প্রশ্ন এটাই ছিল, বিরাট-রোহিত পরবর্তী যুগে ভারতীয় ক্রিকেটের ব্যাটন সামলানোর মতো পোক্ত কাঁধ পাঞ্জাব-তনয়ের আছে কি না? এজবাস্টনে গিলের ডবল ‘মাস্টারক্লাস’-এ সে প্রশ্ন আপাতত বাউন্ডারির বাইরে। যেমনভাবে প্রথম ইনিংসে মহাকাব্যিক ২৬৯ ও পরের ইনিংসে অতিমানবীয় ১৬১ রান গড়েছেন, তাতে নতশিরে ক্রিকেটকুল ওয়াল্ট হুইটম্যানের মতোই হয়তো সমোচ্চারে বলবে– ‘ও ক্যাপ্টেন! মাই ক্যাপ্টেন!’
২৩.
‘ইট ওয়াজ গাভাসকর, দ্য রিয়াল মাস্টার, জাস্ট লাইক আ ওয়াল। ইউ নো দ্য ওয়েস্ট ইন্ডিজ কুড নট আউট গাভাসকর অ্যাট অল!’
ক্রিকেট ক্যালিপসো। চেনা গান। চেনা মুখ। ১৯৭১। ভারতের ক্রিকেট মানচিত্রে তখন আবির্ভূত সুনীল মনোহর গাভাসকর। ক্রিকেট যাঁর গনগনে তেজ টের পাবে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে। ব্যাট হাতে সেই সফরে ৭৭৪ রান। ১৫৪.৮০ ব্যাটিং গড়। মহাতারকার জন্মগাথায় ক্রিকেটপ্রিয় ক্যারিবিয়ানবাসী ক্যালিপসো বাঁধবে, সেই গান চিরায়ত সুর হয়ে থেকে যাবে ২২ গজের বিশ্বে, এটাই তো হওয়ার ছিল। হয়েওছে।
কিন্তু কথা সুনীল গাভাসকরকে নিয়ে নয়। কথা হল এই ২০২৫-এ, ৫৪ বছর পর হঠাৎ কেন গাভাসকর এবং তাঁকে ঘিরে মিথ হয়ে যাওয়া ক্যালিপসোকে মনে করা? মনে করার কারণ একটাই– ভারতীয় ক্রিকেটে ফের নতুন তারকার জন্ম হয়েছে। রক্ত-মাংসের সেই দেহধারীর নাম শুভমান গিল। নতুন তারকা। এহেন শব্দচয়নে ক্রিকেট অনুরাগীদের মনে নিশ্চয়ই ঢেউ খেলে যাবে, দুটো মুখ– শচীন তেণ্ডুলকর, বিরাট কোহলি। কিংবা রাহুল দ্রাবিড়, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো ক্রিকেট-জ্যোতিষ্ক। সেই আকাশগঙ্গা অগ্রাহ্য করে কেন হঠাৎ শুভমান-স্মরণ?
আসলে এজবাস্টন টেস্ট এক নতুন ভারতের সন্ধান দিয়েছে ক্রিকেট দুনিয়া। আবিশ্ব আচমকা আবিষ্কার করেছে, এই ভারত বিদেশের মাটিতে পরাজয়ের গ্লানি বইতে নয়, পরাক্রমের ধ্বজা ওড়াতে এসেছে। যার পুরোধা-পুরুষ অবশ্যই শুভমান গিল। ইচ্ছে যদি অদম্য হয়, শক্তি যদি হয় অপ্রতিরোধ্য তাহলে তাকে প্রতিরোধ করা মুশকিল। সেই ওপেন সিক্রেটকে ২২ গজে মেলে ধরেছেন গিল। সহ-নায়ক হিসেবে প্রতিভাত হয়েছেন কখনও যশস্বী জয়সওয়াল, কখনও ঋষভ পন্থ। কিন্তু বিলেতের বুকে প্রথমবার নেতৃত্ব দিতে নেমে এই পরাক্রম, অতীতে কোনও ভারত অধিনায়ক দেখাতে পারেননি, ভবিষ্যতেও পারবেন কি না, সে উত্তরকালের গর্ভে। আর তাই গিল-প্রসঙ্গের অবতারণা।
সিরিজের প্রথম টেস্টে হার। সেটাও কোণঠাসা অবস্থায় আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে নয়, পরিকল্পনায় ফাঁক না থাকলে লিডসে জয় নয়তো গর্বের ড্র নিয়ে মাঠ ছাড়তে পারত ‘নয়া ভারত’। হয়নি। কিন্তু সেই না-হওয়ার যন্ত্রণাই যে গিলের মধ্যে থেকে শ্রেষ্ঠত্বের খিদে জাগিয়ে তুলবে, কে জানত! সেই আত্মদহনের ফসল এজবাস্টনের প্রথম ইনিংসে ২৬৯ রান। যে ইনিংসের মায়াকাজলে আবিষ্ট গোটা দুনিয়া। ক্রিকেটীয় নৈপুণ্যে তিনি যে আর পাঁচজনের চেয়ে আলাদা, সেটা আবির্ভাবেই প্রমাণ করে দিয়েছিলেন শুভমান। স্বল্প সময়ে ভারতীয় ব্যাটিংয়ের টপ-অর্ডারে নির্ভরতায় তিনি ‘প্রিন্স’ হওয়ার যথাযোগ্য উত্তরাধিকার বহন করেন, সেটাও প্রমাণিত।
কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রশ্ন ছিল। প্রশ্ন এটাই ছিল, বিরাট-রোহিত পরবর্তী যুগে ভারতীয় ক্রিকেটের ব্যাটন সামলানোর মতো পোক্ত কাঁধ পাঞ্জাব-তনয়ের আছে কি না? এজবাস্টনে গিলের ডবল ‘মাস্টারক্লাস’-এ সে প্রশ্ন আপাতত বাউন্ডারির বাইরে। যেমনভাবে প্রথম ইনিংসে মহাকাব্যিক ২৬৯ ও পরের ইনিংসে অতিমানবীয় ১৬১ রান গড়েছেন, তাতে নতশিরে ক্রিকেটকুল ওয়াল্ট হুইটম্যানের মতোই হয়তো সমোচ্চারে বলবে– ‘ও ক্যাপ্টেন! মাই ক্যাপ্টেন!’
