‘উম্ম সাআদ’ উপন্যাসের প্রোটাগনিস্ট উম্ম সাআদ তেমনই একজন ফ্যলাস্তিনি নারী– যাঁরা বাঁচেন আরও ফিদাইঁর জন্ম দেবেন বলে! এই উপন্যাসে আমরা উম্ম সাআদকে দেখি খুঁজে খুঁজে রেফ্যুজি ক্যাম্পে নিজের ছেলে ও তাঁর সহযোদ্ধা বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে। ছেলে, তার নাম সাআদ, তখন বুলেটের ক্ষত বহন করছে। উম্ম সাআদ ছেলেকে সারিয়ে তুলতে চায় তাড়াতাড়ি, যাতে সুস্থ হয়ে উঠে সে দ্রুত প্রতিরোধ যুদ্ধে ফিরতে পারে! মাক্সিম গোর্কির ‘মা’-র মতোই ‘উম্ম সাআদ’ আরব প্রতিরোধ সাহিত্যে মাইলফলক হয়ে থাকল।
২১
গাসসান ফইজ কানাফানি। ফ্যলাস্তিন
বাচ্চারা যেন না মরে!
আকাশে থাকুক তারা
মাটিতে যুদ্ধ যতদিন থাকে।
তারপর একদিন তারা
সহি-সলামৎ ঘরে ফিরবে।
তাদের আব্বু আম্মুরা
‘কোথায় ছিলে’ শুধালে বলবে–
“মেঘের সাথে খেলছিলাম তো!”
নক্বা মানে বিপর্যয়। যে বিপর্যয় একটা ১২ বছরের ফ্যলাস্তিনি ছেলেকে আরও হাজার হাজার ছেলেমেয়ের সঙ্গে ভূমিচ্যুত করে। বাবা-মা-ভাই-বোনের অনিশ্চয়তায় ভরা হাত ধরে প্রথমে জন্ম-শহর আক্কা ছেড়ে দামাস্কাস, দামাস্কাস থেকে কুয়েত, কুয়েত থেকে বেইরুট… সে ছেলে আর কোনওদিন ফিরে পাবে না তার ভিটেমাটি। এক ঠিকানা থেকে পরের ঠিকানায় পৌঁছোতে সে ট্রাকে করে মরুভূমি পেরোবে, তলোয়ারের ফলার মতো ধারালো রোদ তাদের শরীর চিরে চিরে কাটবে। আর তার অনেকদিন পর ছেলেটি বড় হয়ে গিয়ে লিখবে ‘সূর্যের নিচে মানুষেরা’– রিজাই ফি-আ-শামস।
‘রিজাই ফি-আ-শামস’ গাসসান ফইজ কানাফানির প্রথম উপন্যাস। ১৯৬২-তে প্রথমবার তা প্রকাশিত হতেই সাহিত্যরসিকরা নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয়েছিলেন। উপন্যাসে একেবারে নতুন ধারার আঙ্গিকের আধুনিকতা–ফ্ল্যাশব্যাক এফেক্ট এবং একইসঙ্গে অনেক ন্যারেটিভ স্বরের সমান্তরাল যাতায়াত– আরবি উপন্যাসের দুনিয়াকে এক ধাক্কায় অনেকটাই আধুনিক করে তুলেছিল। আরও সাত বছর পেরিয়ে, স্বভূমিতে না ফিরতে পারা তাঁর ‘হাইফায় ফেরা’ নামে আরেকটি উপন্যাস বেরোল। প্রতিবাদের সাহিত্য ততদিনে মোড় নিতে শুরু করেছে প্রতিরোধের ভাষায়। সন্তান ফিদাইঁ হয়ে উঠছে জেনে গর্বিত হয় যেখানে জনক-জননীরা (স্বভূমির জন্য মরতে প্রস্তুত যোদ্ধাদের ফ্যলাস্তিনে ‘ফিদাইঁ’ বলা হয়)। একই বছরে জন্ম নিল তাঁর তৃতীয় উপন্যাস ‘উম্ম সাআদ’। এই উপন্যাসের প্রোটাগনিস্ট উম্ম সাআদ তেমনই একজন ফ্যলাস্তিনি নারী– দৃঢ়, স্থিতধী, প্রত্যয়ী–যাঁরা বাঁচেন আরও ফিদাইঁর জন্ম দেবেন বলে! এই উপন্যাসে আমরা উম্ম সাআদকে দেখি খুঁজে খুঁজে রেফ্যুজি ক্যাম্পে নিজের ছেলে ও তাঁর সহযোদ্ধা বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে। ছেলে, তার নাম সাআদ, তখন বুলেটের ক্ষত বহন করছে। উম্ম সাআদ ছেলেকে সারিয়ে তুলতে চায় তাড়াতাড়ি, যাতে সুস্থ হয়ে উঠে প্রতিরোধ যুদ্ধে সে দ্রুত ফিরতে পারে! মাক্সিম গোর্কির ‘মা’-র মতোই ‘উম্ম সাআদ’ আরব প্রতিরোধ সাহিত্যে মাইলফলক হয়ে থাকল। কিন্তু এটুকুই জানলেও কানাফানির অর্ধেকটাকে জানা হবে শুধু।
ইউনিভার্সিটি থেকে রাজনৈতিক যোগাযোগের কারণে বিতাড়িত সাহিত্যের ছাত্র কানাফানি ছাত্রজীবনে এবং সাহিত্যচর্চা, পত্রপত্রিকার সম্পাদনার প্রথম পর্বে ‘আরব জাতীয়তাবাদী আন্দোলন’-এর গভীর প্রভাবে ছিলেন। তাতে বিপ্লবী বাঁকবদল ঘটল অশান্ত ১৯৬৭-তে। যে তরুণেরা সেদিন শুধু স্বাধীন ফ্যলাস্তিন নয়, মুক্ত, সমাজতান্ত্রিক ফ্যলাস্তিনের স্বপ্ন দেখেছিলেন, গাসসান তাঁদের দলেই ছিলেন। পিএলও-র বামপন্থী নেতা জর্জ হাবাশ যখন ইয়াসির আরাফাতের সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অফ প্যালেস্টাইন (পিএফএলপি) প্রতিষ্ঠা করলেন, গাসসান ফইজ কানাফানি তার প্রতিষ্ঠাতা-সদস্যদের একজন ছিলেন। এর দু’বছর বাদে পিএফএলপি যখন মার্কসবাদ লেনিনবাদকে ফিলিস্তিনি মুক্তিসংগ্রামের তাত্ত্বিক ভিত হিসেবে গ্রহণ করল, সেই ইশতেহারের অন্যতম প্রধান কারিগরও ছিলেন কানাফানি। সে সময়ে তিনি দৈনিক সংবাদপত্র আল-আনোয়ার-এর প্রধান সম্পাদক। সে পদ ছেড়ে দিয়ে দায়িত্ব নিলেন পিএফএলপি-র সাপ্তাহিক আল-হাদাফ-এর (‘আল-হাদাফ’ মানে ‘লক্ষ্য’)। এই সময় থেকেই স্থির লক্ষে নিজের সাহিত্যের ভুবনকে ভেঙে নতুন করে গড়েপিটে নিয়েছিলেন তিনি– ‘উম্ম সাআদ’ ও পরবর্তী উপন্যাসগুলি ছিল তারই ফসল। আরব প্রতিরোধ সাহিত্যের দিশা সত্যি করে নিরুপণ করলেন কানাফানি।
কবিতা লিখেছেন। কিন্তু পৃথিবী তাঁকে চেনে উপন্যাসকার হিসেবে। ফ্যলাস্তিনের প্রতিরোধের কবিতা নিয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাটি লিখেছেন। যদিও পৃথিবী তাঁকে বেশি চেনে ফ্যলাস্তিনের প্রতিরোধ সংগ্রামের মুখপাত্র হিসেবে। ঔপন্যাসিক ও সম্পাদক হিসেবে খ্যাতির মধ্যগগনে থাকাকালীনই কিন্তু তিনি সরাসরি সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে গেছেন। ১৯৭২-এ জাপানিজ রেড আর্মির সহযোগিতায় ইসরায়েলের লড এয়ারপোর্টে ঐতিহাসিক আক্রমণ-সহ ইসরায়েলকে সন্ত্রস্ত করে তোলা একাধিক ‘অফেন্সিভ’-এর পিছনে তাঁর মস্তিষ্ক কাজ করেছিল। মনে রাখতে হবে, এই সময়েই পিএফএলপি প্যালেস্টাইনে দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে উঠে এসেছিল। তার আন্তর্জাতিক মুখপাত্র কানাফানি। সুতরাং, তাঁর মৃত্যুর পরদিন ‘ডেইলি স্টার’ যে লিখেছিল, ‘কানাফানি এমন এক কম্যান্ডো ছিলেন যিনি একবারও একটি গুলি ছোঁড়েননি। তাঁর অস্ত্র ছিল বল-পেন আর যুদ্ধক্ষেত্র ছিল সংবাদপত্রের পৃষ্ঠা’– তা নেহাত মিথ্যে ছিল না। গাসসান কানাফানি শুধুই ন্যায়যুদ্ধের পক্ষে ছিলেন না। যুদ্ধে ছিলেন।
ইসরায়েলের বিষ নজরে থাকবেন তিনি, সেটাই স্বাভাবিক। মোসাদ তাঁকে গুপ্তহত্যার চেষ্টা অবিচ্ছিন্নভাবে চালিয়ে গেছে। ১৯৭২-এর জুলাই মাসের ৮ তারিখ, তখন ৩৬ বছর বয়স তাঁর, বাড়ি থেকে ভাইঝিকে নিয়ে বেরিয়ে গাড়িতে উঠতেই বিস্ফোরণে পুরো এলাকা কেঁপে ওঠে। ছিন্নভিন্ন হয়ে যান, সঙ্গে ১৭ বছরের ভাইঝি লামিসও। বহু ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর গাড়ির পিছনে বোমা রাখতে সফল হয়েছিল মোসাদ। ঘাতকেরা বড় তৃপ্তির হাসি হেসেছিল বুঝি সে রাতে? সময় প্রমাণ করেছে, সে হাসি শেষ হাসি ছিল না। এই হত্যা আরও অনেক গাসসান কানাফানির জন্ম সুনিশ্চিত করেছিল। বিধ্বস্ত গাজা, হার-না-মানা গাজা, প্রতিরোধের গাজায় বসে আজও লিখছেন। এবং… যুদ্ধক্ষেত্ৰে লড়ছেন।
(নিচের অংশটি একটি চিঠি। গাসসান কানাফানির লেখা, তাঁর ছেলে ফইজ-কে। পড়ে দেখুন তো, কবিতার থেকে কম কিছু কি না?
“পাশের ঘর থেকে শুনতে পেলাম তুই তোর মা-কে জিগ্যেস করলি, ‘মা, ও মা! আমি কি ফিলাস্তিনি?’ মা যখন ‘হ্যাঁ’ বলল– গোটা বাড়ি জুড়ে একটা নৈঃশব্দ্য নেমে এল। যেন ভারী একটা কিছু আমাদের মাথার ওপর ঝুলছিল, ধপ করে পড়ে গেল সেটা, বিস্ফোরণ ঘটল, আওয়াজের বিস্ফোরণ, তারপর… নিস্তব্ধতা! একটু পরে আমি তোর কান্না শুনতে পেলাম। আমার পা দুটো জমে পাথর। পাশের ঘরে– আমি যতদূর ভাবতে পারি তার চেয়ে অনেক বড় একটা কিছু– তোর ওই এলোমেলো কান্নার মধ্যে জন্ম নিচ্ছিল। একটা মন্ত্রপড়া ডাক্তারি ছুরির মতো তা যেন তোর বুক চিরে বসিয়ে দিচ্ছিল একটা হৃৎপিণ্ড, তোরই হৃৎপিণ্ড সেটা…!
