দলের শিল্পীদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল বালিগঞ্জ পোস্ট-অফিস-এর কাছে এক বন্ধুর সে-মুহূর্তে খালি ফ্ল্যাটে। আমরা ঠিক করেছিলাম এই শিল্পীদলের সঙ্গে, প্রতিমা বড়ুয়ার সঙ্গে এক-দুটো রাত কাটাব। মেঝেতে ঢালাও বিছানা। তিনি অসুস্থ বলে কোনও অন্য বন্দোবস্ত আমরা করব– তাও তাঁর অপছন্দ। গান-আড্ডার পর ঘুমোতে যেতে গভীর রাত হল। কিন্তু দেখলাম সকালে তিনিই সবচেয়ে আগে উঠে স্নান সেরে তৈরি। একটাই অনুরোধ ছিল আমাদের– যদি সম্ভব হয় তাঁর গলায় ‘হস্তির কন্যা, হস্তির কন্যা’ গানটি সামনে বসে শুনব আরেকবার। বললেন, ‘‘গাইব, কিন্তু তোমরা আমার সঙ্গে পালটা গাইবে।…’’
‘শ্রদ্ধেয় হেমাঙ্গদা,
বহুদিন পর আপনার চিঠি পেলাম…
উত্তর দিতে বেশ দেরি হয়ে গেল, ক্ষমা করবেন। এখানে প্রায় প্রতিদিন বৃষ্টি হচ্ছে। আজ সকাল থেকে চারদিকে মেঘ আর বৃষ্টি আর মাটীয়াবাগের এই পুরোনো অট্টালিকার তিনদিকে শুধু জল। গদাধর নদীর জলে ভরে গেছে চারদিকের ক্ষেত পাথার। মনে পড়ছে অতীতের অনেক কথা, সেই জমিদারী আমল, সেই প্রতিপত্তি, শিকারের জীবন, জঙ্গলে দুমাসের সেই হাতি শিকারের ক্যাম্প, মাহুত-ফান্দির মাঝখানে বাবার সেই মহলদারের চেহারা। সংসার যখন একটা পেতেছি সেই কঠিন জীবনের কথাও মাঝে মাঝে ভাবছি, রান্নাবান্না, কুটনো কাটা, গরু-ছাগল, মুরগী কবুতর ইত্যাদি তবুও এসব কঠিন ব্যাপারের ফাঁকে ফাঁকে ভাবছি ২৬ শে জুন আমার radio recording আছে। Gauhati যেতে হবে, কী গান গাইবো? জীবনটাকে কিছুতেই গুছিয়ে নিতে পারলাম না, শান্তি নেই, সুখের আশা করি না, কেমন যেন সব এলোমেলো ভাব…’
১৭ জুন, ১৯৮০-র এক চিঠিতে প্রতিমা বড়ুয়া লিখছেন হেমাঙ্গ বিশ্বাসকে। প্রতিমার লেখা ‘এলোমেলো ভাব’ একজন শিল্পীর সৃজনশীলতার ক্ষেত্র আর সংসার-যাপনের আবহমান দ্বন্দকে চিহ্নিত করছে অবশ্যই, কিন্তু এ-চিঠি যখনই পড়েছি, অন্য একটা প্রসঙ্গ আমাকে ভাবিয়েছে। আটের দশকের অসম আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছে ততদিনে। প্রতিমা বড়ুয়ার গৌরীপুর তৎপ্রসূত আঁচের বাইরে অবশ্যই নয়। এই ভেতর-বাইরের ব্যাপ্ত বিস্রস্ততায় যাঁকে নিজের অগ্রজ মনে করতেন প্রতিমা, তাঁকে লিখছেন এই চিঠি। প্রাথমিকভাবে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের একটি চিঠির উত্তর হিসাবেই।
প্রতিমার সঙ্গে, বা আরও বিস্তৃতভাবে বললে, গৌরীপুর রাজবাড়িতে প্রতিমা বড়ুয়ার বিখ্যাত পরিবারের সঙ্গে প্রথম যোগাযোগের মুহূর্তগুলি বর্ণনা করে গেছেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস, তাঁর একটি ছোট লেখায়। প্রতিমার গানের শিক্ষানবিশী আর অধ্যয়ন কেন ভিন্ন, কেন তাঁর শান্তভাবে গেয়ে যাওয়া গান এমন তীব্রতায় বেঁধে আমাদের, রেশ রয়ে যায় আজীবন– তা জানতে গেলে তার পারিবারিক পটভূমি সম্পর্কে কিছুটা অবহিত হতে হয়:
