বুদ্ধদেবের প্রথম প্রকাশিত বইয়ের একটা ইতিহাস আছে। ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র ‘রবিবাসরীয়’তে রমাপদ চৌধুরী তাঁকে দিয়ে অনেকগুলো শিকারের গল্প লিখিয়েছিলেন। মূলত সেগুলো নিয়েই ১৩৭২-এর মাঘ মাসে (জানুয়ারি/ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬) তাঁর প্রথম বই ‘জঙ্গল মহল’ প্রকাশিত হয়। বইটির নামকরণও করেছিলেন রমাপদ চৌধুরী। কিন্তু সে-বই কোনও প্রতিষ্ঠিত প্রকাশন সংস্থা থেকে বেরোয়নি। বুদ্ধদেব গুহ নিজেই ছেপেছিলেন। প্রকাশক হিসেবে নাম ছিল বউদির– আমরা সবাই যাঁকে রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী বলে চিনি, সেই ঋতু গুহ-র। বেঙ্গল পাবলিশার্সের মনোজ বসুর ছেলে ময়ূখ বসু ছিলেন বুদ্ধদেব গুহ-র বন্ধু। সম্ভবত সেই সূত্রে ‘জঙ্গল মহল’ বইটির পরিবেশক হয়েছিল বেঙ্গল পাবলিশার্স। আমি ১৯৮৩ সালে সে-বইয়ের নতুন সংস্করণ প্রকাশ করি।
৮.
সেটাও সাতের দশকের একেবারে শুরুর দিকেই হবে, বাবা-দাদারা কিছুদিন ধরে আলোচনা করছিলেন– ব্যবসা বড় হচ্ছে, এবার হিসেবপত্তর আরও গুছিয়ে করা দরকার। নইলে ট্যাক্স নিয়ে ভবিষ্যতে সমস্যা হতে পারে। ট্যাক্সের নিত্য-নতুন আইন-কানুন সম্বন্ধে ভালো ধারণা আছে এমন কারও পরামর্শ নেওয়াই স্থির হল। সেসময় আমাদের হিসেবপত্র দেখতেন নিতাইদা– নিতাই রায়। নিতাইদা কাজ করতেন সেকালের নামকরা ‘টেলিরামা’ কোম্পানিতে। সন্ধের পর দোকানে এসে হিসেবের কাজ সামলাতেন। এভাবেই চলছিল দীর্ঘদিন। কিন্তু বাবা বেশ কিছুদিন ধরেই অভিজ্ঞ পরামর্শদাতার সন্ধানে ছিলেন। তখনই জানা গেল ১২ নং ওয়াটারলু স্ট্রিটের এস এন গুহ অ্যান্ড কোম্পানির নাম। তবে আমরা কিন্তু প্রথমদিন ওয়াটারলু স্ট্রিটের অফিসে না গিয়ে, দক্ষিণ কলকাতায় শচীন্দ্রনাথ গুহর রাজা বসন্ত রায় রোডের বাড়িতে গিয়েছিলাম। একদিন সকালের দিকে বাবা, মেজদা আর আমি পৌঁছে গিয়েছিলাম সেই ঠিকানায়। বাড়ি বলছি বটে, তবে ‘কণীনিকা’ নামের সে-বাড়ি ঠিক সাধারণ লোকের ছোটোখাটো বাড়ি নয়, প্রাসাদোপম বললে ঠিক হবে বোধহয়। সামনে ছড়ানো বাগান, গাড়িবারান্দা পেরিয়ে বাড়িতে ঢুকতেই দেওয়ালে চোখ আটকে যায়। ঘর-বারান্দার দেওয়ালে সারি সারি পশু-পাখির স্টাফ করা মাথা। আমি অমন বাড়ি তার আগে কখনও দেখিনি। গল্প-উপন্যাসে পড়েছি রাজা-মহারাজারা শিকার করে আনা জীবজন্তু এভাবে স্টাফ করে রাখেন। যাই হোক, এস এন গুহের সঙ্গে বাবার কাজের কথা হয়ে গেলে আমরা বেরিয়ে এলাম। তখনও জানি না এই বাড়ির কারও সঙ্গে আমি এতটা জড়িয়ে পড়ব। আমি বলছি লেখক বুদ্ধদেব গুহ-র একেবারে প্রথম দিকের কথা। ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র পাতায় তাঁর শিকারকাহিনি পড়েছি কিন্তু আর কোনও লেখা তখনও পড়েছি বলে মনে পড়ে না। তাছাড়া আমরা লেখক বুদ্ধদেবের সন্ধানেও ‘কণীনিকা’য় যাইনি।
