দুই প্রিয় মানুষের অবিচুয়ারি প্রোগ্রাম করতে হয়েছে আমাকে। ‘কাছের মানুষ সুচিত্রাদি’, এই স্মরণ অনুষ্ঠানে সুচিত্রাদির মেয়ে মণিকুন্তলা এসেছিল তার ব্যক্তিগত শোকাবস্থাকে পেরিয়ে। ‘হে পূর্ণ তব চরণের কাছে’ নবনীতাদিকে স্মরণ করে। ৭ নভেম্বর চলে গিয়েছিলেন তিনি, আমাকে ৯ তারিখ অনুষ্ঠানটি করতে বলা হয়, আমি একটু সময় চাই নিজেকে সামলে ওঠার এবং ১১ নভেম্বর লাইভ অনুষ্ঠান করি যেখানে এসেছিলেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এবং বাণী বসু।
২১.
দূরদর্শনে যেমন বিভিন্ন শিক্ষামূলক অনুষ্ঠানের প্রতি জোর দেওয়া হত তেমনই মহিলাদের অনুষ্ঠানের প্রতিও বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া হত। ‘ঘরে বাইরে’ তো ছিলই, তার সঙ্গে যোগ হল ‘শ্রীময়ী’ নামে এক অনুষ্ঠান। প্রথম দিনের ‘শ্রীময়ী’তে অতিথি ছিলেন নবনীতা দেবসেন, নবপর্যায়ের ‘ঘরে বাইরে’ সূচনার দিনের মতোই। তবে এবার বাড়তি আকর্ষণ ছিল, শাশ্বতী আর আমি– দু’জনেই বসেছিলাম একসঙ্গে। প্রযোজনায় ছিল দেবশ্রী সমাদ্দার।
একসঙ্গে অনুষ্ঠান করার কত যে গল্প আছে, তার মধ্যে দু’-একটি বলি।
ঋকু দত্ত একবার ঠিক করল যে, আমাদের সংগ্রহে রাখা অর্থাৎ আর্কাইভে থাকা সাদা-কালো যুগের যেসব রেকর্ডিং আছে বিশিষ্ট সংগীত শিল্পীদের, যাঁরা তখন আর আমাদের মধ্যে নেই, তাঁদের নিয়ে অনুষ্ঠান করবে দু’টি পর্বে। একটাতে থাকবেন আধুনিক গানের শিল্পীরা অন্যটায় রবীন্দ্র সংগীতের শিল্পীরা। অনুষ্ঠানের নাম দেওয়া হল ‘পুরানো সেই দিনের কথা’। আধুনিক গানের রেকর্ডিংয়ের মধ্যে ছিল শ্যামল মিত্র, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, জগন্ময় মিত্র, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া গান। রবীন্দ্র সংগীতের শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন– দেবব্রত বিশ্বাস, সুবিনয় রায়, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়, সুপ্রীতি ঘোষ এবং তার সঙ্গে এখানেও ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। শুটিং হয়েছিল আমাদের মেকআপ রুমে, যেখানে কাটত আমাদের অনেক দিন, রাত, সাঁঝের বেলা। মেকআপ শেষ করে আয়নার দিক থেকে ঘুরে ক্যামেরা ফেস করে বলতে শুরু করেছিলাম। ক্যাজুয়াল অ্যাপ্রোচে গল্প করতে করতে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার উজাড় করে দিয়েছিলাম দু’জনে পাশাপাশি বসে। সেই সব ঝরে যাওয়া দিনের সাক্ষী ছিলাম আমরা, সেটাই আমাদের জীবনের অনেক বড় পাওনা।
