চিত্রকলার জগতে রামানন্দ বন্দোপাধ্যায়ের ছিল একেবারে নিজস্ব ধরন, ধারণ, ধারণা। দেব-দেবতার ছবি, পৌরাণিক কাহিনি, যা এঁকেছেন তাকে এনেছেন মাটির কাছাকাছি। আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজে মানুষের আচার-আচরণের মধ্যে ঈশ্বরকে উনি মানুষ রূপে দেখেছেন। ‘বিনায়ক-জননী পার্বতী’-কে সহজেই ‘গণেশের মা’ করে তুলেছেন। তাছাড়া ফুল-ফল-গাছপালা পশুপাখি সবই যেন আত্মীয়। উনি নারী চরিত্র এঁকেছেন কাব্যিক লাবণ্যময় রেখায়। রেখা ওঁর হাতিয়ার, হাতের খেলা, ম্যাজিক। এই যে রোজ কাজ করার কথা উনি বলেন সেইখানেই এই রেখাকে দেখলেই বোঝা যাবে যে, সেটাকে উনি কতটাই নিজের করে নিতে পেরেছেন।
২২.
এই যে একটা সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি আমরা, নিরন্তর ঝামেলা-ঝক্কি, অশান্তি, প্রবল অসহিষ্ণুতা, তার মধ্যে একটি শব্দ উচ্চারণেই কেমন মনের মধ্যে এক প্রশান্তি, একটা বিক্ষোভহীনতা। ‘রামানন্দ’ নামটা শুধু লিখব আর শব্দটা বারবার উচ্চারণ করব বলেই বোধহয় এই লেখাটা শুরু করেছি আজ। রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়কে সবাই জানেন চিত্রশিল্পী বা চিত্রকর হিসেবে। খুব নামডাক। মধ্যবিত্তের মাথার মণি।
মানুষটাকে আমি চিনি নানা ভাবে, আমার মতো করে। যে শব্দগুলো বারবার উচ্চারণ করতে দেখি ওঁকে বক্তৃতায়, সাক্ষাৎকারে, লেখালেখিতে কিংবা ঘনিষ্ঠ আলোচনায়, তার মধ্যে দু’টি শব্দ শুনে শুনে, সোজা কথায়, মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল আমার। শব্দ দু’টির একটি হল ‘মা’, অন্যটি ‘কাজ’। মনে হত, এত মা মা করার কী আছে? আরে বাবা, মা কি আর আমাদের নেই! আমরা কখনও মাকে নিয়ে তো কিছুই বলি না। আর কাজ, শুধু কাজ করে যাও, রোজ কাজ করে যাও, কাজ কাজ কাজ! তাও আবার গায়ে-গতরে। দিন যত এগোচ্ছে আধুনিক শিল্পকলার ক্ষেত্রে সবার বিশ্বাস, কাজ কম কথা বেশি, ভাবনাচিন্তা বেশি, আইডিয়া, আইডিয়াই গুরুত্বপূর্ণ! আরও একটা বিষয় আছে, তবে সেটা ওঁর মুখে ততটা বারবার উচ্চারণ হয় না। ‘রামকৃষ্ণ’। ওটা থাকে অন্তরে।
রাম আর কৃষ্ণ মিলে রামকৃষ্ণ। ইনি তো আবার নামের সঙ্গে আনন্দ জুড়ে রামানন্দ হয়েছেন। বেছে বেছে মা নামখানা দিয়েছিলেন বটে, ‘রাম’। পরবর্তী কালে আমাদেরও প্রিয় রাম-দা হলেন। শুনেছি ওঁর মুখে রাম রাম করে পাগল হয়ে যেতেন মা ছোটবেলায়। ‘রাম এইটা করো, রাম সেইটা করো, এখানে বসো রাম, ওখানে নয়।’ আদরের অন্ত নেই, যা চাই তাই তক্ষুনি। ছবি আঁকা পছন্দ। রং বানিয়ে দিচ্ছেন মা, হাতের কাছে নিত্য ব্যবহারের জিনিসপত্র দিয়ে। পাতার রস, ভুষো কালি, পান চুন খয়ের। গোটা দেওয়াল দিয়ে দিচ্ছেন ছবি আঁকার জন্য। ছবি এঁকে দেওয়াল ভরিয়ে দিচ্ছেন রাম। রামানন্দ মানুষ জীবনে যা কিছু, তার অনেকটাই আমি আমার জীবনেরই বলে মনে করি, ভীষণ মিল পাই যেন। বড় মাপের মানুষের সঙ্গে আমাকে মিলিয়ে ভাবা, সে এক দুর্বিনীত চিন্তা ভাবনা।
