অলিম্পিকে নাদিমের বিশ্বরেকর্ড গড়ে সোনা জয়ের পর পাকিস্তানে নাদিমের মা এবং এদেশে নীরজের মায়ের স্টেটমেন্ট সম্প্রীতির ফলক হিসেবে এসে গিয়েছিল লাইমলাইটে। তাই, নাদিমকে আমন্ত্রণ জানানো নীরজের জন্য অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা। এখানে পাকিস্তানি নাদিম নয়, বরং অনেক বেশি করে বন্ধু নাদিমকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন নীরজ। এখানেই সংঘাত, নীরজ এখানে ব্যক্তিগত স্তরে উগ্র জাতীয়তাবাদের হাতুড়ির ঘা খেয়েছেন, ব্যক্তিগত পরিসরে এসে পড়েছে বিভেদের আগুন। এই জায়গায় অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে রবীন্দ্রনাথের চেতনা। ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে সন্দীপ ও নিখিলেশের চরিত্রর সৃজনে তিনি স্পষ্ট করে দিচ্ছেন দু’টি সত্য। এক, দেশপ্রেম ও জাতীয়তবাদের প্রকৃষ্ট চরিত্র আবহমান ধরেই প্রাসঙ্গিক, দেশ-কাল ভেদে এই জাতীয়তাবাদের উগ্রতার তারতম্য হয় কেবল। আর দুই, এই জাতীয়তাবাদী ভাবনার বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে থাকে মানুষ– যে মানুষ এবং তাঁর স্বাভাবিক জীবনচর্যাকে বাদ দিয়ে দেশ গড়ে উঠতে পারে না।
‘নীরজ চোপড়া ক্লাসিকস’– বিষয়টির সঙ্গে কিঞ্চিৎ পরিচিত আমরা সকলেই। ভারতের ক্রীড়া ইতিহাসের সম্ভবত সবচেয়ে সফল অ্যাথলিট নীরজ চোপড়ার নামে এই প্রতিযোগিতা আগামী মাসে আয়োজিত হতে চলেছে বেঙ্গালুরুতে। তার চেয়েও মজার বিষয় হল, এই প্রথমবার ভারতের ক্রীড়া ইতিহাসে কোনও জীবিত অ্যাথলিটের নামে একটি সম্পূর্ণ প্রতিযোগিতার আয়োজন হচ্ছে, শুধু জীবিত না, মাত্র ২৭ বছর বয়সে নীরজের যা অর্জন, তাঁকে সম্মান জানিয়েই এই প্রতিযোগিতার ভাবনা।
এই প্রতিযোগিতাতেই কিছুদিন আগে নীরজ আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন বিশ্বরেকর্ড করে সোনা জেতা তাঁর অলিম্পিকের প্রতিযোগী পাকিস্তানের জ্যাভলিন থ্রোয়ার আরশাদ নাদিমকে। পহেলগাঁও-এর বৈসরণে ইসলামিক সন্ত্রাসবাদীদের হাতে পর্যটক হত্যার ঘটনার পর যখন ভারত সরকার পাকিস্তানিদের এদেশে আগমন বন্ধ করল, তখন নীরজ জানালেন এই আবহে নাদিমের আসার প্রশ্নই নেই, কিন্তু তারপরেও নাদিমকে আমন্ত্রণ করা নিয়ে একের পর এক আক্রমণ ধেয়ে এল দেশের হয়ে অলিম্পিকে সোনাজয়ী অ্যাথলিটের দিকে। যেন পাকিস্তানি নাদিমের নীরজের বন্ধু হওয়াটাই নীরজের পক্ষে একটা গর্হিত অপরাধ!