পরে যখন বুদ্ধদেব গুহ-র সঙ্গে নিকট সম্পর্ক তৈরি হল, তখন তিনি জানিয়েছিলেন তাঁর শিকারে হাতেখড়ি শচীন্দ্রনাথ গুহ-র কাছেই– বাবাই ছেলেকে হাতে বন্দুক ধরতে শিখিয়েছিলেন, যেমন পরে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হওয়ার পর নিজের কোম্পানির শেয়ার হোল্ডারও করেন। বুদ্ধদেবদার কাছে শুনেছি তাঁর বাবা শুধু শিকার নয়, ফুটবলেও বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। ময়দানে সবাই তাঁকে মনা গুহ নামে চিনত। বছর তিনেক মোহনবাগানের গোলকিপার ছিলেন। গোষ্ঠ পাল, উমাপতি কুমারদের সঙ্গে খেলেছেন। একবার সাহেবদের কোনও দলের সঙ্গে খেলা পড়ে। তখন সাহেবরা বুট পরে খেললেও মোহনবাগানের খেলোয়াড়রা খালি পায়েই খেলতেন। সেদিনের খেলায় শচীন্দ্রনাথের হাঁটু লক্ষ্য করে কোনও এক সাহেব এমন পা চালায় যে তাঁকে চিরকালের মতো খেলা ছেড়ে দিতে হয়। বুদ্ধদেব হয়তো ফুটবল খেলেননি, কিন্তু টেনিস, ব্যাডমিন্টন খেলেছেন অনেকদিন।
আমার সঙ্গে বুদ্ধদেব গুহ-র পরিচয় গাঢ় হল ১৯৭২-এর শেষের দিকেই। পরের বছর নববর্ষে আমি প্রকাশ করলাম বুদ্ধদেবের গল্পের সংকলন ‘প্রথমাদের জন্য’। গৌতম রায়ের প্রচ্ছদে বইটি ছেপেছিলাম গোয়াবাগানের নিউ সত্যনারায়ণ প্রেসে। প্রথম থেকেই বুদ্ধদেবদা প্রুফ দেখার ব্যাপারে খুব নির্ভরযোগ্য কারও ওপর ভরসা করতেন। নিজের লেখায় সংযোজন-বিয়োজন করতেন, কিন্তু প্রুফ দেখতেন না। ‘প্রথমাদের জন্য’ বইটির প্রিন্টার্স লাইনে একটা নতুম জিনিস ছাপা হল, ‘প্রুফ সংশোধক জগন্নাথ ভট্টাচার্য’। ভালো প্রুফ রিডার প্রকাশনায় অত্যন্ত জরুরি মানুষ। কিন্তু বই প্রকাশের সময় তাঁদের নাম ছাপার রেওয়াজ তখনও ছিল না, আজও আমাদের বাংলা প্রকাশনায় নেই। অবশ্য পাণ্ডুলিপি থেকে বাঁধানো বইয়ে রূপান্তরের পথে অনেক নেপথ্যকর্মীর নামই ছাপা হয় না। আর ভালো প্রুফ রিডারের সংখ্যা চিরকালই অত্যন্ত কম। জগন্নাথদা সেই ব্যতিক্রমের দলে ছিলেন। বুদ্ধদেব গুহ-র খুবই ভরসার মানুষ তো বটেই।
জগন্নাথ ভট্টাচার্য কাজ করতেন সি কে সেন অ্যান্ড কোম্পানির ‘জবাকুসুম হাউস’-এ। তবে ছাপাছাপির জগতে তাঁর বহুদিনের যাতায়াত। বুদ্ধদেবদার সঙ্গে পরিচয়ের অনেক আগে থেকেই জগন্নাথদার সঙ্গে আমার আলাপ। তিনি দে বুক স্টোরে আসতেন ‘পরীক্ষিৎ’ ছদ্মনামে লেখা রণজিৎকুমার সেনের বইপত্র নিয়ে। সম্ভবত উনি সেসময় ‘পরীক্ষিৎ’-এর লেখা বইপত্তর ছাপা ও বিক্রির দিকটা দেখতেন। আমি প্রকাশনা শুরু করার পর ঠিক বুঝলাম জগন্নাথদা আমাদের বইয়ের প্রুফ-মেক আপ ইত্যাদির দায়িত্ব নিলে কাজের মান ভালো হবে। এভাবে অনেকদিন জগন্নাথদা আমাদের বইয়ের প্রুফ দেখে দিয়েছেন। পরে একসময় আমার মনে হল জগন্নাথদা যদি দে’জ পাবলিশিং-এর প্রোডাকশনের কাজটা পুরো সময়ের জন্য দেখেন তাহলে আরও ভালো হয়। সেই শুরু, তারপর দীর্ঘদিন তিনি দে’জ পাবলিশিং-এর প্রোডাকশন দেখেছেন। তিনি এখানে বসে যেমন কাজ করতেন, তেমনি বাড়ি নিয়ে গিয়েও প্রুফ দেখতেন। ধীরে ধীরে কপি এডিটিং-এর কাজ থেকে শুরু করে প্রোডাকশনের সব কাজই দেখতেন। একটা সময় কোন প্রেসে আমাদের কোন বইয়ের কাজ হচ্ছে সব তাঁর নখদর্পণে থাকত। কাকে কবে কপি দেওয়া হল, কোথায় কী কম্পোজ হচ্ছে, কোথায় প্রুফ দেখে ফেরত পাঠাতে হবে– তিনি সব খেয়াল রাখতেন।
……………………………………………………..