আমারও মা ছিল। সময় পেলে আমাদের সঙ্গে নিয়ে পুতুল গড়ে দিত। মাটি বানিয়ে দিত আমাদেরও। আমরাও মায়ের আলতা চুরি করে কাগজে লেপে, সিমপাতার রস দিয়ে পতাকা এঁকেছি ছোটবেলায়। কিন্তু রামদার মায়ের সঙ্গে তফাত আছে। আমাদের মা রান্না সেরে যখন পুকুরে চান করতে যেত তখন রান্নাঘরে ঢুকে মায়ের কড়াই থেকে ছোট্ট হলুদ রঙের ললিপপের মতো এক টুকরো ফুলকপি নিয়ে ফুঁ দিতে দিতে খাওয়ার জন্য পিছনে বাগানে লুকিয়ে পড়তাম। আমরা অনেকগুলো ভাই। দু’-তিনটে করে এভাবে নিয়ে যাওয়ার পরে কড়াইয়ের গায়ে ঝোলের দাগটা জল কমে গেলে যেমন হয়, ঠিক তেমনি ভাবে ফুটে উঠত।
মা বুঝতে পারত, ঝোলের জিনিস কমে গেছে। তারপরে খাবার চুরির দায়ে পিটুনি। পিটুনি ছাড়াও নানা কাজকর্মে আমাদেরকে ভীষণ খাটিয়ে নিত মা। বাবা আমাদের সঙ্গে সব সময় থাকত না। বাবা স্কুলের মাস্টারি করে অন্য গ্রামে, রোজ বাড়ি থেকে সেখানে যাওয়া সম্ভব না, তাই ওখানেই থেকে যেত। সপ্তাহের শেষে দু’দিন করে বাড়িতে থাকত। মায়ের সঙ্গে মাটি কাটা, বেড়া দেওয়া– এ সমস্ত কঠিন কাজগুলো করতাম। এমনকী বাড়িতে তখন ভাইয়েরা মিলেই ধান সেদ্ধ করার জন্য কাঠের উনুনে জ্বাল দেওয়া আর সোডা দিয়ে সেদ্ধ করা কাপড়-চোপড় নিয়ে পুকুরে গিয়ে কাঁচতে হত। সে গল্প কি লোককে বলার মতো?
রামদার কাছে গল্প শুনে শুনেই মাকে চিনতে পেরেছিলাম পরিণত বয়সে। মাকে বুঝতে শিখেছিলাম। তখন মনে হত, কিছুই কি বলার ছিল না মাকে নিয়ে? স্নানের শেষে মা যখন গামছা দিয়ে গা মুছে দিত, মাথা মুছে দিত তখন কেমন খসখসে গামছাটা হাঁসের পালকের মতো নরম মনে হত। বাবা যখন গামছা দিয়ে গা মুছে দিত তখন মনে হতো চামড়া যেন ছঁড়ে যাচ্ছে। শীতের রাতে পাড়ার কারও সঙ্গে যাত্রা শুনতে যাওয়ার বেলায় বাবা রাগ করত, কিন্তু মা আমাদের যেতে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিত, বাবাকে ম্যানেজ করত। গ্রাম থেকে কলকাতায় গিয়ে পড়াশোনার খরচ চালিয়ে আর্ট কলেজে পড়া সম্ভব কি না, সেসব না বুঝেই মা কিন্তু সায় দিয়ে যেত। মায়েরা কেমন, হিসেব জানে না কিন্তু সন্তানের ইচ্ছেপূরণ করার ব্যাপারে সাংঘাতিক উৎসাহ। অন্যদিকে, কাঁচা হাতে, ঠাকুর রামকৃষ্ণের একটা ছবি এঁকে দরজার মাথায় সেঁটে দিয়েছি। বাবাকে দেখি চান করে এসে সেই ছবিটাকে প্রণাম করে। এসব পরিণত বয়সে মিলিয়ে নিয়েছি রামদার কাছ থেকে।
