‘দ্য হেটফুল এইট’ ভালোলাগার মতো ছবি নয়। কারণ এই ছবি ভালোবাসার জন্য নির্মিত নয়– এই ছবি তারান্তিনোর সবচেয়ে তিক্ত ছবি, যে ছবির শরীর থেকে সিনেমার অনেক আহ্লাদ তিনি এক এক করে সরিয়ে দিয়েছেন। প্রশ্ন উঠতে পারে যে এই ছবি কেন ৭০ মিমির মতে একটি অবসোলিট ফরমাটে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে করতে হল– কারণ ৭০ মিমি স্পেকটাকুলার ল্যান্ডস্কেপের জন্য আদর্শ আর এই ছবির ৯০% ইনডোরে। তারান্তিনোর সবচেয়ে প্রিয় পরিচালক সের্জিও লিওনে। লিওনে একইসঙ্গে অনন্ত ল্যান্ডস্কেপ এবং ওয়াইড স্ক্রিনে টাইট ক্লোজ-আপের জন্য বিখ্যাত; মানুষের মুখের মতো নাটকীয় ল্যান্ডস্কেপ খুব কম পাওয়া যায়, এটা লিওনে দেখলে বোঝা যায়। তখনই বোঝা যায় ‘হেটফুল’ কেন ৭০ মিমি-তে করা।
৯.
এই কিস্তিতে ওয়েস্টার্ন নিয়ে আলোচনার ইতি টানব। জঁরটির সম্যক ধারণা দেওয়া উদ্দেশ্য ছিল না, ইচ্ছে ছিল একটি জঁরের একটু দীর্ঘ আলোচনা করে জঁর জিনিসটা সম্বন্ধেই ধারণা দেওয়া।
গত তিন-চার দশক ওয়েস্টার্ন আর হলিউডের প্রধান জঁর নয়। তার কারণ অনুসন্ধানের পরিসর এখানে নেই; এইটুকু বলা যায়, আধুনিক মিথোলজি হিসেবে ওয়েস্টার্নের যে কাজটা ছিল, আমেরিকা নামক সভ্যতাকে সমীক্ষা করা, অথবা বিস্তীর্ণ প্রান্তরে মানবসভ্যতাকে ন্যূনতম কিছু উপাদানে সাজিয়ে নিয়ে সেইসব আর্কেটাইপের আকৃতি তৈরি করা– এইসব ছেড়ে দিয়ে গত বছর তিরিশেকের ওয়েস্টার্ন হয়ে গেছে শুধুই পিরিয়ড পিস, অতীতকে সুচারুভাবে নির্মাণ করা ব্যতিরেকে সে বেশি কিছু করতে পারছে না। পিরিয়ডের পিসের পুঙ্খানুপুঙ্খ দলিল করা ওয়েস্টার্নের উদ্দেশ্যই ছিল না কখনও।
এই কিস্তিতে আমি ২০১৫ সালের একটি ছবি আলোচনা করে দেখাব ওয়েস্টার্নের কী করার কথা ছিল, এবং হলিউড সেইটাই আর করতে পারে না।
আমি কোয়েন্টিন তারান্তিনোর একটি ছবি নিয়ে আলোচনা করব। ‘দ্য হেটফুল এইট’ তারান্তিনোর প্রথম ওয়েস্টার্ন নয়, এর আগেই তিনি বানিয়েছিলেন ‘জ্যাঙ্গো আনচেইনড’ (২০১২)। সেই ছবিতে মূল রেফারেন্স ছিল বিখ্যাত স্প্যাঘেটি ওয়েস্টার্ন ‘জ্যাঙ্গো’ (সের্গিও করবুচি, ১৯৬৬)। কিন্তু তারান্তিনো দীর্ঘদিন ধরে ছদ্ম-ওয়েস্টার্ন করছেন– ‘কিল বিল ভল্যুম টু’ ও ‘ইনগ্লোরিয়াস বাস্টার্ডস’-ও আত্মার দিক দিয়ে ওয়েস্টার্ন, তর্ক করে দেখানো যায়।
‘দ্য হেটফুল এইট’ রিভিশনিস্ট ওয়েস্টার্ন এবং স্প্যাঘেটি ওয়েস্টার্নের যুগলবন্দি বলা যায়। এই ছবির জন্য সঙ্গীত নির্মাণ করতে তারান্তিনো প্রায় হাতেপায়ে ধরেছিলেন এনিও মরিকোনের, যিনি প্রায় একা হাতে ছয়-সাতের দশকে যাবতীয় স্প্যাঘেটি ওয়েস্টার্নকে সুরের মাধ্যমে প্রাণ ও কৌলীন্য দান করেছিলেন।