ভারতে বৃহত্তর মধ্যবিত্ত সমাজে, এক কৃষক পরিবারের সন্তানের কাছ থেকে এই হার না মানা মনোভাবটাই প্রত্যাশিত ছিল। যে অধ্যবসায় কাকভোরে ওঠে নিজের ক্রিকেট-সাধনায় নিয়োজিত হতেন, সেই চোয়ালচাপা লড়াইয়ের সহজ পন্থায় এজবাস্টনে ভারতকে জেতালেন শুভমান। বোঝালেন, কোনও ‘রকেট সায়েন্স’ নয়, পরিশ্রম আর জেদই পারে সাফল্যের সিঁড়ি ভাঙতে। অধিনায়ক এবং ব্যাটারের এই যুগলবন্দির কথা বললে নিঃসন্দেহে ভারতীয় ক্রিকেটপ্রেমীদের হৃদয়ে ভেসে উঠবে অস্ট্রেলিয়ায় অ্যাডিলেড টেস্টে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের মহারাজকীয় ১৪৪ রানের সেই ইনিংস, কিন্তু শুধু একটি নয়, জোড়া ইনিংসে শতরানের নজিরে পূর্বসূরিদের ছাপিয়ে নিজেকে অন্য উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন গিল। প্রথম ভারতীয় হিসেবে টেস্টে দুই ইনিংসে শতরানের নজির ইতিমধ্যে গড়ে ফেলেছেন। সামনে আরও রেকর্ড-শৃঙ্গে ওঠার হাতছানি। দুই টেস্টের পর ভারত অধিনায়কের নামের পাশে ৫৮৫ রান। ৫৪ বছর আগে সানি-র গড়া ৭৭৪ ভাঙার হাতছানি তাঁর সামনে। শুধু তাই নয়, যে আগুনে ফর্মে রয়েছেন তাতে ডন ব্র্যাডম্যানের অধিনায়ক হিসেবে এক সিরিজে ৮১০ রানের রেকর্ড– তাও সুরক্ষিত নয়।
ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় মজা হল, সেখানে ব্যক্তিগত মুনশিয়ানা উপভোগ্য কিন্তু শেষঅবধি বিচার্য নয়। পরিশেষে যা ক্রিকেটে ভাগ্যরেখা গড়ে দেয়, তা হল দলগত পারফরম্যান্স। এজবাস্টনে ঐতিহাসিক জয়ের (প্রথমবার এই মাঠে জয় পেল ভারতীয় টেস্ট দল, ৫৬ বছরের ইতিহাসে প্রথম) চেয়েও সেটাই সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি টিম ইন্ডিয়ার। আর সেটাকেই পাথেয় করে সিরিজের বাকি টেস্টে লড়াইয়ে নামবে ভারত– শুভমান গিলের ভারত!
