শারীরিক অনুপস্থিতির আগেও কি সে ছিল… সে থাকে…! সকলের মাঝে। চেনা প্রতিবেশ ছেড়ে যাওয়ার আগেও কি দীর্ঘায়িত দিনরাত্রি সে ছিল সেখানেই! বাস্তবিক হারিয়ে যাওয়ার আগেই কি নিজেকেই সে সরিয়ে নেয় তার অব্যবহিত চারপাশ থেকে! ধীরে ধীরে! সে কি প্রস্তুত করে নিজেকেই, হারিয়ে যাওয়ার জন্য… নাকি কোনও এক অলৌকিক মুহূর্তে মনে হয় যথেষ্ট হল, আর নয়। সে কি ক্লান্ত হয়ে পড়ে সারাদিনমান জীবনের দুর্বহ ভার বইতে বইতে! কোনও একদিন কি মনে মনে নামিয়ে রাখে সব! হয়তো বা কোনও অভিমান নয়, নয় কোনও আঘাত, হয়তো বা আকর্ষণ ছিলই না কখনও জীবনের! অথবা ছিল; দিনানুদৈনিকের নিত্যস্রোতে মুছে গেছে যার দাগ।
‘অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়–/ আরো-এক বিপন্ন বিস্ময়/ আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে/ খেলা করে;/ আমাদের ক্লান্ত করে/ ক্লান্ত– ক্লান্ত করে…’
মানুষ হারিয়ে যায়…
যারা তার নিকটজন, হারিয়ে যাওয়ার পরে তারা তাকে খোঁজে। আঁতিপাঁতি করে খোঁজে, গোটা সামাজিক-রাষ্ট্রিক পরিসরের কাঠামোর মধ্যে। রাষ্ট্রের পেশাদার নিরাপত্তা ব্যবস্থাপকদের সাহায্য চায়… বস্তুত কর্তব্য করতে বলে… কাজ হয়, অথবা হয় না। কেউ কেউ ফেরে। নিজেই। কাউকে বা রাষ্ট্রব্যবস্থা ফেরায়। আবার কেউ ফেরে না। যারা ফেরে না; তাদের খোঁজ চলে, চলতে থাকে। চলতে চলতে সন্ধান একসময় ক্লান্ত হয়। হঠাৎ করে বিপর্যস্ত হয়ে যাওয়া আন্দোলিত জীবনের উতল জল থিতিয়ে আসে, থিতিয়ে আসতেই হয় দৈনন্দিন ভাতরুটির সন্ধানে। তখন স্বচ্ছ হয় জীবনের উপরিতল। স্মৃতির মৃত্তিকাকণা জমা হয় নিচে। নানা অনুষঙ্গের মৃদু তরঙ্গ হয়তো বা নাড়া দিয়ে যায় খানিক। তারপরে অভ্যাস হয়ে যায় অনুপস্থিতি। যেমন অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল তার থাকা।
কাকে খোঁজে? কাকে! শারীরিক অনুপস্থিতির আগেও কি সে ছিল… সে থাকে…! সকলের মাঝে। চেনা প্রতিবেশ ছেড়ে যাওয়ার আগেও কি দীর্ঘায়িত দিনরাত্রি সে ছিল সেখানেই! বাস্তবিক হারিয়ে যাওয়ার আগেই কি নিজেকেই সে সরিয়ে নেয় তার অব্যবহিত চারপাশ থেকে! ধীরে ধীরে! সে কি প্রস্তুত করে নিজেকেই, হারিয়ে যাওয়ার জন্য… নাকি কোনও এক অলৌকিক মুহূর্তে মনে হয় যথেষ্ট হল, আর নয়। সে কি ক্লান্ত হয়ে পড়ে সারাদিনমান জীবনের দুর্বহ ভার বইতে বইতে! কোনও একদিন কি মনে মনে নামিয়ে রাখে সব! হয়তো বা কোনও অভিমান নয়, নয় কোনও আঘাত, হয়তো বা আকর্ষণ ছিলই না কখনও জীবনের! অথবা ছিল; দিনানুদৈনিকের নিত্যস্রোতে মুছে গেছে যার দাগ। তাই কোনও গৃহত্যাগী জ্যোৎস্নায়, কোনও অবিরত বর্ষণমুখর ঊষাকালে, কোনও মেঘাচ্ছন্ন দ্বিপ্রহরে, কোনও নিয়নবাতির আলোকোজ্জ্বল নাগরিক সন্ধ্যায়– নিজেকে সে প্রত্যাহার করে নেয়… ঢের হল ভেবে অথবা কিছুই না ভেবে… তাৎক্ষণিক!