‘‘অনেকদিন আগে গণনাট্য সংঘের কয়েকজন গায়ক-গায়িকাকে নিয়ে ধুবড়ি থেকে গিয়েছিলাম গৌরীপুরে… আমাদের প্রধান আকর্ষণ ছিল পরলোকগত প্রমথেশ বড়ুয়ার বাড়ি, আর ‘মুক্তি’ ছায়াছবির একজন মুখ্য অভিনেতা তাঁর সেই হাতিটি… মাটিয়াবাগের সেই স্মৃতিজড়িত ভবনটির সামনেই দেখা হল প্রমথেশ বড়ুয়ার ছোটো ভাই প্রকৃতীশ বড়ুয়ার সাথে। ‘লালজী’ বলেই তিনি সারা আসামে বিখ্যাত। বন্য হাতির সঙ্গে তাঁর আত্মীয়তা, বাঘের সঙ্গে বন্ধুত্ব। ঝিঁঝিঁ-ডাকা সন্ধ্যায় মাটিয়াবাগের খোলা সবুজ ঘাসের গালিচায় বসে তিনি আমাদের শিকারের গল্পে জমিয়ে রাখলেন। বন্য হাতি ধরা তাঁর ব্যবসায়। জঙ্গলেই জীবন কাটাতে হয়। গল্পের মাঝখানে হঠাৎ প্রশ্ন করলেন, ‘আপনারা তো গায়ক, বলুন তো সবচেয়ে, ভালো, ভরাট সুরেলা ও জোরালো গলা পৃথিবীতে কোন শিল্পীর?’ আমরা হকচকিয়ে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলাম… কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে পরাভূত ছাত্রদের কাছে প্রধান শিক্ষকের মতো নিজেই উত্তর দিয়ে বললেন, ‘‘গায়ক হবেন কী করে? সেই গলাটি না শুনলে– সেই গলায় গলা না সাধলে? চলুন আমার সঙ্গে অন্তত ছ’মাস থাকুন আমার তাঁবুতে। গভীর রাতে ঘন অরণ্যে কখনো শুনেছেন বাঘের ডাক? ভারতবর্ষের কত বড়ো বড়ো ওস্তাদের গান শুনলাম, কিন্তু এমন দরদি, দরাজ গলার আওয়াজ কারো শুনলাম না।’’
পিতা প্রকৃতীশ বড়ুয়ার সাথে জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে এই বাঘের ‘ঘরানা’য় সুর সেধেছেন প্রতিমা। তার গলার দরদটা সেখানে…”
প্রমথেশ, প্রকৃতীশের পিতা রাজা খেতাবপ্রাপ্ত প্রভাত বড়ুয়ার কথাও আমরা পাই হেমাঙ্গ বিশ্বাসের লেখায়। বহুগুণসম্পন্ন পণ্ডিত মানুষ প্রভাত বড়ুয়া সংগীতজ্ঞও ছিলেন। তাঁর অঞ্চলের গ্রাম্যজীবনে ছড়ানো ধুলিমাখা সোনাদানা– লোকসংগীতের দিকে শিক্ষিত শ্রেণির দৃষ্টি তিনিই প্রথম ফেরান। তাঁরই অনুপ্রেরণায় প্রমথেশদের বোন, প্রভাতের কন্যা নীহার বড়ুয়া, নীলিমা বড়ুয়া প্রমুখ পরিবারের অনেকে রাজ-আভিজাত্য ছুড়ে ফেলে গৌরীপুরের সাধারণ নিরক্ষর, গরিব মানুষের ঘরে ঘরে ছেঁড়া কাঁথায় মোড়া লোকসংগীতের রত্ন আহরণে লেগে যান। লোকসংগীতের ‘বাহিরানা’, একটা অঞ্চলের আঞ্চলিকতার সমস্ত বৈশিষ্ট্য নিয়ে যে শিক্ষা তৈরি হয়, তা প্রতিমার মতো করে আহরণ করলে দেহে-মনে-প্রাণে লোকশিল্পী হওয়া যায়, এ-কথা হেমাঙ্গ বিশ্বাস মনে করতেন।
প্রতিমার ঘর এবং ঘরানা তাঁকে হাতে ধরে নিয়ে গেছে সে বাহিরানার সন্নিধানে।
২.