শাশ্বতীকে সঙ্গে নিয়ে ৯ অগাস্ট জন্মদিনের অনুষ্ঠান করেছি বলতে গেলে প্রায় প্রতি বছর। অনুষ্ঠান যেভাবেই সাজানো হোক না কেন আমাদের উপস্থিতি অপরিহার্য। সেই কারণে এখনও ডাক পড়ে, কখনও দু’জনের কখনও আমি একা। এমনকী, ২০২০-র মহামারীর বছরও আমাকে বাড়ি থেকে বক্তব্য রেকর্ড করে পাঠাতে হয়েছিল।
২০২২-এর ৯ অগাস্ট ‘স্টুডিও এ’-তে, অর্থাৎ বড় স্টুডিওতে, বিরাট সেট পড়ল। একদিকে দুপুর-বিকেলের সমাবেশ যেটির সঞ্চালক আমি, অন্যদিকে সন্ধে-রাতের সমাবেশ যেটির সঞ্চালক স্নেহাশিস শূর। দ্বিতীয়টি মূলত, সংবাদ পাঠক-পাঠিকাদের নিয়ে। সেই আমাদের প্রথম যুগের তরুণ চক্রবর্তী, ছন্দা সেন, দেবরাজ রায় থেকে শুরু করে সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, ইন্দ্রাণী ভট্টাচার্য, ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়রা ছিল। আমার সঞ্চালনা করা অনুষ্ঠানটি ছিল ভিন্ন স্বাদের। দূরদর্শনের সঙ্গে যাঁদের সর্বদা যোগাযোগ এমন নানা ক্ষেত্রের বিশিষ্ট মানুষ এসেছিলেন। নৃত্যশিল্পী অলকানন্দা রায়, অভিনেত্রী মমতা শঙ্কর (নৃত্যশিল্পীও বটে), রবীন্দ্র সংগীতশিল্পী রাজশ্রী ভট্টাচার্য। দূরদর্শনের প্রাক্তন কারিগরি অধিকর্তা উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও উপস্থিত ছিল সুতপা বন্দোপাধ্যায় এবং প্রথম দিনের ঘোষিকা ও প্রযোজক (পরে সহ-অধিকর্তা, অবসর গ্রহণের আগে আর্কাইভ অ্যান্ড মার্কেটিং ডিভিশনের অধিকর্তা) শর্মিষ্ঠা দাশগুপ্ত। নিবেদিতা চক্রবর্তী প্রযোজনায় ছিল। এই পর্ব শুরু করেছিলাম ‘শ্রীময়ী’-র কথা দিয়ে। ফিরে আসি তাতে। রবিবারে এক ঘণ্টার আসর বসত ‘শ্রীময়ী’তে। রঞ্জনা গিরিই ‘ঘরে বাইরে’র সঙ্গে সঙ্গে এটিও প্রযোজনা করত।
………………………………….
ঋকু দত্ত একবার ঠিক করল যে, আমাদের সংগ্রহে রাখা অর্থাৎ আর্কাইভে থাকা সাদা-কালো যুগের যেসব রেকর্ডিং আছে বিশিষ্ট সংগীত শিল্পীদের, যাঁরা তখন আর আমাদের মধ্যে নেই, তাঁদের নিয়ে অনুষ্ঠান করবে দু’টি পর্বে। একটাতে থাকবেন আধুনিক গানের শিল্পীরা অন্যটায় রবীন্দ্র সংগীতের শিল্পীরা। অনুষ্ঠানের নাম দেওয়া হল ‘পুরানো সেই দিনের কথা’। আধুনিক গানের রেকর্ডিংয়ের মধ্যে ছিল শ্যামল মিত্র, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, জগন্ময় মিত্র, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া গান।
………………………………….