পহেলগাঁও-এর ঘটনার পর যেমন একের পর এক ন্যারেটিভ প্রকট হয়ে উঠল দেশে, যেমন মুসলিম মাত্রই সম্ভাব্য সন্ত্রাসবাদী, কিংবা কাশ্মীরিরা পাকিস্তানের পক্ষে, এমনকী পাড়ায় পাড়ায় মুসলিম কাশ্মীরি দেখামাত্রই লিঞ্চিং-এর মতো ঘটনাও ঘটল; এই আবহে নীরজ চোপড়াও বাদ গেলেন না।
কিন্তু কেন এই দ্বেষ? ইসলামিক মৌলবাদ সারা দুনিয়ার কাছে থ্রেট একথা তো নতুন নয়; কিন্তু এদেশে ধারাবাহিকভাবে যে বিদ্বেষ সৃষ্টিকারী আখ্যানের জন্ম দেওয়া হচ্ছে, তার রোষ থেকে বাদ পড়ছেন না কেউই।
কাশ্মীরিদের সামগ্রিকভাবে সন্ত্রাসবাদী হিসেবে দেগে দেওয়ার পিছনে সুস্পষ্টভাবেই রয়েছে দেশে ইসলামোফোবিয়ার আগুনে ঘৃতাহুতির একটি সূক্ষ্ম প্রচেষ্টা। সারাদেশে, এমনকী এই শহরের বুকেও পুলওয়ামা কিংবা বৈসরণের সাম্প্রতিক ঘটনার পরে কাশ্মীরি শালওয়ালাদের ওপর অত্যাচারের ঘটনা অত্যন্ত পরিচিত। বৈসরণের ইসলামি সন্ত্রাসবাদীদের আক্রমণের পর, সামাজিক মাধ্যমে শ্রীনগরের জনতার শান্তিমিছিল নিয়ে ধেয়ে এসেছে কটাক্ষ। অথচ, এই বুদবুদ ভেদ করে কাশ্মীরের জনতার ওপর ২০০৮ সালে হওয়া চ্যাথাম হাউসের সমীক্ষাটির দিকে তাকালে পরিষ্কার হয়ে যায়, কীভাবে গত ১০ বছরে কাশ্মীরি জনতাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে দেগে দিয়ে রাজনৈতিক মুনাফা তোলার বেসাতি করে গেছে কিছু মানুষ। কী বলছে এই সমীক্ষা?
ভারতের অধীনে থাকা কাশ্মীরের ভূখণ্ডের মধ্যে জম্মু ডিভিশনে মাত্র ১% লোক স্বাধীন বা মুক্ত কাশ্মীরের পক্ষে, লেহ-তে এই সংখ্যাটি ৩০% এবং কার্গিলে ২০%। লাইন অফ কন্ট্রোল বরাবর একটি বৃহৎ স্যাম্পেল সাইজের ওপর সমীক্ষা করে যে ফলাফল এসেছে তা-ও আশ্চর্যজনক। ২৮% মানুষ ভারতের পক্ষে, ভারতের অংশ হিসেবে থাকতে চান, মাত্র ১% মানুষ পাকিস্তানের পক্ষে। লাইন অফ কন্ট্রোল বরাবর বসবাসকারী ৭৪% মানুষ মনে করেন পাকিস্তানি সেনা মোতায়েন তুলে নেওয়া হলে শান্ত হবে কাশ্মীর, যা সরাসরি ভারতের পক্ষে অবস্থান।
আরেকটি তথ্যের দিকেও নজর দেওয়া আশু প্রয়োজন, ভারত সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা কাশ্মীর ভূখণ্ডের মোট জনতার ৬৯%-এরও বেশি মুসলিম ধর্মাবলম্বী; তাই সারা দেশে যে অতি সরলীকরণ তত্ত্ব চলে, অর্থাৎ কাশ্মীরি মুসলমানরা পাকিস্তানের পক্ষে, কিংবা সব কাশ্মীরিরা আজাদ কাশ্মীরের পক্ষে– তা নেহাতই রাজনৈতিক স্বার্থে বানিয়ে তোলা ন্যারেটিভ, এ নিয়ে সংশয় থাকা উচিত নয়। আরেকটি বিষয়ে নজর রাখা প্রয়োজন, আর্টিকেল ৩৭০ তুলে দেওয়ার পর হিন্দুত্ববাদীদের দাবি ছিল যে, কাশ্মীরি পণ্ডিতরা ফের কাশ্মীরে ফিরে যেতে পারবেন, অথচ দেশের শাসকদল বিজেপির ২০২৪ সালের ম্যানিফেস্টোতে কাশ্মীরে, কাশ্মীরি পণ্ডিতদের ফিরিয়ে আনার বিষয়ে কিছুই উল্লেখ করা হয়নি। একটি তথ্য প্রচার করা হয়েছে গত এক বছরে যে, কাশ্মীরে ৩০,০০০ কাশ্মীরি পণ্ডিত ফিরে এসেছেন, কিন্তু এই তথ্য যে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত, তা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন কাশ্মীরি পণ্ডিত সংঘর্ষ সমিতির সক্রিয় সদস্য সঞ্জয় টিকু।