‘দ্য হেটফুল এইট’-এর প্রথমার্ধ্বটি ঘটে বরফাকীর্ণ প্রান্তর ধরে চলা একটি স্টেজকোচে। জন ফোর্ড ‘স্টেজকোচ’ নামে একটি ছবি করেছিলেন– যে গাড়ির মধ্যেই বা আশপাশে ছিল ছবির দুই-তৃতীয়াংশ লোকেশন– সেই ছবিতে একগুচ্ছের খুঁতে চরিত্র আমেরিকান নেশনের আদর্শ ভবিষ্যতের দিকে এগোচ্ছিল। আর এই ছবিতে সেরকমই হাতে-গোনা কিছু খুঁতে চরিত্র ১৮৭৭ সালে সিভিল ওয়ারের পর আমেরিকার শ্মশানের দিকে এগোচ্ছে। ছবির পরের অর্ধ সীমাবদ্ধ থাকে বরফ-পরিবৃত একটি বাড়ির ভিতর; ঠিক যেমন ‘জনি গিটার’-এর (নিকোলাস রে, ১৯৫৪) সিংহভাগ সীমাবদ্ধ ছিল একটি ট্যাভার্নে।
কিন্তু এই ছবির আরেকটি কাঠামো হল আগাথা ক্রিস্টির ১৯৩৯ সালের রহস্য-উপন্যাস ‘অ্যান্ড দেন দেয়ার ওয়াজ নান’ – উল্লেখযোগ্যভাবে যে উপন্যাসের প্রথম নাম ছিল ‘টেন লিটল নিগার্স’ (‘দ্য হেটফুল এইট’-এ এবং সার্বিকভাবে তারান্তিনোতে এই ‘নিগার্স’ শব্দটির অতি ব্যবহার নিয়ে বিতর্ক অনেক দিনের)। বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে একটি সুদূর দ্বীপে অবস্থিত একটি ক্যাসলে দশজন লোককে ডেকে আনা হয়। জানা যায় তারা সবাই কোনও না কোনও সময়ে খুন করেছেন, কিন্তু শাস্তি পাননি। এবার তারা এক এক করে মরতে থাকে; প্যারানয়েড হয়ে বাকিরা বোঝে যে খুনি তাদের মধ্যেই একজন। এই উপন্যাসে কোনও গোয়েন্দা নেই– ক্রিস্টি এমন এক সভ্যতা/ইউরোপ/ব্রিটিশ এম্পায়ারের অন্তিম কাল দেখাচ্ছেন যেখানে সবাই সম্ভাব্য খুনি, এবং অনেক খুনই সামাজিক বিদ্বেষজাত। এই ছবিতে যেমন, সেই উপন্যাসেও ‘জাস্টিস’ একটি প্রধান উপাদান। ‘হেটফুল’-এ এই কাঠামোটাই তারান্তিনো ব্যবহার করতে থাকেন, এবং যখন গল্পটা কেবলই একটি রহস্য-উন্মোচনের দিকে এগোচ্ছে স্বকণ্ঠে রহস্য ব্যাখ্যা করেও দেন। কারণ তিনি সিভিল ওয়ারের পর কয়েক মাস কি বছর পরে দেখাতে চাইছেন যখন গৃহযুদ্ধ থামেনি– আমেরিকায় সবাই সবাইয়ের সম্ভাব্য মার্ডারার।
‘দ্য হেটফুল এইট’ ভালোলাগার মতো ছবি নয়। কারণ এই ছবি ভালোবাসার জন্য নির্মিত নয়– এই ছবি তারান্তিনোর সবচেয়ে তিক্ত ছবি, যে ছবির শরীর থেকে সিনেমার অনেক আহ্লাদ তিনি এক এক করে সরিয়ে দিয়েছেন। প্রশ্ন উঠতে পারে যে এই ছবি কেন ৭০ মিমির মতে একটি অবসোলিট ফরমাটে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে করতে হল– কারণ ৭০ মিমি স্পেকটাকুলার ল্যান্ডস্কেপের জন্য আদর্শ আর এই ছবির ৯০% ইনডোরে। তারান্তিনোর সবচেয়ে প্রিয় পরিচালক সের্জিও লিওনে। লিওনে একইসঙ্গে অনন্ত ল্যান্ডস্কেপ এবং ওয়াইড স্ক্রিনে টাইট ক্লোজ-আপের জন্য বিখ্যাত; মানুষের মুখের মতো নাটকীয় ল্যান্ডস্কেপ খুব কম পাওয়া যায়, এটা লিওনে দেখলে বোঝা যায়। তখনই বোঝা যায় ‘হেটফুল’ কেন ৭০ মিমি-তে করা। কারণ সেই ক্লোজ-আপ বা মিড-শট যখন ধরছেন তারান্তিনো, তখন তিনি ব্যাকগ্রাউন্ডে অন্য চরিত্রগুলিদেরও ফোকাসে রাখতে চাইছেন– তারা প্রপ নয়, তাদেরও দেখতে হয়!
