কোনও একটা সময়ে আমি কলকাতায় পুরনো খবরের কাগজের আর্কাইভ দেখছিলাম। দেখলাম, সেখানে একেবারে নতুনের মতোই রাখা রয়েছে বহু বহু ইলাস্ট্রেটেড উইকলি। জানতে পেরেছিলাম, সেই কাগজগুলোকে বাতিল করা হয়েছে। ফেলে দেওয়া হবে। আমি তৎক্ষণাৎ ফোন করি প্রীতীশকে। প্রীতীশকে ফোন করলে যা স্বাভাবিক, প্রতিবারের মতো সেবারও পাইনি। একাধিকবার ফোন করেও না। এমনকী, এসএমএস-এরও কোনও প্রত্যুত্তর নেই। ক’দিন পরে যখন দেখা হল, বললাম এইসব কথা। তখন অফিসের জানলা দিয়ে কিছুক্ষণ বাইরে তাকিয়েছিল প্রীতীশ।
২৩.
আমার সঙ্গে যখন প্রীতীশ নন্দীর আলাপ হয়, তার বহুদিন আগে থেকেই প্রীতীশের নাম আমি জানি। প্রীতীশ আমার কাছে ছিল একজন কবি, ‘ইলাসট্রেটেড উইকলি’ নামক এক চমৎকার পত্রিকার সম্পাদক। এখন সেই প্রীতীশ আমার বন্ধু, ‘পিএনসি’ কোম্পানির প্রোডিউসার। সে কোম্পানির প্রোডাকশনে বেশ কিছু ভালো ছবিও হয়েছে। যেমন ‘কাঁটে’– যেখানে অভিনয় করেছিলেন অমিতাভ বচ্চন, সঞ্জয় দত্ত, সুনীল শেট্টি। আর সুধীর মিশ্রা-র পরিচালনায় ‘হাজারো খোয়াইশ’-এর মতো ছবিও। অল্প অল্প করে জানতে পেরেছিলাম, প্রীতীশের লেখা প্রায় গোটা তিরিশেক বই রয়েছে। অনুবাদ ও সম্পাদনা ধরলে বোধহয় ষাটখানা!
‘পদ্মশ্রী’ পেয়েছিল প্রীতীশ, কিন্তু তা মাত্র ২৭ বছর বয়সে! পড়াশোনা এই কলকাতায়, লা মার্টিনিয়ার স্কুলে। পরে প্রেসিডেন্সি কলেজে। প্রীতীশের কলেজবেলা নিয়ে সামান্য লিখেছিলেন শুভাপ্রসন্ন, ওঁর ‘আমার ছবি জীবন’ (মিত্র ও ঘোষ) বইতে।
‘ইলাসট্রেটেড উইকলি’র সম্পাদক ছিল প্রীতীশ– ’৮২ সাল থেকে ’৯১ সাল পর্যন্ত। ওই ১০ বছরের পত্রিকাগুলো খেয়াল করলে দেখা যাবে, দুটো ব্যাপারে ঝোঁক ছিল এই পত্রিকা সম্পাদকের। এক, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ– মোটকথা বাংলার সংস্কৃতি, ইতিহাস, শিল্প-সাহিত্য। অন্যটা সিনেজগৎ। যেদিকে প্রীতীশ পরে পা দেবে।
‘ফ্যান্টাসটিকস’ নামে কলকাতার ফুটবলের ওপর প্রচ্ছদকাহিনি করেছিল প্রীতীশ। ছিল ‘গ্রেট বেঙ্গল রেনেসাঁ’ নামে একটি সংখ্যাও। এমনকী, কলকাতার ৩০০ বছর উপলক্ষেও সে সংখ্যা করতে কসুর করেনি।
সিনেমার দিকটা ধরলে সুভাষ ঘাই, রাজকুমার, গুরু দত্ত, স্মিতা পাতিল– এঁদের নিয়ে প্রচ্ছদকাহিনি করেছিল ওর পত্রিকায়। স্মিতা পাতিলের সাক্ষাৎকার নিয়েছিল প্রীতীশই। ১৯৮৪-’৮৬ সালে ও ‘ফিল্মফেয়ার’ পত্রিকারও সম্পাদনা করেছিল। ১৯৮৪ সালে প্রীতীশ অমিতাভ বচ্চনকে নিয়ে একটা প্রচ্ছদকাহিনি করেছিল ইলাস্ট্রেটেড উইকলিতেই। যার প্রচ্ছদে লেখা ছিল: ‘গুড বাই? ইজ অমিতাভ বচ্চন কুইটিং মুভিজ?’ ৪০ বছর পরে অমিতাভ বচ্চন এখনও ছবি করছেন। এখনও ‘স্টার স্টেটাস’ নিয়ে রয়েছেন। এখনও ওঁর কাছে স্ক্রিপ্টের পাহাড় হয়ে থাকে বলে শুনেছি।