তাহলে দেশপ্রেমের নামে যে উগ্র জাতীয়তাবাদের বীজ বুনে দেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে, সারা দেশজুড়ে, সেই প্রবল স্রোতের বিপ্রতীপে নীরজ চোপড়ার এসে পড়া কি নেহাতই আকস্মিক? যেখানে ভারতের অধিকাংশ ক্রিকেটার-ফুটবলার-অ্যাথলিটদের সাম্প্রতিক অতীতে বারবার দেখা গেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যুতে কূটনৈতিক অবস্থান নিতে, সেখানে নীরজ কি খুব স্বেচ্ছায় বিপ্রতীপ অবস্থানে দাঁড়ালেন? সম্ভবত না।
আরশাদ নাদিমের সঙ্গে তাঁর সখ্য সর্বজনবিদিত। অলিম্পিকে নাদিমের বিশ্বরেকর্ড গড়ে সোনা জয়ের পর পাকিস্তানে নাদিমের মা এবং এদেশে নীরজের মায়ের স্টেটমেন্ট সম্প্রীতির ফলক হিসেবে এসে গিয়েছিল লাইমলাইটে। তাই, নাদিমকে আমন্ত্রণ জানানো নীরজের জন্য অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা। এখানে পাকিস্তানি নাদিম নয়, বরং অনেক বেশি করে বন্ধু নাদিমকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন নীরজ। এখানেই সংঘাত, নীরজ এখানে ব্যক্তিগত স্তরে উগ্র জাতীয়তাবাদের হাতুড়ির ঘা খেয়েছেন, ব্যক্তিগত পরিসরে এসে পড়েছে বিভেদের আগুন। এই জায়গায় অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে রবীন্দ্রনাথের চেতনা। ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে সন্দীপ ও নিখিলেশের চরিত্রর সৃজনে তিনি স্পষ্ট করে দিচ্ছেন দু’টি সত্য। এক, দেশপ্রেম ও জাতীয়তবাদের প্রকৃষ্ট চরিত্র আবহমান ধরেই প্রাসঙ্গিক, দেশ-কাল ভেদে এই জাতীয়তাবাদের উগ্রতার তারতম্য হয় কেবল। আর দুই, এই জাতীয়তাবাদী ভাবনার বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে থাকে মানুষ– যে মানুষ এবং তাঁর স্বাভাবিক জীবনচর্যাকে বাদ দিয়ে দেশ গড়ে উঠতে পারে না। দেশের সীমানাকে কাঁটাতারের বদলে মানুষের মনের গণ্ডি দিয়ে মাপতে চাইছেন রবীন্দ্রনাথ। ‘ন্যাশনালিজম ইন দ্য ওয়েস্ট’ বক্তৃতায় তিনি বলছেন অবশিষ্ট পৃথিবীর দুর্বলতার সুযোগে ফুলে ফেঁপে ওঠা, এবং প্রতিবেশী সমাজগুলিকে গ্রাস করাই ‘নেশন’ বা ‘জাতি’-র একমাত্র বাসনা হয়ে পড়ছে– এতেই জন্ম নিচ্ছে পারস্পরিক ঈর্ষা ও আতঙ্ক।
‘For then it goads all its neighbouring societies with greed of material prosperity , and consequent mutual jealousy, and by the fear of each other’s growth into powerfulness.’ (Rabindranath Tagore, Nationalism in the West)
এখানে আরেকটি জরুরি প্রশ্ন হল, আরশাদ নাদিমকে আমন্ত্রণের জন্য যে সাধারণ ভারতীয়রা নীরজকে অশ্রাব্য গালিগালাজ করছেন, নীরজের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, তাঁরা দেশের গৌরবের প্রশ্নে নীরজের কৃতিত্বের সিকিভাগ অর্জনও করে উঠতে পারেননি, একথা যেমন ঠিক, তেমনই এই ভারতের নাগরিক হিসেবে মতামত দেওয়ার অধিকার যতখানি নীরজের, ততখানি তাঁদেরও, একথাও সত্যি; কিন্তু কেন যুক্তিসম্মত মতামতের বদলে তাঁদের মনে এসে পড়ছে এই তীব্র দ্বেষ? ‘বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য’ ধারণার দেয়ালে এই তীব্র জাতীয়তাবাদী বিবমিষা? খুব গভীরে গিয়ে দেখলে দেখা যাবে গত এক-দেড় দশক ধরে ভারতের জাতীয়তাবাদী ধারণায় একাধিক ফ্যাক্টরের মধ্যে একটি ফ্যাক্টর হল, বলিউডে তৈরি হওয়া কিছু ছবি যা বাস্তব ইতিহাস বিচ্যুত এবং সরাসরি