‘দ্য আর্ট অফ ক্যাপ্টেন্সি’-তে দারুণ একটা কথা বলেছিলেন মাইক বেয়ারলি। বলেছিলেন– ‘আ ক্যাপ্টেন ইজ সামওয়ান হু ক্যান ইন্সপায়ার দ্য টিম টু অ্যাচিভ মোর দ্যান দ্য সাম অফ ইটস পার্টস।’ গিল তাঁর ব্যাটিংবিক্রমে, বিলিতে টেস্ট যুদ্ধে প্রতিটি পদচারণায় সেই সত্যকে জারিত করছেন অন্য উচ্চতায়। নম্র, বিনয়ী ভারতীয় তারকা নিজেকে মেলে ধরেছেন দলের ব্যাটিং অর্ডারের এমন এক পজিশনে। যেখানে অতীতে রানের মণিমাণিক্য বর্ষণ করে গিয়েছেন শচীন তেণ্ডুলকর, বিরাট কোহলির মতো রথী। অথচ শচীনসুলভ প্রতিভা গিল নন, বিরাটখচিত আগ্রাসন তাঁর অভিধানে নেই। যা আছে, তা হল অনুশাসন, শৃঙ্খলা। বাধ্য ছাত্রের মতো ক্রিকেটে মন সঁপে রাখার একটা স্থিতধী-হৃদয়। তাতেই ‘নিউ ইন্ডিয়া’র পোস্টার বয় হয়ে উঠেছেন তিনি। অনুপ্রাণিত করেছেন গোটা দলকে। যার ফসল– আকাশ দীপের মতো পেসার, যিনি অতীতে ইংল্যান্ডের মাটিতে খেলেননি, সেই বঙ্গ তারকার বিস্ফোরক আত্মপ্রকাশ। জো রুট থেকে ইংল্যান্ডের ব্যাটিং অর্ডারের মহারথীরা তল খুঁজে পাননি আকাশদীপের ইনসুইঙ্গারের। ‘বাজবল’-কে পাড়া ক্রিকেটের ছেলেখেলার পর্যায়ে নামিয়ে এনেছিলেন আকাশ, নিজের অদম্য জেদ আর লড়াইয়ের অভিপ্রায়ে। অথচ সেই ছেলেকে দেখে কে বলবে, ক্রিকেট তাঁর বেঁচে থাকার আশ্রয়। অকালে বাবাকে হারিয়েছেন, মাথার ছাদ সরে গেছে সেই শোকের ছ’মাসের ব্যবধানে দাদাকে হারিয়ে। বাড়িতে মা, দিদি ক্যানসারের সঙ্গে লড়ছেন। আক্ষরিক অর্থেই আকাশ পরিবার ও ভারতীয় দলে জীবনদীপ হয়ে নিজেকে মেলে ধরলেন। বোঝালেন– ‘ক্রিকেট ইজ নট আ গেম, ইটস আ ওয়ে অফ লাইফ’!
যতদিন ক্রিকেট থাকবে, এই জীবনগাথাও থাকবে। ক্যারিবিয়ান দ্বীপের দমকা হাওয়ায় নয়, ক্রিকেটের ধাত্রীভূমি ইংল্যান্ডে, পড়ন্ত বিকেলের শীতের কামড়ে জীবনের সেই জয়গান অনুরণিত হবে চিরকাল– ঠিক ক্যালিপসোর মতো।
…………………… পড়ুন ওপেন সিক্রেট-এর অন্যান্য পর্ব …………………….
পর্ব ২২: শচীন-বিরাটরা আসেন-যান, ভারত থেকে যায়
পর্ব ২১: কিং কোহলি দেখালেন, ধৈর্যের ফল বিরাট হয়
পর্ব ২০: মনকে শক্ত করো টেস্ট, রাজা আর ফিরবেন না
পর্ব ১৯: মুকুল কিংবা ফিলিস্তিনি বালক, খুঁজে চলেছে যে যার ঘর
পর্ব ১৮: ধোনিবাদ: ধাঁধার চেয়েও জটিল তুমি…
পর্ব ১৭: সাদা সাদা কালা কালা
পর্ব ১৬: গতবারের বিক্রি প্রতিবারই ছাপিয়ে যায় বইমেলা, কারণ দামবৃদ্ধি না পাঠকবৃদ্ধি?
পর্ব ১৫: সেন ‘মায়েস্ত্রো’কে ভুলে বাঙালি দেখিয়েছে, সে আজও আত্মবিস্মৃত
পর্ব ১৪: শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসই বাঙালির প্রকৃত সান্তা
পর্ব ১৩: প্রবাসে, দোতলা বাসে, কলকাতা ফিরে আসে
পর্ব ১২: না-দেখা সেই একটি শিশিরবিন্দু
পর্ব ১১: ঘোর শত্রুর বিদায়বেলায় এভাবে বলতে আছে রজার ফেডেরার?
পর্ব ১০: অভিধানের যে শব্দটা সবচেয়ে বেশি মনুষ্যরূপ ধারণ করেছে
পর্ব ৯: জোট-অঙ্কে ভোট-রঙ্গ
পর্ব ৮: দক্ষিণ বিসর্জন জানে, উত্তর জানে বিসর্জন শেষের আগমনী
পর্ব ৭: পুজো এলেই ‘সর্বজনীন’ নতুবা নিঃসঙ্গ?
পর্ব ৬: এক্সক্লুসিভের খোয়াব, এক্সক্লুসিভের রোয়াব
পর্ব ৫: শাসন-সোহাগের দ্বন্দ্বসমাস
পর্ব ৪: পাঁকাল সাধনায় নাকাল
পর্ব ৩: দেখা ও না-দেখার সিদ্ধান্ত
পর্ব ২: মহাবিশ্বে যে টোকে না, সে বোধহয় টেকেও না
পর্ব ১: অফিসে দৈবের বশে প্রেমতারা যদি খসে