডের কাউন্টি ক্রিকেটে দুটো দ্বিশতরান করার সুবাদে।
বডিলাইন সিরিজের ঠিক ৩০ বছর পর, ১৯৬২-র ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের ব্রিজটাউন টেস্টে চার্লি গ্রিফিতের বাউন্সারে ভারত অধিনায়ক নরি কন্ট্র্যাক্টরের মাথার খুলি ফেটে যাওয়ার পর, এক তরুণ ক্রিকেটারের ওপর বর্তায় দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্ব। ২১ বছরের মনসুর আলি খান পতৌদি, পোলো খেলতে গিয়ে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পিতা ইফতিখার আলি খানের মৃত্যুর দিনটায় ছিল যাঁর ১১তম জন্মদিন! টেস্ট অভিষেক হওয়ার ছ’মাস আগে ইংল্যান্ডে এক গাড়ি দুর্ঘটনায় যিনি হারিয়েছিলেন তাঁর ডান-চোখের দৃষ্টি। চোখ হারালে অন্য যে কোনও ব্যাটার হতাশায় তলিয়ে যেতেন, কিন্তু তরুণ নবাব নিজের স্টান্স খানিকটা স্কোয়ার-অন করে, টেকনিকে সামান্য রদবদল এনে নিজেকে দিব্যি টেস্ট ক্রিকেটের উপযোগী করে তুলেছিলেন। তার বহু আগেই স্কুল-ক্রিকেটে তাঁর ব্যাটিং দেখে পতৌদিকে সই করায় ইংলিশ কাউন্টি সাসেক্স।
১৯৬০ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রবেশ করেন পতৌদি জুনিয়র। এবং বাবার মতোই তাঁরও ক্রিকেট কেরিয়ারে সবথেকে বেশি সেঞ্চুরি অক্সফোর্ড দলের হয়েই। নিজের আত্মজীবনী “টাইগার’স টেলস”-এ পতৌদি লিখেছেন, ‘ভারতীয় দলকে নেতৃত্ব দেওয়া তখন সবথেকে কঠিন কাজ ছিল। কারণ প্লেয়াররা বহুভাষা ও আঞ্চলিক পক্ষপাতে বিভক্ত!’ কিন্তু তরুণ নবাব তাদের একত্রিত করে কিছুদিনের মধ্যেই একটা সংঘবদ্ধ দল হিসেবে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছিলেন। এমন একটা দল, যা সেরা টেস্ট-খেলিয়ে দেশগুলির মোকাবিলা করার রসদ ও আত্মবিশ্বাসে পরিপূর্ণ। ভারতীয় ক্রিকেটে নবাব টাইগার (পরে ক্ষিপ্র ফিল্ডিং-এর জন্য ‘টাইগার’ নামে পরিচিত) পতৌদির সবথেকে বড় অবদান এটাই। কিংবদন্তি স্পিনার বিষেণ সিং বেদীর মতে, পতৌদির আগমন ‘ভারতীয় ক্রিকেটের শ্রেষ্ঠ ঘটনা’।
ইংল্যান্ড ও ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ডের (ইসিবি) তরফে ভারত-ইংল্যান্ড চলতি টেস্ট সিরিজে পতৌদি ট্রফির নাম বদলে তেণ্ডুলকর-অ্যান্ডারসন ট্রফি করে দেওয়া হয়েছে। এই পরিবর্তনে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড বা বিসিসিআই-এরও মত রয়েছে, তবে কোনও আলোচনা করা হয়নি পতৌদি-পরিবারের সঙ্গে! ভারতের মাটিতে ১৯৫১ থেকে এই ট্রফি ভারতীয় বোর্ডের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা অ্যান্থনি ডি’মেলোর নামাঙ্কিত, যা অপরিবর্তিতই থাকছে। দুই বোর্ডের এই যৌথ সিদ্ধান্ত ক্রিকেট-মহলে বিতর্কের ঝড় তুলেছে! এরপর অবশ্য স্বয়ং সচিন তেণ্ডুলকর মঞ্চে অবতীর্ণ হয়ে ইসিবি ও বিসিসিআই-কে অনুরোধ করেন যে, পতৌদির উত্তরাধিকার যেন খর্ব না হয় সেদিকে নজর দিতে। তখন দুই বোর্ডের তরফ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, সিরিজ-জয়ী অধিনায়ককে পতৌদির নামাঙ্কিত মেডেল দিয়ে সম্মানিত করা হবে। তবে মূল ট্রফির নাম বদলে এই মেডেল দেওয়াটা অনেকটাই নেহাতই সান্ত্বনা পুরস্কারের মতো বা মনে হতে পারে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দেওয়ার শামিল। পতৌদিদের সম্মান এতে অনেকটাই ক্ষুণ্ণ হল তো বটেই, সঙ্গে মুছে গেল ইতিহাসের একটা অধ্যায়ও!