১৯৮৫ সালে কার্টুনিস্ট বাল ঠাকরেকে নিয়েও প্রচ্ছদ করেছিল প্রীতীশ এই কাগজেই। প্রচ্ছদকাহিনির নাম ছিল: ‘কার্টুনিস্ট: এক্সপ্লোরিং দ্যা আদার ওয়ার্ল্ড অফ বাল ঠাকরে, শিবসেনা অ্যান্ড দ্য সুপ্রিম কিং অফ বম্বে’। ১৯৯৮ সালে প্রীতীশ রাজ্যসভার সদস্য হয়েছিল। মহারাষ্ট্রকে প্রতিনিধিত্ব করেছিল ও। শিবসেনার টিকিটও পেয়েছিল। প্রায় ৬ বছর মেম্বার ছিল ও।
প্রীতীশের মতে, ‘ইলাসট্রেটেড উইকলি’ এক সময় ভারতের সবথেকে আলোচিত পত্রিকা ছিল। কিন্তু কীভাবে এই পত্রিকার সম্পাদক হয়েছিল প্রীতীশ? বলি সেই গল্পটা! কোথা থেকে যেন প্রীতীশ ফিরছিল কলকাতায়। ফ্লাইটে। কাছাকাছিই বসেছিলেন অশোক জৈন। তিনি জানতেন যে, প্রীতীশ লেখালিখির সঙ্গে জড়িয়ে। তখন সদ্য সদ্য পদ্মশ্রীও পেয়েছে। ওদের মধ্যে কথাবার্তা শুরু হয়। অশোক জৈন প্রীতীশকে ওঁর কার্ড দিয়েছিলেন, যেখানে লেখা ছিল অশোক জৈন এবং শুধুমাত্র ওঁর ঠিকানা। ফলে প্রীতীশ তখনও জানত না অশোক জৈন ছিলেন ‘টাইম অফ ইন্ডিয়া’ গ্রুপের তৎকালীন মালিক। তিনিই পরে প্রীতীশ নন্দীকে ইলাস্ট্রেটেড উইকলির সম্পাদক করেন।
কোনও একটা সময়ে আমি কলকাতায় পুরনো খবরের কাগজের আর্কাইভ দেখছিলাম। দেখলাম, সেখানে একেবারে নতুনের মতোই রাখা রয়েছে বহু বহু ইলাস্ট্রেটেড উইকলি। জানতে পেরেছিলাম, সেই কাগজগুলোকে বাতিল করা হয়েছে। ফেলে দেওয়া হবে। আমি তৎক্ষণাৎ ফোন করি প্রীতীশকে। প্রীতীশকে ফোন করলে যা স্বাভাবিক, প্রতিবারের মতো সেবারও পাইনি। একাধিকবার ফোন করেও না। এমনকী, এসএমএস-এরও কোনও প্রত্যুত্তর নেই। ক’দিন পরে যখন দেখা হল, বললাম এইসব কথা। তখন অফিসের জানলা দিয়ে কিছুক্ষণ বাইরে তাকিয়েছিল প্রীতীশ।
বেশ কয়েক বছর হয়ে গিয়েছে বন্ধুত্বের। তখন ‘ইলাস্ট্রেটেড উইকলি’র ১০ বছর পেরিয়ে গিয়েছে, রাজ্যসভার সদস্য হিসেবেও, ওর কোম্পানিও অনেক দিন হল চালাচ্ছে, বইটইও লেখা হয়েছে যথেষ্ট– সেরকম সময়ে ওর কোনও একটা কবিতাকে রেফারেন্স করে একটুকরো কথা বলেছিলাম। প্রীতীশ নিজের কবিতার রেফারেন্সই ধরতে পারল না। প্রীতীশের প্রখর মগজাস্ত্র, তবুও। আমি বললাম, বাড়ি গিয়ে বইটা একবার দেখো। প্রীতীশ নির্লিপ্ত ও হালকা গলায় বলল, ওর কাছে ওর অনেক কবিতার বই-ই নেই। আমি খানিক অবাক। জিজ্ঞেস করলাম, কেন? বলল, দুটো শহর, অনেক বাড়ি, বহু জায়গায় বহু রকমের কাজ, তাই।
কলকাতায় ইন্দ্রদাকে (ইন্দ্রনাথ মজুমদার) জানালাম প্রীতীশের এই অবস্থা। এর পর থেকে ইন্দ্রদা, ক’মাস অন্তর অন্তর গোটা কতক বই জোগাড় করে রাখত প্রীতীশের জন্য, প্রীতীশেরই বই! নয় নয় করে ২০-২৫টা বই তো হবেই।
আশা করি, সেগুলো আর হারায়নি প্রীতীশ!
