এই শতকের সূচনায় সন্জীদা খাতুন ফিরে এসেছিলেন শান্তিনিকেতনে। গবেষণার বিষয় করলেন রবীন্দ্রসংগীতের স্বরলিপির ইতিবৃত্তকে। তখন তাঁর অবস্থান পূর্বপল্লীর পঞ্চবটি বাসগৃহে। সেই একই জীবনযাপন। সারাদিন গবেষণার কাজে রবীন্দ্রভবন গ্রন্থাগারে অথবা কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকা আর বিকালে গান গাইতে বসা। তাঁর গুণমুগ্ধ প্রিয়জনেরা আসতেন তাঁর কাছে– বিশুদ্ধ উচ্চারণে গান শুনতে, তাঁর কথা শুনতে। কানাই সামন্ত, সত্যেন্দ্রনাথ রায়, সুতপা ভট্টাচার্য, শান্তা ভট্টাচার্য, সতীন্দ্র ভৌমিক, জয় চট্টোপাধ্যায়, রজত মিশ্র, শ্যামলী খাস্তগীর আরও অনেকে। আমার ভূমিকা ছিল তাঁর কাছাকাছি থাকা, আর তাঁর যে-কোনও কাজে লাগতে পারা। ২৫ মার্চ সন্জীদা খাতুনের প্রয়াণে বিশেষ লেখা।
আটের দশকের প্রথম ভাগ। শান্তিনিকেতন পূর্বপল্লির ‘পলাশ’ বাড়ি। শ্যামলী খাস্তগীর পরিচয় করিয়ে দিলেন তাঁর মিনু আপার সঙ্গে। নিরাভরণ দোতলার ঘরখানা। পশ্চিমের বড় জানলা খোলা, সূর্য অস্তমিত হচ্ছে। ছোট্ট হারমোনিয়ামটি সামনে রেখে তিনি গাইছেন– ‘সন্ধ্যা হল গো ও মা, সন্ধ্যা হল বুকে ধরো/ অতল কালো স্নেহের মাঝে ডুবিয়ে আমায় স্নিগ্ধ করো।’ বিশুদ্ধ উচ্চারণের ধ্বনিমাধুর্যে ছন্দিত হয়ে উঠছে তাঁর স্বরতন্ত্রী। মধ্যবয়সিনী সেই নারীর কণ্ঠ-মহিমায় সেদিনই নিমগ্ন হতে পেরেছিলাম, হতে পেরেছিলাম তাঁর স্নেহ ও সান্নিধ্যে ধন্য।
রবীন্দ্র-অনুরাগী, নজরুলের বন্ধু, সুপণ্ডিত মোতাহার হোসেনের কন্যা সন্জীদা শান্তিনিকেতনে স্নাতকোত্তর স্তরের পড়াশোনা করতে এসেছিলেন তাঁর পিতার আগ্রহে। অধ্যাপক প্রবোধ সেনের সুযোগ্য ছাত্রী। এমএ ক্লাসে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ওপর যে গবেষণাপত্রটি রচনা করলেন– ভবিষ্যতে তা হয়ে উঠল স্নাতকোত্তর স্তরের পাঠ্য। বাংলাদেশ তখন পূর্ব পাকিস্তান, ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষিতে জাতির জীবনে স্বাধীনতার বীজটি সঞ্জীবিত হয়েছে। ঘর বাঁধলেন ওয়াহিদুল হকের সঙ্গে, যিনি ওপার বাংলার সাংবাদিকতা ও রবীন্দ্রসংগীতের প্রচার ও প্রসারের পথিকৃৎ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপিকার পদে যোগদান করেছেন। গড়ে তুলেছেন ‘ছায়ানট’। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রবাহটিকে তীব্রতর করেছেন রবীন্দ্রনাথকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে।
এল একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ। বাংলা ভাষার জন্য, বাঙালির সংস্কৃতির জন্য এবং বাংলার মানুষের একান্ত প্রার্থিত স্বদেশের স্বাধীনতার জন্য রক্তাক্ষয়ী সংগ্রাম এনে দিল স্বাধীনতা। স্বাধীন দেশে স্বাধীনতার বাণীবহ সন্জীদার মূল মন্ত্র হল অধ্যাপনার পাশাপাশি রবীন্দ্রচর্চার প্রগাঢ় অন্বেষণ অব্যাহত রাখা। বেগম সুফিয়া কামালের সভাপতিত্বে গঠিত হয়েছে জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত পরিষদ, যাঁদের কাজ সারা দেশব্যাপী রবীন্দ্রসংগীতের প্রবাহকে জাতির হৃদয়ে পৌঁছে দেওয়া। পাশাপাশি রবীন্দ্রচেতনায় জাতিকে উজ্জীবিত করার কাজ।
……………………………………………..