রামদাকে একবার নিয়ে গিয়েছিলাম আমাদের গ্রাম্য পরিবেশে, বসিরহাটে। বসিরহাট একেবারে গ্রাম নয়, চমৎকার একটি মহকুমা শহর। টাউন। সেই টাউনের সমস্ত কিছুতে গ্রামের চরিত্র মিশে আছে। আছে নদী ইছামতী, আর আছে গায়ে গায়ে মহকুমার ছোট ছোট গ্রাম। পুবে পূর্ব পাকিস্তান যা এখন বাংলাদেশ, ইছামতী নদী চলে গেছে টাকি, হাসনাবাদ হয়ে বঙ্গোপসাগরে। আছে হাতের কাছেই সুন্দরবন। নদীপথে সমুদ্র। রেল আর সড়কপথে কলকাতার সঙ্গে যোগাযোগ। এমনই গোছালো টাউনে ভালো ভালো মানুষের বাস। আমাদের পাশের গ্রামের মানুষ, নাট্যব্যক্তিত্ব মনোজ মিত্র। অদূরে টাকিতে কমলকুমার মজুমদার, নীরদ মজুমদারের আদি বাড়ি। ভালো লাগবে শুনে, ধনীরাও ছিলেন সেখানে। ছিলেন স্যর রাজেন মুখার্জি, তাঁর ছেলে স্যর বীরেন মুখার্জি, যার সহধর্মিণী লেডি রাণু মুখার্জি। যাদের বসিরহাট অঞ্চলে মার্টিন বার্ন রেল আর বার্নপুরে ছিল ‘স্টিল অথরিটি অফ ইন্ডিয়া’।
রামানন্দদা গ্রামের কথা বলতে, শুনতে এবং দেখতে পছন্দ করেন। আমাদের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে উঠোনে পা রাখতেই চোখ চলে গেল মায়ের দিকে। মা তখন মাটির বাড়িটার দাওয়ার এক কোনে উঁচু পিড়ি পেতে বসে কাঠের জ্বালে রান্না করছিল। আজ বিশেষ অতিথিরা খাবেন, মা নিজের হাতেই রান্না করছে। পরে কলকাতায় ফিরে গিয়ে রামদা বেশ কয়েকটা ছবি এঁকেছিলেন আমার মাকে মনে করে। আধঘোমটায় একজন মহিলা উঁচু মাটির দাওয়ায় বসে রান্না করছে। আমাকে ছবি দেখিয়ে হাসি-হাসি মুখ করে বলেছিলেন, ‘সমীর, চিনতে পার?’
কলেজ থেকে পাশ করার অনেক পরে, আমার বিয়ের পরপর একটা ছবির এক্সিবিশন মানে চিত্রকলা প্রদর্শনী করেছিলাম বসিরহাটে, গ্রামের মানুষকে আমার কাজ দেখাতে। ১৯৮২ সাল বললেও হত, বিয়ের পরপর বললাম কারণ, সদ্য বিয়ের ব্যাপারেও কনে দেখা, পাকা দেখা এবং কনে আশীর্বাদ ইত্যাদি করেছিলেন রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়। তা উনি এলেন ওই প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পৌরহিত্য করতে। ছবি কেন আঁকি, গ্রামের মানুষকে সেই গল্প শোনাতে রামানন্দদা এলেন আর এলেন তখনকার দিনে জনপ্রিয় কলা সমালোচক সন্দীপ সরকার। এছাড়াও আরও অন্য কাগজ থেকেও দু’-একজন কলা সমালোচক এবং ফটোগ্রাফার। স্থানীয় অতিথিদের মধ্যে ছিলেন বসিরহাটের তৎকালীন মহকুমা শাসক মানে এসডিও, বসিরহাট মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান আর স্কুলের ছবি আঁকার শিক্ষক।