তাও কি আজ প্রথম! নাকি এমনটা যুগে যুগেই হয়ে আসছে…! রোগ-শোক-জরা-মৃত্যুর কার্যকারণসূত্রে কি তা অন্বিত! ‘বিষ্ণুপ্রিয়া গো আমি চলে যাই, তুমি থাকো ঘুমঘোরে…’ ঘুমঘোরে কি কেবল বিষ্ণুপ্রিয়াই নাকি নিজেও এতদিন ছিল! এ কি এক জাগরণ! তা কি কোনও মহতের অন্তর্গত ডাক! নাকি এমনিই, মৌহূর্তিক! সার্ত্রীয় সত্তা ও শূন্যতা! মহাপ্রস্থান কি শোক না প্রতিবাদ নাকি প্রত্যাখ্যান!
শোভনের পরিচয়জ্ঞাপক চিহ্ন ছিল ডান কানের কাছে বড় একটি জড়ুল। আজ থেকে ৭৭ বছর আগে প্রকাশিত প্রেমেন্দ্র মিত্রর ‘সামনে চড়াই’ সংকলনে প্রথম গল্প ছিল ‘নিরুদ্দেশ’। বাড়ি ছাড়ার দু’বছর পরে যখন ফেরে সেই সময় বাড়ির নায়েব কর্মচারীরা তাঁকে বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করতে বাধা দেয়। তার বৃদ্ধ বাবা স্খলিতপদে তার দিকে এক পা এগিয়ে আবার থমকে যান– বিজ্ঞাপনে পুরস্কারের ঘোষণায় বহুবার প্রতারকদের মুখোমুখি হয়েছেন তিনি একমাত্র সন্তানের সন্ধানে। শোভন নিজের মৃত্যুসংবাদ শুনেছিল নিজের বাড়ি ফিরে। আসলে সহসা কারও অন্তর্ধানে যে নিরাময়হীন ব্যাধি, তার একরকম মানসিক সমাধান চায় নিকটজন। অজ্ঞাত অনুপস্থিতি কি তাদের নিজেদেরও উত্তরহীন প্রশ্নের সম্মুখীন করে দেয়? সেখানে মৃত্যুও কি এক রকমের সমাধান?
অমলেন্দু চক্রবর্তীর ‘অবিরত চেনামুখ’ প্রকাশিত হয় ৫৫ বছর আগে। সে গল্প অবলম্বনে মৃণাল সেন ‘একদিন প্রতিদিন’ ছবি করেন ৪৫ বছর আগে। বাড়ির একমাত্র রোজগেরে মেয়ে চিনু কর্মক্ষেত্র থেকে একরাতে বাড়ি ফেরে না। প্রথমে মনে করা হয়, ওভারটাইম খাটতে হচ্ছে মেয়েটাকে। তারপরে তার বোন বেরিয়ে ফোন করে জানে, অফিস বন্ধ। বাড়ির লোক চিন্তিত হয়ে পড়ে। বাড়িওয়ালা আর কিছু ভাড়াটে প্রতিবেশী আগ্রহী হয়ে ওঠে। কেউ সমব্যথী, কেউ সমালোচনা মুখর। পরিবারের কর্মহীন বড় ছেলে, যার হাতখরচও চিনু চালায়, সে পুলিশে জানায়, মর্গে খোঁজ করে বিধ্বস্ত হয়। হাসপাতালে খোঁজাখুঁজি হয় দুর্ঘটনায় আহত হয়ে ভর্তি আছে কি না। এর মধ্যেই চিনু ফিরে আসে শীতল এক পারিবারিক পরিসরে।
চিনু বাড়ির একমাত্র রোজগেরে মেয়ে না হয়ে ছেলে হলে কি এই গল্প বা ছবি হত! আর্থিক স্বাধীনতা কি নারীকে সামাজিক স্বাধীনতা এনে দিতে পারে? এই প্রশ্নে থমকে থাকে সমাজ-সময়।