দু’টি অনুষ্ঠানের কথা বলব, দু’টিই আলোর দিশারি। প্রথমটির শিরোনাম ‘সাজাও আলোয় ধরিত্রীরে’। দীপাবলিকে উপলক্ষ করে হয়েছিল। চন্দনা চক্রবর্তীর গানে, কথায়, মন্দার মুখোপাধ্যায়ের কবিতা ও কথায় সেদিনটি আলোকোজ্জ্বল ছিল। রবীন্দ্রনাথ যে ‘আপন আলো’র কথা বলেছেন তারই বার্তা ছিল এতে।
অন্য অনুষ্ঠানটির নাম ‘উত্তরণ’। নৃত্যশিল্পী অলকানন্দা রায়, যিনি সংশোধনাগারের ছেলেমেয়েদের আলোর পথ দেখিয়েছেন, তাঁদের জীবনে উত্তরণ ঘটিয়েছেন, সেই আমাদের মুন্নিদি ছিলেন অতিথি। তিনি বলেন, ‘ওদের উত্তরণের সঙ্গে সঙ্গে আমারও উত্তরণ ঘটেছে।’
একটা কথা বলা হয়নি, ‘শ্রীময়ী’ ছিল লাইভ ফোন-ইন অনুষ্ঠান। আগেও হয়তো বলেছি যে, লাইভ অনুষ্ঠান করতে আমার বেশি মজা লাগে, একটা চ্যালেঞ্জ আছে।
‘শ্রীময়ী’তে ‘শুধু যাওয়া আসা’ নামে নববর্ষের আগে যেমন অনুষ্ঠান করেছিলাম তেমনই ‘ঘরে বাইরে’তে করলাম ‘আসা যাওয়ার পথের ধারে’। দু’টি অনুষ্ঠানেই গান গেয়েছিল রঞ্জিনী মুখোপাধ্যায়। প্রথমটিতে মন্দার আর গোপা দত্ত। পরেরটিতে জমিয়ে আড্ডা দিয়েছিলেন সুচিত্রা ভট্টাচার্য।
আবার একটু ‘ঘরে বাইরে’র কথায় ফিরতে ইচ্ছে করছে। এই অনুষ্ঠানের অন্তর্গত একটি পর্ব ছিল ‘আলাপ-পরিচয়’। স্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন জনের সাক্ষাৎকার নিয়েছি এই পর্বে। কবি, প্রাবন্ধিক, গল্পকার, পরিবেশবিদ জয়া মিত্র এসেছেন, এসেছেন সাহিত্যিক সুচিত্রা ভট্টাচার্য, নাট্য ব্যক্তিত্ব সোহাগ সেন। এছাড়া আছে আরও অনেকের সঙ্গে আলাপ-পরিচয়, রীতা ভিমানী, আভেরী চৌরে, শমিতা বসু। বিলেত থেকে পিয়ালী রায়, সঙ্গীতা দত্ত দেশে এলে তাদের।
‘নটী-কথা’ নামে দুই পর্বের অনুষ্ঠানটিও ‘ঘরে বাইরে’র অন্তর্গত। ছিলেন ছন্দা চট্টোপাধ্যায় (তাঁর অভিনীত উৎপল দত্তর ‘টিনের তরোয়াল’-এর ময়নাকে দেখে মুগ্ধ ছিলাম বরাবর), আর ছিল ঈশিতা মুখার্জি, স্বাগতা মুখার্জি ও বিদীপ্তা চক্রবর্তী।
১৫ সেপ্টেম্বর ভারতীয় দূরদর্শনের প্রতিষ্ঠা দিবসে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল রঞ্জনা আর অবশ্যই আমি সঞ্চালনায়। পঙ্কজদা শর্মিষ্ঠাদিকে ডেকেছিলাম। বিষয় ছিল ‘দূরদর্শনের পরম্পরায় নারী’।
দুই প্রিয় মানুষের অবিচুয়ারি প্রোগ্রাম করতে হয়েছে আমাকে। ‘কাছের মানুষ সুচিত্রাদি’, এই স্মরণ অনুষ্ঠানে সুচিত্রাদির মেয়ে মণিকুন্তলা এসেছিল তার ব্যক্তিগত শোকাবস্থাকে পেরিয়ে। ‘হে পূর্ণ তব চরণের কাছে’ নবনীতাদিকে স্মরণ করে। ৭ নভেম্বর চলে গিয়েছিলেন তিনি, আমাকে ৯ তারিখ অনুষ্ঠানটি করতে বলা হয়, আমি একটু সময় চাই নিজেকে সামলে ওঠার এবং ১১ নভেম্বর লাইভ অনুষ্ঠান করি যেখানে এসেছিলেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এবং বাণী বসু।
