বাঙালিরা ঐতিহাসিকভাবেই বৃহত্তর বিশ্বের শিল্পচেতনার সাথে সংযোগ স্থাপনে উৎসাহী। সেই মর্মেই যদি আমরা মাহফুজ, পামুক, দোলাতাবাদি পড়ি, বা কিয়ারোস্তামি আর ফারহাদির চলচ্চিত্র দেখি, আমরা দেখব কীভাবে শোক আর যন্ত্রণাকে শিল্পে রূপ দেওয়া যায়, কীভাবে বেঁচে থাকার সংগ্রাম সাক্ষ্য হয়ে ওঠে। আমরা দেখব, সাহিত্য আর সিনেমা কীভাবে এক জাতির মর্যাদা টিকিয়ে রাখতে পারে যখন তাদের শহর ধ্বংস হয়ে গিয়েছে, যখন তাদের কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এ আসলে বাংলা ভাষার ও জাতির সংগ্রামের সমান্তরাল– যারা দেশভাগ, দুর্ভিক্ষ বা রাজনৈতিক দমনের মুখে দাঁড়িয়ে নিজের ভাষা আর স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে।
মধ্যপ্রাচ্য আবার যুদ্ধের অন্ধকার পথে। এই অঞ্চলের যুদ্ধের ইতিহাস যত পুরনো, ততটাই সমৃদ্ধ তাদের সাহিত্য ও শিল্পবোধ। আশ্চর্যজনকভাবে এই অঞ্চলের সাহিত্য ও চলচ্চিত্র সেরকমভাবে আমাদের সামনে এসে পৌঁছয় না। অথচ বাংলার সঙ্গে এই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক যোগসূত্র কিন্তু দীর্ঘকালের। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ফারসি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। ছোটবেলা থেকে হাফেজের কবিতা শুনে বড় হয়ে ওঠেন রবিঠাকুর। পরবর্তীকালে ইরানে রবিঠাকুরের সাহিত্যচর্চা খুবই জনপ্রিয় হয় এবং দু’বার উনি সেই দেশের সরকারি আতিথেয়তা গ্রহণ করেন। এমনকী, শান্তিনিকেতনে পারস্য সাহিত্যের অধ্যাপকও উনি নিয়োগ করেছিলেন।
ঐতিহাসিক ও সামাজিক যে সাদৃশ্য, তা বাংলা আর মধ্যপ্রাচ্যের শিল্পচেতনাতে ফুটে ওঠে। উপনিবেশের ইতিহাস, দেশভাগ ও শরণার্থী আশ্রয় হোক অথবা রাজনৈতিক অস্থিরতা– এইসবের অভিজ্ঞতা ফুটে ওঠে দুই অঞ্চলের সাহিত্য-সিনেমায়। এই সৃষ্টিকর্মগুলোর শক্তি কেবল তাদের গল্পে নয়– তাদের টিকে থাকার, স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার এক নৈতিক অবস্থান হয়ে দাঁড়ায়। তাই যখন আমরা এই অঞ্চলের সাহিত্য বা চলচ্চিত্র পড়ি কিংবা দেখি, তখন সেটা শুধু ‘তাদের গল্প’ শোনা নয়– কোথায় যেন নিজেদের গল্পই খুঁজে পাওয়া যায়।
যেমন ইরানি লেখক মাহমুদ দোলাতাবাদির ‘মিসিং সোলুচ’ উপন্যাসে দেখা যায় গ্রামীণ ইরানি সমাজে পিতৃতান্ত্রিক নিয়মের ভেতরে এক নারীর টিকে থাকার লড়াই, যখন তার স্বামী কোনও ব্যাখ্যা ছাড়াই উধাও হয়ে যায়। আশাপূর্ণা দেবীর নায়িকাদের মতোই, এই নারী শোককে পরিণত করে বেঁচে থাকার শক্তিতে, নীরবতাকে রূপ দেয় কার্যকর প্রতিরোধে। সেরকমই তাঁর ‘দ্য কর্নেল’ উপন্যাসে এক পিতার হাহাকার চিত্রিত হয়েছে– যে পিতা রাষ্ট্রের হাতে নিহত মেয়ের লাশ কবর দিতে গিয়ে নিজের নৈতিক জটিলতা ও শোকের মুখোমুখি দাঁড়ায়। এই নৈতিক যন্ত্রণার প্রতিধ্বনি পাই আমরা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বা তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের নায়কদের অন্তর্দ্বন্দ্বে, যেখানে ইতিহাসের ভার ব্যক্তিগত মুক্তির স্বপ্নকে অনেক সময়ই গ্রাস করে ফেলে।
