একটার পর একটা প্লাস্টিকের কৌটোয় সাজানো বিস্কুট। পাশে চা তৈরির সরঞ্জাম। দোকানের ভিতর নেই কোনও পাখা। মেঝেতে বসেই কাগজের কাপে চা বিক্রি করেন চিত্তরঞ্জন পাল। দোকানের এককোণে একটু জায়গা, সেখানেই তাঁর হাতের অনুপম শৈলীতে প্রাণময় হয়ে ওঠে মা লক্ষ্মীর সরাচিত্র। সরাচিত্রের ফরিদপুরী ঘরানাকে টিকিয়ে রেখেছেন তিনি, শত প্রতিকূলতার মধ্যেও। ‘মাটির পুতুল’ বললে যেমন কৃষ্ণনগরের কথা মনে আসে, তেমনই মা লক্ষ্মী সরা বলতে বাঙালি বোঝে নদীয়ার তাহেরপুরকে। কিন্তু তাহেরপুরের সেই গরিমাকে ফুলিয়ায় বসে টেক্কা দিয়ে চলেছেন বছর ৬৫-র চিত্তরঞ্জন পাল। পথ দুর্ঘটনায় তাঁর একটা চোখ ক্ষতিগ্রস্ত। তবুও হাল ছাড়েননি। তাঁর হাতেই প্রাণময় হয়ে ওঠে লক্ষ্মীর সরাচিত্র। পাশাপাশি স্থান পেয়েছে শ্রীকৃষ্ণ-রাধা, পুত্রকন্যাদের নিয়ে দুর্গার মতো বহু দেবদেবী। আবার লক্ষ্মী নিজেও দুই সহচরীদের নিয়ে এসেছেন। এসবই আপন হাতের মুনশিয়ানায় তুলে ধরেছেন শিল্পী। এ বছর প্রায় ৪,৫০০ মতো মা লক্ষ্মীর সরাচিত্র এঁকেছেন তিনি। অথচ সামাজিক সম্মান বলতে কিছুই নেই। শিল্পী হিসেবে আজও তিনি প্রান্তিক। সেই প্রান্তিক শিল্পীর সঙ্গেই সামান্য কথাবার্তা। কথালাপে শুভঙ্কর দাস।
গ্রাফিক্স: অর্ঘ্য চৌধুরী
আপনাদের পরিবারের সরাচিত্র শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ইতিহাসটা বলুন?
আমাদের আদি নিবাস বা পৈতৃক ভিটে ছিল পূর্ববঙ্গের ফরিদপুর জেলার ঘরিষা গ্রাম। সামনেই ছিল ফুলেশ্বর স্টিমার ঘাট। এই গ্রামেই বংশপরম্পরা ধরে সরাচিত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিল আমাদের পরিবার। আমার জ্যাঠামশাই অতীন্দ্রচন্দ্র পাল আদি গণকা সরা তৈরি করতেন। গণকদের কাছ থেকে তিনি এই সরা তৈরির শিল্পটি শিখেছিলেন। পূর্ববঙ্গে প্রথম আমার জ্যাঠামশাই এই শৈলীটি জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। পরবর্তীতে বাবা ও তারপর আমি এই শৈলী রপ্ত করেছি। মাত্র ১০ বছর বয়সে পশ্চিমবঙ্গের সোদপুরের পানিহাটিতে চলে আসি। সেখানেই এই শিল্পের সাধনা চলতে থাকে।পরে নদিয়ার ফুলিয়ায় চলে আসি।
সরাচিত্র অঙ্কনের পাশাপাশি আপনারা কি সরাটাও তৈরি করেন?
আগে গোটা প্রক্রিয়াই আমরা করতাম। অর্থাৎ, পোড়ামাটির সরাটা নিজেরাই তৈরি করতাম। কিন্তু এখন বয়স হয়েছে। ফলে শুধু সরাচিত্রটাই আমি করি। পোড়ামাটির সরাটা কিনে আনা হয়। রং করার সময় গুঁড়ো রঙের সঙ্গে গদের আঠা মিশিয়ে রঙের মিশ্রণ তৈরি করা হয়। রঙ করার পর বার্নিশ করা হয়। আমাদের সরা একটা সময় কলকাতার শিয়ালদহর বৈঠকখানা বাজারে যেত। এখন উল্টোডাঙ্গাতে আমাদের সরা পাওয়া যায়।
পরবর্তী প্রজন্ম শিখছে? অর্থাৎ, আপনার ছেলেমেয়েরা কি আপন করে নিয়েছে এই শিল্পশৈলীকে?