……………………………. পড়ুন কেয়ার অফ দূরদর্শন-এর অন্যান্য পর্ব ……………………………
পর্ব ২০: রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তির একশো বছর উদযাপন করেছিলাম দূরদর্শন কেন্দ্রে
পর্ব ১৮: হুইল চেয়ারে করে দূরদর্শনে শেষ অভিনয় করতে এসেছিলেন তৃপ্তি মিত্র
পর্ব ১৭: বাংলা টেলিভিশনে সেই প্রথম ‘মা ও মেয়ে’ নিয়ে সিরিজ অনুষ্ঠান
পর্ব ১৬: রবীন্দ্রনাথের স্থাপত্যচিন্তা নিয়ে তথ্যচিত্র সেই প্রথম
পর্ব ১৫: ট্রেনে শুটিং-এর সময় সলিল চৌধুরী গেয়েছিলেন, ‘এই রোকো, পৃথিবীর গাড়িটা থামাও’
পর্ব ১৪: দূরদর্শনের জন্য প্রথম তথ্যচিত্র করা আসলে ছিল অ্যাডভেঞ্চার!
পর্ব ১৩: সেন্ট পল ক্যাথিড্রালকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে সারা দুপুর সাপ্তাহিকীর শুটিং হয়েছিল!
পর্ব ১২: দূরদর্শন ভবনের উদ্বোধনের দিন প্রধানমন্ত্রী স্মিত হাসি নিয়ে তাকিয়ে ছিলেন দুই উপস্থাপকের দিকে
পর্ব ১১: প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আততায়ীর হাতে নিহত, গোলযোগের আশঙ্কায় দূরদর্শনের বাইরের গেটে ঝুলছিল তালা!
পর্ব ১০: সাদা-কালো থেকে রঙিন হয়ে উঠল দূরদর্শন
পর্ব ৯: ফুলে ঢাকা উত্তমকুমারের শবযাত্রার বিরাট মিছিল আসছে, দেখেছিলাম রাধা স্টুডিওর ওপর থেকে
পর্ব ৮: যেদিন বীণা দাশগুপ্তার বাড়ি শুট করতে যাওয়ার কথা, সেদিনই সকালে ওঁর মৃত্যুর খবর পেলাম
পর্ব ৭: ফতুয়া ছেড়ে জামা পরতে হয়েছিল বলে খানিক বিরক্ত হয়েছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস
পর্ব ৬: ভারিক্কিভাব আনার জন্য অনন্ত দাস গোঁফ এঁকেছিলেন অল্পবয়সি দেবাশিস রায়চৌধুরীর মুখে
পর্ব ৫: দূরদর্শনে মান্য চলিত ভাষার প্রবর্তক আমরাই
পর্ব ৪: রবিশঙ্করের করা দূরদর্শনের সেই সিগনেচার টিউন আজও স্বপ্নের মধ্যে ভেসে আসে
পর্ব ৩: অডিশনের দিনই শাঁওলী মিত্রের সাক্ষাৎকার নিতে হয়েছিল শাশ্বতীকে!
পর্ব ২: স্টুডিওর প্রবল আলোয় বর্ষার গান গেয়ে অন্ধকার নামিয়ে ছিলেন নীলিমা সেন
পর্ব ১: খবর পেলাম, কলকাতায় টেলিভিশন আসছে রাধা ফিল্ম স্টুডিওতে
এবার রুশিদের দাবি সোভিয়েত ইউনিয়নকে অক্ষুণ্ণ, অটুট রাখার উদ্দেশ্যে ১৯৯১ সালের ১৯ থেকে ২১ আগস্ট কমিউনিস্টদের যে-অভ্যুত্থান ঘটেছিল, সেই উপলক্ষে ২১ আগস্ট ‘অভ্যুত্থান’ ব্যর্থ হওয়ার দিনটিকেই পালন করা হোক ‘জাতীয় উৎসব’ হিসেবে।