জগন্নাথ ভট্টাচার্য কাজ করতেন সি কে সেন অ্যান্ড কোম্পানির ‘জবাকুসুম হাউস’-এ। তবে ছাপাছাপির জগতে তাঁর বহুদিনের যাতায়াত। বুদ্ধদেবদার সঙ্গে পরিচয়ের অনেক আগে থেকেই জগন্নাথদার সঙ্গে আমার আলাপ। তিনি দে বুক স্টোরে আসতেন ‘পরীক্ষিৎ’ ছদ্মনামে লেখা রণজিৎকুমার সেনের বইপত্র নিয়ে। সম্ভবত উনি সেসময় ‘পরীক্ষিৎ’-এর লেখা বইপত্তর ছাপা ও বিক্রির দিকটা দেখতেন। আমি প্রকাশনা শুরু করার পর ঠিক বুঝলাম জগন্নাথদা আমাদের বইয়ের প্রুফ-মেক আপ ইত্যাদির দায়িত্ব নিলে কাজের মান ভালো হবে। এভাবে অনেকদিন জগন্নাথদা আমাদের বইয়ের প্রুফ দেখে দিয়েছেন। পরে একসময় আমার মনে হল জগন্নাথদা যদি দে’জ পাবলিশিং-এর প্রোডাকশনের কাজটা পুরো সময়ের জন্য দেখেন তাহলে আরও ভালো হয়।
……………………………………………………..
অনেকদিন এভাবেই চলছিল। বেশ কয়েকবছর পর একদিন ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র বিজ্ঞাপন বিভাগের জয়ন্ত গাঙ্গুলির সঙ্গে দেখা হতে উনি জানালেন তাঁরা এমন একজন লোক খুঁজছেন, যিনি কলেজ স্ট্রিটের প্রকাশকদের ভালোভাবে চেনেন এবং তাঁদের কাছ থেকে পত্রিকার জন্য বিজ্ঞাপন জোগাড় করে আনতে পারবেন। আমি বুঝতে পারছিলাম তাঁরা জগন্নাথদাকেই চাইছেন। আনন্দবাজার-এর বিজ্ঞাপন বিভাগে আমার যাতায়াত ছিল। ওখানেই ছিলেন আমার বিশেষ শুভাকাঙ্ক্ষী প্রবোধবন্ধু অধিকারী। প্রবোধদার কথা আমি পরে আবার বলব। প্রবোধদার সূত্রেই জয়ন্তবাবুর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। জগন্নাথদাকে তাঁরা নিজেদের বিভাগে নিতে চাওয়ায় আমি আর আপত্তি করিনি। জগন্নাথদা ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র বিজ্ঞাপন বিভাগে চলে গেলেও আমৃত্যু আমার নিকটজন ছিলেন। ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’য় শনিবারের বইয়ের পাতায় একসময়ের ‘বেস্টসেলার’ কলামটি তিনিই দেখতেন। আজ জগন্নাথদাও নেই, ‘বেস্টসেলার’ কলামও ছাপা হয় না। বইয়ের পাতাও এখন মূল কাগজ থেকে ক্রোড়পত্রে চলে গেছে।
বুদ্ধদেব গুহ-র বহু চিঠিতে জগন্নাথদার উল্লেখ আছে, মূলত প্রুফের কারণেই। পরে যখন জগন্নাথদা আনন্দবাজারে চলে গেলেন তখন অনেক সময় বুদ্ধদেব ‘জ-বাবু’ বলে চিঠিতে মজাও করেছেন।
বুদ্ধদেবের প্রথম প্রকাশিত বইয়ের একটা ইতিহাস আছে। ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র ‘রবিবাসরীয়’তে রমাপদ চৌধুরী তাঁকে দিয়ে অনেকগুলো শিকারের গল্প লিখিয়েছিলেন। মূলত সেগুলো নিয়েই ১৩৭২-এর মাঘ মাসে (জানুয়ারি/ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬) তাঁর প্রথম বই ‘জঙ্গল মহল’ প্রকাশিত হয়। বইটির নামকরণও করেছিলেন রমাপদ চৌধুরী। কিন্তু সে-বই কোনও প্রতিষ্ঠিত প্রকাশন সংস্থা থেকে বেরোয়নি। বুদ্ধদেব গুহ নিজেই ছেপেছিলেন। প্রকাশক হিসেবে নাম ছিল বউদির– আমরা সবাই যাঁকে রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী বলে চিনি, সেই ঋতু গুহ-র। বেঙ্গল পাবলিশার্সের মনোজ বসুর ছেলে ময়ূখ বসু ছিলেন বুদ্ধদেব গুহ-র বন্ধু। সম্ভবত সেই সূত্রে ‘জঙ্গল মহল’ বইটির পরিবেশক হয়েছিল বেঙ্গল পাবলিশার্স। আমি ১৯৮৩ সালে সে-বইয়ের নতুন সংস্করণ প্রকাশ করি। ‘জঙ্গল মহল’-এর উৎসর্গের পাতাটিও চমৎকার। সেখানে বুদ্ধদেব লিখেছেন,
‘আমার বাবাকে,
যাঁর হাত ধরে প্রথমে বনে-পাহাড়ে গিয়েছিলাম; এবং যাঁর উৎসাহ, আশাবাদ, অদম্য সাহস, রসবোধ এবং সুপুরুষ ব্যক্তিত্ব আমাকে সর্বক্ষণ অনুপ্রেরণা জাগায়;
এবং আমার মাকে,
যাঁর পিছুডাক না শুনে প্রথমে বনে-পাহাড়ে গিয়েছিলাম; এবং যাঁর স্নেহ, মমতা ও আশীর্বাদ সম্পৃক্ত অসীম কল্যাণকামনার পরিমণ্ডল আমাকে অনুক্ষণ ঘিরে থাকে।’
বউদিকেও স্বীকৃতি জানিয়েছিলেন এই বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকায়। লিখেছিলেন, ‘শ্রীমতী ঋতু গুহর সানন্দ সম্মতি না থাকলে লেখার মত অন্তর্মুখী সখ অংকুরেই বিনষ্ট হত।’ বুদ্ধদেব আর ঋতু গুহ-র ভালোবাসার গল্পই ‘খেলা যখন’ উপন্যাসে ফুটে উঠেছে। বুদ্ধদেব-ঋতু গুহের বিয়ে হয় ১৯৬২ সালে। আমার সে-তারিখ মনে থাকার কথা নয়। কিন্তু পুরোনো চিঠি খুঁজতে বসে হঠাৎই আমার নিজের লেখা একটা চিঠির কপি হাতে এল। ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৭ সালে বুদ্ধদেব আর ঋতু গুহকে যৌথভাবে লিখেছিলাম,
‘পূজনীয় দাদা ও বৌদি,
পত্রে আমার প্রণাম নেবেন। ক্যালেন্ডারের জন্ম থেকেই ফেব্রুয়ারি মাস এবং তাতে ১৯ তারিখ আছে। কিন্তু ২৪ বছর আগে আপনাদের দু’জনের জীবনে ১৯ তারিখটা হয়ে উঠেছিল একটা মধুময় তারিখ। সেই তারিখটারই ২৫ তম আবির্ভাব হবে আগামী ১৯ তারিখে। কল্যাণীয়া মালিনী, সোহিনী এবং শ্রদ্ধেয় বাবুয়াদা, বুলাদার নেমন্তন্ন চিঠি পেয়েছি। নিশ্চয়ই যাবো। কিন্তু বৌদি এবং দাদা আপনাদের কাছে যে স্নেহ ভালোবাসা পেয়েছি তারই অধিকারে আমার একটা আবদার আছে। কলকাতার উৎসবের পরে আপনাদের ‘আপনজন’দের হোটেল ব্লু ভিউ’র হনিমুন স্যুইটে পঁচিশতম মধুচন্দ্রিমার স্বাদ নিতে হবে। দোলনা থাকবে, খিচুড়ি থাকবে, প্রাইভেসির ব্যবস্থা থাকবে, দাদার পান জর্দা এবং ডালপুরি এবং জেলুসিল থাকবে। যদি আপনাদের বিশেষ কোনো ফরমাস থাকে– তাও পালন করতে এই দেওর ও ভাই এক পায়ে প্রস্তুত। দোহাই বৌদি ও দাদা, আমাকে নিরাশ করবেন না। আসতেই হবে ‘আপনজন’দের হনিমুন স্যুইটে। কবে সুবিধা হবে জানালেই প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা হবে। বাচালতা করে থাকলে কান মুলে দেবেন। আপনারা আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম নেবেন। স্নেহার্থী–