শুধু ইরানি সাহিত্য নয়, বৃহত্তর অঞ্চলের সাহিত্যেও একই প্রতিধ্বনি শোনা যায়। নাগিব মাহফুজের ‘কায়রো ট্রিলজি’ তিন প্রজন্মের এক কায়রো পরিবারের গল্প বলে, যেখানে পিতৃতান্ত্রিক শাসন, ঔপনিবেশিকতার উত্তরাধিকার এবং চেনা সমাজের ক্রমাগত ভাঙনের ছবি ফুটে ওঠে। আবার ‘আ ড্রিফ্ট অন দ্য নাইল’ উপন্যাসের আনিস চরিত্রটি আমাদের এমন এক মানুষের মুখোমুখি দাঁড় করায়, যে আক্ষরিক ও নৈতিক দুই অর্থেই দিকহীন, ভেসে চলেছে শূন্যতায়। এই হীনম্মন্যতা আর অসহায়তা মনে করিয়ে দেয় বিনয় মজুমদারের কবিতার অস্তিত্ববাদী শূন্যতাকে, কিংবা সমরেশ মজুমদারের উপন্যাসের নরম অথচ তীক্ষ্ণ আত্মজিজ্ঞাসাকে। যখন প্যালেস্তিনীয় কবি মাহমুদ দারউইশ ভিটে হারানোর যন্ত্রণার কথা লেখেন, তার সঙ্গে জীবনানন্দ দাশের দেশের প্রতি তীব্র নস্টালজিয়ার ভাষা ও ভাবের মিল অস্বীকার করা যায় না।
শিল্পশৈলীতেও অনেক মিল লক্ষ করা যায়। উচ্চমার্গের বাংলা সিনেমার মতোই এই অঞ্চলের চলচ্চিত্রে অনেক সময় এক সংযত নান্দনিকতা দেখা যায়। যেখানে শোকপ্রকাশের জন্য ভাষার বদলে আবহ বা নৈঃশব্দ্যের প্রয়োগ করা হয় নিপুণভাবে। এই মননশীলতা মনে করিয়ে দেয় ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’ সিনেমার নীরব শোককে, যেখানে ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি আর ঐতিহাসিক ক্ষত মিলেমিশে যায়। সেরকমই লিঙ্গ-বৈষম্যের গল্প বলার মধ্যে সত্যজিৎ রায়ের সূক্ষ্ম কিন্তু দৃঢ় ভঙ্গি লক্ষ করা যায়। জাফর পানাহির ‘দ্য সার্কেল’ এবং ‘অফসাইড’ সিনেমাগুলোতে দেখা যায়, কীভাবে নারীর শরীর রাষ্ট্রের তৈরি নিষিদ্ধ এলাকাগুলোতে প্রবেশ করে কেবল উপস্থিতির মাধ্যমে আইন অমান্য করে। এই চলচ্চিত্রগুলোর নীরব প্রতিরোধ আমাদের মনে করায় ‘মহানগর’ সিনেমায় আপাত সাধারণ নারীর সমাজব্যবস্থার অসাম্যের বিরুদ্ধে সংঘর্ষের কথা।
এত মিল সত্ত্বেও তাহলে মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের শিল্প-সাহিত্য আমাদের মধ্যে জনপ্রিয় নয় কেন? আর কেনই-বা আমাদের এই সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হওয়া জরুরি? যদিও আমাদের ইতিহাসের সঙ্গে তাদের অভিজ্ঞতার অদ্ভুত মিল আছে– দেশভাগ, দুর্ভিক্ষ, সেন্সরশিপ, রাজনৈতিক দমন– অনেক কারণেই আমাদের সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান খুব সীমিত। প্রধান কারণ, আমাদের সাহিত্যপাঠের পশ্চিম-কেন্দ্রিক মানসিকতা। আমাদের প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থা ইংরেজি, মার্কিন, ফরাসি বা রুশ সাহিত্যকেই ‘বিশ্বসাহিত্য’ বলে চিনিয়ে এসেছে। আমাদের আধুনিক পাঠ্যক্রমে বা সাহিত্যচর্চায় পশ্চিমী প্রভাব এখনও লক্ষণীয়। একসময় বাম মতাদর্শের টানে আমরা দক্ষিণ আমেরিকার সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হলেও মধ্যপ্রাচ্য বা আফ্রিকান সাহিত্য আমাদের কাছে সেভাবে এসে পৌঁছয়নি।
