বর্তমান প্রজন্মের অনেকে ননী ভৌমিককে রুশ সাহিত্যের অনুবাদক হিসেবে জানলেও আমাদের কাছে তিনি ‘ধুলোমাটি’ ও ‘ধানকানা’র লেখক। লেখক জীবনের শুরুতেই অনুবাদক হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিজের হাতে মুছে দিলেন তাঁর জীবনের বহুপ্রতিশ্রুত একটি অধ্যায়। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা ওই অনুবাদের সুবাদেই, বিদেশে। আবার তিনি মস্কোয় না থাকলে সেখানে দীর্ঘকালের জন্য অনুবাদকরূপে আমার স্থিতিরও কোনও সম্ভাবনা ছিল না, তাঁর সঙ্গে অন্তরঙ্গতারও নয়।
১৩.
ননী ভৌমিকের মস্কো যাত্রা প্রসঙ্গে
মস্কোয় ছোট বড় যে কোনও বাঙালির কাছে, এমনকী বাংলা ভাষাবিদ রুশিদের কাছেও তিনি ছিলেন ‘ননীদা’।
তখনও তিনি কলকাতায়, গোপাল হালদারের সঙ্গে ‘পরিচয়’ পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদনার দায়িত্বে আছেন, সেই সময় পত্রিকার ১৩৬২-র জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় ‘কালান্তরের ক্লাসিক’ শিরোনামে গোর্কির রচনার চারটি অনুবাদ গ্রন্থের (‘মা’– অনুবাদক পুষ্পময়ী বসু, ‘গল্প সংগ্রহ’ ১ম খণ্ড– অনুবাদক নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়, ‘আমার ছেলেবেলা’– অনুবাদক অমল দাশগুপ্ত , ‘নানা লেখা’– অনুবাদক সরোজ দত্ত) একটি সমালোচনা লিখেছিলেন। লেখার উপসংহারে তাঁর প্রশ্ন: ‘মূল রুশের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে বাংলা অনুবাদের সময় কি আসেনি? অদূর ভবিষ্যতে যেন তা আসে, পাঠক হিসেবে এই আশা জানিয়ে রাখি।’ (বাঁকা হরফ আমার)
এই ছত্রগুলি কি তাঁর আসন্ন মস্কো যাত্রার পূর্বাভাস? কেননা এই লেখার পর বছর দেড়েক যেতে না যেতে ১৯৫৭-র জানুয়ারিতে তিনি নিজেই অনুবাদকের কাজ নিয়ে মস্কোয় চলে গেলেন। যোগ দিলেন সেখানকার ‘বিদেশী ভাষায় সাহিত্য প্রকাশালয়’-এ। ‘মূল রুশের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে বাংলা অনুবাদের’ যে কথা তিনি লিখেছিলেন, সেটাও তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ অনুবাদকের কাজে যখন ননীদা যোগ দিতে যান সেই সময় রুশ ভাষা তাঁর জানা ছিল না। কিন্তু প্রকাশনালয়ের বাংলা ভাষাবিদ সম্পাদকেরা ‘মূলের সঙ্গে’ বাংলা অনুবাদ মিলিয়ে নিয়ে অনুবাদককে পরামর্শ দিয়ে অনুবাদটিকে যতদূর সম্ভব মূলানুগ করার জন্য সাহায্য করতেন। লক্ষণীয় এই যে, ননীদা কিন্তু সরাসরি রুশ থেকে বাংলা অনুবাদের কথা বলেননি। তাই তাঁর মস্কো যাত্রাটা আকস্মিক ছিল না বলেই মনে হয়।
ননীদা কলকাতা ছেড়ে চলে যাওয়ার কিছুদিন বাদে ‘পরিচয়’ পত্রিকার ১৩৬৩-র ফাল্গুন সংখ্যার শেষ পৃষ্ঠায় যুগ্ম সম্পাদকের জায়গায় সম্পাদক হিসেবে গোপাল হালদার ‘সম্পাদক পরিবর্তন’ শিরোনামে ঘোষণা করলেন: ‘পরিচয় সম্পাদনায় এ মাস থেকে কিছু পরিবর্তন সাধিত হল। আমাদের সহযোগী বন্ধু শ্রীননী ভৌমিক কার্যপলক্ষে বিদেশে গিয়েছেন, সেখানেও তিনি বাংলা সাহিত্যেরই কাজ করবেন।…’
কী তাঁর সেই কাজ? আমাদের তো অন্য আরেকটি অক্ষেপ রয়ে গেল– যিনি কিংবদন্তি লেখক হতে পারতেন, তিনি শেষ পর্যন্ত কিংবদন্তি অনুবাদকে পরিণত হলেন! তাঁর একমাত্র উপন্যাস ‘ধুলোমাটি’। (ধারাবাহিকভাবে ‘পরিচয়’-এ প্রকাশিত হওয়ার পর) তাঁর মস্কো যাত্রার অব্যবহিত প্রাক্কালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।