সুধাংশুশেখর দে’
এমনই ছিল বুদ্ধদেবের সঙ্গে আমার সম্পর্ক। কেবলমাত্র প্রকাশক-লেখক কেজো সম্পর্কের বাইরে এমন আত্মীয়তা গড়ে ওঠা আজকের দিনে কঠিন। সবটাই সম্ভব হয়েছিল দাদার উদার স্বভাবের জন্য। তিনি যেমন অল্পে রেগে যেতেন আবার মুহূর্তে গলে জল হয়ে যেতেন। পুরোদস্তুর প্রেমিক পুরুষ ছিলেন। বাংলা সাহিত্যের আলোচনায় তাঁর কথা বিশেষ বলা হয় না বলে তাঁর অভিমান ছিল। কিন্তু পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে ফেলার আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল তাঁর। এখানে বলে রাখি, মালিনী আর সোহিনী দাদা-বউদির আদরের দুই মেয়ে। আর বাবুয়াদা(বিশ্বজিৎ গুহ), বুলাদা (ইন্দ্রজিৎ গুহ) বুদ্ধদেবের দুই ভাই।
আমি ‘প্রথমাদের জন্য’ বইটির পর থেকে নিয়মিত তাঁর বই প্রকাশ করেছি। দ্বিতীয় বই পেয়েছিলাম ‘স্বগতোক্তি’ নামে একটা উপন্যাস, ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত সে-বইয়েরও প্রচ্ছদ করেছিলেন গৌতম রায়, বইটা ছেপেছিলাম নিশিকান্ত হাটই-এর তুষার প্রিন্টিং ওয়ার্কস থেকে। তার পর ১৯৭৬ সালে বেরোয় ‘চবুতরা’ উপন্যাস– এবার প্রচ্ছদ করলেন বুদ্ধদেব গুহ-র চিরকালের পছন্দের শিল্পী সুধীর মৈত্র, বই ছাপা হল ঈশ্বর মিল লেনের বাণীশ্রী প্রেসে। পরের বছর ছাপলাম ‘লবঙ্গীর জঙ্গলে’। মিলি দাসের আঁকা প্রচ্ছদে সে-বইও ছাপা হয়েছিল বাণীশ্রী প্রেসে। বানীশ্রী প্রেসের সুকুমার সামন্তের সঙ্গেই বই ছাপা নিয়ে আমার যাবতীয় কথাবার্তা চলত। পরে অবশ্য ‘লবঙ্গীর জঙ্গলে’র মলাট বদলে যায়। সুধীর মৈত্র-র আঁকা নতুন মলাটের সেই বই ছাপা হল মসজিদ বাড়ি স্ট্রিটের দে প্রিন্টার্স থেকে। এর পরে আমাদের বহু কাজ দে প্রিন্টার্সের দিলীপ দে-র হাত দিয়েই হয়েছে। তাঁর সঙ্গেও আমাদের অত্যন্ত হৃদ্যতার সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল।
‘লবঙ্গীর জঙ্গলে’র গায়ে-গায়েই ছাপা হল ‘লালা মিঞার শায়েরী– সে এক আশ্চর্য পদ্যের বই। পাঠক-পাঠিকারা নিশ্চয়ই জানেন, তবু বলে রাখি ‘লালা’ বুদ্ধদেব গুহ-র ডাকনাম। ‘লালা মিঞার শায়েরী’র প্রস্তাবনায় তিনি লিখেছেন,
‘অনেকরকম দুঃখ লালার
থাকবেও তা, থাকলে বেঁচে
সবচে বড় দুঃখটা এই,
কাঁকড়া পেলো হৃদয় ছেঁচে।।’