প্রতিমা বড়ুয়াকে আমি নিজে প্রথম দেখি ‘ক্যালকাটা স্কুল অফ্ মিউজিক’-এর হলে এক অনুষ্ঠান মঞ্চে। যতদূর মনে পড়ে, এক রবিবার। আমার নিজের বয়স বোধহয় তখন দশেরও কম, তাই একে সাতের দশকের শেষার্ধের কোনও সময় বলে ধরা ভুল হবে না। এ অনুষ্ঠানের আয়োজক ছিলেন কলকাতার কয়েকজন লোকসংগীত গবেষক, যাঁরা এরও দশকাধিক আগে স্থাপন করেছিলেন ‘Folkmusic and Folklore Research Institute’ নামে একটি সংস্থার। যখনকার কথা বলছি, তখন সংস্থাটির অস্তিত্ব আর সে-ভাবে না থাকলেও লোকগান-লোকগাথার নানা আঙ্গিকের চর্চা ব্যক্তিগত অথবা যৌথ পরিসরে ধারাবাহিকভাবে জারি রেখেছিলেন এর সদস্য বা ঘনিষ্ঠজনরা। সেবার প্রতিমা বড়ুয়াকে কলকাতায় নিয়ে আসার উদ্যোগে শামিল ছিলেন এঁদের মধ্যে অন্তত দু’জন– হেমাঙ্গ বিশ্বাস, প্রসূন মজুমদার।
প্রাথমিক আলাপচারিতার পর প্রতিমা গান শুরু করলেন। বহু গান– ঘণ্টা দুয়েকেরও বেশি সময় ধরে। তাদের কিছু আমি পারিবারিকসূত্রে আগে শুনেছি, বেশিরভাগই শুনিনি। কিন্তু সেদিনের যে একটি গানের কথা, সুর ও ভঙ্গি আমার কান থেকে কখনও যায়নি, জীবনের নানা মুহূর্তে যার অপ্রত্যাশিত ফিরে আসা আমি আটকাতেও পারিনি কখনও, প্রতিমার চিঠির সেই এলোমেলো ভাবের এক অনন্য বিবরণ বোধহয় সে গানে রয়ে গেছে:
‘আজি আওলাইলেন মোর বান্দা ময়াল রে
হাতির পিটিত্ থাকিয়ারে মাহুত
থোড় কলা ভাঙ্গো
নারীর মনের কথা তোমরা কী বা জান রে
…
বিদেশিয়া মাহুত তোমরার
দেশ দূরান্তরে
মিছা মায়া নাগেয়ারে মাহুত
ছাড়িয়া যাইবেন মোকে রে।’
‘Folkmusic and Folklore Research Institute’ ১৯৬৭ সালের পয়লা অক্টোবর লোকসংগীত নিয়ে অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি সংগ্রহগ্রন্থ (anthology) প্রকাশ করে। তাতে গৌরীপুর রাজপরিবারের কন্যা, গোয়ালপাড়িয়া লোকগানের বিশারদ এবং সংগ্রাহক, নীহার বড়ুয়ার একটি নিবন্ধ ছিল (মূল বাংলা লেখাটির শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়-কৃত অনুবাদ এই সংগ্রহের অন্তর্ভুক্ত হয়)। ওপরের গানটির প্রথম পঙ্ক্তি সেখানে অনূদিত হয়ে দাঁড়ায়:
You have set in confusion my settled home…
মূল লেখাটিতে নীহার বড়ুয়া লিখছেন:
‘‘ভূটানের পাদদেশ থেকেই গোয়ালপাড়ার বনবিভাগের সীমানা। তরাইয়ের অন্যান্য অঞ্চলের মতো এরও এক গভীর ‘চিরশ্যামল’(evergreen area) অরণ্যের অংশগুলিই হস্তীযূথের লীলাভূমি।… বর্তমান জগতের এই বৃহত্তম স্থলচর জীবদের ধরে এনে মানুষ কাজে লাগায় এবং এদের ধরার দুঃসাহসিক কাজের ভার গ্রহণ করে এই বেপরোয়া ‘ফান্দি’, ‘মাহুত’ ও তার সহকর্মীর দল… যখনি ডাক আসে তখনি এঁদের সব বন্ধন নিমেষে খসে যায়– কেউ ‘মেলাশিকার’ অর্থাৎ পোষা হাতী থেকে ফাঁস দিয়ে হাতী ধরতে– কেউ ‘খেদা-শিকারে’ অর্থাৎ তাড়া করে ‘গড়ে’ ফেলার কাজে গড়ের অভিমুখে বেরিয়ে পড়ে।