‘ইন্যাক্ট’ পত্রিকাতে প্রথম পড়ি হাবিব তনভীর-এর ‘আগ্রা বাজার’ ও ‘চরণদাস চোর’-এর কথা, যা অচিরেই হয়ে উঠেছিল ভারতীয় থিয়েটারের মাইল ফলক। তারপর থেকে আমাদের বন্ধুত্ব। দেশজুড়ে ভারতীয় থিয়েটারের একটা বন্ধু গোষ্ঠীতে আমরা জড়িয়ে পড়েছিলাম– তার মধ্যে বয়সের ব্যবধানের কোনও চোখরাঙানি ছিল না। সেই বন্ধুগোষ্ঠীর অনেকেই প্রয়াত, সেই স্মৃতি ও বেদনাই হাবিব তনভীর-কে নিয়ে লিখতে গেলে ব্যথিত করে।
১৯৬০-এর মাঝামাঝি থেকে ১৯৮০-র মাঝামাঝি পর্যন্ত ভারতীয় থিয়েটারে একটা অবাধ সৃজনশীল দেওয়া-নেওয়ার যুগ সৃষ্টি হয়েছিল। অহরহ সব এক করে দেওয়ার শাসনদারি কোনও আস্ফালন তখন আকাশ-বাতাস কলুষিত বা দূষিত করেনি। বরং দেশজুড়ে একটা বন্ধুগোষ্ঠীতে আমরা জড়িয়ে পড়েছিলাম– তার মধ্যে বয়সের ব্যবধানের কোনও চোখরাঙানি ছিল না। সেই বন্ধুগোষ্ঠীর অনেকেই প্রয়াত, সেই স্মৃতি ও বেদনাই হাবিব তনভীর-কে নিয়ে লিখতে গেলে ব্যথিত করে। সেই বন্ধুগোষ্ঠীর মধ্যে আগ্রহ, কৌতূহল, অনুসন্ধিৎসা ও সহমর্মিতার একটা নাড়ির অন্তরঙ্গ যোগ ছিল। চিন্তা-সংবাদ-ভাবনার আদানপ্রদানের যোগসূত্র বলতে ছিল বন্ধু রাজিন্দর পল-এর সযত্ন, উদ্যোগী সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘ইন্যাক্ট’ পত্রিকা– সেই পত্রিকাতেই প্রথম পড়ি হাবিব তনভীর-এর ‘আগ্রা বাজার’ ও ‘চরণদাস চোর’-এর কথা, যা অচিরেই হয়ে উঠেছিল ভারতীয় থিয়েটারের মাইল ফলক।
১৯৭৬ সালে ভারতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রীয় শিক্ষা সংস্থান একটি ভারত-মার্কিন দু’দিনব্যাপী আলোচনাচক্রের আয়োজন করে কলকাতায়। বিষয় ছিল বিভিন্ন শিল্পকলার মধ্যে আদানপ্রদান। থিয়েটার সম্পর্কে একটি বিশেষ অধিবেশনে আলোচক মনোনীত হয়েছিলেন রিচার্ড শেখনার, বাদল সরকার ও হাবিব তনভীর। আমার ভূমিকা ছিল ওই অধিবেশনের প্রারম্ভিক সূত্রভাষণ দানের। সংস্থানের কলকাতা দপ্তরের অধ্যক্ষ পপি আয়ার এই প্রস্তাব নিয়ে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতেই আমি তাঁর কাছে প্রস্তাব করি, হাবিব-এর ১৯৭৫ সালের সদ্যতম প্রযোজনা ‘চরণদাস চোর’ কলকাতায় ওই উপলক্ষে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হোক! যা শুনেছি ততদিনে ‘চরণদাস চোর’ সম্পর্কে আমার নাট্যবন্ধুদের কাছে– বিশেষত রতি বার্থলমিউ ও বিন্দু বাত্রার কাছে– তাতে মনে হয়েছিল, শহর-গ্রাম, ভদ্রলোক-জনজাতির যুগবাহিত বিভাজন পেরিয়ে এই ঐতিহাসিক কীর্তি দেখার অভিজ্ঞতা আমাদের আলোচনায় হয়তো অন্যই মাত্রা এনে ফেলতে পারে। পপি প্রস্তাবটা লুফে নেন! শ্রীশিক্ষায়তনের তখনও অসম্পূর্ণ এক প্রেক্ষাগৃহে কলকাতায় ‘চরণদাস চোর’-এর সেই প্রথম চমকপ্রদ অনুষ্ঠান, যা আমাদের আলোচনাকেও বিপুলভাবে প্রভাবিত করেছিল। কলকাতার থিয়েটার মহল খবর পেয়েও সে অনুষ্ঠানে তেমনভাবে জমায়েত হননি। কারা শেষ পর্যন্ত এসেছিলেন, এখন আর মনে নেই। হাবিব ও তাঁর বাঙালি স্ত্রী মণিকা ও পরে তাঁদের কন্যা নাগিন-এর সঙ্গে বন্ধুত্বের সেই সূত্রপাত। সঙ্গে সঙ্গেই এক অন্য নাট্যদর্শন তথা আজীবন নাট্য নিরীক্ষার ‘আবিষ্কার’।
ছত্তিশগড়ের রায়পুরে যে ক্ষয়িষ্ণু সাবেকি অভিজাত পরিবারে হাবিবের জন্ম, বড় হয়ে ওঠার কালে তাঁর চারিপাশের অধিবাসী জনজাতি মানুষের জীবনের সঙ্গে বিন্দুমাত্র পরিচয় হয়নি তাঁর– অকপটে তা স্বীকার করেছেন তিনি তাঁর আত্মজীবন কথায়। মফস্সল শহরে স্কুলজীবন শেষ করে নাগপুরে যখন কলেজে পড়তে গেছেন, তখনও তাঁর সাধস্বপ্ন বোম্বাই চলচ্চিত্রে তারকা হওয়ার। সেই টানেই বোম্বাই যাত্রা ও ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সঙ্গে সম্পর্ক ও অন্য দৃষ্টির উন্মোচন। তার অনেক পরে, দেশবিদেশ ঘুরে ফিরে এসে তাঁর আবিষ্কার সেই রায়পুরের ‘নাচা’ শিল্পীদের ভ্রাম্যমাণ ছোট্ট অভিনেতৃ গোষ্ঠীর অসামান্য সেই মানুষদের, যাঁদের সহজাত অভিনয় ক্ষমতাকে কেন্দ্রে স্থাপন করে তাঁর আজীবন নাট্যকর্ম, যার উদ্ঘাটন ‘চরণদাস চোর’-এ, যা আজও অভিনীত হয়ে চলেছে। পুরাতন অভিনেতা-অভিনেত্রীরা প্রয়াত, নতুনেরা তাঁদের জায়গা নিয়েছেন– সাধারণ্য সেখানে পৌঁছয় অসাধারণ নাট্যকলায়।