ক্রাউন সাইজের ৬৪ পাতার বইয়ে ‘মিঞা’ নিজেই এক চরিত্রের মতো হাজির। ‘লালা মিঞার শায়েরী’তে ‘প্রিয়ার উকুন’ নামে একটা পদ্য আছে। এমন নামের যে কবিতা হতে পারে, তা কস্মিনকালে কেউ ভেবেছে বলে তো মনে হয় না! বইটা হাতে নিয়ে পাতা ওলটাতে গিয়ে সেই শায়েরির চার লাইন এতদিন পরে আবারও নজর কাড়ল, ‘প্রিয়ার বাড়ি যায় মিঞা তাও/স্বামী তাকায় যেন শকুন;/মিঞা যেন বাধ্য বাঁদর/যত্নে বাছে প্রিয়ার উকুন।’
বুদ্ধদেব এমনিতে বইয়ের প্রুফ নিয়ে খুব একটা চিন্তা করতেন না, সেকথা আগেই বলেছি। কিন্তু বইয়ে ছাপার ভুল আছে, পাঠকদের কাছে এমন কথা শুনলে অল্পেই বিচলিতও হয়ে পড়তেন। একটা সালহীন চিঠি পাচ্ছি কোনো এক বছরের এপ্রিল মাসের আট তারিখে লেখা,
‘সুধাংশু,
প্রুফে অনেক ভুল থাকছে। এত ভুল কারেকশন করবার মত সময় আমার নেই। তুমি ভালো করে এবং অত্যন্ত যত্নসহকারে প্রুফ দেখাবার বন্দোবস্ত করো। না হলে আমি আনন্দমেলার রঞ্জনবাবুকে ঠিক করে দিতে পারি। রমাপদবাবুর গল্প সংগ্রহের প্রুফ উনি দেখেছিলেন। আমাকে যে Proof দেবে তাতে আমি কেবল লেখার উৎকর্ষতাই[য.] দেখব। Compositor-এর ভুল কারেক্ট করতে পারব না। প্রতি Chapter-এর শেষে সাদা জায়গা থাকবে। প্রতি নতুন Chapter– নতুন পাতায় আরম্ভ হবে। তাতে জায়গা যতখানি ছাড়তে হবে, ছেড়ো। Compose করার সময়– Chapter এর শেষে এসে জায়গা ছাড়তে বোলো।
জগন্নাথবাবু এখন অনেক জায়গায় ছড়িয়ে ফেলেছেন নিজেকে। এদিকে আমার লেখার কপিও তাঁর করতে হবে। তাই জগন্নাথবাবু প্রুফ দেখলে তাঁকে অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে দেখতে বোলো। ছাপায় যেন একটি ভুলও না থাকে।…’
জগন্নাথদা ততদিনে নিশ্চয়ই ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’য় যোগ দিয়েছেন। তাই আমি তখন বুদ্ধদেবদার বইয়ের কপি পেলে প্রুফের যাবতীয় কাজ করার জন্য সুবীর ভট্টাচার্যের হাতে তুলে দেওয়া শুরু করেছিলাম। সুবীর ভট্টাচার্য দীর্ঘদিন দে’জ পাবলিশিং-এর অন্যতম প্রধান সম্পাদক ছিলেন। প্রকাশনার সমস্ত বিষয় তাঁর মাথায় ছবির মতো সাজানো থাকত। সুবীরদাকে নিয়ে পরে বিস্তারে অনেক কথা বলার আছে। তবে বুদ্ধদেবের একটি বই (সন-তারিখ মিলিয়ে দেখে মনে হচ্ছে সেটা বুদ্ধদেব গুহ-র ভ্রমণকাহিনি ‘ইলমোরাণদের দেশে’ হওয়াই উচিত) সুবীরদা নিবিড়ভাবে সংশোধন করে লেখকের কাছে পাঠালে ৩০ অক্টোবর ১৯৮৭ সালে বুদ্ধদেব একটি চিঠি দেন আমাকে,
‘সুধাংশু,
Correction যা করেছেন সুবীর বাবু তা ঠিকই আছে। আমার বানান ভুল হয়, বেশি সময়েই অজ্ঞতাজনিত কারণে নয়, অসাবধানতার কারণে। তবে এই কপিতে অনেক ভুল ছিলো যেগুলি যে-মেয়েটি কপি করেছে তারই কৃতিত্ব। তাকে সাহায্য করতে গিয়েই এই বিপত্তি। আমিও যখন কপি Correct করি তখন চোখ থাকে লেখার দিকেই, বানানের দিকে নয়। নির্ভুল বানান জানলে স্কুলের শিক্ষক এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকও হওয়া যায় কিন্তু লেখক নাও হওয়া যেতে পারে। অবশ্য এ কথা মানি যে প্রত্যেক শিক্ষিত লোকেরই উচিত নির্ভুল বানান লেখা। কিন্তু আমি তো কখনওই নিজেকে শিক্ষিত বলে দাবী করিনা কারো কাছেই। বাংলা ভাষার ছাত্রও তো কখনও ছিলাম না। বাংলা কেন, অন্য কোনো ভাষারই নয়। কমার্সই পড়েছিলাম। তাই সুবীরবাবুকে বোলো যেন নিজগুণে আমাকে ক্ষমা করেন। উনি দেখে দিলে আমিও নিশ্চিন্ত থাকি। আমার সব লেখাই ওঁকে দিয়ে Correction করিয়ে নিও। এবং সঙ্গের চিঠিটি ওঁকে দিও। ভালো থেকো।
দাদা’
এই হলেন বুদ্ধদেব। নিজের ভুল স্বীকার করতে জানতেন, অন্যের কাজের প্রশংসা করার মতো দরাজদিল মানুষ ছিলেন। সুবীরদার নিখুঁত কাজ তাঁকে মুগ্ধ করেছিল।
দে’জ পাবলিশিং আর দে বুক স্টোর দুই প্রতিষ্ঠানই যখন ভালো চলছে তখন আমরা অনুভব করছিলাম নিজেদের একটা ছাপাখানা থাকা দরকার। তাহলে দে’জ পাবলিশিং-এর বই বাইরে থেকে ছাপিয়ে আনার ঝক্কি অনেক কমে, টাকা-পয়সারও খানিকটা সাশ্রয় হয়। সেটা আশির দশকের মাঝামাঝি, তখন বাংলা প্রকাশনায় অফসেট প্রিন্টিং আর কম্পিউটার কম্পোজের যুগ এসে গেছে। একে একে সবাই অফসেট প্রেসে ছাপা শুরু করছে। সেসময় আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম একটা ছাপাখানা তৈরির। বাবা এবং দুই দাদাও বললেন, প্রেস করলে একেবারে আধুনিক প্রেসই করতে হবে। ১৯৮৬ সালে ট্যাংরা এলাকায় আমাদের দে’জ অফসেট-এর কাজ শুরু হল। প্রথম থেকেই দে’জ অফসেট দেখে আমার বড়দার বড়োছেলে বাচ্চু (স্বপন)। প্রকাশনার জন্য বাইরের কাজ সামলে বাচ্চুর সঙ্গে আমিও জড়িয়ে থাকতাম দে’জ অফসেটের কাজকর্মে। অনেক পরে, ২০০৯ সালে আমি আর আমার ভাই বাবু মিলে ওই ট্যাংরা এলাকাতেই আর একটি নতুন প্রেস তৈরি করি। নতুন প্রেসের নাম হয় বিসিডি অফসেট– বিসিডি বাবার নামের আদ্যক্ষর দিয়ে তৈরি। এই প্রেসে ছাপা বইয়ে মুদ্রক হিসেবে বাবু-র নাম ছাপা হয়, কিন্তু এখন বাবুর ছেলে মুন্না (সুদীপ্ত) খুবই দক্ষতার সঙ্গে প্রেসের কাজ সামলায়।
যাইহোক, দে’জ অফসেট শুরুর দিকে আমাদের ছাপা একটা বই বুদ্ধদেব গুহ-র হাতে পৌঁছলে তিনি ১৮ ডিসেম্বর ১৯৯০ সালে একটি চিঠিতে আমায় লিখছেন,
‘…বিকাশ গ্রন্থ ভবনের মালিকেরা এসেছিলেন নতুন বই এর জন্যে। সেটা কোনো খবর নয়। খবরটা হলো দে’জ অফসেটের বইটি (ফনীভূষণ [য.] আচার্যর) দেখে চোখ জুড়িয়ে গেলো। যেমন কাগজ তেমন টাইপ, তেমন ছাপা, তেমন বাঁধাই। দেখি ‘বাজা তোরা রাজা যায়’ [য.] কেমন করো।…’
এখানে বুদ্ধদেব সম্ভবত ফণিভূষণ আচার্য-র (পি আচার্য নামে খ্যাত) ‘শব্দ সন্ধান: শব্দাভিধান’ বইটির কথা বলেছেন। বিকাশ গ্রন্থ ভবনের ওই বইটি দে’জ অফসেটে ছাপা হয়েছিল।