রামানন্দদা লক্ষ্য করেছিলেন আমাদের কাজের যত্ন। গ্রামের পরিবেশে দড়িতে সেফটিপিন দিয়ে ছবির কাগজগুলোকে আটকে সেই প্রদর্শনী ছিল না, সে প্রদর্শনী করার সঙ্গে সঙ্গে মনের মধ্যে এটাও কাজ করেছিল যে ছবি কাকে বলে, তার একটা আন্দাজ দেওয়া এবং ছবির প্রদর্শনী কাকে বলে, তারও একটা ধারণা দেওয়া। শহরে গিয়ে যারা প্রদর্শনী দেখতে পায় না তাদের প্রদর্শনীর সমস্ত আঙ্গিকের ব্যবস্থা করা। ছবিগুলো প্রথমে সঠিকভাবে ফ্রেম করা হয়েছিল। সেই ফ্রেম করেছিল কলকাতার ‘বালিগঞ্জ ফ্রেমার্স’। ছবিগুলোর সব টাইটেল ঠিক করা এবং তার একটা লিস্ট। আমন্ত্রণপত্র যথাসম্ভব ভালো কাগজে সুন্দর ডিজাইনে, শহরে ঠিক যেমনটি করা হয়, তেমনই প্রিন্ট করে এবং তাতে উদ্বোধনের দিনে যে অতিথিরা থাকবেন তাদের নাম উল্লেখ করে সেই কার্ড বানানো হয়েছিল। বানানো হয়েছিল বেশ কয়েকটি সিল্ক স্ক্রিনে প্রিন্ট করা পোস্টার। সেগুলোকে শহরের বিভিন্ন লাইব্রেরি, স্কুল-কলেজ এবং ক্লাবে লাগিয়ে যতটা সম্ভব পারা যায় জনসাধারণকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। আর বানানো হয়েছিল হলের গেটে লাগানোর জন্য একটি সুদৃশ্য ব্যানার। উদ্বোধনের দিনে প্রচুর লোক। ছেলেমেয়েদের হাত ধরে বাবা-মা। ভালো জামাকাপড় পরিয়ে ছেলেদের চুল আঁচড়ে, মেয়েদের চুলে ফিতে বেঁধে সবাই যেন মেলা দেখতে বা পুজো দেখতে চলেছে। কাউকে জিজ্ঞেস করলে বলছিল, ‘আমরা ট্যাংকের পুকুর ধারের স্কুলে চিত্রকলা প্রদর্শনী দেখতে যাচ্ছি।’
উদ্বোধনের দিনে সন্ধেবেলা রামানন্দদার কথা শুনে সবাই যারপরনাই মুগ্ধ। পরের বারের প্রদর্শনী করার আবদার আর তার সঙ্গে রামানন্দবাবুকে কে চাই-ই চাই। কারণ, ওঁর কথা শোনা এবং ওঁকে দেখা নাকি অনেকটা ভগবৎ দর্শনের মতো মনে হয়েছিল সবার! একটা সান্নিধ্যের আনন্দ। সেটা একটা আলাদা মাত্রা দিয়েছিল গ্রামের ওই প্রদর্শনীতে। রামানন্দদা সুকথক, মিষ্টভাষী, মুখে একখানা হালকা হাসি সবসময় বাঁধিয়ে রেখেছেন যেন। ভীষণ স্পষ্ট উচ্চারণ আর সংযত বাংলা শব্দচয়ন ওর কথার একটা মস্ত বড় দিক।
রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে আমার যোগাযোগ রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলাপের বহু আগে। এই যোগাযোগ ভারি অদ্ভুত, অন্যরকম। রামদার ছোটবেলায় রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে যে যোগাযোগ, মনের টান, সেটা এসেছিল ওঁর বাবা-মায়ের কাছ থেকে। অদ্ভুতভাবে আমিও বাবা-মায়ের কাছ থেকে এই রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে যোগসূত্রে বাঁধা পড়ে আছি। গ্রামে থাকাকালীন, তখন আমি বোধহয় ক্লাস সিক্সে পড়ি, বাবা আমাকে নিয়ে যাবে শিকড়া কুলীনগ্রাম, সেখানকার রামকৃষ্ণ মিশনের আশ্রমে। মনে আছে আমার স্কুলের জীবনে গ্রামে তখনও জাতপাত এ সমস্ত ছিল। জীবন খুব সরল ছিল না, তাই বাবা, মা যাচ্ছে গুরুদীক্ষা নিতে, সঙ্গে আমিও। গুরুদীক্ষা নিলে নাকি আমাদের মত গ্রাম্য মানুষ এবং অ-ব্রাহ্মণদের পুজোপার্বণ আর নানা রকম উপাসনার কাজে যোগ দিতে পারব। দীক্ষা নিলে অন্য বড় ক্লাসে উঠে যাব, যেন জাতপাতের ঊর্ধ্বে ওঠার প্রমোশন!