সন্জীদা খাতুন নিয়ে আরও একটি প্রয়াণলেখ: রবীন্দ্রনাথের গানের প্রচলিত পর্যায় বিভাগকেই প্রশ্ন করেছিলেন সন্জীদা খাতুন
……………………………………………..
শান্তিনিকেতনে সাতের দশকে সন্জীদা গবেষণা করলেন। প্রকাশিত হল ‘রবীন্দ্রসংগীতের ভাবসম্পদ’ গ্রন্থ। আটের দশকের সূচনায় সন্জীদা আবার শান্তিনিকেতনে। তাঁর ডি. লিটের গবেষণার বিষয় ধ্বনি থেকে কবিতা। অসাধারণ বাগ্মিতায় ও যুক্তির নিপুণতায় তুলে ধরলেন রবীন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, শঙ্খ ঘোষের কবিতায় কী করে ধ্বনির বৈচিত্রে কবিতার নির্মাণ তার বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টান্ত। রবীন্দ্র পুরস্কার লাভ করলেন এই গ্রন্থটির জন্য। আমার সৌভাগ্য এই গ্রন্থটির নির্মাণ পর্বে আমি তাঁর সান্নিধ্যে থেকেছি। তাঁরই সংস্পর্শে পরিচিত হয়েছি অম্লান দত্ত, সত্যেন্দ্রনাথ রায়, সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়, নরেশ গুহ প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে। ততদিনে হয়ে উঠেছি তাঁর পরিবারের আপনজন। শান্তিনিকেতনে এবং ঢাকায় তাঁর পরিবারে এবং ছায়ানটের বৃহত্তর পরিবারে দেখেছি তাঁর কর্মকাণ্ড। কী অবিচল নিষ্ঠায় রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি, অতুলপ্রসাদী কিংবা রজনীকান্ত, দ্বিজেন্দ্রলাল প্রমুখের সংগীতের চর্চায় সমৃদ্ধ করছেন সমগ্র বাংলাদেশের ছাত্রছাত্রীদের।
এই শতকের সূচনায় আবার এলেন শান্তিনিকেতনে। এবার গবেষণার বিষয় রবীন্দ্রসংগীতের স্বরলিপির ইতিবৃত্ত। তখন তাঁর অবস্থান পূর্বপল্লীর পঞ্চবটি বাসগৃহে। সেই একই জীবনযাপন। সারাদিন গবেষণার কাজে রবীন্দ্রভবন গ্রন্থাগারে অথবা কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকা আর বিকালে গান গাইতে বসা। তাঁর গুণমুগ্ধ প্রিয়জনেরা আসতেন তাঁর কাছে– বিশুদ্ধ উচ্চারণে গান শুনতে, তাঁর কথা শুনতে। কানাই সামন্ত, সত্যেন্দ্রনাথ রায়, সুতপা ভট্টাচার্য, শান্তা ভট্টাচার্য, সতীন্দ্র ভৌমিক, জয় চট্টোপাধ্যায়, রজত মিশ্র, শ্যামলী খাস্তগীর আরও অনেকে। আমার ভূমিকা ছিল তাঁর কাছাকাছি থাকা, আর তাঁর যে-কোনও কাজে লাগতে পারা।
বেশ মনে পড়ে, পয়লা বৈশাখ রমনার বটবৃক্ষমূলের সম্মেলনে বিস্ফোরণ ঘটেছিল। কেউ নিহত না-হলেও সাংস্কৃতিক কর্মযজ্ঞে এমন আক্রমণের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন স্পষ্ট ভাষায়। শান্তিনিকেতনে তাঁর নেতৃত্বে আমরাও সমবেত হয়ে প্রতিবাদ করেছি। ব্যক্তিত্বের যে প্রবল আগুন তাঁর মধ্যে ছিল, তা ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন উত্তরসূরিদের মধ্যে।
আরেকটি ঘটনা। ২০১২ সালে শান্তিনিকেতনে ‘দেশিকোত্তম’ গ্রহণের আগের দিন, কথা দিয়েছিলেন আমাদের চতুর্দশী সাহিত্য সভার আসরে আসবেন, তাঁর অনুগামী ছায়ানটের সদস্যদের নিয়ে। তাই রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধীর সঙ্গে নৈশভোজের সময় পিছিয়ে দিয়ে আমাদের মাঝে এসেছিলেন!
তাঁকে ঘিরে স্মৃতির সম্ভার শেষ হওয়ার নয়। অসামান্য এই নারী ব্যক্তিত্বের উদ্দেশে আমার অশেষ শ্রদ্ধা প্রণাম নিবেদন করি এই স্মৃতিচারণায়।
…………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………..