আমি একবারই দেখেছি বীরেনদাকে। বিল্টু নিয়ে গিয়েছিল আমাকে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। মনে পড়ে রাহুল-ও (পুরকায়স্থ) ছিল। সেটা ১৯৮০-র দশকটির গোড়ার দিক। এর ঢের আগে ১৯৬৮-’৬৯ এবং ৭০-এর দশকে লাল টুকটুক স্বপ্ন দেখা তরুণ সমাজের ওপর যখন নেমে এসেছিল রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, সেদিন ভারতেতিহাসের এক গ্রন্থি সময়ে দিনবদলের স্বপ্নতাড়িত তামাম জনতার মাঝে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন ঝড়ের সওয়ার এক অক্লান্ত চারণ।
তাঁর জন্মশতবর্ষ পার হয়ে গিয়েছে। আজ ২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ চিরজাগরুক কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ১০৩তম জন্মদিনটিতে, শুধু এইটুকু লিখেই আমি যেন তাঁকে আমার এই চিলেকোঠার টংয়ের ঘরে তাঁকে দেখতে পাচ্ছি। বহুপথ ঘুরে ঘুরে তিনি উপস্থিত হয়েছেন। ধূলিধূসর তাঁর পাঞ্জাবির পকেটের কোণটি ছেঁড়া, বিকেলের অপরূপ আলো তাঁর চোখে-মুখে– হ্যাঁ, তিনি হাজির। আর আমিও ভাবছি, আর কোনও ভয় নেই। আর কোনও দুশ্চিন্তা নেই। বীরেনদা এসে গিয়েছেন।
আবার আমাকে দেখে যেন বীরেনদা অনুযোগ করছেন, ‘তুমি তো আমার বাড়িতে আসো নাই।’ আমি নতমস্তকে বলছি, ‘যাবো বীরেনদা, আপনি হাসপাতাল থেকে ছুটি পেয়ে বাড়ি ফিরলেই আমি আপনার বাড়ি যাবো।’
মেডিকেল কলেজের কার্ডিওলজি ডিপার্টমেন্টের বেডে পিছনে বালিশের ঠেস দিয়ে আধশোওয়া বীরেনদার সঙ্গে আমার এই কথাবার্তা হয়েছিল। তিনি সেখানে তখন চিকিৎসাধীন ছিলেন ডা. ভূমেন্দ্র গুহের তত্ত্বাবধানে। হাসপাতালের বেডেই পাঞ্জাবির পাশ পকেট থেকে বিড়ির গোছা বের করে নিজে একটি ধরিয়ে আমার দিকে বাড়িয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘তুমি একটা বিড়ি খাবা?’
এই তো তিনি এখনও বললেন আমার টংয়ের ঘরে।
আমি একবারই দেখেছি বীরেনদাকে। বিল্টু নিয়ে গিয়েছিল আমাকে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। মনে পড়ে রাহুল-ও (পুরকায়স্থ) ছিল। সেটা ১৯৮০-র দশকটির গোড়ার দিক। এর ঢের আগে ১৯৬৮-’৬৯ এবং ৭০-এর দশকে লাল টুকটুক স্বপ্ন দেখা তরুণ সমাজের ওপর যখন নেমে এসেছিল রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, সেদিন ভারতেতিহাসের এক গ্রন্থি-সময়ে দিনবদলের স্বপ্নতাড়িত তামাম জনতার মাঝে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন ঝড়ের সওয়ার এক অক্লান্ত চারণ। আক্রান্ত তরুণ প্রজন্মর সহায়। সংক্ষিপ্ত এই রচনায় মোদ্দা কথাটিই বলি, তিনি স্বপ্ন দেখায় জুগিয়েছিলেন সাহস। সেদিন, সেই অভাব-অনটনের মফস্সলে, মন কেমন করে ওঠা এক বালকের হাতে পত্রপত্রিকায় উড়ে উড়ে এসেছিল বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা, সে এক রূপকথাই :
একজন কিশোর ছিল, একেবারে একা
আরও একজন ক্রমে বন্ধু হল তার
দুয়ে মিলে একদিন গেল কারাগারে
গিয়ে দেখে তারাই তো কয়েক হাজার।
সেই বালক, একটু বড় হয়ে যখন উত্তরপাড়া কলেজে পড়তে গেল, তার বছর দুই আগে ওই কলেজে পুলিশ আধা সেনার অভিযান ঘটেছিল। বীরেনদা লিখেছিলেন: ‘রক্ত রক্ত শুধু রক্ত দেখতে দেখতে দুই চোখ অন্ধ হয়ে যায়/ শিক্ষক ছাত্রের রক্ত প্রতিটি সিঁড়িতে ঘরে চেয়ারে চৌকাঠে বারান্দায়।’
তাঁর কবিতা স্লোগান হয়ে ওঠেনি কখনও। ভুয়ো বামপন্থার মোড়কে মোড়া নয়। ভোটসর্বস্ব ভণ্ডদের জন্য তিনি লিখে গিয়েছেন ‘লেনিন শতবর্ষে’ কবিতাটি:
কবর থেকে উঠে এলেন
সামনে মহত সভা
অবাক হয়ে দেখেন তিনি
ভাষণ দিচ্ছে বোবা।
আরও অবাক শুনছে যারা
জন্ম থেকেই বধির তারা
যেই না তিনি মুখ ফেরালেন
‘হা হতোস্মি’ বলে
লক্ষ খোঁড়ার মিছিল গেল
তাঁকেই পা-য়ে দলে।
স্মৃতি থেকে কবিতাটি লিখলাম। আমার মুখস্থ। ছায়া শরীরে বীরেনদা শুনলেন। একটু হাসলেনও।
আমরা তো এদিকে হোম-ডেলিভারিকে বিদায় দিয়ে ততদিনে ভাতের হোটেলে বেঞ্চি বুক করে ফেলেছি। যে কোনও মেসতীর্থেই ধীরে জেগে ওঠে এই সব হোটেল। তাদের হোটেল বললে বড় পাঁচ-সাত তারা-রা কুপিত হতে পারে। না বললে, আমাদের সম্মানে লাগে।