…পড়ুন ফ্রেমকাহিনি-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ২২। উত্তরের গলি, হলুদ ট্যাক্সি ও উস্তাদ আমজাদ আলি খান
পর্ব ২১। তপতীর বই পড়েই প্রিন্টের প্রতি আমার উৎসাহ বেড়ে গেল
পর্ব ২০। মৃত্যুর ২২ বছর পর বসন্ত চৌধুরীর ওপর বই হয়েছিল শুভাদার জন্যই
পর্ব ১৯। মৃণালদার মুদ্রাদোষগুলো আবারও দেখতে পেলাম অঞ্জন দত্তর সৌজন্যে
পর্ব ১৮। ১৭টা রাজ্য ঘুরে ১০৫৫টা পুরনো সিনেমা হলের ছবি তুলেছে হেমন্ত
পর্ব ১৭। এক বাঙালি বাড়ি আসবে বলে দু’রকমের মাছ রেঁধেছিলেন নানা পাটেকর
পর্ব ১৬। সুব্রত মিত্র ও সৌম্যেন্দু রায়ের মধ্যে কোনও প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল না
পর্ব ১৫। ১০ বছর বয়সেই ব্রাউনি ক্যামেরায় ছবি তোলা শুরু করেছিল রিনামাসি
পর্ব ১৪। তাল ও সুর দিয়ে তৈরি এক গ্রহে থাকতেন উস্তাদ বিসমিল্লা খাঁ
পর্ব ১৩। মৃণাল সেনকে এক ডলারেই গল্পের স্বত্ব বিক্রি করবেন, বলেছিলেন মার্কেস
পর্ব ১২: পুরনো বাড়ির বারান্দায় মগ্ন এক শিল্পী
পর্ব ১১। প্রায় নির্বাক গণেশ পাইন আড্ডা মারতেন বসন্ত কেবিনে
পর্ব ১০। আজাদ হিন্দ হোটেল আর সুব্রত মিত্রর বাড়ির মধ্যে মিল কোথায়?
পর্ব ৯। শান্তিনিকেতনের রাস্তায় রিকশা চালাতেন শর্বরী রায়চৌধুরী
পর্ব ৮। পুরনো বইয়ের খোঁজে গোয়েন্দা হয়ে উঠেছিলেন ইন্দ্রনাথ মজুমদার
পর্ব ৭। কলকাতার জন্মদিনে উত্তম-সুচিত্রার ছবি আঁকতে দেখেছি মকবুলকে
পর্ব ৬। বিয়ের দিন রঞ্জা আর স্যমন্তককে দেখে মনে হচ্ছিল উনিশ শতকের পেইন্টিং করা পোর্ট্রেট
পর্ব ৫। আলো ক্রমে আসিতেছে ও আমার ছবি তোলার শুরু
পর্ব ৪। মুম্বইয়ের অলৌকিক ভোর ও সাদাটে শার্ট পরা হুমা কুরেশির বন্ধুত্ব
পর্ব ৩। রণেন আয়ন দত্তর বাড়ি থেকে রাত দুটোয় ছবি নিয়ে বেপাত্তা হয়েছিলেন বসন্ত চৌধুরী
পর্ব ২। ইশকুল পার হইনি, রাধাপ্রসাদ গুপ্ত একটা ছোট্ট রামের পেগ তুলে দিয়েছিল হাতে
পর্ব ১। ঋতুর ভেতর সবসময় একজন শিল্প-নির্দেশক সজাগ ছিল