৪৭ বছর আগে লেখা রমাপদ চৌধুরীর উপন্যাস ‘বীজ’ অবলম্বনে ৩৫ বছর আগে মৃণাল সেন ছবি করেন ‘এক দিন আচানক’। এক মুষলধারা বৃষ্টির সন্ধ্যায় এক প্রবীণ অধ্যাপক বাড়ি থেকে একটু হাঁটতে বেরিয়ে আর ফেরেন না। সন্ধে বাড়তে বাড়তে রাত হয়, রাত শেষ হয়ে দিন সপ্তাহ মাস… গোটা পরিবার যেমন চেষ্টা করে জীবনের পূর্ব ছন্দে ফিরতে, তেমনই বুঝতে চায় ঠিক কী ঘটল, কেন ঘটল! ধীরে ধীরে অধ্যাপকের বড় ছেলে অমু তার অপটু ব্যবসায়; ছোট মেয়ে সীমা তার কলেজে আর বড় মেয়ে নীতা তার অফিসে। এই নির্মিত স্বাভাবিকতায়, ক্ষতের রক্তের ফল্গুধারা কি বহমান? অমু ব্যবসায় দাঁড়ায়, সীমা কলেজে ফার্স্ট ক্লাস পায়, নীতা তার প্রেমিক অলোকের পাশে, তবু সম্পর্কটা যেন থমকে আছে। তাদের মা স্বাভাবিকভাবেই ডিপ্রেশনে চলে যান। অধ্যাপকের জীবনের ছিন্ন টুকরোগুলো এক করতে চায়, বাড়ির সকলে বুঝে নিতে চায় নিরুদ্দিষ্টের মনোজগৎ; অধ্যাপক কী তাঁর প্রাক্তন ছাত্রীর প্রেমে পড়েছিলেন? তার পড়াশোনার জগৎ কি তছনছ হয়ে গিয়েছিল? কুম্ভিলকবৃত্তিতে?
আলেয়ান্দ্রো গার্বার বিসেসির জন্ম ১৯৭৭ সালে মেক্সিকোয়। তিনি গল্পকার ও চলচ্চিত্র পরিচালক। ২০০৪ সালে তাঁর তথ্যচিত্র ‘মোরাদা’ পুরস্কৃত হয়, ২০১০ সালে ‘ভাহো– বিয়ন্ড দ্য স্টেপস’ ফিচার মারাকেচ ফেস্টিভ্যালে স্পেশাল জুরি অ্যাওয়ার্ড পায়; ২০১৪ সালে ‘আ সেপারেট উইন্ড’ ওয়ারশ ফেস্টিভ্যালে নমিনেশন পায়; ২০১৬ সালে ‘লুসেস ব্রিলান্তেস’ মেক্সিকান সিনেমা জার্নালিস্ট সিলভার গডেস পায়। এই বছর নিজের গল্প থেকে নির্মিত ছবি ‘আরিলো দে হোমব্রে মুয়েত্রো’ বা ‘‘ডেড ম্যান’স স্যুইচ’’ ১০৮ মিনিটের ছবিটি এমনই বহু প্রশ্ন তুলে দেয়।
অন্তর্ধান-নিরুদ্দিষ্ট হওয়া সর্বদাই রাজনৈতিক; সামাজিকভাবে তো বটেই ব্যক্তিক স্তরেও। মেক্সিকো-সহ লাতিন বিশ্বে যে রাজনৈতিক সমস্যা এর আগেও একাধিকবার উঠে এসেছে। উত্তরহীন বহু প্রশ্ন। ৪২ বছরের দালিয়া মেক্সিকোয় মেট্রোরেলের চালক। স্বামী এক ছেলে আর এক মেয়ে নিয়ে তার স্বাভাবিক মধ্যবিত্ত জীবন। স্বামী লোকটি ছিল মেট্রোর ইঞ্জিনিয়ার। তাদের দিনানুদৈনিকের জীবনে একদিন সাবওয়ে টানেলের অন্ধকার বৃত্তের মধ্যে তার খেয়াল হয় তার স্বামী আজ সারাদিন অন করেনি। জীবন ছুটে চলেছে একটা আধা-আলো আধা অন্ধকার সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে। ট্রেন চালাতে চালাতেই সে ফোন করে তাকে। স্যুইচড অফ! অন্ধকার সুড়ঙ্গের থেকে ফোন যায় স্কুলছাত্র পুত্রের কাছে, সে জানায় বাবা ফেরেনি এখনও, ফোনও করেনি। মেয়েও ছাত্রী, সে তার পুরুষ বন্ধুর সঙ্গে বাইরে তখন। আত্মীয়-স্বজন আসে। পুলিশ প্রথমে অভিযোগ নিতেই চায় না, অপেক্ষা করতে বলে। পাশে এসে দাঁড়ায় দালিয়ার বন্ধু-প্রেমিকের মধ্যবর্তী সীমায় থাকা পুরুষটি। স্বামীর সহকর্মীদের কাছে যায় দালিয়া, কখন সে বেরিয়েছে বা অস্বাভাবিক কিছু তাঁরা লক্ষ করেছিল কি না জানতে। তাঁরা সমব্যথী আবার তাঁরাই প্রশ্নসঙ্কুল– তার স্বামীর রোজকার জীবনে অস্বাভাবিক কিছু ঘটেছে কি না, তা তো জানার কথা দালিয়ারই!