দর্শক কার সঙ্গে আইডেন্টিফাই করতে পারে, সেটা বুঝে তার ভিত কিঞ্চিত আলগা করে দেওয়া, এইভাবে তারান্তিনো আইডেন্টিফিকেশন নিয়ে খেলছেন বহুদিন। ‘কিল বিল ১’-এর প্রথম দৃশ্যেই নায়িকা অন্যায় করেন, কন্যার সামনে তার মা-কে হত্যা করেন (তার অমলিন প্রতিশোধের ভিতটা আলগা হয়ে যায়)। ‘ইনগ্লোরিয়াস বাস্টার্ডস’-এ জার্মান ফ্যাসিস্টরা আমেরিকানদের চেয়ে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য চরিত্র– তারা সাহসী, তারা দেশপ্রেমিক, তারা প্রেমিক, তারা আবেগে উদ্বেল হন– আর আমেরিকানরা গামবাট ভোতা চরিত্র। ‘ডেথ প্রুফ’-এ যে মেয়েগুলি ভিলেনের হাতে নৃশংসভাবে মারা যায় তাদের সঙ্গে যে মেয়েগুলি ভিলেনের সঙ্গে যুদ্ধে জয়ী হয়– তাদের কোনও সম্পর্ক বা পরিচিতি নেই। ‘হেটফুল’-এ ডেইজি একগাদা খুনে পুরুষের মধ্যে একমাত্র নারী– ছবির শুরু থেকে শেষ অবধি আদ্যন্ত প্রহৃত– অথচ সে সবচেয়ে চালাক, সবচেয়ে ক্ষমতাশালী (একটি গোটা দল চালায় সে), সবচেয়ে ঠান্ডা মাথার চরিত্র। সে ভায়োলেন্সের ভিক্টিম, অথচ তথাপি প্রখর বুদ্ধি তাকে শেষ অবধি বাঁচিয়ে রাখতে পারে যেখানে পরপর লাশ পড়ছে– তার সঙ্গেই তো আমাদের আইডেন্টিফাই করার কথা ছিল। কিন্তু সে-ই ছবির সবচেয়ে রেসিস্ট চরিত্র। তারান্তিনো আমাদের টিজ করছেন– যে দেখো দর্শক, এই নারী ভিক্টিম, কিন্তু সে রেসিস্ট– দর্শক, তুমি কি এর সঙ্গে আইডেন্টিফাই করবে?
‘হেটফুল’-এর ইন্টারভালের আগেই ছবির একমাত্র মুখ্য কৃষ্ণাঙ্গ একজন বৃদ্ধের সম্মুখীন হন– যিনি সন্তানশোকে আছেন, শুনেছেন সন্তান এই অঞ্চলেই মারা গিয়েছিলেন গৃহযুদ্ধের সময়ে। এই বৃদ্ধ যুদ্ধে জেনারেল ছিলেন, রেসিস্ট দক্ষিণপন্থীরা তাকে নায়কের সম্মান দেয়। কৃষ্ণাঙ্গ তাকে চিনতে পারে। আমরা দু’টি চ্যাপ্টার পরেই জানব যে বৃদ্ধ আসলে একটি ঘৃণ্য শিঁরদাড়াহীন কাপুরুষ– মধ্যবিত্তেরা যেমন হয় অনেক সময়ে, অন্যায় দেখেও চুপ করে বসে থাকে যারা তেমন আর কি। স্যামুয়েল জ্যাকসন অভিনীত সেই কৃষ্ণাঙ্গ বলেন যে মৃত্যুর দিন শ্বেতাঙ্গ বৃদ্ধের ছেলেকে সে দেখেছে; তার হাতেই মৃত্যু হয়েছে সেই পুত্রের। তারপর একটি ফ্ল্যাশব্যাক আছে– ওরকম ভায়োলেন্ট দৃশ্য আমেরিকান ছবিতে কমই হয়েছে– কৃষ্ণাঙ্গ জানান কীভাবে বরফে ঢাকা অঞ্চলে সেই যুবককে সম্পূর্ণ নগ্ন করে হাঁটিয়েছিল সে, যখন সে মৃত্যুও চাইছিল না, চাইছিল একটি ব্ল্যাঙ্কেট। তখন কৃষ্ণাঙ্গ তার উত্থিত কালো লিঙ্গ বের করে যুবককে বলে লেহন করতে। যুবক করে– কারণ ত্রিসীমানায় সেটিই একমাত্র উত্তাপের উৎস। দেখতে দেখতেই বোঝা যায় যে ফ্ল্যাশব্যাকটি বোধহয় সত্যি নয়– স্যামুয়েল জ্যাকসনের তিক্ত-শ্লেষাত্মক কণ্ঠে সেটি একটি নির্মাণ। এই দৃশ্যে একটি আজীবন ধরে বর্ণ ও জাতের নামে হজম করা অপমানের উত্তর উগড়ে দেওয়া আছে– এতই তিক্ত ও ভায়োলেন্ট, যে দর্শকের সমর্থনও চায় না এই দৃশ্য।
এই কৃষ্ণাঙ্গ চরিত্রটি গৃহযুদ্ধে মিলিটারিতে ছিল। তার পকেটে একটি কিংবদন্তিসম চিঠি থাকে– আব্রাহাম লিঙ্কনের লেখা সেই চিঠিই তার কৌলিন্য, তাই জন্যই সাদা চামড়ারা তাকে অপমান করার আগে দু’বার ভাবে। ছবির মাঝপথে জানা যায় যে সেই চিঠিটা আসলে জাল। ছবির শেষ শটে প্রধান ভিলেন কড়িকাঠ থেকে ঝুলছে। কৃষ্ণাঙ্গ নায়ক অণ্ডকোষ হারিয়েছে মিনিট পনেরো আগে– অন্তিম ডুয়েলের সময়ে সে বোঝে যে তার পিস্তলে গুলি শেষ। এই পৌরুষের পরাকাষ্ঠা মানুষটি ভয় পেয়ে যায় হয়তো জীবনে প্রথমবার, কারণ তার উল্টোদিকে ছবির সবচেয়ে ডেঞ্জারাস নারীটি একটি পিস্তলের দিকে এগোচ্ছে। এই সময়ে যে ছেলেটি প্রমাণ করেছিল যে সেই লিঙ্কনের চিঠিটি জাল, সে চিঠিটি আবার পড়তে চায়। দু’টি চরিত্রই তখন মৃত্যুর দোরগোড়ায়– এই অবস্থায় সেই নকল চিঠিটা ছবিতে প্রথমবার পড়ে শোনানো হয়।
নতুন গণতান্ত্রিক আমেরিকার স্বপ্ন নিয়ে রচিত সেই জাতির জনকের ‘নকল’ চিঠিটি আমরা একটি সম্ভাব্য আমেরিকার ফ্যান্টাসি হিসেবেই পড়ি। যে ফ্যান্টাসি ডোনাল্ডের ট্রাম্পের আমেরিকায় অপমানিত হচ্ছে এখন, অথচ যে ফ্যান্টাসি ছাড়া সুদিনের আর কোনও ঠিকানা নেই। তারপর সেই চরিত্র চিঠিটি রক্তমাখা দলা পাকিয়ে ছুড়ে ফেলে দেয়, আমেরিকার সবচেয়ে জাতীয়তাবাদী জঁরে আমেরিকার শ্মশান-নির্মাণ করে আমেরিকা নামক ধারণাটির পোস্টমর্টেম করা হয় ‘দ্য হেটফুল এইট’-এ।
…পড়ুন এই কলামের অন্যান্য পর্ব…
৮. একটি মৃতদেহ দেখানো ও না-দেখানোর তফাত থেকে বোঝা যায় ‘শোলে’ শুধুমাত্রই অনুকরণ নয়
৭. যখন জঁর নিজেকে নিয়েই সন্দিহান
৬. আমেরিকার ‘হয়ে ওঠা’-র কল্পগল্প
৫. একটি সভ্যতার হয়ে ওঠার মিথোলজি
৪: পশ্চিমে এল এক নারী, বেজে উঠল অমর সংগীত
৩. জঁরের ফর্দ– দৃশ্য, শব্দ, প্রেক্ষাপট
২. ট্যাক্সি ড্রাইভার এবং তার পূর্বসূরি দুই নায়ক ও একটি ছদ্মবেশী জঁর
১. ভাঙনের শহরে এক নামহীন আগন্তুক এবং চারখানি গল্পের গোত্র