২০১৩ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের ‘prohibition of employment as manual scavengers and their rehabilitation act’-এর আওতায় যে নিয়মগুলো নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়, সেখানে বলা হচ্ছে যে নিযুক্ত সাফাই কর্মীদের ত্বকের কাছাকাছি যেন কোনও রকম ক্ষতিকারক গ্যাস বা রাসায়নিক দ্রব্য আসতে না পারে। ভয়ংকর কোন অসুখ, শ্বাসকষ্ট বা sensory disease থেকে বাঁচাতে হবে তাদের। কোন সেপটিক ট্যাঙ্ক বা নর্দমায় ঢুকে কাজ করার সময় এয়ার কম্প্রেসার, air breathing-এর যন্ত্র, gas mask, full body suit ইত্যাদি জিনিস বাধ্যতামূলকভাবে সঙ্গে রাখতে হবে। ২ ফেব্রুয়ারির কলকাতার ঘটনায় একজন ঠিকাদারের খোঁজ পাওয়া গিয়েছে যিনি এই তিনজন সাফাই কর্মীকে কাজে লাগিয়েছিলেন এবং স্বাভাবিকভাবেই দুর্ঘটনার পরে তিনি নিখোঁজ।
‘নীলকণ্ঠ করেছেন পৃথ্বীরে নির্বিষ,
আর তুমি? তুমি তারে করেছ নির্মল।
এসো বন্ধু, এসো বীর, শক্তি দাও চিতে,
কল্যাণের কর্ম করি, লাঞ্ছনা সহিতে।’
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বিশ শতকের প্রথম দশকে এই কবিতাটি লিখেছিলেন শিবের সঙ্গে মেথরদের তুলনা করে। শিব গরল পান করে পৃথিবীকে করেছেন বাসযোগ্য, তেমনই মেথররা বীর, বিষের ন্যায় বর্জ্য ধারণ করেও আদায় করতে পারেননি ভদ্রবিত্তের অনুকম্পা। প্রশ্ন জাগে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে মেথর বা শহরের বুকে মলমূত্র সাফাইকর্মীদের শুধু দেবচরিত্রে উন্নীত করলে চলবে কী? বীর, বন্ধু, নীলকণ্ঠী এই সকল অভিধার পরেও যা ভাবায় তা হল, গোটা দেশে ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও, আইনবিরুদ্ধ ভাবে তার ব্যাপকতা এবং সাফাইকর্মীদের ধারাবাহিক মৃত্যুর পরিসংখ্যান। ২৯ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট জানায় যে, ভারতের অন্তত ছয়টি মেট্রোপলিটন শহরে ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং একেবারে নিষিদ্ধ করতে হবে এবং তার তিনদিনের মধ্যেই কলকাতায় তিন ব্যক্তি মারা গেলেন লেদার কমপ্লেক্সের ম্যানহোলে তলিয়ে গিয়ে। ক্ষতিপূরণ ঘোষিত হয়েছে ১০ লক্ষ টাকা। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য ২০১৩ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের ‘prohibition of employment as manual scavengers and their rehabilitation act’-এর আওতায় যে নিয়মগুলো নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়, সেখানে বলা হচ্ছে যে নিযুক্ত সাফাই কর্মীদের ত্বকের কাছাকাছি যেন কোনও রকম ক্ষতিকারক গ্যাস বা রাসায়নিক দ্রব্য আসতে না পারে। ভয়ংকর কোন অসুখ, শ্বাসকষ্ট বা sensory disease থেকে বাঁচাতে হবে তাদের। কোন সেপটিক ট্যাঙ্ক বা নর্দমায় ঢুকে কাজ করার সময় এয়ার কম্প্রেসার, air breathing-এর যন্ত্র, gas mask, full body suit ইত্যাদি জিনিস বাধ্যতামূলকভাবে সঙ্গে রাখতে হবে। যেই সরকারি কর্মচারী এই কাজে সাফাই কর্মীদের নিযুক্ত করছেন তাঁদের সমস্ত প্রোটেকটিভ গিয়ার এবং সেগুলি আদৌ ঠিকমতো কাজ করছে কি না, তা তদারকি করতে হবে। ২ ফেব্রুয়ারির কলকাতার ঘটনায় একজন ঠিকাদারের খোঁজ পাওয়া গিয়েছে যিনি এই তিনজন সাফাই কর্মীকে কাজে লাগিয়েছিলেন এবং স্বাভাবিকভাবেই দুর্ঘটনার পরে তিনি নিখোঁজ। ২০১৩ সালের ভারতীয় আইন এটাও বলে এই প্রকার কাজ শুরু করার আগে পার্শ্ববর্তী এলাকার হাসপাতাল বা ক্লিনিকের ফোন নম্বর, ঠিকানা জোগাড় করে রাখতে হবে আগাম সতর্কতা মেনে। এমনকী, সাফাই কর্মীদের নিয়মিত টিকা দেওয়া, শারীরিক পরীক্ষা, বিশেষ করে রেসপিরেটরি অর্গান পরীক্ষা করা বাধ্যতামূলক।