শুনেছি অনুবাদকের কাজ নিয়ে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়েরও নাকি মস্কোয় যাওয়ার কথা ছিল। যে কোনও কারণেই হোক, তা হয়ে ওঠেনি। ভাগ্যিস হয়নি! তাহলে তো আমরা একজন কথাশিল্পীর সঙ্গে সঙ্গে একজন কবিকেও অকালে হারাতাম। দু’জনে একই সঙ্গে যাত্রা শুরু করেছিলেন। কিন্তু সুভাষদার পায়ের তলায় তখন সরষে– দেশে বিদেশে ঘুরে ঘুরে যখন তিনি অভিজ্ঞতার ঝুলি ভরছেন, ননীদা তখন শেকড় গেড়ে বসেছেন ভিনদেশে।
কলকাতায় থাকতে ‘ধুলোমাটি’ আর ‘ধানকানা’-র লেখক ননী ভৌমিককে দূর থেকে দেখেছি সম্ভ্রমের দৃষ্টিতে, দেখেছি ‘পরিচয়’ পত্রিকার অফিসে। আলাপের সুযোগ হয়নি, আলাপ করার স্পর্ধাও ছিল না। তারপর হঠাৎ একদিন শুনতে পেলাম ‘বিদেশী ভাষায় সাহিত্য প্রকাশালয়’-এ অনুবাদকের কাজ নিয়ে ননী ভৌমিক মস্কোয় চলে গেছেন। সেই যে গেলেন আর ফিরলেন না।
বর্তমান প্রজন্মের অনেকে তাঁকে রুশ সাহিত্যের অনুবাদক হিসেবে জানলেও আমাদের কাছে তিনি ‘ধুলোমাটি’ ও ‘ধানকানা’র লেখক। লেখক জীবনের শুরুতেই অনুবাদক হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিজের হাতে মুছে দিলেন তাঁর জীবনের বহুপ্রতিশ্রুত একটি অধ্যায়। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা ওই অনুবাদের সুবাদেই, বিদেশে। আবার তিনি মস্কোয় না থাকলে সেখানে দীর্ঘকালের জন্য অনুবাদকরূপে আমার স্থিতিরও কোনও সম্ভাবনা ছিল না, তাঁর সঙ্গে অন্তরঙ্গতারও নয়।
ননী ভৌমিক কলকাতা ছেড়ে যাওয়ার কিছুকাল বাদে ‘সোভিয়েত দেশ’ পত্রিকায় তাঁর একটি ছবি বেরিয়েছিল মনে আছে– গায়ে ভারী ওভারকোট, মাথায় আস্ত্রাখান টুপি, তার ওপর জুঁইফুলের মতো ছড়িয়ে আছে পেঁজা বরফ। ছবিটা ছিল সম্ভবত কোনও এক যৌথখামারের সাক্ষাৎকার বিবরণীর সঙ্গে। কলকাতায় দেখা চেহারার সঙ্গে খুব একটা মিল খুঁজে পাইনি। আসলে বাইরের আবরণগুলো ছিল বড্ড বেশি ভারী। তাতে চাপা পড়ে গিয়েছিল তাঁর আসল চেহারাটা।
(চলবে)
…পড়ুন রুশকথার অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১২। ‘প্রগতি’ ও ‘রাদুগা’র অধঃপতনের বীজ কি গঠনপ্রকৃতির মধ্যেই নিহিত ছিল?
পর্ব ১১। সমর সেনকে দিয়ে কি রুশ কাব্যসংকলন অনুবাদ করানো যেত না?
পর্ব ১০। সমর সেনের মহুয়ার দেশ থেকে সোভিয়েত দেশে যাত্রা
পর্ব ৯। মস্কোয় অনুবাদচর্চার যখন রমরমা, ঠিক তখনই ঘটে গেল আকস্মিক অঘটন
পর্ব ৮: একজন কথা রেখেছিলেন, কিন্তু অনেকেই রাখেননি
পর্ব ৭: লেনিনকে তাঁর নিজের দেশের অনেকে ‘জার্মান চর’ বলেও অভিহিত করত
পর্ব ৬: যে-পতাকা বিজয়গর্বে রাইখস্টাগের মাথায় উড়েছিল, তা আজ ক্রেমলিনের মাথা থেকে নামানো হবে
পর্ব ৫: কোনটা বিপ্লব, কোনটা অভ্যুত্থান– দেশের মানুষ আজও তা স্থির করতে পারছে না
পর্ব ৪: আমার সাদা-কালোর স্বপ্নের মধ্যে ছিল সোভিয়েত দেশ
পর্ব ৩: ক্রেমলিনে যে বছর লেনিনের মূর্তি স্থাপিত হয়, সে বছরই ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার সূচনাকাল
পর্ব ২: যে দেশে সূর্য অস্ত যায় না– আজও যায় না
পর্ব ১: এক প্রত্যক্ষদর্শীর চোখে রাশিয়ার খণ্ডচিত্র ও অতীতে উঁকিঝুঁকি