পাশের ঘরে কী হচ্ছে সেটা দেখার জন্যেও আমি নড়তে পারছিলাম না।
আমি বুঝছিলাম, আমার দূরে রয়ে যাওয়া স্বভূমি পাশের ঘরে আবার জন্ম নিচ্ছে: পাহাড়, জলপাইবাগান, মৃত মানুষেরা, ছেঁড়া ব্যানারগুলি (বা কয়েকটা ভাঁজ করাও হয়তো)– সব কিছু মিলেমিশে রক্ত আর মাংস কেটে কেটে ভাবীকাল হয়ে বসে যাচ্ছে আরেকটা বাচ্চার বুকের ভিতরে… আচ্ছা তোর কি মনে হয়, মানুষ গর্ভের মধ্যিখানে ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে? এক্কেবারে না, জানিস! সে হঠাৎ করে জন্ম নেয়, হঠাৎ করেই তার হৃৎপিণ্ডে দিপদিপানি শুরু হয়ে যায়। শৈশবের ছাদ থেকে একটানে রাস্তার রুক্ষতায় তাকে নামিয়ে আনতে ফিলাস্তিনের একটা দৃশ্যই যথেষ্ট।”)
……………………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………………
পুনশ্চ: বিস্ফোরণে মৃত্যুর দিন বাড়ি থেকে বেরনোর খানিক আগে ভাইঝি লামিস নাজিম কাকাকে পরামর্শ দিচ্ছিলেন, যাতে তিনি প্রতিরোধের কথা এত জোরেসোরে বলবার বদলে গল্প লেখালিখিতে ফিরে যান আবার। স্মিত হেসে গাসসান কানাফানি ছোট্ট উত্তর দিয়েছিলেন– ‘প্রতিরোধই তো আসল গল্প।’
…পড়ুন কবি ও বধ্যভূমি…
পর্ব ২০: যে তাঁত বুনেছে রক্তপতাকা
পর্ব ১৯: আমাকে দেখাও সেই বন্দিকক্ষ
পর্ব ১৮: কতটা দীর্ঘ হলে জনযুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয়? (২য়)
পর্ব ১৭: কতটা দীর্ঘ হলে জনযুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয়? (১ম)
পর্ব ১৬: পারো যদি বজ্র হয়ে এসো
পর্ব ১৫: কামানের মুখে কলহাস্যে এ কী ভালোবাসা!
পর্ব ১৪: গান্ধিনগরে রাত্রি
পর্ব ১৩: সিলারের পাপড়ি অথবা একজন পেশমেরগার মৃত্যু
পর্ব ১২: ডানার পালকে সূর্যকে নিয়ে…
পর্ব ১১: প্রিয় কমরেড, এসো একসাথে মরি
পর্ব ১০: প্রাণভিক্ষা? বেছে নিই মৃত্যুর অহংকার বরং!
পর্ব ৯: তিমিরের অন্তে যদি তিমিরবিনাশ
পর্ব ৮: অক্সিজেন মৃতদের জন্য নয়!
পর্ব ৭: আকাশে তারারা জ্বলছে, ফ্যলাস্তিনকে ভয় দেখিও না!
পর্ব ৬: কোথায় লুকোবে কালো কোকিলের লাশ?
পর্ব ৫: আমার দুঃখের কথা কি পাথরকে বলব?
পর্ব ৪: আমি সেই মেয়ে, যে আর ফিরবে না
পর্ব ৩: আমাকে পোড়াতে পারো, আমার কবিতাকে নয়!
পর্ব ২: এস্তাদিও চিলে আর চল্লিশটা বুলেটের ক্ষত
পর্ব ১: বিপ্লব, প্রেম ও কবিতাকে আমৃত্যু আগলে রেখেছিলেন দ্রোণাচার্য ঘোষ