২০১৩-র পরে ২০২৩ সালে ‘NAMASTE’ বা ‘National action for mechanised sanitation ecosystem’ স্কিম চালু করে কেন্দ্রীয় সরকার, যার লক্ষ্য ছিল আগামীদিনে একজন সাফাই কর্মীও যাতে প্রাণ না হারান, তা সুরক্ষিত করা। জীবন বিমা ১০ লক্ষ থেকে ৩০ লক্ষ করার কথাও বলা হয়। এরপরেই ২০২৫-এ, ২৯ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট জানায় যে, মেট্রোপলিটন শহর যেমন দিল্লি, মুম্বই, চেন্নাই, কলকাতা, বেঙ্গালুরু এবং হায়দরাবাদে কোনও ভাবেই শহরের নর্দমা পরিষ্কার করার জন্য সাফাই কর্মীদের নিযুক্ত করা যাবে না। উক্ত শহরগুলিকে ১৩ ফেব্রুয়ারির মধ্যে এফিডেভিট জমা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, তার ঠিক ১১ দিন আগে কলকাতার এই দুর্ঘটনা শহরের বহু শতকব্যাপী চলে আসা ম্যাথর বা সাফাই কর্মীদের দুর্দশার ইতিহাসের জানান দেয়।
১৮৬৩ সালে ঔপনিবেশিক কলকাতায় ‘স্ক্যাভেঞ্জিং’ নিয়ে জারি হয়েছিল আইন। তখনকার বাংলায় চন্ডালরা রাস্তা, বাড়ি এমনকী, জেলখানার মলমূত্র পরিষ্কার করার দায়িত্বে থাকতেন। আমাদের দেশে জাতপাত এবং সাফাইয়ের কাজ একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সমাজে অন্তজ শ্রেণিরাই বংশ পরম্পরায় মলমূত্র সাফ করবেন– এই রীতি ভেঙে ঔপনিবেশিক শাসকরা নিজস্ব আইন বলবৎ করেন। জাতপাতভিত্তিক কাজের পরিবর্তে মিউনিসিপ্যালিটি নিযুক্ত করবে সাফাইকর্মচারী, এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলেন উনিশ শতকের মেথররা। নিজেদের কাস্ট অকুপেশন বা জাতপাত নির্দিষ্ট কাজ যদি খোয়াতে হয়, হঠাৎ করে তাহলে খাবে কী তারা? অন্য কোন কাজ তাদের পেটে ভাত জোগাবে? পরীক্ষিত ঠাকুর গবেষণা করেছেন ঔপনিবেশিক কলকাতার ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জারদের ধর্মঘট, রাজনৈতিক চেতনা, পারিশ্রমিক আদায়ের ইতিহাস নিয়ে। C Furedy ১৯৮৪ সালে কলকাতার সাফাই কর্মীদের নিয়ে একটি জার্নালে লিখছেন যে, কলকাতার বিভিন্ন কারখানা এবং মেথরদের মধ্যে এক চিরাচরিত সম্পর্ক আছে। খুব কম টাকায় বর্জ্য পদার্থ সাফ করিয়ে নেওয়ার জন্য এই স্ক্যাভেঞ্জাররা একপ্রকার শ্রম দিতে বাধ্য হয়। এখনও যে দলিত শ্রেণির সঙ্গে শহরের পয়প্রণালী পরিষ্কার করার মতো কাজের গভীর সংযোগ রয়েছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। একুশ শতকে বেসরকারি কর্পোরেট কোম্পানির রাজত্বে স্বল্পমূল্যে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়েস্ট পরিষ্কার করিয়ে নেওয়ার মতো ঘটনা অহরহ হয়ে থাকে। লেদার কমপ্লেক্সের এই দুর্ঘটনা সেই বিষয়কে মান্যতা দেয়। শ্রমিক দিয়ে শহরগুলোর রাস্তার নিচের নর্দমা পরিষ্কার করানোর ব্যবস্থাকে কিছু বছর আগে সুপ্রিম কোর্ট ‘গ্যাস চেম্বারে মরতে পাঠানোর’ সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। ২০২১ সালে গৌতম ঘোষের প্রযোজনায় (ঈশান ঘোষের পরিচালনায়) ‘ঝিল্লি’ সিনেমাটির কথা এখানে মনে পড়ে। বকুল একজন ফোর্থ জেনারেশন স্ক্যাভেঞ্জার, যে বেড়ে উঠেছে কলকাতার ধাপা অঞ্চলে। চলচ্চিত্র সমালোচকরা এটিকে একটি ‘ডিসটোপিয়ান প্লট’ বলেছিলেন, মনে রাখা প্রয়োজন আমরা প্রত্যেকেই সেই ডিসটোপিয়ার অংশ। কলকাতার মতো মহানগরে কলেজে বিয়ের নাটক, সরস্বতী পুজো, আরও কত প্রয়োজনীয় বিষয় নিয়েই তো জনরোষ তৈরি হয়! কেবল হয় না তথাকথিত শীলিত সমাজের চোখে ‘নিচু’ জাতের, নিম্নবিত্তের তিনজন সাফাই কর্মীর মৃত্যু নিয়ে ক্ষোভ, এটা কি ডিসটোপিয়া নয়?