কীসের জন্য এই নামবদল? দুই বোর্ডের তরফে যুক্তি, তেণ্ডুলকর ও অ্যান্ডারসন সাম্প্রতিক কালের হওয়ায় নবীন প্রজন্মের কাছে এই সিরিজ আরও বেশি আকর্ষক ও প্রাসঙ্গিক হবে। কিন্তু এই যুক্তি মানতে নারাজ বহু ক্রিকেটীয় ব্যক্তিত্ব। সুনীল গাভাসকর তাঁর নিজের কলামে লিখেছেন, এই সিদ্ধান্ত প্রকৃতপক্ষেই বিরক্তিকর। সানি আরও বলেছেন যে, এই প্রথম শুনলাম কোনও ব্যক্তির নামাঙ্কিত ট্রফির নামবদল করা হল। গাভাসকরের ইঙ্গিত, যাঁদের নামে নতুন করে এই ট্রফির নামকরণ হল, তাঁরা তা প্রত্যাখ্যান করতেই পারেন। কারণ, একই যুক্তিতে একসময় আবার নামবদলে যাবে! কপিল দেবও এই সিদ্ধান্ত নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। গাভাসকর-কপিলদের আর এক সতীর্থ কারসন ঘাউড়িও মনে করেন, পতৌদি পরিবারের ঐতিহাসিক অবদানের কথা মাথায় রেখে কখনওই মূল ট্রফির নামবদল করা উচিত নয়, বরং শচীন-অ্যান্ডারসনের নামে মেডেল চালু করা যেতে পারত। বিসিসিআইয়ের এই নিয়ে কড়া পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল।
ক্রিকেট মহলের আরও প্রশ্ন, কোনও সিরিজের ঐতিহাসিক নাম কি এভাবে বদলে দেওয়া যায়? অ্যাসেজ সিরিজ বা ফ্রাঙ্ক ওরেল ট্রফির নাম পরিবর্তন করলে কি তা বর্তমান প্রজন্মের কাছে বেশি প্রাসঙ্গিক হবে? যে কোনও ট্রফির নামের মর্মার্থ নিহিত থাকে সংশ্লিষ্ট দু’দেশের সম্পর্কের ইতিহাসের গভীরে। যেমন ১৮৮২-র দর্শকদের উইকেট পুড়িয়ে সেই ছাই দিয়ে কাপ বানানোর গল্প থেকেই অ্যাসেজ-সিরিজের নামকরণ ও তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব। তেমনই প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ অধিনায়ক ফ্রাঙ্ক ওরেলের নেতৃত্বে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটে। ১৯৬০-’৬১-তে অস্ট্রেলিয়া সফরে তার নিদর্শন দেখা যায় ব্রিসবেনে প্রথম ঐতিহাসিক টাই-টেস্টে, উত্তর-ঔপনিবেশিক ক্যারিবিয়ান-ক্যালিপসো ক্রিকেটে মজে যায় ক্রিকেট দুনিয়া। তাই পরবর্তীতে অস্ট্রেলিয়া-ওয়েস্ট ইন্ডিজ টেস্ট সিরিজ ট্রফি ওরেলের নামাঙ্কিত করা হয়।