বিভাজনের রাজনীতির সপক্ষে কথা বলে। ভারতের মতো দেশে, যেখানে কয়েক হাজার বছর ধরে একাধিক বিদেশি শক্তির আগমন ও সাম্রাজ্য বিস্তারের ধারাবাহিক ইতিহাস রয়েছে, সেখানে ইতিহাস-নির্ভর ছবির ক্ষেত্রে ইতিহাস বিচ্যুতি কিংবা সামাজিক ইস্যু নিয়ে ছবি করার ক্ষেত্রে তথ্য বিকৃতি যে জনমানসে বিপুল প্রভাব ফেলতে পারে, তা নিশ্চিতভাবেই জানেন ছবি নির্মাতারা। তারপরেও ‘ছাবা’ কিংবা ‘উড়ি: দ্য সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ কিংবা ‘দ্য কেরালা স্টোরি’র মতো ছবি নির্মিত হচ্ছে এবং এর প্রভাবে আড্রিনালিন রাশ বাড়ছে সাধারণ জনতার মনে।
‘উড়ি: দ্য সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ ছবিটি যখন ২০১৯ সালে রিলিজ করে সে সময়ে ছবিটি ব্যাপক সাড়া ফেলে সারা দেশে, অথচ বিবিসি-র রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৬ সালে উড়িতে ভারতীয় সেনার বেসক্যাম্পে আক্রমণের প্রত্যুত্তরে যে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করেছিল ভারত তাতে ভারতীয় সেনা নিশ্চিতভাবে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর সীমানায় প্রবেশ করেছিল, কিন্তু যে ক্ষয়ক্ষতি তাঁরা পাকিস্তানি সেনা ঘাঁটিতে করেছে বলে সারা দেশে প্রচারিত হয়েছে, তা অতিরঞ্জিত, অপপ্রচার।
‘দ্য কেরালা স্টোরি’র মতো ছবির ক্ষেত্রে ঘটেছিল আরও বড় তথ্যগত ভ্রান্ত ধারণার প্রচার। ছবির গল্প অনুযায়ী ৩২০০০ অ-মুসলিম মেয়েকে এ গল্পের উপজীব্য ধরা হয়, যাঁদের ধর্মান্তরিত করে আইসিস-এর হয়ে যুদ্ধের জন্য মধ্যপ্রাচ্যে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অথচ, এই ৩২০০০ সংখ্যাটি নিয়ে যখনই প্রবল আলোচনা শুরু হয়, সঙ্গে সঙ্গে সংখ্যাটি নেমে আসে ৩-এ। কিন্তু ততদিনে বড় সংখ্যক মানুষের মনে গেঁথে গেছে ভ্রান্ত ধারণা।
একইভাবে ‘ছাবা’ ছবিতে শম্ভাজী ও মারাঠা সাম্রাজ্যের প্রকৃত ইতিহাসের তোয়াক্কা না করে বহু কাল্পনিক গল্পের আশ্রয় নিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে এক ন্যারেটিভ, যেখানে মোগল সাম্রাজ্যের একমাত্র অবদান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা হয়েছে ঔরঙ্গজেবের অত্যাচারকেই। এই সিনেমার প্রভাব এমনই যে সিনেমা হলে শম্ভাজীর পোশাকে ঘোড়া নিয়ে ঢুকে পড়া কিংবা সিনেমাহলের পর্দা কেটে দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটল। তাই দিনের পর দিন ভারতের সাধারণ জনতার মনে ধারাবাহিকভাবে যে তীব্র জাতীয়তাবাদী ধারণা গড়ে তোলা হয়েছে, সেই ধারণা অন্ধের মতো আক্রমণ করতে শেখায় দেশের হয়ে অলিম্পিকে সোনা এনে দেওয়া কিংবদন্তিকেও।
ময়দানের ভেতরে, প্রতিদ্বন্দ্বিতা কিংবা প্রতিযোগিতার যে টানটান মুহূর্ত, সে মুহূর্তে দিনের শেষে করমর্দনে এসে শেষ হওয়ার কথা, ময়দানের বাইরে রাজনীতির অঙ্গনে সে করমর্দন বদলে গেছে তর্জনী উঁচিয়ে রাখা হুংকারে। খেলার স্পিরিট যেখানে ‘নীরবে নিভৃতে কাঁদে’। একথা সর্বৈব সত্য, যে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান থেকে প্রেসিডেন্ট, তাঁদের ঘোষিত রাজনৈতিক স্ট্যান্ড অনুযায়ীই প্রবল ভারত-বিদ্বেষী। পাক সেনা-কর্তার, ছবিতে ভারতীয় সেনার গলা কাটার ইশারা করা ভিডিও-ও অবাক করে না আজকাল। কারণ, একাধিকবার সন্ত্রাসবাদ ইস্যুতে বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীকে নানাভাবে মদত দিয়েছে পাক সরকার। কাশ্মীরের অশান্তি জিইয়ে রাখতে পারলে, ভারতের পর্যটন শিল্পের বিপুল ক্ষতি, যা পাকিস্তানের কাছে সোনায় সোহাগা। সমীক্ষা বলছে, জম্মু-কাশ্মীরে গত কয়েক বছরে পর্যটন শিল্পের বাড়বাড়ন্তের ফলে বেকারত্ব কমেছে। কাশ্মীরি যুবকদের বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী সংগঠনে চলে যাওয়ার পিছনে এই বেকারত্ব একটি বড় কারণ। তাই বৈসরণের ঘটনায় পাকিস্তান নিশ্চিতভাবে লাভবান হবে, এই লাভের গুড় যাতে পাকিস্তান খেতে না পারে তার দায়িত্ব ভারতের নির্বাচিত সরকারের; কাশ্মীরি জনতার সুযোগসুবিধা প্রদান, পর্যটন শিল্পের দ্রুত স্বাভাবিকীকরণ এবং জঙ্গিদমনে কঠোর ভূমিকা নেওয়া– এই তিন লক্ষ্যপূরণ ব্যতীত কোনও কিছুই এই মুহূর্তে প্রাথমিক হতে পারে না। কিন্তু যা প্রাথমিক হয়ে উঠছে তা আভ্যন্তরীণ হিন্দু-মুসলিম প্রভেদ, পাকিস্তান বিদ্বেষের নামে স্বাভাবিক মুক্তচিন্তাকে প্রশ্নের মুখে ফেলা, সামান্য শালওয়ালা থেকে দেশের সোনাজয়ী অলিম্পিয়ান কেউই যেখানে বাদ পড়ছেন না।
নীরজ চোপড়া, আপনি নিশ্চিত গত কয়েকদিনে বুঝে গেছেন, আধুনিক ভারতের বিরাট সংখ্যক জনতার মনের গহীনে পুষে রাখা দ্বেষ কতখানি আঘাত আনতে পারে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায়। এই দেশকে সোনা এনে দেওয়ার জন্য আপনি হরিয়ানার ছোট্ট গ্রাম থেকে ২০ কিলোমিটার রাস্তা পেরিয়ে রোজ ছুটে যেতেন ট্রেনিং-এ, আমি নিশ্চিত এই থ্রেট, এই আক্রমণের পরেও আপনি অনুতপ্ত হবেন না, আপনার এক মুহূর্তের জন্যও সংশয় হবে না এই ভারতের আবহমান বিশালতা নিয়ে। কারণ, খেলার মাঠকে আপনি ভালোবেসেছেন মন থেকে, আর সেই ময়দানি বিশালতাই আপনার বন্ধু নাদিমকে নিয়ে এসেছে আপনার ঠিক পাশে। আবার দেশের সিদ্ধান্তের সমর্থনে আপনি জোর গলায় একথা বলতে পেরেছেন যে, এই পরিস্থিতিতে নাদিম আসতে পারবে না, আসার প্রশ্নই আসে না, কারণ, জাতীয়তাবাদ নির্ধারিত দেশ ধারণার বাইরে আপনার কাছে দেশ এক অন্য বিভায় উজ্জ্বল। যেখানে দেশপ্রেমের বলি হয় না কোনও সহনাগরিক, দেশ যেখানে কাঁটাতারে ঘেরা ভূখণ্ড নয়, দেশ এক চেতনামাত্র।
…………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………..
বলা হয়, প্যান্ডোরার বাক্সে নাকি এখন শুধু প্রত্যাশা রাখা আছে। কিন্তু কেউ বাক্সটা খোলে না। কেউ সাহস দেখায় না। যে পুরাণকথা শেষ হয় একটি মেয়ের জানার খিদেকে নিয়ন্ত্রণ করে, সেই পুরাণকথার বিশেষ দ্রষ্টব্যে যদি আশাবাদ থেকে থাকে, তবে সেই বাক্স এখনও খোলা হয়নি কেন? তার মানে এতদিন যে গল্প বলা হয়েছে, সেটা আদ্যন্ত মিথ্যে।
শহরের অতীত ও ঐতিহ্য নির্মাণের এক বিশেষ মুহূর্ত ছিল বিশ শতকের গোড়ার বছরগুলি। এই সময়ে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটছে, কলকাতা পুরসভায় ভারতীয় প্রতিনিধিদের গলার জোর বাড়ছে, বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে প্রথমবার শহরের রাস্তায় মানুষ মিছিল বের করছেন– ফলে বোঝাই যাচ্ছিল কলকাতার দাবিদার অনেক, শুধু ব্রিটিশ রাজপুরুষদের নয় এ শহর।