চিত্তরঞ্জন পাল (উত্তেজিত কণ্ঠে): এই শিল্প তো অচল। সম্মান পাচ্ছি না। বছরে একদিন বিক্রি, অর্থাৎ কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোর আগের দিন। সারা বছর তৈরি করব আর বিক্রি হবে একদিন। বিক্রি না হলে পড়ে থাকবে। আর পড়ে থাকলে সরাচিত্রগুলো ধুলো পড়ে নষ্ট হয়ে যায়। ব্যর্থ হবে সারা বছরের পরিশ্রম। তাই ছেলে শিখছে না। আমি শিখেছি। কিন্তু কি লাভ হল! নতুনরা কেউ এই শিল্প শিখছে চাইছে না। সংসার টানতে চা বিক্রি করতে হচ্ছে। কোনও ভাতা নেই। সর্বোপরি সম্মান পাই না। আমি চাই, আমার তৈরি সরাচিত্র সংগ্রহশালায় যাক। সমাজের শীর্ষে থাকা মানুষেরা যাতে আমার এই শিল্পের কদর করতে পারে, সেটাই আমি চাই। আর কেউ যদি এই শিল্পকে আপন করে নিয়ে শিখতে চায়, তবে আমি শেখাব।
…………………………………………………….
এই শিল্প তো অচল। সম্মান পাচ্ছি না। বছরে একদিন বিক্রি, অর্থাৎ কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোর আগের দিন। সারা বছর তৈরি করব আর বিক্রি হবে একদিন। বিক্রি না হলে পড়ে থাকবে। আর পড়ে থাকলে সরাচিত্রগুলো ধুলো পড়ে নষ্ট হয়ে যায়। ব্যর্থ হবে সারা বছরের পরিশ্রম। তাই ছেলে শিখছে না। আমি শিখেছি। কিন্তু কি লাভ হল! নতুনরা কেউ এই শিল্প শিখছে চাইছে না।
…………………………………………………….
সরাচিত্রের বিভিন্ন ধরনের পুতুলের সমাহার হয়, যেমন এক পুতুল সরা অর্থাৎ সেখানে শুধু লক্ষ্মীদেবীর ছবি থাকবে, তেমনই দুই পুতুল, এই বিষয় একটু আলোকপাত করুন?
যেমন এক পুতুল, জোড়া লক্ষ্মী অর্থাৎ একই সরাচিত্রে দুই লক্ষ্মী। তেমন রাধা-কৃষ্ণ, লক্ষ্মী-নারায়ণ। আবার ছয় পুতুল যেমন একই সরাচিত্রে বা একটি সরার ওপর দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ আর সবার নিচে আরও একটি লক্ষ্মী থাকবে। আবার তিন পুতুল সরা অর্থাৎ সরাচিত্রে লক্ষ্মী দুইদিকে তার দুই সহচরী থাকবে। মান্যতা আছে যে এই সহচরীরা হল জয়া এবং বিজয়া। আবার এমন সরাও আছে যেখানে হাতির পিঠে বসে আছেন মা লক্ষ্মী। এই সবই আমি এ বছর বানিয়েছি।
এর মধ্যে আদি ও অকৃত্রিম হচ্ছে গণকা সরা, যেখানে মা দুর্গা অসুর বধে রত। তার চারদিকে পুত্র ও কন্যারা। পায়ের নিচে লক্ষ্মী। পুরো সরটা মাটির মূর্তির পেছনে যে চালি থাকে সেটাই রঙের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এই সরাচিত্রের প্রাথমিক রঙটা লাল রাখা হয়। দুর্গা ও তার ছেলে মেয়েদের চলনে একটা ধীরজ ভাব রয়েছে। দুর্গার মাথার ওপর শিব বিদ্যমান। এই গণকা সরা এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। দুই সপ্তাহে প্রায় ৩০০ মতো সরা আকি। মাসে ৬০০। মূলত সরাগুলোর দাম শুরু হয় ৭০-৮০ টাকা থেকে। যদিও পাইকারি দাম আরও কম। কিন্তু গণকা সরার দাম ৫০০ টাকা।
………………………………………………..
আরও পড়ুন শিল্পী শ্যামলবরণ সাহা-র সাক্ষাৎকার: আমার আঁকা বাঁশগাছের ছবি আসলে সেলফ পোর্ট্রেট, এটা কোনও চমক নয়
………………………………………………..
সাক্ষাৎকার শেষ হতেই লোকসংস্কৃতি গবেষক তারাপদ সাঁতরার কথা মনে পড়ে গেল। তিনি বাংলার সরাচিত্রের বর্ণবিন্যাস ও রেখাঙ্কনে গ্রাম্য সরলতার প্রতিমূর্তিকে খুঁজে পেয়েছিলেন। আর সেই সরলতার প্রতিমূর্তিকে খুঁজে পেলাম চিত্তরঞ্জন পালের হাল না ছাড়া হাসিতে। এই হাসি যেন বলে চলে জীবনের তীব্র প্রতিকূলতার মধ্যেও সাবলীলভাবে তুলির মোচড় দিয়ে জীবন্ত করা যায় মা লক্ষ্মীকে। কিন্তু শুধু সরা বেচেঁ লক্ষ্মী পাওয়া যায় না এ দেশে।
……………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………….
ছবি লেখকের সংগ্রহ থেকে