… এইসব পর্বশেষে আসে বিশ্রামের কাল। গোয়ালপাড়ার সমতলভূমির রসিক মাহুত তার সাধের ‘দোতোরা’টি নিয়ে বসে গিয়ে তার সাঙ্গপাঙ্গদের মাঝে। ভুলে যায় সারাদিনের ক্লান্তি, ভুলে যায় তাদের দিবসের আসুরিক কার্য্যকলাপ… তখন দোতোরার ‘উল্টাডাঙের’ সঙ্গে মনে পড়ে যায় অজানা যুগের অজানা কবির রচিত… গানের পদ।”
‘বিদেশিয়া’ মাহুত– যে তার সাজানো ঘরদুয়ার আচম্বিত হাওয়ার মতো এসে ‘আওলিয়ে’ দিয়েছে, উথাল-পাথাল করেছে জীবন– তার সঙ্গে প্রণয়াবদ্ধ মেয়ের আকুলতার, আশংকামথিত যন্ত্রণার গান ‘আজি আউলাইলেন’।
সুরের দিক থেকেও এ গান এই অঞ্চলের ভাওয়াইয়া গানের একেবারে প্রতিনিধিত্বমূলক। এ গান প্রসঙ্গে হেমাঙ্গ বিশ্বাস লিখছেন:
‘সুরের এই আঞ্চলিক ঢংটিই লোকসঙ্গীতের প্রাণভোমরা। আর গৌরীপুরের লোকগীতিরই প্রাণভোমরাটিকে প্রতিমা নিজের কণ্ঠে বন্দী করতে পেরেছেন। এখানেই তার সাফল্য। এর সঙ্গে তাঁর কণ্ঠে মিশেছে সামন্ত সমাজে নিগৃহীত মেয়েজীবনের বেদনাবোধ… ভাওয়াইয়া হল মূলত সামাজিক দৌরাত্ম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ… আমাদের দেশের লোকসঙ্গীতের সারিতে একে পাশ্চাত্য ‘প্রোটেস্ট সংস’-এর পরিপূর্ণ মর্যাদা দিতে পারি…
ভাওয়াইয়ার আন্দোলায়িত বিলম্বিত আর্তি যেমন প্রতিমার গলায় মূর্ত তেমনি আবার গৌরীপুরের অন্য বৈশিষ্ট্য মেয়েদের গান, বিশেষত বিয়ের গান কিংবা কার্তিকপূজার নৃত্য-সম্বলিত গীত ও সমানভাবেই সার্থক। চট্কার শানিত ব্যঙ্গ ও প্রতিমার পরিবেশনায় যেন আরো তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে।’’
৩.
সত্তরের শেষের সে-অনুষ্ঠানের পর বহুবার কাছ থেকে শোনার সুযোগ হয়েছে প্রতিমা বড়ুয়ার গান। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মৃত্যুর পাঁচ বছর পর ‘হেমাঙ্গ বিশ্বাস মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’-এর পক্ষ থেকে ১৯৯২ সালে রবীন্দ্রসদনে এক অনুষ্ঠানে তাঁকে আর সিলেট থেকে বিদিতলাল দাসকে নিয়ে এসেছিলাম আমরা। অসুস্থ ছিলেন বেশ খানিকটা। তবু গানের পর গানে, তার মধ্যে বেশ কয়েকটি বিরল, কী উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা দু’জনেই, যাঁরা পরিপূর্ণ রবীন্দ্রসদন প্রেক্ষাগৃহে সে-অনুষ্ঠান দেখেছেন, মনে করতে পারবেন। অনুষ্ঠানটির নাম রাখা হয়েছিল: ‘ভাওয়াইয়া-ভাটিয়ালি’।
