Robbar

একবার সুন্দরের পানে চেয়ে, একবার বেদনার পানে

Published by: Robbar Digital
  • Posted:July 9, 2024 3:47 pm
  • Updated:July 9, 2024 7:02 pm  

আমাদের সিনেমার দেবতারা যে সকলেই স্বর্গের উদ‌্যানবাসী তা তো নন! অনেকই মর্তের উপগলিতে লুকিয়ে থাকেন ছদ্মবেশে। গুরু দত্ত সেরকমই ছিলেন। গুরু দত্ত আশির পদনখে রোমান্টিক, কিন্তু তিনি জানেন অন‌্যান‌্য প্রকাশ মাধ‌্যমে অন্তত আপেক্ষিক স্বাধীনতা আছে সমাজবিরোহিত বোধ করার, কবিতা বা চিত্রকলা অন্তত কলাকৈবল্যবাদের ছলনায় মুখ লুকোতে পারে। কিন্তু সিনেমার তেমন আড়াল নেই। সিনেমা জন্মসূত্রেই জনপদবধূ। আমাদের জনপ্রিয় ছবির জগতে পিয়াসার মতো কনে দেখা আলো আর কোথায়?

সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়

যে মুহূর্তে আমার গুরু দত্তের কথা মনে পড়ে, তখনই মনে পড়ে ‘সুবর্ণরেখা’ ছবিতে ঋত্বিক ঘটক পরিত‌্যক্ত রানওয়েতে যে ভাঙাচোরা এরোপ্লেনটিকে রেখেছিলেন, তার কথা। যেন এক ভগ্নপক্ষ বাজপাখি। গুরু দত্ত এবং ঋত্বিক ঘটক দু’জনেই ঘটনাক্রমে ভারতীয়, হয়তো আন্তর্জাতিক সিনেমাতেও ধ্বংসস্তূপে আলো। কী আশ্চর্য সমাপতন! দু’জনেই নিজেদের নিয়ে গিয়েছেন সর্বনাশের প্রান্তে। দু’জনেই মাত্র আটটি ছবি নিবেদন করেছেন মহাকালের সমীপে। দু’জনেই মৃত‌্যুর পরে আবিষ্কৃত হয়েছেন দেশের বাইরে। যেমন ‘গগ্যাঁ-র চেয়ার’, তেমনই গুরু দত্তের কোনও বারান্দার টুকরো বা হয়তো সিঁড়ি। আসলে তাঁর সমস্ত রচনাবলি ধ্বংসাবশেষ ও আত্মবিলাপ। ভারতীয় চলচ্চিত্রে গুরু দত্ত (১৯২৫-’৬৪) এমনই এক স্রষ্টা, যাঁর চিত্রমালার স্তর থেকে স্তরান্তরে ভ্রমণকালে আমাদের নজর এড়ায় না তাঁর ক্রম উন্মোচনশীল আত্মপ্রতিকৃতি সমূহ। একটু আগেই যা বলছিলাম, এক আশ্চর্য সমাপতন যে, গুরু দত্ত, ঋত্বিক ঘটক এবং বারীন সাহা জন্মেছিলেন একই বছরে, ১৯২৫ সালে। তিনজনই ভগ্নরথ কর্ণের মতো পড়ে আছেন ইতিহাসের কুরুক্ষেত্র প্রান্তরে। আর এই ১৯২৫ সালই দেখবে যুদ্ধজাহাজ পটেমকিনের অভ‌্যুদয়, সিনেমাশাস্ত্র তার ব‌্যাকরণ খুঁজে পাবে। যুগপৎ কালীদাস ও মল্লিনাথকে খুঁজে পাবে আইজেনস্টাইনের মধ্যে।

Guru Dutt - IMDb
গুরু দত্ত

যখনই আমরা বাঙালি বারেন্দ্র ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে কর্ণাটকি ব্রাহ্মণ গুরু দত্তের তুলনা করি, তখনই দেখি দু’জনেরই পানপাত্র উপচে পড়েছে দৃশ‌্য আর ছবিতে। কী বিধুর দু’জনের প্রস্থান! ঋত্বিক ভারতীয় চলচ্চিত্রের সেই অসমসাহসিক অভিযাত্রী, যিনি মেলোড্রামাকে উন্নীত করেন মহাকাব‌্যের স্তরে। গুরু দত্তের যাত্রা অত সুদূরে নয়, তবু যখনই ‘পিয়াসা’ (১৯৫৭), ‘কাগজ কে ফুল’ (১৯৫৯), ও ‘সাহেব বিবি অউর গোলাম’ (১৯৬২) আমাদের মনোযোগ দাবি করে, দেখতে পাই অশ্রুনদীর পরপারে এক নির্জন ও রিক্ত কবিকে। একবার সুন্দরের পানে চেয়ে, একবার বেদনার পানে গুরু দত্ত তবে কোথায় গেলেন?