‘বাজা তোরা, রাজা যায়’ বুদ্ধদেব গুহ-র দে’জ থেকে প্রকাশিত বইগুলির মধ্যে প্রথম অফসেটে ছাপা বই। ১৯৯১-এর বইমেলায় এটি ছাপা হয়। তার আগের বছর পূজাবার্ষিকী ‘আনন্দমেলা’য় ছাপা এই লেখাটি খুব প্রশংসিত হয়। পয়লা অক্টোবর ১৯৯০-এ একটা চিঠিতে দেখছি উনি লিখছেন,
‘…তোমাকে বইমেলার জন্য ছোটদের বই ‘বাজা তোরা, রাজা যায়’ দেব। একটু বাড়িয়ে দেব। কপি দশ তারিখের মধ্যে লোক পাঠিয়ে নিয়ে যেও। অসম্ভব না হলে সুধীরবাবুকে দিয়ে প্রচ্ছদ ও ILLUSTRATION করাতে পারো। নইলে সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায় দিয়ে। সুব্রতই আনন্দমেলাতে এঁকেছিলো এবং ভালো ILLUSTRATION করেছিলো। এক্ষুণি ওর সঙ্গে যোগাযোগ করে ফেলো। পরে মেলার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়বে। এই বইটি বাদলবাবুর কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছি তোমার জন্যে।…’
শেষ পর্যন্ত সুধীর মৈত্র-র প্রচ্ছদ আর অলঙ্করণেই ‘বাজা তোরা, রাজা যায়’ প্রকাশিত হয়।
তার ছ-বছর আগেই অবশ্য আমি প্রকাশ করেছি বুদ্ধদেবের জনপ্রিয় উপন্যাস ‘কোজাগর’– ১৯৮৪-র বইমেলার সময়, ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশিত হয় ‘কোজাগর’। এই লেখা এমন সাড়া ফেলে দেয় যে শুধু মার্চ মাসেই দু-দুটো সংস্করণ করতে হয়। প্রকাশের পরের মাসেই তৃতীয় সংস্করণে পৌঁছে যাওয়া প্রকাশনার পক্ষে যেমন সম্মানের, তেমনই বুদ্ধদেব গুহ-র বিপুল জনপ্রিয়তারও আন্দাজ পাওয়া যায়। ‘কোজাগর’-এর মলাট এবং অলংকরণও সুধীর মৈত্র-র করা। বইটা আমি ছেপেছিলাম হেমেন্দ্র সেন স্ট্রিটে অশোক কুমার ঘোষের নিউ শশী প্রেস থেকে।
লিখন: শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়
……………………………… ইতি কলেজ স্ট্রিট-এর অন্যান্য পর্ব …………………………
পর্ব ৭: পুজো সংখ্যায় না-বেরনো উপন্যাস বই আকারে সুপারহিট
পর্ব ৬: মানবদার বিপুল অনুবাদের কাজ দেখেই শিশির দাশ তাঁর নাম দিয়েছিলেন– ‘অনুবাদেন্দ্র’
পর্ব ৫: সাতবার প্রুফ দেখার পর বুদ্ধদেব বসু রাজি হয়েছিলেন বই ছাপানোয়!
পর্ব ৪: লেখকদের বেঁচে থাকার জন্য অনেক কিছুই লিখতে হয়, প্রফুল্ল রায়কে বলেছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র
পর্ব ৩: পয়লা বৈশাখের খাতায় শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় মজাচ্ছলে লিখেছিলেন, ‘সুধাংশুরা রাজা হোক’
পর্ব ২: বাংলা মাসের সাত তারিখকে বলা হত ‘গ্রন্থতিথি’, বিজ্ঞাপনেও বিখ্যাত ছিল ‘৭-ই’
পর্ব ১: সত্তরের উথাল-পাথাল রাজনৈতিক আবহাওয়ায় আমি প্রকাশনার স্বপ্ন দেখছিলাম