ওরেলের মতোই ভারতীয় ক্রিকেটে গত শতাব্দীর ছয়ের দশকে বহু পরিবর্তন এসেছিল টাইগার পতৌদি ও তাঁর আগ্রাসী নেতৃত্বের মাধ্যমে। যেমন হাতে ভালো ফাস্ট-বোলার না থাকায় প্রথা ভেঙে বেদী-এরাপল্লি প্রসন্ন-ভগবৎ চন্দ্রশেখর-শ্রীনিবাস বেঙ্কটরঘবন সমৃদ্ধ বিখ্যাত স্পিন-চতুর্ভুজকে খেলানোর উদ্ভাবনী ক্ষমতা, তুখোর ফিল্ডার একনাথ সোলকার-আবিদ আলিদের টিমে এনে ফিল্ডিংয়ে প্রভূত উন্নতি, তরুণ প্রতিভা গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথকে তুলে আনার মতো সিদ্ধান্ত পতৌদির মাস্টারস্ট্রোক বলা যায়। এসবই ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
পতৌদি ট্রফি দু’দেশের প্রাক্ ও উত্তর-ঔপনিবেশিক সম্পর্কের ইতিহাসের এই অধ্যায়গুলোরই বার্তা দেয় সমগ্র ক্রিকেটবিশ্বকে। সেই ইতিহাসের অধ্যায়কে মুছে ফেলতেই কি এই নাম পরিবর্তন? ক্রিকেট-ধারাভাষ্যকার হর্ষ ভোগলে সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছেন, “দু’দেশের ক্রিকেটের সঙ্গে গভীর যোগ ছিল পতৌদি নামের। পিতা-পুত্র দু’জনেই সাসেক্সের হয়ে খেলেছেন; সিনিয়র ইংল্যান্ড ও ভারত দু’দলের হয়ে টেস্ট খেলেছেন, জুনিয়র ইংলিশ স্কুল-ক্রিকেটে রেকর্ড গড়েছেন; পতৌদি ট্রফিকে জড়িয়ে একটা সুন্দর বলয় ছিল!”
ভারতীয় বোর্ড ও আইসিসি-তে এখন জয় শাহ-র যুগ চলছে। সমাজের অন্যান্য পরিসরের মতো ভারতীয় ক্রিকেটে পড়েছে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রভাব। যেভাবে দেশব্যাপী ইতিহাস বিকৃত করার অ্যাজেন্ডা নিয়ে চলছে কেন্দ্রীয় সরকার, যার জেরে বিজেপি-শাসিত রাজ্যেগুলোর পাঠ্যক্রম থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে মুঘল অধ্যায়, ব্রিটিশ-শাসকদের বিরুদ্ধে টিপু সুলতানের মতো মুসলিম রাজাদের লড়াইয়ের ইতিহাসকে বিকৃত করা হচ্ছে, সেই পথ ধরেই দেশের ক্রিকেটের বিবর্তনের দুই নায়ককে মুছে ফেলার প্রচেষ্টাও শুরু হল। সংঘ-পরিবারের শাসকরা যে কোনও মুসলিম জাতীয় আইকনকেই এদেশের ইতিহাস থেকে ব্রাত্য করে দিতে চান!
সম্প্রচার স্বত্ব থেকে পাওয়া বিপুল অর্থে বলীয়ান বিসিসিআই কর্তারা, আইসিসির মঞ্চে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া বোর্ডকে সঙ্গী করে ছড়ি ঘুরিয়ে চলেছেন ঠিকই; কিন্তু ‘ভারতীয় ক্রিকেটের অন্যতম আকর্ষক চরিত্র’ টাইগার পতৌদির অধ্যায় ক্রিকেট ইতিহাস বা ক্রিকেটপ্রেমীদের মন থেকে মুছে ফেলা কি সম্ভব?
……………………………..
ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার ডিজিটাল
……………………………..