A man for all genres: Guru Dutt – Madraswallah
কাগজ কে ফুল

আজ যখন বিপুল গৌরবে ভারতীয় চলচ্চিত্র তাঁর শতবর্ষ উদযাপন করবে, তখন আমার ধারণা হিন্দি চলচ্চিত্রের তিনিই শীর্ষবিন্দু। তিনিই অদৃষ্ট ও অশ্রুতকে স্পর্শ করতে পারলেন প্রথম আরবসাগরের উপকূলে। আজ আর অস্বীকারের উপায় নেই যে, গুরু দত্তের গীতিকবিতা আসলে ইতিহাসের তরঙ্গভঙ্গ। আমরা যদি সেসময়ের দিকে তাকাই, তাহলে বিমল রায়, মেহবুব খাঁ, এবং রাজ কাপুরের ছবিগুলোকে যদি পাশাপাশি দেখি, তাহলেই বুঝব গুরু দত্তের মহিমা। যদি আমরা তাঁর গানের দৃশ্যায়নের কথা ভাবি, তখনই দেখব যে ‘মেঘে ঢাকা তারা’য় ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙল ঝড়ে’ যে দক্ষতার সঙ্গে ঋত্বিক চিত্রায়ণ করেছেন, ঠিক তেমনভাবেই গুরু দত্ত ‘জানে কিয়া তুনে কহি’ গানটিকে রচনা করেছেন। নেহাত পণ্যানারী গুলাব ধরেই নিয়েছে যে কবি বিজয় তার গ্রাহক। ইশারায়, ইঙ্গিতে সে বিজয়কে অনুসরণ করে আসতে বলছে। গুলাবের পিছনে পিছনে বিজয় আসছে। কারণ বিজয় কৌতূহল মেটাতে চায় যে, মেয়েটি কেমনভাবে তার কবিতার সন্ধান পেল। এই বিজয় আসলে তো বোদলেয়ারের মতো এমন একজন কবি, যিনি যান দুভালকে পরীক্ষা করছেন– সে কী করে আত্মার স্ত্রোত্র খুঁজে পায়। আর এই বিজয়ই সেই মানুষ যে প্যারিসস্প্লিনি যে শিরস্ত্রাণ বোদলেয়ার হারিয়েছিলেন, তাকে আবার সেই মর্যাদা লুপ্ত হতে দেখে ‘পিয়াসা’য়। ‘পিয়াসা’ বস্তুত আধুনিক কবির জীবনের দলিল। এই যে গুলাব মেয়েটি– ওয়াহিদা রহমান ক‌্যামেরা থেকে দূরে চলে গিয়েছে, বিজয়কে সে আকর্ষণ করতে পারছে না। এবং তারপরে আবার সে ক্লোজআপে আসছে। মানুষের শরীরের সমস্ত অংশটির দিকে আমরা যেভাবে আকর্ষিত হই, তা হচ্ছে তার চোখ। মুখোমুখি দু’টি মানুষের চাউনির মধ‌্যে অদৃশ‌্য একটি সরলরেখা টানলে দু’জনের চলনের টানাপোড়েন খেয়াল করা যায়। গুরু দত্ত যে কী অসামান‌্য আলো ব‌্যবহারে তা করেছেন এবং এই দৃশ‌্যে যদি আমরা দেখি যে গুলাব একবার ঘনছায়ায় হারিয়ে যাচ্ছে, আবার ফিরে আসছে, এবং তার পরে করেনথিয়াম থামের আড়ালে লুকিয়ে পড়ছে। আবার দেখা দিচ্ছে। এর ফলে পর্দায় সব বাধা তুচ্ছ করে এক সম্মোহনী আকর্ষণের জন্ম হয়। ভূমির সমান্তরালে ক‌্যামেরা চলছে। মাঝখানে শুধু যতিচিহ্নের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে লম্বা থামগুলি। এই দৃশ‌্যের নিজস্ব একটা মাত্রা আছে, যা শটের নিজস্ব ছন্দে অল্পক্ষণের জন‌্য হলেও ছেদ ঘটায়। গোদার ‘মন্তাজ মাই ফাইন কেয়ার’ প্রবন্ধে বলেছিলেন যে, চলচ্চিত্র পরিচালনা যদি চোখের দেখা হয়, তাহলে মন্তাজ হল হৃদয়ের স্পন্দন। এই যে গানটিকে দৃশ্যায়িত করা হয়েছে, তাতে গুলাব যখন সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে থাকে, তখন আমাদের মনে হয় তার পুরুষ কৃতকর্ম নবীন না হলেও একটি নারী যেন ঈশ্বরীর মতো। কোনও দিন ‘পিয়াসা’-র গুলাবকে ভোলা যাবে না। যেমন ভোলা যাবে না গুরু দত্তের আত্মজীবনী। আমরা আগে এই পরিস্থিতিগুলিকে ব‌্যাখ‌্যা করতাম না। আমাদের সিনেমার দেবতারা যে সকলেই স্বর্গের উদ‌্যানবাসী তা তো নন! অনেকই মর্তের উপগলিতে লুকিয়ে থাকেন ছদ্মবেশে। গুরু দত্ত সেরকমই ছিলেন। গুরু দত্ত আশির পদনখে রোমান্টিক, কিন্তু তিনি জানেন অন‌্যান‌্য প্রকাশ মাধ‌্যমে অন্তত আপেক্ষিক স্বাধীনতা আছে সমাজবিরোহিত বোধ করার, কবিতা বা চিত্রকলা অন্তত কলাকৈবল্যবাদের ছলনায় মুখ লুকোতে পারে। কিন্তু সিনেমার তেমন আড়াল নেই। সিনেমা জন্মসূত্রেই জনপদবধূ। পিয়াসার নায়ক বিজয় কবি, কিন্তু শিরোভূষণহীন। পিয়াসা হয়তো কাব‌্যের শিখরপ্রদেশ ছুঁতে পারেনি, কিন্তু শিল্পের সম্ভ্রম যে কবিকে ক্লান্ত করে, তা বুঝিয়ে দিয়েছে সভ‌্যতার রুগ্ণ বিকেলে। আমাদের জনপ্রিয় ছবির জগতে পিয়াসার মতো কনে দেখা আলো আর কোথায়?