মেট্রোর ইউনিয়ন লিডারের কাছে যায় দালিয়া, সে পুরনো বৈরিতার তাপে শীতল। দিন বয়ে যায়। একদিন কাজ থেকে ফিরে দেখে মেয়ে বাড়ি নেই। ঢের রাত হয়ে গেছে বলে মেয়েকে আনতে যায় তার পুরুষ-বন্ধুর বাড়ি থেকে। এই অন্তর্ধান যেন সাড়া ফেলেনি তেমন মেয়ের মনে। আরেক দিন কাজ থেকে ফিরে দেখে সমপ্রেমী ছেলে তার পুরুষ-বন্ধুর সঙ্গে লগ্ন। এরই মধ্যে একদিন মেট্রো চালাতে চালাতে দালিয়ার স্বামীর নম্বর থেকে একটা ফোন আসে। জীবনের অন্ধকার সুড়ঙ্গের মধ্যে মুহূর্তের জন্য ট্রেন থামিয়ে দেয় দালিয়া। জানা যায় ফোনটা কেউ খুঁজে পেয়েছে একটা হাইওয়ের পাশে জলার ধারে। টানেলের মধ্যে নিয়ম ভেঙে ট্রেন থামানোয় কাজ যায় দালিয়ার। বন্ধু-প্রেমিকের মধ্যবর্তী পুরুষটিকে নিয়ে সেইখানে যায় দালিয়া, কিন্তু কোনও দিশা পায় না স্বামীর। পুরুষটি বুঝিয়ে দেয় এই পরিস্থিতিতে সে আসলে দালিয়ার প্রতীক্ষারত। কিন্তু দালিয়া কি তা চায়? দালিয়ার চারপাশে সকলের প্রবল হিংস্রভাবে উদাসীন। অন্ধকার সুড়ঙ্গের মধ্যে ছুটে চলেছে পরিণামহীন জীবন।
………………………………………………………..
পড়তে পারেন অন্য একটি লেখাও: আমাদের কাঙ্ক্ষিত প্রেম অসময়েও আসতে পারে
………………………………………………………..
কোথায় যায় মানুষ, চেনা প্রতিবেশ ছেড়ে, কেন যায়! ২৫৮৭ বছর আগে জন্ম নেওয়া সিদ্ধার্থর মতো কিংবা ৫৩৮ বছর আগে জন্ম নেওয়া বিশ্বম্ভর মিশ্রের মতো মহতের ডাক শোনে কি সবাই! নাকি কেউ কেউ ১২৯ বছর আগে ভাদ্র থেকে কার্তিকে লেখা রবীন্দ্রনাথের অতিথি গল্পের তারাপদ! ‘…পরদিন তারাপদকে দেখা গেল না। স্নেহ-প্রেম-বন্ধুত্বের ষড়যন্ত্রবন্ধন তাহাকে চারিদিক হইতে সম্পূর্ণ রূপে ঘিরিবার পূর্বেই সমস্ত গ্রামের হৃদয়খানি চুরি করিয়া একদা বর্ষার মেঘান্ধকার রাত্রে এই ব্রাহ্মণবালক আসক্তিহীন উদাসীন জননী বিশ্বপৃথিবীর নিকট চলিয়া গিয়াছে।’ তেমন যাওয়াও কি যায় আজ এই বিশ্বায়িত হাতের মুঠোয় বন্দি পৃথিবীতে? কোনও বিশ্বজননীর কোলের প্রতি নিরঙ্কুশ বিশ্বাস বা আশ্রয় হয় আজও? নাকি ছোট হতে থাকা পৃথিবীতে আরও অনেকটা বেরিয়ে গেছে হাতের মুঠোর থেকে! সেই যাওয়া কি পলায়ন নাকি প্রত্যাখ্যান নাকি প্রতিবাদ নাকি সেসব কিছুই নয়… ‘সুপক্ব যবের ঘ্রাণ হেমন্তের বিকেলের– / তোমার অসহ্য বোধ হল;’।
………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………