তাঁর দলের শিল্পীদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল বালিগঞ্জ পোস্ট-অফিস-এর কাছে এক বন্ধুর সে-মুহূর্তে খালি ফ্ল্যাটে। আমরা ঠিক করেছিলাম এই শিল্পীদলের সঙ্গে, প্রতিমা বড়ুয়ার সঙ্গে এক-দুটো রাত কাটাব। মেঝেতে ঢালাও বিছানা। তিনি অসুস্থ বলে কোনও অন্য বন্দোবস্ত আমরা করব– তাও তাঁর অপছন্দ। গান-আড্ডার পর ঘুমোতে যেতে গভীর রাত হল। কিন্তু দেখলাম সকালে তিনিই সবচেয়ে আগে উঠে স্নান সেরে তৈরি। একটাই অনুরোধ ছিল আমাদের– যদি সম্ভব হয় তাঁর গলায় ‘হস্তির কন্যা, হস্তির কন্যা’ গানটি সামনে বসে শুনব আরেকবার। বললেন, ‘‘গাইব, কিন্তু তোমরা আমার সঙ্গে পালটা গাইবে। মানে, আমি যদি গাই, ‘বালু টিলটিল পঙ্খীরা কান্দে বালুতে পড়িয়া–’, তোমরা গাইবে, ‘গৌরীপুরীয়া মাহুত কান্দে– ও, সখী ঘরবাড়ি ছাড়িয়া, সখী ও’, তারপর না হয় সবাই মিলে গাইব ওই অংশটা: ‘ও মোর সারিন হা্তির মাহুত রে/যেদিন মাহুত চলিয়া যান, নারীর মন মোর কান্দিয়া রয় রে।’”
কীভাবে কেটেছিল আমার, আমাদের সবার সে-সকাল তা অবশ্যই বর্ণনার প্রয়োজন নেই। বাইরে রোদ ঝলমলে আকাশ, ঘরের ভেতর আধো-অন্ধকার। আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ দিনগুলির একদিন ছিল সেটা। তার মধ্যে বসে প্রতিমা বলেছিলেন, ‘আজ যে-গানগুলো আমার গাইতে ইচ্ছে করছে, তা একটু অন্যরকম। এই তো মাসখানেকও হয়নি। অনুষ্ঠান করতে গিয়ে বিরাট দুর্ঘটনার মধ্যে গিয়ে পড়লাম আমরা। খোলামকুচির মতো গাড়ি গিয়ে পড়ল রাস্তার ওপাশে এক খাদের মতো জায়গায়।’
নিজেদের শারীরিক যন্ত্রণার চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল এক অতিগুণী সহশিল্পীকে সে দুর্ঘটনায় হারানোর বেদনা। এ-ঘটনা বর্ণনার পর যখন তিনি গাইলেন এক বহুশ্রুত গান–
‘একবার হরি বলো মন-রসনা/ মানবদেহার গৈরব কোরো না/মানবদেহা মাটির ভাণ্ড/ভাঙিলে হবে খণ্ডরে খণ্ড…।’
আমরা বাক্রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম! এ গান কত শুনেছি, গেয়েছি আগে। শুধু তাঁর মতো করে ভাবতে পারিনি।
তার দশ বছর পর, শেষ ডিসেম্বরের সকালে সমস্ত দৈনন্দিন কাগজ যখন জানাচ্ছে তাঁর চেতনা ক্রম-বিলীয়মান, কোনও ভরসাই প্রায় আর নেই ফেরার, ভূপেন হাজারিকা তাঁকে দেখতে গিয়ে হাসপাতালে তাঁদের সুবিখ্যাত যৌথ গানগুলি একটার পর একটা গাইছেন যাতে আধো-আচ্ছন্নতায়, চৈতন্যপ্রান্তে দাঁড়িয়েও কোনও জাদুবলে তিনি গুনগুনিয়ে উঠতে পারেন একটা-দুটো কলি, তখন এক দশক আগের ওই সকালে বালিগঞ্জের ফ্ল্যাটে হঠাৎ গেয়ে ওঠা তাঁর একটা গানের কথা আমার মনে ফিরে ফিরে আসছিল:
‘ও জীবন রে, জীবন ছাড়িয়া না যাস মোকে,
তুই জীবন ছাড়িয়া গেইলে কায় করিবে আদর, জীবন রে–’।
তথ্যসূত্র:
১) হেমাঙ্গ বিশ্বাস রচনাসংগ্রহ (১), সম্পাদনা প্রণব বিশ্বাস ও রঙিলী বিশ্বাস, দে’জ পাবলিশিং, ২০১২
২) গোয়ালপাড়ার লোকজীবন ও গান: প্রান্তবাসীর ঝুলি, নীহার বড়ুয়া, সম্পাদনা চন্দ্রা মুখোপাধ্যায়, স্ত্রী, জানুয়ারি ২০০০