সাহেব বিবি অউর গোলাম

সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে থাকেন ওয়াহিদা রহমান– নরকের সুরবিস্তার। গুরু দত্ত চলকে ওঠা আলোর টুকরোয় তার গুলাবকে দেখলেন জীবনের পানপাত্রে। বাসনার বহ্নিশিখা। কিন্তু এক অলৌকিক দৃষ্টিপাত, যা সহসা অন্তর্হিত হয়, আবার অমরতা পরমুহূর্তে ফিরিয়ে যাকে দেয় সময়ের বেলাভূমিতে। ‘আজ সজন মোহে অঙ্গ লাগালো’ গানটিতে গুলাব তার মৃত‌্যুকে, জীবনাধিক জীবনকে লুকিয়ে রাখে চোখের পল্লবে। মুখের রেখায় জমে থাকে শ্রাবস্তীর কারুকার্য। অথবা ‘সাহেব বিবি অউর গোলাম’-এর ছোটি বহু মীনাকুমারি! ‘না যাও সাইয়া চুরাকে বাইয়া’ গানটির প্রতিটি শব্দে কামনার দগ্ধাবশেষ! এই নারীই দয়িতকে স্পর্শ করতে চায়। তবু বোঝে, পুরুষ কত দূরে! দেহের উৎসব শেষে ইতিহাস ছোটি বহুকে পুনর্নির্মাণ করে ভোরের কল্লোলে। গুরু দত্তের নারী যুগপৎ পতিতা ও উত্থিতা। গুরু দত্তকে আমরা যে রোমান্টিক ভেবেছি, তার একটা সঠিক কারণ আছে। ফ্রাঙ্ক কারমোদ একজন রোমান্টিক শিল্পীকে যেভাবে বলতে চেয়েছেন– হন্টেড, লোনলি, ভিক্টিমাইজড, একধরনের মৃত‌্যুতাড়িত শহিদ, গুরু দত্ত ঠিক তাই। এক প্রান্তিকতা থেকেই গুরু দত্ত জীবন বিষয়ে তাঁর মন্তব‌্য সমূহ শিল্পকর্মের অন্তর্ভুক্ত করেন। তাঁর আত্মজৈবনিকতা, প্রতিরূপায়ণের দিক থেকে মেলোড্রামার আঙ্গিক বেছে নেয়। যেমন ঋত্বিক ঘটক বেছে নিয়েছিলেন। অথচ এই মেলোড্রামায় ইতিহাসের সমর্থন আছে। শিল্পায়ন ও শহরায়নের চাপ গত শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকেই গান্ধী, নেহরুর স্বপ্নকে ফিকে করে দেয়। তাতে যেমন দেশে আধুনিকতার পরিসর উন্মোচিত হয়, তেমনই সামাজিক স্থানচ‌্যুতি মর্মান্তিক হয়ে ওঠে। গুরু দত্তের প্রধান কৃতিত্ব রাষ্ট্র ও সংস্থা বনাম ব‌্যক্তির সংঘাতকে প্রধানত নারীচরিত্রের বিভঙ্গে তিনি নথিভুক্ত করেন। অর্থাৎ, গুরু দত্তের ছায়াছবি সামাজিক রূপান্তরের নৈতিক উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তাকে ব‌্যক্তির, বিশেষত নারীর চরিত্রায়নে দেখতে চায়। যা ঐতিহাসিক তা যখন পারিবারিক সমস‌্যায় পর্যভূষিত হয়, তখন মেলোড্রামার স্বর্ণ সম্ভাবনা। আর এই মুহূর্তটি পপুলার হিন্দি ছবিতে গুরু দত্তের প্রতি নিবেদিত। আমাদের যাবতীয় পুষ্পাঞ্জলি রূপান্তরের সমস‌্যায় গুরু দত্তের ছবিতেই অর্পিত হয়। কী সুন্দরভাবেই না তার সম্পর্কে লেখার সময় অরুণ খোপকার একদা লিখেছিলেন– ‘ট্র্যাজেডি ইজ লিঙ্কড টু মিথ, দি এপিক ইজ লিঙ্কড টু হিস্ট্রি’। কিংবদন্তি থেকে মহাকাব‌্যে উত্তরণের পথে গুরু দত্তের নিজস্ব ত্রুটি সমূহ তিনি গোপন করেননি। বরং দেশ বিভাগকে নিয়ে ঋত্বিক ঘটক যেভাবে সমকেন্দ্রিক বৃত্তগুলি রচনা করেন যা ব‌্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও শৈল্পিক দরজাগুলি পার হয়ে স্বর্গারোহন পর্ব সমাপ্ত করে, তার অভাবে কীভাবে গুরু দত্ত আত্মনাশের অভিপ্রায়কে সম্মুখবর্তী করতে থাকেন সেই প্রয়াস আমরা লক্ষ করি। ‘মিস্টার ও মিসেস ফিফটি ফাইভ’ থেকে ‘কাগজ কি ফুল’ পর্যন্ত সমস্তই এই আত্মহননের রক্তাক্ত স্মৃতিচিহ্নগুলিকে ধারণ করে রাখে।

File:Pyaasa-1957-002-waheeda-rehman-guru-dutt.jpg - Wikimedia Commons
পিয়াসা

আজ আমরা বুঝতে পারছি যে, গুরু দত্তকে বুঝতে গেলে আমাদের পিটার ব্রুকসের ‘মেলোড্রামাটিক ইমারজিনেশন’ বা মেলোড্রামা সম্পর্কে যে নবীন ধারণাগুলি প্রচলিত সেই ধারণাগুলিকে বুঝতে হবে। যখন আমরা মীনা কুমারীকে ‘সাহেব বিবি গুলাম’-এ দেখি, তার যে মাংসল নিবেদন– এই বৈপরীত‌্যই গুরু দত্তকে আধুনিক করে। তিনি বৈষ্ণব কবিদের মতো, অথবা চণ্ডীদাসের মতো শ্রীরাধিকাকে নেহাত কৃষ্ণ-সমর্পিতা এক নারী হিসাবে বর্ণনা করেননি। বরং পরতে পরতে কামনার তপ্ত নিশ্বাসে যখন ছোটি বহু আছড়ে পড়ে, তখন আমরা বুঝি আধুনিক নারীর পরিতাপ ও নিশ্বাস ইতিহাসকে কীভাবে পুড়িয়ে দিয়ে যায়।