আরও বড় কারণ যথাযথ অনুবাদের অভাব। খুব কম মধ্যপ্রাচ্যের সাহিত্যকর্ম বাংলায় অনুবাদ হয়েছে। বাংলা প্রকাশনা জগৎ আর প্রকাশকদের আরবি, ফারসি বা তুর্কি ভাষা থেকে সরাসরি অনুবাদ করার পরিকাঠামো অপেক্ষাকৃত কম। আরবি বা ফারসি ভাষা থেকে অনুবাদ বেশিরভাগই সময়েই হয় ইংরেজি বা ফরাসি ভাষার মাধ্যমে। যেমন, সিগাল প্রকাশনা সংস্থা এই অঞ্চলের সাহিত্যকে ইংরেজি ভাষায় আমাদের সামনে তুলে ধরেছে; বাংলা ভাষায় এই কাজ খাপছাড়াভাবে হয়েছে ক্ষুদ্র প্রকাশক বা ব্যক্তিগত উদ্যোগে। সিনেমার ক্ষেত্রে যদিও এখন ওটিটি প্লাটফর্মের সুবাদে বিভিন্ন ভাষার ছবি ক্রমশ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।
আমরা বাঙালিরা ঐতিহাসিকভাবেই বৃহত্তর বিশ্বের শিল্পচেতনার সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে উৎসাহী। সেই মর্মেই যদি আমরা মাহফুজ, পামুক, দোলাতাবাদি পড়ি, বা কিয়ারোস্তামি আর ফারহাদির চলচ্চিত্র দেখি, আমরা দেখব কীভাবে শোক আর যন্ত্রণাকে শিল্পে রূপ দেওয়া যায়, কীভাবে বেঁচে থাকার সংগ্রাম সাক্ষ্য হয়ে ওঠে। আমরা দেখব, সাহিত্য আর সিনেমা কীভাবে এক জাতির মর্যাদা টিকিয়ে রাখতে পারে যখন তাদের শহর ধ্বংস হয়ে গিয়েছে, যখন তাদের কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এ আসলে বাংলা ভাষার ও জাতির সংগ্রামের সমান্তরাল– যারা দেশভাগ, দুর্ভিক্ষ বা রাজনৈতিক দমনের মুখে দাঁড়িয়ে নিজের ভাষা আর স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে।
আমাদের সাহিত্য সমাদর প্রকৃত অর্থে বিশ্বজনীন হবে, যখন আমাদের সামনে এইসব বিধ্বস্ত দেশের সাধারণ মানুষের কথা এসে পৌঁছবে– যা আমরা এতকাল শুধু উপনিবেশকারীদের বয়ানেই শুনে এসেছি, মেনে নিয়েছি। এর জন্য প্রয়োজন যত্নশীল অনুবাদ ও বিপণন। এখন ভারতীয় সাহিত্য অনূদিত হয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে সমাদর পাচ্ছে। সেরকমই আমরা যদি এখন কায়রো, তেহরান, ইস্তানবুল, বাগদাদকে আমাদের সাহিত্য-প্রতিবেশী হিসেবে দেখি– আমরা দেখব যে হারানো এবং ক্ষয়ের ইতিহাসে আমরা একা নই। এই অঞ্চলের লোকেরাও আমাদেরই মতো শিল্পকে প্রতিরোধের অস্ত্র করেছে।
আজ যখন পৃথিবীর অনেক দেশেই গণতন্ত্র নতুন চাপের মুখে টলমল করছে, যখন বাকস্বাধীনতা আর সাংস্কৃতিক স্বায়ত্তশাসন আবার হুমকির মুখে, তখন এই সাহিত্য আর সিনেমা কেবল অনুপ্রেরণাই নয়, টিকে থাকার, সাক্ষ্য রাখার, প্রতিরোধ করার মডেল হয়ে ওঠে। এটা বেঁচে থাকার সাহিত্য– আর আমরা, বাংলায়, এই সাহিত্যকে আমাদের নিজের অসমাপ্ত কাহিনির অংশ হিসেবে আপন করে নিতে পারি।
………………………………
ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার ডিজিটাল
………………………………