শান্ত সুন্দর আশ্রমিক পরিবেশ। ছোট্ট পরিষ্কার ঘরের মেঝেতে এই দীক্ষা দেওয়ার কাজটা চলছে। আমার পালা এল, ঢুকলাম। ঘরের মেঝেতে দুটো আসন। পরনে গেরুয়া বসন, মাথায় গেরুয়া টুপি একজন সাধু বসে একটাতে, অন্যটায় আমাকে বসতে বলা হল। গুরু, নির্বাণানন্দজি মহারাজ। দারুণ নাম, তখন উচ্চারণ করতে পারতাম না। মন্ত্র দিলেন, কয়েকটি সহজ শব্দ। জটিল যা, তা এই শব্দগুলোর ব্যবহারবিধি। কীভাবে সন্ধেবেলায় আহ্নিক করতে হবে, কতবার ওই মন্ত্র জপ করতে হবে, ধ্যান, কোন পায়ের ওপর কোন পা, কোন হাতের ওপরে কোন হাত রেখে বসতে হবে– এ সমস্ত লম্বা করে যখন বলছিলেন তখন আমার চোখ চলে যাচ্ছিল দেওয়ালে বাঁধানো কিছু ছবির দিকে। গুরু হাসলেন। আমার অন্য কানে যেন অন্য মন্ত্র দিলেন, বললেন, ‘যা কিছু বললাম সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, তুমি মন দিয়ে পড়াশোনা করবে আর সব সময় ভালো করে খেলাধুলো করবে, সেটাই তোমার মন্ত্র জপ।’ আমি মন্ত্রের শব্দগুলো আজও মনে রেখেছি আর ছোট্ট করে ওই বয়সেও কেমন যেন দ্বিতীয় মন্ত্রটাও বুঝে ফেলেছিলাম। সেদিন রামকৃষ্ণ বুঝলাম আর বড় হয়ে বুঝলাম রামকৃষ্ণ মিশন।
রামানন্দদার সঙ্গে আমার আলাপ হয় আনন্দবাজারের অফিসে। উনি তখন পুরুলিয়া রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যাপীঠে শিল্প-শিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন, মাঝে মাঝে কলকাতায় আসেন। তখনকার ‘দেশ’ পত্রিকায় রামানন্দ বন্দোপাধ্যায়ের ড্রইং দিয়ে মলাট হত আর ভেতরে লেখার মধ্যেও ছোট ছোট ফাঁক থাকলে সেখানে উনি ভরিয়ে দিতেন ছোট ছোট ড্রইং করে। সেগুলো খুব চমৎকার লাগত। রামানন্দদার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হয় যখন আমি বিড়লা মিউজিয়ামে কাজ করছি তখন থেকে। উনি চলে এসেছেন গোলপার্কে, পুরুলিয়া রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যাপীঠ ছেড়ে। গোলপার্কের রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচার-এর মিউজিয়াম তৈরির কিউরেটর হিসেবে কাজে যোগ দিয়েছেন।
তখন বিড়লা মিউজিয়ামে আমি। মিউজিয়াম ইন্টেরিয়র করার একটা ধারণা তৈরি হচ্ছে আমার সবে। শুরুর দিক, তবুও রামানন্দদা গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অফ কালচার-এর মিউজিয়াম সাজানোর ব্যাপারে আমাকে মাঝে মাঝে ডাকতেন। অনেকদিন কাজ করতে করতে রাত হয়ে গেলে, ইনস্টিটিউটের পাশেই, রামদার বাড়িতেই খেয়ে নিতাম এবং শুয়ে পড়তাম। একদিন উনি বললেন, আজকে মিউজিয়ামের জন্য অনেকগুলো জিনিসপত্র এসেছে। তার সঙ্গে ছোট ছোট কিছু জিনিস এসেছে যেগুলো খুবই মূল্যবান। ‘তোমাকে একটা দেখাব আর দেখাব না শুধু, তোমার হাতেও দেব। সেইটা দেখার পর আমার ধারণা, তোমার আজকের রাতের ঘুম নষ্ট হয়ে যাবে’, এই বলে আমাকে উনি একটা ছোট খাম দিলেন তার মধ্যে ভাঁজ করা একখানা চিঠি। সাবধানে খাম খুললাম, ভাঁজ করা কাগজের চিঠিটা পড়তে গিয়েই আমার শরীরের