গুরু দত্ত

গুরু দত্তের সঙ্গে বাঙালির একটি নিজস্ব অন্তরসূত্র আছে। গুরু দত্তের প্রাথমিক শিল্পশিক্ষা তো উদয় শঙ্করের কাছে। ‘ইন্ডিয়ান কালচারাল সেন্টার’-এ, আলমোড়ায়। এবং সেখানে তিনি ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবকেও পেয়েছিলেন। যখন গুরু দত্তের জীবনকৃতী ব‌্যাখ‌্যা করতে হয়, তাখন দেখা যাবে যে, শরৎচন্দ্রের ‘দেবদাস’-এর একটি বাস্তব সম্প্রসারণ। এই যে দেবদাস, চন্দ্রমুখী এবং পারো নামক দুই নারীর মধ‌্যে বিভক্ত হয়ে আছেন, গুরু দত্তের ব‌্যক্তিগত জীবনের অত‌্যন্ত প্রামাণ‌্য নথি অনুসরণ করলেই বোঝা যায়, তিনি কীভাবে দুই নারীর মধ‌্যে, দুই মেরুর মধ‌্যে রক্তাক্ত হয়ে থাকেন। লক্ষ‌ করার মতো বিষয়, ‘কাগজ কে ফুল’ যখন তিনি বানাচ্ছেন, তার প্রধান চরিত্র চলচ্চিত্র-পরিচালক সুরেশ সিনহা, যিনি গুরু দত্ত নিজে, তিনি ‘দেবদাস’ অবলম্বনে ছবি বানাচ্ছেন। সিনেমার মধ‌্যে আরেক সিনেমা, যার মধ‌্যে হঠাৎ সে আবিষ্কার করে শান্তি অর্থাৎ ওয়াহিদা রহমানকে, যিনি পার্বতীর ভূমিকায় অভিনয় করবেন। ‘দেবদাস’ যেভাবে একধরনের আত্মহননের দিকে এগিয়ে যায়, সেভাবেই গুরু দত্ত ক্রমশ নিজের প্রস্থানলিপি প্রস্তুত করেন। এবং ‘সাহেব বিবি অউর গোলাম’-এর সেটও তিনি তৈরি করেছিলেন কলকাতা থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে ধান‌্যকুড়িয়ায়। শচীনদেব বর্মন এবং হেমন্ত মুখোপাধ‌্যায়ের সুরারোপ তাঁর ছবিতে এবং তাঁর একাধিক গান, আমাদের কাছেও অশ্রুধারার মতো। যেমন ‘পিয়াসা’-র বিখ‌্যাত ‘জানে ও ক‌্যায়সে লোগ থে জিনকে প‌্যায়ার কো প‌্যায়ার মিলা’ এই গানটি গেয়েছেন হেমন্তবাবু। অথবা হেমন্তবাবুর পরিচালনায় যখন ‘অলিরও কথা শুনে ভ্রমর হাসে’ গানটির হিন্দি সংস্করণ ব‌্যবহৃত হয় ‘সাহেব বিবি অউর গোলাম’-এ, তখন আমরা দেখি ওয়াহিদা রহমান ঠিকই বলেছেন, গুরু দত্ত তাঁর যাবতীয় কান্না গানে নিবেদন করতে পারতেন। অথচ স্বয়ং গুরু দত্ত মনে করেন যে গান ভারতীয় চলচ্চিত্রে সুপ্রযুক্ত হয়নি সবসময়। আসলে গানকে গুরু দত্ত ছবির চলনের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে পারতেন। যেটা ঋত্বিক ঘটকও পারতেন। এবং যেখানে আমাদের ফিল্ম সোসাইটির আন্দোলনে ঋত্বিক ঘটকেরই সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র স্বর। তার কারণ তিনি মনে করেন কমল মজুমদারের সঙ্গেই যে আমাদের জীবন গানে পরিপূর্ণ। কমলবাবু বলেন, হিন্দু বাঙালিই একমাত্র বাঙালি যে শ্মশানেও গান গায়। এই যে ‘মেঘে ঢাকা তারা’-য় বা ‘কোমল গান্ধারে’ গানের প্রাচুর্য, এই যে ‘পিয়াসা’-য় এত গান, ‘সাহেব বিবি অউর গোলাম’-এ গান– এই গানকে নেহাত গান হিসাবে বিবেচনা করা অনুচিত হবে। এগুলো কবিতার সম্প্রসারণ। গুরু দত্ত নিজে কবি ছিলেন। আর কবি হিসাবে তিনি যখন আলোর সঙ্গে খেলা করেন, তখন আলো আর ছায়ায় ঈশ্বর নিজেকে মর্ত‌্যভূমিতে আনেন, তা চিনতে আমাদের ভুল হয় না।

গুরু দত্তকে শতবর্ষের মুহূর্তে প্রণাম।

………………………………………………………………………

আরও পড়ুন অরুণোদয়-এর লেখা: গুরু দত্তর সব পেয়েছির শহর এই কলকাতাই

………………………………………………………………………