মধ্যে একটা বিদ্যুৎ খেলে গেল যেন। অদ্ভুতভাবে রাতের ঘুম তো পরের কথা এখনিই চিঠিটা হাতে করে কাঁপছি। চিঠিখানা স্বামী বিবেকানন্দের লেখা আমেরিকা থেকে মহেন্দ্র দত্তকে। অল্প এক লাইন দু’লাইন পড়ছি, দেখছি বেশি। এই বাংলা ভাষা, এই বাংলা হাতের লেখা, এই সেই কাগজ, যেখানে তাঁর কলমের ছোঁয়া, তাঁর হাতের ছোঁয়া, তার আঙুলের ছাপ। সেটা আমি আমার হাতে করে ছুঁয়ে আছি ভাবতে একটা শিহরন, এখন অবর্ণনীয় অনুভূতি।
সারা পৃথিবী জুড়ে এক একটা জায়গায় একেক বছরে ওয়ার্ল্ড কনভেনশন হয় রামকৃষ্ণ মিশনের। সেবারে বেলুড় মঠে ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন।সেখানে বড় করে আলপনা দিয়েছিলেন কৃষ্ণাদি। রামানন্দদার স্ত্রী কৃষ্ণাদি, অসাধারণ ওয়াশ পদ্ধতিতে ছবি আঁকতেন। সে ছবি অনেকেই দেখতে পায়নি। নিজস্ব আঙ্গিকে সে এখন অদ্ভুত মায়াবি জগৎ তৈরি হত। কনভেনশনে বেলুড় মঠে সেবারে বিশাল বড় করে রঙিন আলপনা দিয়েছিলেন উনি। সেই আলপনার রং বাছাইটাও দেখার মতো। এই কনভেনশনে বড় এগজিবিশনের একটা ব্যবস্থা হয়। সেইখানে ছবির বিষয় ছিল ঠাকুর রামকৃষ্ণের ‘কথামৃত’। মনে আছে, পরিতোষ সেন এঁকেছিলেন, জলে কচ্ছপ থাকলেও তার মন পড়ে থাকে ডাঙায়, যেখানে ডিম পেড়ে এসেছে। অনেক শিল্পীর কাজ জোগাড় হলো। কাজ দিয়েছিলেন চণ্ডী লাহিড়ী, তাঁর কার্টুনে কথামৃত। কাজ দিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। তেমনই গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট-এর মিউজিয়ামের শুরুর দিকে স্বামী বিবেকানন্দের ওপরেও একটা এগজিবিশনের আয়োজন করা হয়। এমন সব কাজেই আমি রামানন্দদার পাশাপাশি থাকতাম।
ধর্মীয় বিষয়ে আগ্রহ, কিন্তু রামানন্দ ধর্মান্ধ নন, উনি সাধুও নন। ওঁর বচন, বসন আর বপুতে সাধুভাব। শৌখিন মানুষ। ঘোরতর গৃহস্থ, সংসারে থেকে সংসারের সমস্ত স্বাদ নিয়েছেন। এমনকী প্রাতিষ্ঠানিক কাজ, আনুষ্ঠানিক কাজ এ সমস্ত মনোযোগ দিয়ে করতেন এবং বেশ ভালো রকমই করতেন। আমার অফিসের চাকরির ইন্টারভিউতে উনি সিলেকশন কমিটিতে ছিলেন, আরও এরকম প্রতিষ্ঠান, মিউজিয়াম ইত্যাদি জায়গায় উনি উপদেষ্টা ছিলেন। ওঁর মধ্যে একটা হিসেবি মানুষ বাস করত। না হলে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ব্যাপারটা উনি অত নিপুণভাবে করতেন কীভাবে?
এ প্রসঙ্গে একটা উদাহরণ দিই। আমার অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস-এ এগজিবিশন হবে সেই নিয়ে রামদার সঙ্গে আলোচনা করছিলাম। উনি আমার জন্য পুরো প্রদর্শনী পরিকল্পনা করলেন। যেটা একেবারেই কিউরেটর বা এই ধরনের পরিচালক বা পরিকল্পক হিসেবেই কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকেই করলেন যেন। প্রদর্শনীর অনেক আগে, অর্থাৎ, পত্রপত্রিকায় যদি এক মাস পরে লেখা বের হয়, তাহলে একমাস আগেই কাজগুলোকে ফ্রেম করে ফেলতে বললেন– ‘সেগুলোকে আমার এই মিউজিয়ামের একটি দেওয়ালে তুমি একদিনের জন্য সাজিয়ে রাখো এবং খবরের কাগজে যারা লেখেন, যারা কলা সমালোচক তাদেরকে তুমি ডেকে কাজগুলো আগেই দেখিয়ে দাও।’ শুধু তাই নয়, সেই কাজগুলো দেখানোর জন্য যা যা দরকার সে সমস্ত বুদ্ধিও উনি আমাকে দিয়েছিলেন। যেমন, ওঁরা কীভাবে আসবেন, তাদের যাতায়াতের স্বাচ্ছন্দ, সহজ ভাবে ছবিগুলোকে দেখানোর ব্যবস্থা করা ইত্যাদি। ছবিগুলোর ফটোগ্রাফ, ছবির নাম, কাজের বিষয়ে সংক্ষিপ্ত লেখা এসমস্ত হাতে ধরিয়ে দিতে উনিই বলে দিয়েছিলেন। এর ফলটা চমৎকার হয়েছিল। পরিষ্কার বোঝা যায় যে, ওঁর একটা প্ল্যানিং অ্যান্ড অর্গানাইজিং ব্যাপারে মাথা কাজ করত।
কলকাতা ছেড়ে এরপর চাকরি সুবাদে ব্যাঙ্গালোরে গেলাম। সঙ্গে বছরখানেকের পুত্র। আমাদের পুত্রসন্তানের নামকরণও করেছিলেন রামানন্দদা, কার্ডে ছবি এঁকে জন্মের দিনেই। এটা শান্তিনিকেতনের অভ্যেস। ছবির নিচে লেখা, ‘সোমবারে এসেছেন সোমক-বাবু, মাণিক আমাদের, মাণিকতলায়’। এক লাইনে এই লেখাটার মধ্যে আছে সোমবারে জন্ম, নাম সোমক এবং স্থান কলকাতার মানিকতলার এক নার্সিংহোম। ব্যাঙ্গালোরে যোগাযোগ থাকত চিঠিতে আর অদ্ভুতভাবে আর একটা যোগসূত্র আমাদের, রামকৃষ্ণ মিশন। উনি আমাকে কোনও অসুবিধায় পড়লে রামকৃষ্ণ মিশনের সাহায্য নিতে বলতেন। অফিস থেকে মাঝে মাঝে যেতাম ব্যাঙ্গালোর রামকৃষ্ণ মিশনের হয়ে ‘আনেকাল’ নামে কর্ণাটকের একটা পাহাড়ি জায়গায়। পাহাড়ি গ্রাম, ভারি চমৎকার। খুব হাতির উৎপাত তাই ছোট ছোট পাহাড়ের মাথায় দু’-তিন চার পরিবারের এক একটি হ্যামলেট, মানে ছোট ছোট গ্রাম। আমাদের ওখানে যাওয়া, মূলত খাদ্য, চিকিৎসা আর ছোটখাটো কিছু শেখানোর ক্লাস নিয়ে। ছবি আঁকার ক্লাস নেওয়া আমার কাজ।
চিত্রকলার জগতে রামানন্দ বন্দোপাধ্যায়ের ছিল একেবারে নিজস্ব ধরন, ধারণ, ধারণা। দেব-দেবতার ছবি, পৌরাণিক কাহিনি, যা এঁকেছেন তাকে এনেছেন মাটির কাছাকাছি। আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজে মানুষের আচার-আচরণের মধ্যে ঈশ্বরকে উনি মানুষ রূপে দেখেছেন। ‘বিনায়ক-জননী পার্বতী’-কে সহজেই ‘গণেশের মা’ করে তুলেছেন। তাছাড়া ফুল-ফল-গাছপালা পশুপাখি সবই যেন আত্মীয়। উনি নারী চরিত্র এঁকেছেন কাব্যিক লাবণ্যময় রেখায়। রেখা ওঁর হাতিয়ার, হাতের খেলা, ম্যাজিক। এই যে রোজ কাজ করার কথা উনি বলেন সেইখানেই এই রেখাকে দেখলেই বোঝা যাবে যে, সেটাকে উনি কতটাই নিজের করে নিতে পেরেছেন। পিগমেন্ট আর নিজের মতো আঠা মিশিয়ে বানাতেন রং। হাতে রং লাগলেই আনন্দ, রং মাখতে যেমন পছন্দ করতেন, তেমনই পুরলিয়ার আদিবাসীদের দেওয়াল লেপনের মতো করে উনিও হাতে রং মেখে পটে রং লেপন করতেন, তারপরে রেখা। সেই রেখা কখনও শক্তিশালী, কখনও কখনও তার চলতি পথে কোথাও হারিয়ে যাওয়া। তাই বলে কি ওঁর ছবিতে সমকালীন কোন চরিত্র নেই? আছে। এই রেখা একদিকে যেমন লাবণ্যময়, অন্যদিকে আবার এই রেখার সমষ্টিতেই তৈরি হচ্ছে ছবির কাঠামো, যা একেবারেই সমকালীন চিত্রকলার প্রধান চরিত্র। সমকালীন শব্দটা ওঁর বেশি পছন্দের নয়। উনি পছন্দ করেন ‘চিরকালীন’ শব্দটাকে।
……………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………
রামানন্দ বন্দোপাধ্যায় শিল্পী যতটা, তার চেয়ে কর্মী বেশি, সেটা ওঁর নিজের কথা। কর্ম করতেই আনন্দ। সংসারে থেকেও সংসার থেকে পালিয়ে আছেন যেন শুধু কর্মের মাধ্যমে। শুরুতে বলেছি, ‘রামানন্দ’ নামটাই যেন এক মন্ত্রের মতো। ওঁর ছায়ায় আরও অনেক কাজের কথা বলা হল না। ‘রামকৃষ্ণ’ খুঁজতে গিয়ে বুঝলাম যে, সংসারে থেকেও ঈশ্বর চিন্তা করা যায়। সংসারের সমস্ত কিছু কাজ ঠিকমতো বুঝে উপাসনাও করা যায়। জীবনের সমস্ত হিসেব ঠিকমতো করেও ধ্যানমগ্ন হওয়া যায়। উনি গৃহী-সন্ন্যাসী। রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় আমার ছবি আঁকার গুরু নন, উনি আমার জীবন যাপনের পথপ্রদর্শক।
… পড়ুন ‘মুখ ও মণ্ডল’-এর অন্যান্য পর্ব …
পর্ব ২১: ‘তারে জমিন পর’-এর সময় আমির খান শিল্পীর আচার-আচরণ বুঝতেই আমাকে ওঁর বাড়িতে রেখেছিলেন
পর্ব ২০: আমার জলরঙের গুরু শ্যামল দত্ত রায়ের থেকে শিখেছি ছবির আবহ নির্মাণ
পর্ব ১৯: দু’হাতে দুটো ঘড়ি পরতেন জয়াদি, না, কোনও স্টাইলের জন্য নয়
পর্ব ১৮: সিদ্ধার্থ যত না বিজ্ঞানী তার চেয়ে অনেক বেশি কল্পনা-জগতের কবি
পর্ব ১৭: ডানহাত দিয়ে প্রতিমার বাঁ-চোখ, বাঁ-হাত দিয়ে ডানচোখ আঁকতেন ফণীজ্যাঠা
পর্ব ১৬: আমার কাছে আঁকা শেখার প্রথম দিন নার্ভাস হয়ে গেছিলেন প্রধানমন্ত্রী ভি. পি. সিং
পর্ব ১৫: শঙ্করলাল ভট্টাচার্য শিল্পীদের মনের গভীরে প্রবেশপথ বাতলেছিলেন, তৈরি করেছিলেন ‘বারোয়ারি ডায়রি’
পর্ব ১৪: নাটককে পৃথ্বী থিয়েটারের বাইরে নিয়ে এসে খোলা মাঠে আয়োজন করেছিল সঞ্জনা কাপুর
পর্ব ১৩: চেষ্টা করবি গুরুকে টপকে যাওয়ার, বলেছিলেন আমার মাইম-গুরু যোগেশ দত্ত
পর্ব ১২: আমার শিল্প ও বিজ্ঞানের তর্কাতর্কি সামলাতেন সমরদাই
পর্ব ১১: ছবি না আঁকলে আমি ম্যাজিশিয়ান হতাম, মন পড়ে বলে দিয়েছিলেন পি. সি. সরকার জুনিয়র
পর্ব ১০: তাঁর গান নিয়ে ছবি আঁকা যায় কি না, দেখার ইচ্ছা ছিল ভূপেনদার
পর্ব ৯: পত্র-পত্রিকার মাস্টহেড নিয়ে ম্যাজিক দেখিয়েছিলেন বিপুলদা
পর্ব ৮: সৌমিত্রদার হাতে কাজ নেই, তাই পরিকল্পনাহীন পাড়া বেড়ানো হল আমাদের
পর্ব ৭: ঘোড়াদৌড়ের মাঠে ফ্যাশন প্যারেড চালু করেছিলেন মরিন ওয়াড়িয়া, হেঁটেছিলেন ঐশ্বর্য রাইও
পর্ব ৬: একাগ্রতাকে কীভাবে কাজে লাগাতে হয় শিল্পের বিভিন্ন ক্ষেত্রে, ধরিয়ে দিয়েছিলেন গুরু গোবিন্দন কুট্টি
পর্ব ৫: কলকাতা সহজে জয় করা যায় না, হুসেন অনেকটা পেরেছিলেন
পর্ব ৪: যে পারে সে এমনি পারে শুকনো ডালে ফুল ফোটাতে, বলতেন চণ্ডী লাহিড়ী
পর্ব ৩: সহজ আর সত্যই শিল্পীর আশ্রয়, বলতেন পরিতোষ সেন
পর্ব ২: সব ছবি একদিন বের করে উঠোনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলাম, বলেছিলেন অতুল বসু
পর্ব ১: শুধু ছবি আঁকা নয়, একই রিকশায় বসে পেশাদারি দর-দস্তুরও আমাকে শিখিয়েছিলেন সুনীল পাল